আর্কাইভউপন্যাস

মুহুরিবাড়ি

হরিশংকর জলদাস

১৬/১৭ লাভ লেন।

মুহুরিবাড়ি।

মুকুন্দমুহুরি।

রাস্তার নাম লাভ লেন। লেন বলতে মানুষ যা বোঝে, এটি সেরকম নয়। এটির নাম হওয়া উচিত ছিল লাভ রোড বা লাভ স্ট্রিট। আসলে স্ট্রিটের মতোই প্রশস্ত এটি। দৈর্ঘ্য যা হোক, প্রস্থ হেলাফেলার নয়। পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশ ফুট প্রশস্ত। দুটো বিরাট লরি বা বাস অনায়াসে পাশাপাশি চলতে পারে। তার ওপর ফুটপাত। লাভ লেনের দৈর্ঘ্য খুব বেশি নয়। আধ কিলোমিটার মতন। রাস্তাটা টিলামতন। দুপাশের বাড়িঘরের গড়ন দেখে বোঝা যায়, এক সময় ইংরেজদের জমজমাট আবাসস্থল ছিল এখানে। বাংলো ধরনের মনোরম বাড়ি। কোনওটা একতলা, কোনওটা দ্বিতল। চারদিকে মাথা তোলা দেয়াল। সামনে চক মেলানো বাগান।

ইংরেজরা চলে যাবার পর বাড়িগুলোর জৌলুশ কমতে শুরু করেছিল। কোনও কোনও বাড়ি ভেঙে সেখানে বহুতল মাথা উঁচিয়েছে। দু-একটা বাড়ি পুরনো ইতিহাস গায়ে মেখে বেঁচেবর্তে আছে। এ রকম একটা বাড়ি হাতবদল হয়ে হয়ে মুকুন্দ মুহুরির হাতে এসে পড়েছিল। বাড়িটির অন্য একটা নাম থাকলেও মানুষের মুখে মুখে এর নাম হয়ে গিয়েছিল মুহুরিবাড়ি।

মুকুন্দ আদালতে মুহুরিগিরি করত। গয়ানাথ সমাদ্দারের অধীনে। গয়ানাথ বাবু সিনিয়র উকিল ছিলেন। নামকরা। লোকে বলত, গয়ানাথ উকিল কেস হাতে নিলে খুনের আসামিও খালাস পেয়ে যায়। বিচারকরাও গয়ানাথবাবুর সঙ্গে সমীহ করে কথা বলতেন। কম বয়সে গয়ানাথবাবু মুকুন্দকে ছত্রচ্ছায়া দিয়েছিলেন। মুকুন্দ মুহুরির তখন খুব দুঃসময়। ঘরে বিধবা মা। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর পরই বাবা ধুম করে মারা গেল। খাতুনগঞ্জের এক আড়তে খাতা লিখত বাবা। গ্রামজীবন অভাব-অনটনে দুঃসহ হয়ে উঠলে মাকে নিয়ে শহরে চলে আসে মুকুন্দ। হাতে তখন সামান্য টাকা। হরচন্দ্র মুন্সেফ লেনে দুই রুমের সস্তা একটা বাড়ি ভাড়া নিল। তারপর শুরু হলো এখানে-ওখানে কাজ খোঁজা। দারোয়ানের চাকরি থেকে অফিসের পিয়ন, কোথাও চাকরি জুটল না মুকুন্দের। যতদিন যায়, জীবনটা ফিকে হতে থাকে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে অনেক আগেই। হাতের টাকা ফুরিয়ে গেছে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে পরিচয় নেই যে ধার-উধার চায়।

মা একদিন বলে, মুকুন্দ, চল গাঁয়ে ফিরে যাই। এখানে আর পেড়ে উঠছি না বাবা।

মুকুন্দ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কিছু বলে না।

গলির মুখে সেলিম মিয়ার মুদির দোকান। একদিন বুড়ো সেলিম মিয়া বলে, তুমি এক কাজ করো মুকুন্দ বাবু।

কী কাজ চাচা ?

তুমি গয়ানাথবাবুর সঙ্গে দেখা করো।

গয়ানাথ! গয়ানাথবাবু আবার কে ?

সেলিম মিয়া দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলল, ধুর বোকা! এতদিন আছ এখানে, গয়ানাথ সমাদ্দারকে চেন না!

মুকুন্দ কাতরকণ্ঠে বলে, সত্যি চাচা আমি গয়ানাথ সমাদ্দারকে চিনি না।

সেলিম মিয়ার মায়া হলো। নিত্যদিনের সদাইটা মুকুন্দ এই সেলিম মিয়ার দোকান থেকেই কেনে। সদাই দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে মুকুন্দ সম্পর্কে প্রায় সবটাই জানা হয়ে গিয়েছিল সেলিম মিয়ার। সে জানত, বাপমরা এই ছেলেটি মা নিয়ে বড় অভাবে আছে। তাকে যদি একটু সাহায্য করে আল্লাহ খুশি হবেন।

নরম গলায় দরদ মিশিয়ে সেলিম মিয়া বলল, সামনের এই রাস্তাটি ধরে এগোলে সাতটা বাড়ির পরে গয়ানাথ সমাদ্দারের বাড়ি। বিখ্যাত উকিল। কোর্টে তাঁর কদরের শেষ নেই। তুমি ওই উকিলের কাছে গিয়ে ধন্না দাও। বলবে, আমাকে বাঁচান আপনি। মা নিয়ে না খেয়ে আছি। যেকোনও একটা চাকরির ব্যবস্থা না করলে শুকিয়ে মরব আমরা। মেজাজ যদি ভালো থাকে, কোনও একটা হিল্লে হয়ে যাবে তোমার। ও হ্যাঁ, একটা ব্যাপারে সাবধান করা দরকার। খুব মেজাজি মানুষ কিন্তু গয়াবাবু। মেজাজ খারাপ থাকলে লাথি ঝাঁটাও মারতে পারেন। আর মেজাজ ভালো থাকলে তোমার সামনের দরজা খুলে যাবে। আর হ্যাঁ, রাত সাড়ে দশটার দিকে যেয়ো। মক্কেলের চাপ কম থাকবে তখন। এতক্ষণ কথা বলার পর হাঁপিয়ে উঠেছিল সেলিম মিয়া।

মুকুন্দের চোখমুখ খুশিতে ভরে উঠেছিল। একটা চাকরির বিনিময়ে লাথি ঝাঁটাও খেতে প্রস্তুত সে।

না, গয়ানাথ সমাদ্দার ধুর-ছেই করেননি সে-রাতে। মনটা ভালো ছিল ওই সময় তাঁর। একটা জটিল মামলা হেরে যেতে যেতে জিতে গিয়েছিলেন সেদিন। মুকুন্দের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেছিলেন। সব শুনে বলেছিলেন, ঠিক আছে। কাল থেকে তুমি এসো। সকাল আটটায় আসবে। আমার সঙ্গে আদালতে যাবে।

পরদিন ঠিক সময়ে সমাদ্দারবাড়িতে উপস্থিত হয়েছিল মুকুন্দ। সেদিন থেকে খ্যাতিমান উকিল গয়ানাথ সমাদ্দারের অধীনে মুকুন্দের মুহুরিগিরি শুরু হয়েছিল।

সে কতকাল আগের কথা! একদিন গয়ানাথ সমাদ্দার পরলোকে গেলেন। ততদিনে মুকুন্দ ঝানু মুহুরিতে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘদিন সমাদ্দারবাবুর সঙ্গে থেকে থেকে আইনের মারপ্যাঁচগুলো মুকুন্দের জানা হয়ে গেছে। বইটইও দু-চার দশখানা পড়ে ফেলেছে মুকুন্দ। একটা সময়ে দেখা গেল, একজন ভালো উকিলের চেয়েও কম জানা নেই মুকুন্দের।

একদিন এক বন্ধু পরামর্শ দিল, তুমিও উকিলগিরি শুরু কর না কেন ?

প্রস্তাবটা বেশ মনে ধরে গেল মুকুন্দের। ইন্টারমিডিয়েট তো আগেই পাস করা ছিল। প্রাইভেটে ডিগ্রি পরীক্ষা দিল। পাস করল। পরের দুই বছর খাটাখাটি করে এলএলবিটাও উতরে গেল। মুকুন্দ মুহুরি উকিলের খাতায় নাম লেখাল। ভাগ্যক্রমে দু-চারটা কেসও জিতে গেল।

আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি মুকুন্দ মুহুরিকে। কালক্রমে আদালতে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেলেন মুকুন্দ মুহুরি। মুকুন্দ মুহুরি থেকে উকিল হয়ে গেলেন। এই দেশে দুটো জিনিসের খামতি হয় না কখনও। জনসংখ্যা আর মামলা। যত দিন গড়ায়, মানুষ বাড়ে। যত মানুষ বাড়ে, তত ঝগড়াঝাটি হামলা-মামলা বাড়ে। যত মামলা তত পোয়াবারো। উকিলদের আর পুলিশদের। ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভাই, কাকার বিরুদ্ধে ভাইপো, শ্বশুরের বিরুদ্ধে জামাই, খালার বিরুদ্ধে বোনঝি। একটা মামলা ঠুকে দিলেই হলো। অমনি উকিলের তহবিল ভরতে শুরু হলো।

উঠতি শহর তখন চট্টগ্রাম। চারদিকে শহর বাড়তে শুরু হয়েছে। আগে যেটা গাঁ-গঞ্জ-মফস্সল ছিল, শহর দ্রুত গিলতে লাগল তাদের। জায়গা-জমির দাম হু হু করে বাড়তে আরম্ভ করল। তাতেই আত্মীয়স্বজনের মধ্যে জায়গা নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু হলো। রেশারেশি বাড়ল। ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট বাড়ল। গাঁ-গঞ্জ-মফস্সলের মানুষ কোর্টের দরজা চিনে গেল। ওতে বাদী-বিবাদীর গুচ্ছ গুচ্ছ টাকায় উকিল-মোক্তারের ভাণ্ড পূর্ণ হয়ে উঠতে লাগল।

মুকুন্দ মুহুরি শহরের একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি হয়ে গেলেন। একদিন ১৬/১৭ লাভ লেনের ওই বাড়িটি কিনে ফেললেন। বাড়ির মালিক একদা ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। সুদ-আসলের সেই টাকা শোধ করতে পারেননি তিনি। বাড়িটি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। বাড়িটি কিনে নেওয়া মুকুন্দ মুহুরির পক্ষে কঠিন ছিল না।

পুরনো আমলের দোতলা বাড়ি। সামনে বিরাট প্রাঙ্গণ। থরে থরে ফুলগাছ বাড়িজুড়ে। অন্যান্য গাছও বিস্তর। প্রাচীন একটি নিম গাছ বাড়ির ছাদে ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িটি বেশ বড়সড়। স্থাপত্যের গরিমা নেই তেমন। টানা দরদালান। লাগোয়া ঘর। পাশাপাশি। বেশ বড় বড়। নিচের তলায় কিচেন, ড্রইংরুম, স্টাডিরুম, গেস্টরুম, সার্ভেন্টসরুম। ওপর তলার প্যাটার্নটা একটু অন্যরকম। পাঁচ পাঁচটা বেডরুম। সাজানো-গোছানো ড্রইংরুমও আছে একটা। বাড়িটা ইউ টাইপের। দোতলার বারান্দা বিশাল ও মনোরম। বারান্দায় দাঁড়ালে অনতিদূরের ডিসি হিল হাতে ছোঁয়া যায়।

বাড়িটির পেছনদিকের দেয়ালে অশ্বত্থের চারা গজিয়েছিল। এখানে-ওখানে শ্যাওলাও ধরেছিল। মুকুন্দবাবু বাড়িটি কেনার পর সংস্কার করালেন। ভেতরে-বাইরে রং লাগালেন। উঠানের মাঝখানে একটি তুলসীমঞ্চ স্থাপন করলেন। সেখানে সতেজ তুলসীগাছ বাতাসে দোল খেতে লাগল।

এক শুভদিনে ভাড়াবাড়ি ছেড়ে নিজের বাড়িতে উঠে এলেন মুকুন্দবাবু। সঙ্গে স্ত্রী এবং তিন কন্যা। মা তখন স্বর্গে গেছে। মুকুন্দবাবুর তখন পঞ্চাশ, স্ত্রীর পঁয়ত্রিশ। দেরিতে বিয়ে করেছিলেন মুকুন্দ মুহুরি। তিন মেয়ে―বারো, দশ, আট।

অসাধারণ রূপসী সুদীপা সেন। মুকুন্দবাবুর গায়ের রং শ্যামলার দিকে। সুন্দরী বউকে নিয়ে মুকুন্দবাবু যখন বেরোতেন, বড় গর্ববোধ করতেন। মানুষেরা ফিরে ফিরে তাকাত তাঁর বউয়ের দিকে। তাই বলে সুদীপা হেলাফেলা করত না মুকুন্দকে। সবাই বলত, এ রকম রাজযোটক লাখে একটা মেলে।

প্রথম মেয়ে যখন জন্মাল, মুকুন্দ মুহুরি নাম রাখলেন দিশা। দ্বিতীয়টা জন্মালে অনুপ্রাসের নেশায় পেয়ে বসল তাঁকে।

স্ত্রীকে বললেন, এই মেয়ের নাম রাখব তিশা।

স্ত্রী বললেন, এত সুন্দর সুন্দর নাম থাকতে তিশা কেন ?

মুকুন্দবাবু বললেন, দিশার সঙ্গে তিশারই তো মিল! মিলের ব্যাপারটা খেয়াল করবে না তুমি ?

তোমার নামেও যেমন মিল, মুকুন্দ মুহুরি, মুমু। একটু মুচকি হেসেছিলেন সুদীপা সেন।

ঠিকই ধরেছ। বলি, তুমিও কি পিছিয়ে আছ ?

মানে!

ওই যে সুদীপা সেন, সুসু।

সুদীপা ধমকে ওঠেন, এই এই! এসব কী বলছ তুমি ? সুসু! সুসু মানে কী ? যত সব অসভ্যতা!

অতটুকু ভেবে মুকুন্দবাবু কথাটা বলেননি। স্ত্রীর কথায় ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন। কাতর হয়ে বললেন, আমি ওভাবে তো ভেবে বলিনি কথাটা! কিছু মনে কর না তুমি।

ঠিক আছে, ঠিক আছে বলে ঈষৎ একটু হেসেছিলেন সুদীপা।

সেই মুকুন্দবাবুর যখন তৃতীয় কন্যাটি হলো, নাম রাখলেন নিশা। দিশা, তিশা, নিশা―তিনজনেই মায়ের রূপটা পেয়েছে। তিনজনেরই সোনার বরণ। তবে দিশার রঙটা একটু চাপা-ফরসা।

মীরা পিসি এসে উপস্থিত হলেন একদিন। মুকুন্দের বাবা গোবিন্দ। ওই গোবিন্দ মুহুরিরই একমাত্র বোন মীরা পিসি। বড় ঘরে বিয়ে হয়েছিল। স্বামী ভূমি অফিসে চাকরি করতেন। জমিজমা বাড়িয়েছেন অনেক। সেই সময়ের রাস্তাঘাটহীন পদুয়া গ্রাম। ওই গ্রামের নিজের জন্মভিটেয় দোতলা বাড়ি তুলেছিলেন মীরা পিসির স্বামী। দুই ছেলে। লেখাপড়া শিখেছিল। একজন স্থানীয় হাই স্কুলে মাস্টারিতে ঢুকেছিল, অন্যজন বাপের অফিসে। ছেলে দুটোকে বিয়েও করিয়েছিলেন তারাপদ বাবু। হঠাৎ করে একদিন চোখ বুজলেন। অফিসের চেয়ারে বসা-অবস্থায় দেহ রেখেছিলেন তিনি। জমির কী একটা অবৈধ কাজ করে দেবেন বলে একজনের কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছিলেন। কাজটা করতে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিলেন। পার্টি ছিল জাঁহাবাজ। অপমান করে বসেছিল। সেই অপমান সইতে পারেননি তারাপদ বাবু।

শ্রাদ্ধাদি চুকতে না চুকতে দুই ভাইয়ের মধ্যে গুঁতাগুঁতি শুরু হয়ে গিয়েছিল। বউ দুটি সেই বিবাদে ফুঁ দিতে শুরু করল জোরেশোরে। ছোট ছেলেটি বুদ্ধিমান। শান্ত মেজাজে বড় ভাইকে নিয়ে বসল একদিন। নিজেদের মধ্যে আপস করে নিল। ওপর তলায় বড় ভাই, নিচের তলায় সে। জায়গাজমিও সমান সমান ভাগ হলো। দুই ভাই, বউ, তাদের বাচ্চাকাচ্চা―সবারই ঠাঁই হলো। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হলো না শুধু মায়ের।

ছোট ভাই বলল, দাদা, মায়ের দায়িত্বটা তুমিই নাও। আমার বউটা একটু অগোছালো ধরনের। ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো সামাল দিতে গিয়ে হিমশিম খায় ললিতা। মায়ের যত্ন-আত্তিটা ঠিকঠাক মতন করতে পারবে না সে।

বড় ভাই বলল, দেখ সুনীল, আমি মাস্টার মানুষ। কতইবা বেতন আমার! ওই বেতন দিয়ে সংসার টানা মুশকিল। তার ওপর মায়ের দায়টা কী করে নিই আমি, বল।

শিক্ষকতা বড় ভাইয়ের মনে স্বার্থপরতা জাগিয়েছে, মানবতা জাগায়নি।

জমি-বাড়ি ভাগভাটোয়ারা নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে যে ঝগড়া-দ্বন্দ্বটা হয়নি, মাকে নিয়ে সেই ঝঞ্ঝাটটা শুরু হলো।

মীরা দেবী বুঝে গেলেন। এই বাড়িতে তাঁর অন্ন ফুরিয়েছে। তিনি গেঁয়ো বোকা বা অদূরদর্শী নন। বুদ্ধিমতী ও ব্যক্তিত্বশালিনী। একদিন ছোট ছেলেকে বললেন, সুনীল, তুই কি আমাকে মুকুন্দের বাড়িতে পৌঁছে দিতে পারবি ?

সুনীল কৃত্রিম অবাকপলা দেখিয়ে বলে, কেন মা! তুমি মুকুন্দদার বাড়িতে যাবে কেন ?

মা বলল, একটু গা জুড়াতে মন চাইছে।

ভাইপো মুকুন্দ মুহুরির বাড়িতে চলে এসেছিলেন মীরা পিসি। সেই যে আসা, আর ফিরে যাননি পদুয়ায়, নিজের পেটে ধরা ছেলেদের কাছে।

দুই

মীরা পিসি আসায় মুকুন্দ বাবুর ভেতরবাড়ির খোলনলচে পাল্টে গেল।

ফার্নিচারগুলো এদিক থেকে ওদিক গেল, ওদিকেরগুলো এদিকে এল। দেয়ালে টাঙানো ছবিগুলোরও অদলবদল হলো। রুমগুলোর ফ্লেভারটাই অন্যরকম হয়ে গেল তখন। কী রকম যেন নতুন নতুন! স্নিগ্ধ স্নিগ্ধ। মীরা পিসির এই কাজটি সবারই ভালো লেগে গেল।

মীরা পিসি আসাতে সুদীপা যে একটু শঙ্কিত আর অসন্তুষ্ট হননি, এমন নয়। একান্ত শয্যায় স্বামীকে সেকথাটা বলেছিলেনও।

আমার কিন্তু ব্যাপারটা সুবিধার মনে হচ্ছে না। বলেছিলেন সুদীপা।

একটা জটিল কেস নিয়ে ভাবছিলেন তখন মুকুন্দ বাবু। স্ত্রীর কথায় চটকা লেগেছিল। বলেছিলেন, কোন ব্যাপারটার কথা বলছ!

ওই যে তোমার পিসিমার কথা। কথা নেই, বার্তা নেই। ধুম করে চলে এলেন। হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, সারাজীবনের জন্য চলে এসেছেন।

চট করে ভেজানো দরজার দিকে তাকালেন মুকুন্দ বাবু। সতর্ক কণ্ঠে বললেন, আস্তে আস্তে। ও রকম করে  বলো না সুদীপা। তুমি তো পিসিদের অর্থনৈতিক অবস্থা জানো না! আমাদের দু-চারবার কিনে নিতে পারবেন।

তার পর উদাসী চোখে সিলিংয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন মুকুন্দ বাবু। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ছেলেরা নিশ্চয়ই পিসির মনে দুঃখ দিয়েছে ভীষণ। মানুষ কী আর সহজে ঘর ছাড়ে রে সুদীপা!

সুদীপা চুপ করে থাকলেন। তিনি ভেবেছিলেন, স্বামী তাঁর কথায় সুর মেলাবেন। স্বামীটি যে তাঁর পিসিমার জন্য এ রকম করে অনুভব করেন, ভাবেননি।

এই সময় বিষণ্ন গলায় মুকুন্দ বাবু আবার বলেছিলেন, দেখো, পিসি আসায় হয়ত এই পরিবারের উপকারই হবে! বলে পাশ ফিরে শুয়েছিলেন মুকুন্দ মুহুরি।

মুকুন্দ বাবুর অনুমানে ভুল হয়নি। মীরা পিসি আসায় এই পরিবারের উপকারই হয়েছিল। মেয়েগুলো কথা বলার একজন প্রবীণ আত্মীয়া খুঁজে পেল। তারা মীরা দিদিমার কাছে রামায়ণ-মহাভারতের বৃত্তান্ত শুনবার সুযোগ পেল। গ্রামের কথা, কৃষক-কৃষানির কথা, নদীর কথা, বিচিত্র ধরনের মানুষের গল্প শুনতে পেল তারা দিদিমার কাছে। তারা তাঁকে আঁকড়ে ধরল। মীরা দিদিমাও আপন নাতি-নাতনির কথা দিশা-তিশা-নিশাকে পেয়ে ভুলতে বসল।

মুকুন্দবাবু ব্যস্ত মানুষ। মেয়েদের সময় দিতে পারেন না। সুদীপা রূপসী। রূপসীরা সাজপ্রিয় হয়। সুদীপা সেনও ব্যতিক্রম নন। সাজগোছেই অধিকাংশ সময় ব্যয় হয় তাঁর। কন্যাদের দেখভাল করার সময় নেই তাঁর হাতে। মীরা পিসি কন্যাদের দায়িত্ব নেওয়ায় সাজগোঁজে আরও বেশি মগ্ন হয়ে পড়লেন সুদীপা সেন।

বেশ আগে থেকেই মুহুরিবাড়ির খাওয়ার পাঠটা ঝিনির্ভর হয়ে পড়েছিল। মালতি ঝি বহুদিনের পুরনো। তাকে সাহায্য করে লক্ষ্মী। মালতি আর লক্ষ্মীই গোটা হেঁশেলটা নিয়ন্ত্রণ করত। সুদীপা নাক গলাতেন না। ঝিরা যা রাঁধত, তা-ই খেত সবাই। মাছ-মাংসের তেল-ঝোলের তরকারি রেঁধেই দায় সারত ঝিরা। সকালে পাউরুটি, ডিমপোচ, কলা-কমলা, জেলি। দুপুরে চিকেন ফ্রাই, রূপচাঁদা ফ্রাই, মুরগির ঝোল, ভেটকি-বাঁটা, রুই-কাতলার কারি এবং সালাদ। রাতে দিনের বাসি তরকারি।

মীরা পিসি রান্নার ধরনটাই পাল্টে দিলেন। তেল-মশলার খাবার কমিয়ে দিলেন। তিনি রুই মাছের মাথা দিয়ে মুড়িঘণ্ট করলেন। নারকেল দিয়ে মোচার ঘণ্ট, কাঁচকলার কোপ্তা, উচ্ছে ভাজা, পোস্ত-আলু, কুমড়োর ছক্কা―এসব রাঁধতে শুরু করলেন পিসি। বাড়ির সবারই জাঙ্ক ফুড খাওয়া মুখ। গাঁইগুঁই শুরু করল সবাই। কেউ প্রকাশ্যে, কেউ অপ্রত্যক্ষে। ধৈর্য ধরে সব শুনে গেলেন পিসি।

ভাইপো-বউকে বললেন, শোন বউমা, চামড়ায় শুধু স্নো-পাউডার লিপস্টিক লাগালে চেহারা খোলতাই হয় না। ভেতরের সজীবতাও দরকার। গাছকে যেমন সার দিতে হয়, শরীর সতেজ রাখার জন্যও সারের প্রয়োজন। এই বেগুন-মোচা-লাউ-সীম-মুলা-আলু হলো সারের মতন, জৈব সার। যত খাবে, স্কিন উজ্জ্বল হবে। খুব বেশি খেতে বলছি না। অল্প অল্প খাও। তোমাদের প্রিয় খাবারের সঙ্গে একটু একটু করে খাও।

স্কিনের কথা বলাতে ভাইপো-বউ প্রতিবাদ করলেন না। বরং খুশি হলেন। একটু আধটু চেখে দেখা শুরু করলেন।

আর দিশা-নিশা-তিশা তো দিদিমার নেওটা! দিদিমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল ওরাও। শুধু তা-ই নয়, সপ্তাহে একদিন, বৃহস্পতিবার নিরামিষ চালু করে দিলেন মীরা পিসি।

এক  রোববার, সেদিন মুকুন্দ মুহুরি ঘরে।  রোববার বলে কোর্ট বন্ধ সেদিন। মীরা পিসি ভাইপোকে ধুম করে এক প্রস্তাব দিয়ে বসলেন, মুকুন্দ, আজ তুই দুপুরের খাবারটা পিঁড়িতে বসে খা।

সুদীপা, তিন কন্যা তখন ডাইনিং টেবিলে বসে পড়েছেন। মুকুন্দ বাবু চেয়ারে বসতে যাবেন, ওই সময় কথাটা বললেন পিসি।

অবাক চোখে পিসির দিকে তাকালেন মুকুন্দ বাবু। সুদীপার তো পুতলি বেরিয়ে আসার উপক্রম! কন্যা তিনজন দিদিমার কথা বুঝতে পারেনি বলে নির্বিকার।

মুকুন্দ বাবু পিসির কথাটা শুনেছেন, কিন্তু ভালো করে বুঝতে পারলেন না। তাই থতমত চোখে পিসির দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

তুই বোধহয় আমার কথা বুঝতে পারিসনি বাবা। মীরা পিসি বললেন।

মুকুন্দ বাবু বললেন, তুমি ঠিকই ধরেছ পিসি। তোমার কথা আমি ভালো মতো বুঝতে পারিনি।

বলছি, আজ একটু পিঁড়িতে বসে দুপুরের ভাতটা খা বাপ।

মুকুন্দবাবুর কী হলো কে জানে, পিসির প্রস্তাবের কোনও প্রতিবাদ করলেন না। সুবোধ বালকের মতো পিঁড়িতে গিয়ে বসলেন। পিঁড়িটা আগেই বিছিয়ে রেখেছিলেন পিসি।

চোখ-ইশারা দিতে মালতি আর লক্ষ্মী ভাতের থালা, বাটি বাটি তরকারি এনে থালার তিনদিকে গুছিয়ে রাখল।

মীরা পিসি হাতে পাখা নিয়ে ভাইপোর পাশে চাঁচিতে বসে পড়লেন। ওখান থেকে বললেন, বউমা, তুমি তোমার মেয়েদের নিয়ে খাওয়া শুরু কর। মালতি-লক্ষ্মী টেবিলে খাবার দিয়ে রেখেছে।

সুদীপা খাওয়া শুরু করবে কী, পিসি-ভাইপোর দিকে কৌতূহলী নিষ্পলক চোখ দুটো দিয়ে তাকিয়ে থাকলেন।

মুকুন্দ বাবু খাওয়া শুরু করতে গিয়ে দেখলেন, বাটিতে কলমি শাক, ঘন খেসারি ডাল। অন্যান্য খাবারও যথারীতি আছে।

বাটি থেকে কলমি শাক পাতে ঢেলে দিয়ে পিসি বললেন, প্রথম গরাসটা কলমি শাক দিয়ে খা বাপ। বলতে বলতে ভাতের পাশে খেসারি ডালটাও ঢেলে দিলেন।

মুকুন্দ মুহুরি চুপচাপ খেতে শুরু করলেন। পিসি হাতপাখা দিয়ে মুকুন্দের মাথায়-গায়ে বাতাস করে যেতে লাগলেন।

অর্ধেক খাওয়া হয়ে গেলে পর পিসি জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা মুকুন্দ, আজ যে তোকে ডাইনিং টেবিল থেকে পিঁড়িতে নামিয়ে আনলাম, সবকিছুর আগে কলমি-খেসারি খেতে দিলাম, তোর মনে কোনও প্রশ্ন জাগেনি ? কেন পিসি এই অদ্ভুত কাণ্ডটি করছি ?

মুকুন্দ মুহুরি উকিল মানুষ। ঝানু উকিল। ওকালতি করতে করতে চুল পেকেছে তাঁর। কিছু যে অনুধাবন করতে পারছেন না, এমন নয়। তারপরও কারণটা পিসির মুখ থেকে শুনতে চান।

বললেন, আসলে ঘটনাটা কী, বুঝতে পারছি না পিসি!

পিসি বললেন, দেখ বাপ, আমার খুব বেশি লেখাপড়া নেই। কিন্তু জীবন-অভিজ্ঞতা আছে প্রচুর।

পিসি, তা তো আমি জানি। সেই ছোটবেলায় শ্বশুরবাড়ি থেকে তুমি যখন বাপের বাড়ি, মানে আমার দাদুর বাড়ি আসতে, তোমাকে সবাই সমীহ করে চলত। বাবা যখনই সময় পেত তোমার গল্প করত আমার কাছে। তোমার ব্যক্তিত্বে সবাই নাকি মুগ্ধ থাকত। সেই তুমি এমনি এমনি যে কাজটি  করিনি, তা আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু কেন যে করলে বুঝতে পারছি না!

মীরা পিসি ম্লান একটু হাসলেন। বললেন, আমার বাবা খুব গরিব ছিল। মানুষের কাছ থেকে জমি নিয়ে বর্গা চাষ করত। জমির মালিককে তার অংশ দিয়ে বাবার ভাগে খুব কম ধানই থাকত। সাত মাস মতন চলত আমাদের, সেই ধানে। পরের পাঁচ মাস খুব টানাটানি হতো। চারজনের মুখের খাবার জোগাতে বাপ অন্যের খেতে দিনমজুরের কাজ করত। মা সে সময় পুকুরপাড় থেকে শাক তুলে আনত। খেসারি ডাল ছিল সবচাইতে সস্তার ডাল। বলে হঠাৎ থেমে গেলেন মীরা পিসি।

ওই খেয়ে খেয়েই আমাদের বড় হয়ে ওঠা। আমার আর তোমার বাপের। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন পিসি। তারপর বললেন, তোর বাপ যখন চাকরিটা করা শুরু করল, তোদের অবস্থাটা ফিরল। সব খোঁজ রাখতাম আমি। ভাইটি আমার মারা গেলে তোদের সংসারে আকাল নেমে এল। তোরা খাদে পড়ে গেলি। তারপর তো কত কষ্ট করে দাঁড়ালি তুই! এখন তোর সোনার সংসার। কণামাত্র অভাব নেই তোর সংসারে। কিন্তু বাপ, তোর এই জীবনটা তো তোর ওই অভাবী জীবনের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে! হাঁপিয়ে উঠলেন পিসি। তার পরও তিনি থামতে চাইলেন না। দীর্ঘ একটা দম নিয়ে বললেন, তোর ওই কষ্টের জীবনের কথা তোর বউ, তোর মেয়েরা জানে না, দেখেনি। আজ আমার উদ্দেশ্য ছিল তোর ফেলে-আসা ওই জীবনের সঙ্গে তোর পরিবারের মানুষদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া। আর হ্যাঁ, তোকেও মনে করিয়ে দেওয়া যে দুঃখের পরে সুখ আসে যেমন, সুখের পরে দুঃখও। সুযোগ পেলে গরিব-দুখীদের সাহায্য করিস বাপ। তাতে স্বর্গে বসে আমার বাবা, তোর বাবা-মা তৃপ্তি পাবে রে মুকুন্দ! বলতে বলতে মুখে আঁচল চাপা দিলেন পিসি। দ্রুত উঠে দাঁড়ালেন। বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলেন।

খাওয়া শেষ করে কারও সঙ্গে কথা বলেননি মুকুন্দ মুহুরি। একপলক চোখ তুলে দেখেছিলেন, মেয়েরা নিবিষ্ট মনে খেয়ে যাচ্ছে। সুদীপা প্লেটের ভাতগুলো আনমনে নেড়েচেড়ে যাচ্ছেন। অন্যদিন হলে জিজ্ঞেস করতেন, ভাত খাচ্ছ না কেন সুদীপা ? রান্না ভালো হয়নি ? আজ কিছুই জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করল না তাঁর। শ্লথ পায়ে বেডরুমের দিকে এগিয়ে গেছিলেন মুকুন্দ বাবু।

ছুটির দিনের দ্বিপ্রহরে একটু ঘুমানোর অভ্যেস মুকুন্দ বাবুর। তবে খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়েন না। কোনওদিন বিশাল জানালার ফাঁক দিয়ে রাজপথের মানুষের চলাচল দেখেন, কোনওদিন টেবিলে রাখা গুচ্ছের বই থেকে যেকোনো একটি বই টেনে নেন। গল্প বা কবিতার। মনোযোগ দিয়ে পড়েন না। উসুখুস মন নিয়ে কার জন্য যেন অপেক্ষা করেন! এক সময় তাঁর প্রতীক্ষার সময় শেষ হয়। সুদীপা ঘরে ঢোকেন। কখনও আলতো খোঁপা, কখনও শিথিল শাড়ি। মেয়েরা যার যার রুমে চলে গেলে নরম পায়ে ঘরে ঢোকেন সুদীপা সেন। দেখে মিষ্টি একটু হাসেন মুকুন্দ বাবু। খুব যে আসক্তি জাগে তখন তাঁর, তা নয়। তবে সান্নিধ্য-আকাক্সক্ষা প্রবল হয়ে ওঠে। বিছানায় যান তাঁরা। পাশাপাশি শুয়ে পড়েন। কখনও আলত হাতটা মুকুন্দ সুদীপার বুকের ওপর তুলে দেন, কখনও সুদীপা মুকুন্দের চুলে বিলি কাটেন। কোনও কোনও দিন ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ান দুজনে। ওখানেই থেমে যান। কোনও দিন মন উতলা হয়ে উঠলে রতিক্রীড়ায় মগ্ন হন। কখনও মুকুন্দের আগ্রহে, কখনও সুদীপার আহ্বানে। তারপর সন্ধ্যা পর্যন্ত অঘোরে ঘুমান তাঁরা।

আজ কিছুই করলেন না মুকুন্দ বাবু। সরাসরি খাটে শুয়ে পড়লেন। ঘুমানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু ঘুম এল না। একটু তন্দ্রা আসছে, চট করে কেটে যাচ্ছে। এই অবস্থায় একটা দৃশ্য বারবার তাঁর চোখে ভেসে উঠতে লাগল। সে মধুরামের কোঁতা হয়ে দাঁড়ানোর দৃশ্য। দুহাত জড়ো করে গামছা কাঁধের মধুরাম  জড়োসড়ো হয়ে তাঁর সামনে কুঁজো হয়ে থেকেছিল সেদিন।

সেই সন্ধ্যায় জটিল একটা কেস নিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলেন তিনি। কালকে হেয়ারিং। আগামীদিনের তাঁর যুক্তি-তর্কের ওপরই কেসটির জয়-পরাজয় নির্ভর করছে। বিকেল থেকে নানা বই পড়ে, গভীরভাবে ভেবেও অকাট্য যুক্তি খাড়া করতে পারছেন না। একটু একটু ঘামছেন তিনি। ভেতরের অস্থিরতাও টের পাচ্ছেন। এই সময় হরিপদ দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিল। হরিপদ এই বাড়ির ফাইফরমাশের লোক। বাজার করা থেকে বাগানে পানি দেওয়া, বাড়িতে কে এল, কে গেল―তদারক করা হরিপদর কাজ।

সেই হরিপদকে দেখে চোখ কুঁচকে তাকিয়েছিলেন মুকুন্দবাবু।

হরিপদ বলেছিল, একজন লোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায় কর্তা।

বেশ বিরক্তি নিয়েই ধমকের গলায় মুকুন্দ মুহুরি বলে উঠেছিলেন, দেখছ না তুমি, আমি ব্যস্ত আছি ? বিদেয় করো। বল, আজ দেখা করতে পারব না।

হরিপদ বলেছিল, আমি বলেছিলাম কর্তা। কিন্তু লোকটা নাছোড়। বলল, জীবনমরণ সমস্যা। দেখা তাকে নাকি করতেই হবে।

বললাম না, দেখা করতে পারব না। অনেকটা গর্জেই উঠলেন মুকুন্দ বাবু।

তিন

লোকটির নাম নাকি মধুরাম। সম্পর্কে আপনার ..

মধুরাম! হরিপদর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠেছিলেন মুকুন্দ বাবু।

হরিপদ বলেছিল, হ্যাঁ কর্তা। ওই নামটাই তো বলল! আমি না না করেছি। কিন্তু লোকটি এমন ঝোলাঝুলি শুরু করল, বাধ্য হয়ে আপনার কাছে আসতে হলো।

মুকুন্দবাবু তখন তাঁর স্মৃতি হাতড়ে যাচ্ছেন। শিবপুর গ্রাম। তাঁর জন্মভিটে। মাটির বাড়ি। মাঝারি উঠান। উঠানঘেঁষা পুকুর। খেঁজুর গাছের ঘাট। টলটলে জল। এপার-ওপার সাঁতার কাটা ঢোঁড়া। বাড়ির পাশে সতীশজেঠুর বাড়ি। যক্ষ্মা রোগে কাতর জেঠু। খুল্লুত খুল্লুত কাশি। জেঠুর গায়ে ভারী খদ্দেরের চাদর। গলায় ফুটোফোটা মাফলার। আধময়লা ধুতি আর ফতুয়া। জেঠুর বাড়ির পাশে সন্ধ্যাদিদের বাড়ি। উঠানে বরই গাছ। গাছভর্তি বরই। এরপর মাখন কাকা, নিশিকান্ত দাদু, গগন মামার বাড়ি। দূরে দূরে আরও অনেকের। সবাই আত্মীয়। দূর সম্পর্কের। গ্রামটায় এমন মমতাজড়ানো যে অনাত্মীয়ের দূরত্ব ভুলে গিয়ে সবাই আপন আপন। অভাবের সময় কতই-না সাহায্য করেছে ওরা! কেউ চাল দিয়ে, কেউ খেতের সবজি দিয়ে, কেউ-বা সহানুভূতি দিয়ে।

একে একে সবার কথা, সবকিছুর কথা মনে পড়ছে মুকুন্দ বাবুর! কই মধুরামের কথা তো মনে পড়ছে না! মধুরাম ? মধুরাম ?

সময় তো কম গড়াল না! কম করে হলেও পঁচিশ বছর। পঁচিশ বছর আগে গ্রামের পাট চুকিয়ে দিয়েছিলেন মুকুন্দবাবু। জন্মভিটেটা শিবপুর হাই স্কুলের হেডমাস্টার নৃসিংহ চক্রবর্তীর কাছে বেচে দিয়েছিলেন। ফিরে আসার সময় সতীশজেঠু ঝাপটে ধরে বুকের কাছে টেনে নিয়েছিল।

বলেছিল, বুঝি বাপ, তোর এখন শহুরে জীবন। রুজিরোজগারের জায়গাও ওখানে। তোর কোনও ভাই নেই যে এই ভিটেয় থাকে। শহর থেকে দূরগ্রামের জায়গাজমি দেখভাল করা কঠিন। তোর দিক থেকে বিবেচনা করে হয়ত বলবি, ভিটেটা বিক্রি করে দিয়ে ঠিক কাজটিই করেছিস। কিন্তু বাপ, এই ভিটের টানে দু’চার বছরে হলেও একবার আসতিস তুই। এখন তো আর আসবি না রে বাপ! তারপর হঠাৎ চুপ করে গিয়েছিল সতীশজেঠু। যে সতীশ জেঠু অবিরাম খুক খুক করে কাশে, ওই মুহূর্তে কাশতেও ভুলে গিয়েছিল।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মুকুন্দ বাবুর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে জেঠু বলেছিল, আর যা-ই করিস বাপ, এই গ্রামের মানুষদের ভুলিস না।

হঠাৎ সংবিতে ফিরলেন মুকুন্দ মুহুরি। হাতের কলমটা টেবিলে ছড়ানো কাগজপত্রের ওপর অনেকটা ছুড়েই দিলেন। চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে চোখ বুজলেন। কিছুতেই মধুরামকে স্মরণে আনতে পারলেন না। চোখ খুলে দেখলেন, হরিপদ তখনও দরজায় দাঁড়িয়ে।

আস্তে করে বললেন, নিয়ে এসো।

মুকুন্দবাবু দেখলেন, চল্লিশ-বিয়াল্লিশের মধুরাম। খোঁচা দাড়ি। ঝাঁকড়া চুলে চিরুনি দেওয়ার অভ্যেস আছে বলে মনে হলো না। আধপুরনো হাফ শার্ট গায়ে। রং চটা। কলারের দিকে ছেঁড়া। কোনও চটি পরে এসেছে, না খালি পায়ে, বোঝা গেল না। যদি পরে আসে, বাইরে রেখে এসেছে। ঘরের ভেতর বাইরের জুতো পরে ঢোকা নিষেধ।

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দুহাত জড়ো করে প্রণাম জানাল মধুরাম। মুখ দিয়ে কোনও শব্দ বের হলো না।

একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মুকুন্দ বাবু, মধুরামের দিকে। মধুরামের শীর্ণ মুখে ম্লান অপ্রস্তুতের আভা। একটা জিনিসের ওপর মুকুন্দবাবুর দৃষ্টি আটকে গেল। সে মধুরামের চকচকে দুটো চোখ। জলভরা চোখ দুটো দিয়ে সে মুকুন্দবাবুর দিকে তাকিয়ে আছে।

দ্রুত মুকুন্দবাবু ভেবে যাচ্ছেন―কে এই মধুরাম ? তাঁর গ্রাম থেকে এসেছে বলছে, কিন্তু তিনি চিনতে পারছেন না। বয়সে তরুণ হলে মধুরামকে চিনতে না-পারা স্বাভাবিক ছিল। কারণ গত প্রায় পঁচিশ বছর ধরে তিনি শিবপুরে যাননি। ওই সময়ের মধ্যে জন্ম নেওয়াদের চিনতে পারা সম্ভব নয়। কিন্তু এই মধুরাম তো তরুণ নয়! চল্লিশের এপার-ওপার বয়স। এই বয়সের মধুরামকে তো তাঁর চেনার কথা!

ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলেন মুকুন্দ বাবু। বললেন, তুমিই মধুরাম!

মধুরাম মাথা নুইয়ে বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ।

তা মধুরাম, হরিপদকে তুমি বলেছ, শিবপুর থেকে এসেছ।

আজ্ঞে হ্যাঁ।

তোমাকে তো আমি চিনতে পারছি না! কোন পাড়ায় বাড়ি তোমার ?

আজ্ঞে চিনতে না পারাই স্বাভাবিক। ছোটবেলায় আমি ভীতু ধরনের ছিলাম। মানুষের সামনে আসতে ভয় করতাম।

এখন সেই ভয় কি কেটে গেছে ? জিজ্ঞেস করতে গিয়ে থমকে গেলেন মুকুন্দ মুহুরি। অসহায় এই মানুষটির সঙ্গে ঠাট্টা করতে ইচ্ছে করল না তাঁর। বললেন, কোন পাড়ায় তোমার বাড়ি, বললে না তো!

মধুরাম বলল, আজ্ঞে, আমাদের বাড়িটা কোনও পাড়ায় ছিল না। কানুনগোদের পোড়ো বাড়িটার পেছনে যে জংলামতন জায়গা ছিল, ওখানেই ছিল আমাদের বাড়ি।

ছিল কেন বলছ, এখন নেই ?

আছে আজ্ঞে।

তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু তোমাকে আমি চিনতে পারছি না কেন ?

মধুরাম তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আমার বাবার নাম অভিরাম, অভিরাম মিত্তির।

অভিরাম, অভিরাম! কোন অভিরাম ? মুকুন্দবাবু গ্রাম ছেড়েছেন, অনেক বছর হয়ে গেল। গ্রামের মুখগুলো স্মৃতিতে ঝাপসা হয়ে গেছে। সেই ঝাপসা মুখগুলোর মধ্যে মুকুন্দবাবু আঁতিপাঁতি করে অভিরাম মিত্তিরের মুখটি খুঁজে ফিরতে লাগলেন।

মধুরাম মৃদু কণ্ঠে বলে, বাবার একটি মুদির দোকান ছিল। চৌরাস্তার মোড়ে। শিবমন্দিরের কাছে।

শুনে শরীরটা প্রথমে অবশ হয়ে গেল মুকুন্দবাবুর। তারপর অপরাধবোধ তাঁকে আচ্ছন্ন করল। এরপর চেয়ার থেকে উঠতে গিয়ে ধপাস করে বসে পড়লেন আবার।

তার মুখ দিয়ে অস্পষ্টভাবে বেরিয়ে এল, হরিপদ, মধুরামকে বসতে দাও।

হরিপদ মধুরামকে একটা চেয়ারে বসাল।

মুকুন্দবাবু ঘোরের মধ্যে বললেন, খাবার-দাবার নিয়ে এসো।

মধুরাম  জড়োসড়ো হয়ে চেয়ারে বসেছে। দৃষ্টি নিচের দিকে। মুকুন্দ বাবু নিষ্পলক চোখে মধুরামের দিকে তাকিয়ে থেকে ভেবে যেতে লাগলেন।

ভয়াবহ অভাব তখন সংসারে। বেশ কমাস আগে বাবা গত হয়েছে। মায়ের হাতে যা কিছু জমাপাতি ছিল, খরচ হয়ে গেছে। মা আশপাশের বাড়িতে গিয়ে ধার-উধার শুরু করল। পড়শিরাও বিরক্তি প্রকাশ করতে লাগল একটা সময়ে। গাঁয়ের মানুষ তাকে তখন তেমন করে চেনে না যে তার হাতে কিছু টাকা তুলে দেবে। মোটা আঁকাড়া চাল, পুকুরপাড়ের শাক আর খেসারির ডাল দিয়ে কিছুদিন অতিবাহিত হলো। একদিন পিঠ ঠেকে গেল দেয়ালে।

সকালে মা বলল, আজ আর রাঁধতে পারব না রে মুকুন্দ! ঘরে চাল বাড়ন্ত। ডাল-তেল কিছুই নেই। উপোস দিতে হবে আজ। ঠোঁটে দাঁত চেপে মায়ের কথা শুনে গেল মুকুন্দ। কী করবে, কোথায় যাবে, দিশা পেল না। একপা দুই পা করে বাড়ির বাইরে এসে রাস্তায় দাঁড়াল। মেটে রাস্তা। এঁকেবেঁকে ওই সুদূরে মিলিয়ে গেছে। হাঁটতে শুরু করল মুকুন্দ। হাঁটতে হাঁটতে কানুনগোদের পোড়োবাড়ি পেরিয়ে এল। দাঁড়িয়ে পড়েছিল মুকুন্দ। এরপর কোথায় যাবে ? কোনদিকে যাবে ? ঠিক ওই সময়ে অভিরাম মিত্তিরের মুদির দোকানটা চোখে পড়েছিল মুকুন্দের। আনমনে দোকানটির দিকে এগিয়ে গিয়েছিল সে। কাস্টমারকে সদাই দিতে ব্যস্ত তখন অভিরাম। কেউ তেল চাইছে, কেউ নুন, কেউ মুড়ি চাইছে, কেউ-বা চাল-ডাল।

সামনের বেঞ্চিটিতে ধপ করে বসে পড়েছিল মুকুন্দ। বেশ কিছুক্ষণ পর মুকুন্দের ওপর নজর পড়েছিল অভিরামের। বলেছিল, বাবা, তোমাকে তো ঠিক চিনতে পারছি না!

মুক্ন্দু বলেছিল, শহরে পড়ি আমি। আমার বাবার নাম গোবিন্দ মুহুরি।

দ্রুত দোকান থেকে বেরিয়ে এসেছিল অভিরাম। বলেছিল, তুমি গোবিন্দদার ছেলে! তা বেশ বেশ। আজ এদিকে এলে যে! কোনও দরকার আছে বুঝি ? তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাতর গলায় অভিরাম বলল, তোমাদের দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে অকালে গোবিন্দদা চলে গেলেন! বলতে বলতে কাঁধের গামছাটি দিয়ে চোখ মুচতে লাগল অভিরাম।

তা বাবা, তোমাদের দিন চলছে কেমন করে ? কাছ ঘেঁষে গাঢ় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল অভিরাম।

বড় অভাব কাকা। মাথা নিচু করে বলেছিল মুকুন্দ।

গাঁয়ের মানুষ অভিরাম। লেখাপড়া জানে না। কর গুনে গুনে হিসাব করে। তার ঘরেও যে দারিদ্র্য নেই, তা নয়। বড় ভালো মানুষ অভিরাম। মুকুন্দের ওই একটি বাক্যে যা বোঝার বুঝে গেল।

দোকানে ঢুকে চাল-ডাল-আলু-নুন-পেঁয়াজ আরও দু’চারটা টুকিটাকি প্রয়োজনীয় জিনিস একটি থলেতে ভরল। তারপর মুকুন্দকে উদ্দেশ করে বলল, তুমি বাড়িতে যাও বাবা। কিছুক্ষণ পর এই থলেটা বাড়িতে পৌঁছে যাবে তোমার।

লজ্জায় তখন মুকুন্দের মাথাটা মাটিতে মিশে যেতে চাইল। ভিক্ষা! সে আজ অভিরাম কাকার কাছ থেকে ভিক্ষার থলে নিয়ে বাড়ি ফিরবে!

টের পেল অভিরাম। দোকান থেকে বেরিয়ে এসে মুুকুন্দের হাত ধরল। মৃদু গলায় বলল, বাবারে, আমি পয়সাওয়ালা নই। এই মুদির দোকানটিই ভরসা আমার। তোমাকে মুফতে দেওয়ার ক্ষমতা নেই আমার। যখন তুমি পারবে, দাম দিয়ে যেয়ো। লজ্জা পেয়ো না তুমি। আজকের কথাটি কাউকে বলব না আমি।

মুকুন্দ ধরা গলায় জিজ্ঞেস করল, কত টাকা কাকা ?

অভিরাম বলেছিল, উনিশ টাকা বারো আনা।

সেই উনিশ টাকা বারো আনা শোধ করতে পারেনি মুকুন্দ। ওই ঘটনার সপ্তাহখানেকের মধ্যে শহরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তারপর তো বন্ধুর পথে পথচলা শুরু হয়েছিল তার। বহু বছর পর মুকুন্দের অবস্থা ফিরেছিল। জীবনের ডামাডোলের মধ্যে অভিরামকাকার কথা, উনিশ টাকা বারো আনার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন মুকুন্দবাবু।

আজ মধুরামের মুখে অভিরামের নাম শুনে সেই ঋণের কথা, সেই অকাতর সাহায্যের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল মুকুন্দ মুহুরির।

মধুরামের খাওয়া শেষ হলে মুকুন্দ বাবু জিজ্ঞেস করেছিলেন, কোনও দরকারে কি এসেছ ? মধুরাম ? অভিরামকাকার উপকারের কথা চেপে গিয়েছিলেন মুকুন্দবাবু। ইচ্ছা―মধুরাম সেই প্রসঙ্গ তোলে কি না, দেখা। কিন্তু না, মধুরাম সেকথার ধারেকাছেও গেল না।

কাঁচুমাচু হয়ে বলল, সকালের দিকে পৌঁছেছি শহরে। ঠিকানা জানতাম না। শুধু জানতাম, আপনি আমাদের গ্রামের লোক। বলে থেমে গেল মধুরাম। একটু ঢোঁক গিলে মধুরাম আবার বলল, বাড়ি খুঁজে পেতে সন্ধ্যে হয়ে গেল।

তা কী দরকার মধুরাম ?

আমার মেয়ের বিয়ে। একমাত্র মেয়ে। দশ হাজার টাকা যৌতুক চেয়েছে। তিন হাজার জোগাড় করেছি। আরগুলো জোগাড় করতে পারিনি। আপনি যদি সাহায্য করেন। এক নিশ্বাসে বলে গেল মধুরাম।

মনে মনে ঈশ্বরকে প্রণিপাত জানালেন মুকুন্দ বাবু। এতদিন পর উনিশ টাকা বারো আনার ঋণ শোধ করে দেওয়ার সুযোগ দিয়েছেন তিনি। সেই সন্ধ্যায় গভীর আবেগজড়ানো কণ্ঠে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মুকুন্দ বাবু, নিজে বিয়ের দিন সশরীরে উপস্থিত থেকে টাকাটা মধুরামের হাতে দেবেন। মধুরাম যেন হাতে স্বর্গ পেয়েছিল।

কিন্তু বিয়ের দিন মুকুন্দ মুহুরি মধুরামের মেয়ের বিয়েতে যাননি। কাউকে দিয়ে টাকাটাও পাঠাননি তিনি। যে-রাতে বিয়ে মেয়েটির, সেই সন্ধ্যায় নিশা মারা গিয়েছিল। দুপুরে এক বান্ধবীর বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে গিয়েছিল। ফিরেই ভেদবমি। ডাক্তার কিছুই করতে পারেননি। মুকুন্দবাবু পাথর হয়ে গিয়েছিলেন।

সপ্তাহখানেক পরে তিনি যখন সংবিতে ফিরলেন, মধুরামের কথা মনে পড়েছিল। হরিপদকে পাঠিয়েছিলেন শিবপুরে। হরিপদ ফিরে এসে বলেছিল, সে রাতে যৌতুকের পুরো টাকা না পেয়ে বরপক্ষ বিয়ে না করিয়ে ফিরে গিয়েছিল। মধুরামের মেয়ে অপমানে-লজ্জায় গলায় দড়ি দিয়েছিল।

চার

সেই ক্ষত বুকে চেপে দিন কাটাচ্ছিলেন মুকুন্দ মুহুরি। কিছুতেই স্বস্তি খুঁজে পান না তিনি। এত বড় বাড়ি, ব্যাংকে মোটা অঙ্কের টাকা, ওকালতিতে প্রচণ্ড সুনাম, সুখের দাম্পত্যজীবন―কোনও কিছুই তাঁকে সুখী করে না। বার বার মনে পড়ে যায় মধুরামের মেয়েটির কথা। কী নাম ছিল মেয়েটির ? সেই সন্ধ্যায় নামটি জিজ্ঞেস করেননি মধুরামকে। ভেতরে আবেগ কাজ করছিল ভীষণ। ঋণশোধের আনন্দাবেগ। পরোপকারের অহংকারও যে কিছুটা মিশে ছিল না সেই আবেগে, অস্বীকার করেন কী করে মুকুন্দবাবু ? কিন্তু সেই আনন্দাবেগ শেষ পর্যন্ত অপরাধে পর্যবসিত হয়েছে। উকিল মানুষ তিনি। তিনি জানেন, আইনের চোখে তিনি অপরাধী। কথা দিয়ে কথা না রাখার অপরাধ। তাঁর কথা না রাখার কারণেই তো মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে! এই আত্মহত্যার প্ররোচনাকারী তো তিনিই! মুকুন্দ মুহুরি ভাবতেন আর মরমে মরে যেতেন। ঘটনাটা ভুলে থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যেতেন তিনি।

আজ পিসি গরিবদের সাহায্যের কথাটি তুলে মধুরামের কথা মনে করিয়ে দিলো। বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে লাগলেন মুকুন্দবাবু।

বিকেলটা গড়িয়ে গেল সন্ধ্যার দিকে। কেন জানি  সুদীপা আজ বেডরুমে এলেন না। হয়তো মেয়েদের সঙ্গে বা মীরা পিসির সঙ্গে আজ গল্পগুজবে মেতেছেন সুদীপা সেন। মাঝেমধ্যে এ রকম হয় সুদীপার। দিশা-তিশার বেডরুমে ঢুকে যান। মেয়েরা বড় হয়ে গেছে। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা বেডরুম। নিশারও ছিল। ও মারা যাওয়ার পর রুমটি তালা দেওয়া। মাঝে মাঝে এরকম দুপুরবেলা নিশার ঘরে ঢোকেন সুদীপা। ভেতর থেকে খিল দেন। তারপর নিশার বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে অঝোরে কাঁদতে থাকেন। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েন। মুকুন্দবাবু জানেন সেটা। সুদীপার সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনও কথা বলেন না। তিনি জানেন, তাতে কন্যা হারানোর ব্যথাটা আরও প্রবল হয়ে উঠবে সুদীপার বুকে।

দিশা-তিশা রাতে আলাদা ঘরে শুলেও অপরাহ্ণটা এক ঘরে কাটায়। কখনও দিশার সঙ্গে, কখনও তিশার বিছানায়। যেদিন মন টানে ও-ঘরে ঢোকেন সুদীপা। কথায়-খুনসুটিতে সময় পার করেন। মেয়েদের মধ্যে নিজের যৌবনবেলাকে খুঁজে ফিরেন তখন, সুদীপা। আজও বোধহয় সেরকম কিছু একটা হয়েছে। ভাবলেন মুকুন্দবাবু।

নিজ শয্যায় আর ভালো লাগছিল না মুকুন্দ বাবুর। বাইরে তাকিয়ে দেখলেন, সন্ধ্যা নেমে গেছে।

এখন কি কৃষ্ণপক্ষ, না শুক্লপক্ষ ? শুক্লপক্ষই হবে বোধহয়। নইলে বাইরে এত আলো কেন ? মন বলল, এ আলো বাড়ির চতুর্দিকের গার্ডলাইটের আলো। হরিপদকে বলা আছে, সন্ধ্যা হয় হয় সময়ে যাতে বাড়ির চারদিকের আলোগুলো জ্বালিয়ে দেয়। হরিপদ তা-ই করেছে মনে হয়।

তারপরও এত আলো! এত উজ্জ্বল আলো হওয়ার তো কথা নয়! স্নিগ্ধ ঐশ্বর্যময় অলৌকিক আলোর কণাগুলো তাঁর বাড়ির চারদিকে ভেসে বেড়াচ্ছে বলে মনে হলো মুকুন্দ মুহুরির। আর শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করল না তাঁর। ছাদে যেতে মন চাইল। উঠলেন তিনি। ওয়াশরুমে ঢুকে চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিলেন। ঘন চুলে আলতো করে চিরুনি বোলালেন। হালকা একটা চাদর গায়ে জড়ালেন। হেমন্তের শেষাশেষি। বাতাসে শৈত্যের ক্ষীণ উপস্থিতি। ছাদের দিকে পা বাড়ালেন মুকুন্দ বাবু।

ছাদে উঠে দেখলেন, চরাচরজুড়ে জোছনার ঢল। পূর্ণিমা না হলেও পূর্ণিমার আগের বা পরেরদিন আজ। নইলে এত গহিন-গভীর জোছনা কেন ?

ছাদে উঠার পর ব্যথাতুর মনটাতে প্রশান্তির প্রলেপ লাগতে শুরু করল মুকুন্দবাবুর।

কেনার পর মুকুন্দ বাবু বাড়িটির নাম রেখেছিলেন―ঠাঁই। খোদাই করা একটা সাদা মারবেল মূলফটকের ডানপাশের পিলারে স্থাপন করেছিলেন। লেখা ছিল―ঠাঁই, ১৬/১৭ লাভ লেন, চট্টগ্রাম। খোদাইকারীর পোক্ত হাত। খোদাইটা এমন চমৎকার হয়েছিল যে পথচারীদের অনেকে ফলকটির সামনে থমকে যেত। বাড়িটির পশ্চিমে দেয়ালঘেঁষে বাঁশঝাড়। একটু ওদিকে সুপারিগাছের সারি। সন্ধ্যা হলে বাঁশঝাড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে বক নামে। মাইল দুয়েক দূরের ফয়’স লেকে দিনের আহার শেষ করে রাতের আশ্রয়টা এই বাঁশঝাড়েই নেয় বকেরা। আজ ফকফকা জোছনা বলে বাঁশের মাথায় বকদের দেখতে পেলেন মুকুন্দ বাবু।

মুকুন্দ মুহুরির ছাদবাগানটা দেখার মতো। ছাদে প্রথম যেদিন উঠেছিলেন, বিশালত্ব দেখে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন―ছাদে বাগান করবেন। ফল ও ফুলের বাগান। পরে যখন বাড়িতে থিতু হলেন, তাও বেশ কমাস পরে, ছাদবাগানের বাসনাটা প্রবল হয়ে উঠল মনে। মনে মনে চাইলেই তো আর ছাদবাগান হয় না! ছাদবাগানের হেপা তো অনেক! মাটি, গোবর, সার, চারা, টব―এসব তো আছেই, তার চেয়ে বেশি দরকার এমন একজন মালি, যে প্রাণের যত্নে বাগানটিকে দাঁড় করাতে পারবে।

হরিপদের সামনে কথাটি একদিন তুলেছিলেন মুকুন্দবাবু।

হরিপদ বলেছিল, আমার সঙ্গে একজন লোকের পরিচয় আছে কর্তা।

পরিচয় আছে ? কে সে ?

যে বাগানটিকে আপনার মনের মতো করে সাজিয়ে দিতে পারবে। কর্তার প্রশ্নের প্রথমাংশের উত্তর না দিয়ে শেষ অংশের উত্তর দিয়েছিল হরিপদ।

তা তার নামটি কী ? থাকে কোথায় ? বিরক্ত না হয়ে মুকুন্দবাবু জানতে চেয়েছিলেন।

হরিপদ বলেছিল, ওর নাম হারাধন কর্তা। হারাধন মালাকার। ডিসি হিলের গোড়ায় ‘সুরভি নার্সারি’ নামে যে নার্সারিটি আছে, ওখানে কাজ করে হারাধন। আমাদের গ্রামের পাশের গ্রামে বাড়ি। জাত মালি কর্তা। আপনি বললে একদিন নিয়ে আসতে পারব।

মুকুন্দবাবু বলেছিলেন, কিন্তু ও তো একটা জায়গায় কাজ করছে পার্মানেন্টলি। সে কি কাজ করতে পারবে এখানে ?

পারবে কর্তা। নার্সারিতে ওর কাজ তো দিনের বেলায়! সন্ধ্যার দিকে এখানে কাজ করতে তার কোনও অসুবিধা হবে না।

তাহলে একদিন ডেকে আন তাকে। কথা বলি। বাগানটা করতে পারবে কিনা দেখি। মৃদু গলায় বলেছিলেন মুকুন্দবাবু।

এক বিকেলে হারাধনকে নিয়ে এসেছিল হরিপদ।

ছোটখাটো মানুষ হারাধন। বামন বললেও ভুল হবে না। গাল দুটো বসা বসা। গর্ত গর্ত চোখ। আধপুরনো জামা ঠেলে কণ্ঠা দুটো উঁচিয়ে আছে। বড় বড় পায়ের পাতা। সামনের দিকে ছড়ানো। পায়ের আঙুলগুলো বিসদৃশভাবে লম্বা। হঠাৎ হারাধনের হাতের দিকে চোখ পড়েছিল মুকুন্দবাবুর। চমকে উঠেছিলেন। আরে! এত সুন্দর হাত! অনেকটা মেয়েদের হাতের মতন। কোমল, সতেজ। আঙুলগুলোতে যেন মায়া আর ভালোবাসা জড়িয়ে-ছড়িয়ে আছে! ওতেই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন মুকুন্দবাবু। তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতার চোখ বলেছিল, যার হাতের আঙুল এত মনোরম, তার হাতেই তো গাছের চারাগুলো বড় হয়ে উঠবে! ওই হাত দুটো যে মায়ের হাত!

সেদিনই কাজে বহাল হয়েছিল হারাধন। শর্ত এরকম―সন্ধ্যার আগে আগে আসবে। সার-মাটি-টব-চারা জোগাড় করার দায়িত্ব ওর। কখনও সখনো গ্রামের বাড়িতে গেলে এক দুইদিন আসবে না। যাওয়ার আগে এমন ব্যবস্থা করে যাবে, যাতে গাছগুলো জল-খাবারের অভাবে না পড়ে।

সত্যি হারাধনের দুহাতে মমতা জড়ানো। শুধু হাত-আঙুল কোমল আর সুন্দর হলে তো হয় না, তার পেছনে একটা মমতাময় মনও থাকা চাই। সেই মনের সঙ্গে হাতের কারুকার্যের সম্মিলন ঘটলে যেকোনো কাজ সিদ্ধি পায়। হারাধনের সেরকম একটা মনও ছিল।

মাস দুয়েকের মধ্যে মুকুন্দ বাবুর ছাদটা ঝলমল করে উঠতে শুরু করল। ছাদের একদিকে পাশাপাশি ফলের চারার টব―আম, পেয়ারা, লেবু, জলপাই, আমলকি, কমলা, জাম্বুরা, কামরাঙা, ডালিম, তেঁতুল, লটকন―এসব। অন্যপাশে থরে-বিথরে সাজানো ফুলের টব। টবে টবে নানা ফুলের হাসিমুখ।

এর পর অনেকটা বছর কেটে গেছে। এখন ছাদে নানা ফলের বাহার। একদিন যারা শিশু ছিল, এখন তারা ফলবতী মা। মা যেমন নিজের বুকে সন্তানকে জড়িয়ে রাখে, মুকুন্দবাবুর বাগানের ফলগাছগুলোও ফলগুলোকে ডালে-গায়ে জড়িয়ে রেখেছে। হারাধন এখনও কাজ করে মুকুন্দবাবুর বাগানে। বয়স হয়ে গেছে হারাধনের। কাজের গতি ধীর হয়েছে। কিন্তু হাতের আঙুলে মমতা আগের তুলনায় আরও গভীরতর হয়েছে।

হারাধনের করা ছাদবাগানের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে আছেন মুকুন্দবাবু। বাগানে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা আছে। কেন জানি আজ আলো জ্বালাতে ইচ্ছে করল না তাঁর। জোছনায় বাগানে এক মোহময় পরিবেশ তৈরি হয়েছে। মুকুন্দবাবু সেই পরিবেশে ব্যাঘাত ঘটাতে চাইলেন না। একটু ডানে, নিম গাছটির প্রসারিত ডালটির নিচে বসার ব্যবস্থা করেছেন মুকুন্দ বাবু। শ্বেতপাথরের টেবিল, তার চারদিকে বসার চেয়ার। একটু ওদিকে একটা আরামকেদারা। ছাদে উঠলে ওই কেদারাতেই বসেন মুকুন্দ বাবু। আজ বসতে ইচেছ করল না তাঁর। নিম গাছের ছায়ায় গিয়ে দাঁড়ালেন।

নিশা যেদিন মারা গেল, এ রকম জ্যোৎস্নাময় সন্ধ্যা ছিল। মুকুন্দবাবুর মনে আছে, নিশার শবের সঙ্গে সঙ্গে হেঁটে গিয়েছিলেন তিনি। বলুয়ার দিঘির শ্মশান পর্যন্ত। শহরের আলো ঝলমল রাজপথ থেকে অন্ধকারমতন একটা ছোট রাস্তায় ঢুকলে জোছনাটা নজরে পড়েছিল তাঁর। শোকাতুর ওই রকম দুঃসময়েও গা-ভাসানো জোছনা দেখে চমৎকৃত হয়ে উঠেছিলেন তিনি। মেয়ে হারানোর বেদনার কথা মুহূর্তের জন্য ভুলে গিয়েছিলেন মুকুন্দবাবু। নইলে কেন পূর্ণ চোখে আকাশের দিকে তাকাবেন তিনি! দেখেছিলেন, গোলাকার আলোকময় চাঁদটি তাঁর সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছেন। প্রথমে মনটা ভীষণ আনচান করে উঠেছিল। তারপর ধীরে ধীরে নিবিড় এক প্রশান্তি তাঁর মন জুড়ে বিস্তৃত হয়েছিল।

আজও, এই সন্ধ্যেবেলায়, ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে জ্যোৎস্নালোকে স্নাত হতে হতে তাঁর মনটা ওই সন্ধ্যাটির মতো প্রগাঢ় স্বস্তিতে ভরে যেতে লাগল। তাঁর মনে হলো, পৃথিবীতে অবিরত কত ঘটনাই-না সংঘটিত হচ্ছে! কোনও কোনও ঘটনা পৃথিবীর হিসেবটাই বদলে দেয়। অনেকের জীবনের যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগের খাতাটাই ওলটপালট হয়ে যায়। সে-রাতে মধুরামের মেয়ের বিয়েতে যেতে না পারা, অপমানিত হয়ে মধুরামের মেয়েটির আত্মহত্যা, সেরকমরই একটা ঘটনা। মধুরামের মেয়েটির বিয়েতে তাঁর না-যাওয়ায় পরের যে ঘটনাগুলো ধারাবাহিকভাবে ঘটে গিয়েছিল, তা যেন অবধারিত এবং অলৌকিক। না না, মধুরামের মেয়ের আত্মহননকে অলৌকিক বলে নিজের দায় এড়াতে চান না মুকুন্দ মুহুরি। তাঁর কারণেই তো একটি পরিবার তছনছ হয়ে গিয়েছিল সেই রাতে! ঈশ্বরও কি কম প্রতিশোধ নিয়েছেন ? তাঁর সবচেয়ে প্রিয় মেয়েটিকে তো কেড়ে নিয়েছেন তিনি! মুকুন্দ বাবু জানেন না, কে আগে মরেছে! নিশ্চয়ই মধুরামের মেয়েটি আগে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে, তার পরেই ঈশ্বর হিংস্র হয়ে উঠেছেন তাঁর ওপর! মধুরামের মেয়েটির আত্মহত্যার পরেই তো ঈশ্বর তাঁর ছোট মেয়েটিকে কেড়ে নিয়ে শোধ নিয়েছেন।

এরকম করে ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তে হাত দুটো বুকের কাছে জড়ো করলেন মুকুন্দ বাবু। মনে মনে আওড়াতে লাগলেন, হে প্রভু, তুমি যদি আমার ওপর ক্ষুব্ধ হও, শোধ তো নিয়েছ! কম তো ক্ষতি করনি তুমি আমার!  আমার সবচাইতে প্রিয় যে ধনটি ছিল, যাকে মুহূর্তকাল না দেখলে বুকটা আইঢাই করে উঠত, তাকে তো ছিনিয়ে নিয়েছ প্রভু! ওখানেই থেমে যাওনি তুমি ঈশ্বর। চোখের বদলে চোখ তুলে নিয়েছ তুমি। আর না। আমার অন্য দুটি মেয়ের দিকে কোপকটাক্ষে তাকিয়ো না আর। তাদের রেহাই দাও তুমি। তোমার এ কীরকম বিচার ঈশ্বর ? যে অপরাধী, তারই তো শাস্তি হওয়া উচিত! তুমি তা করলে না। অন্যায় করলাম আমি। শাস্তির কৃপাণটা নামিয়ে আনলে আমার কোমল শিশু কন্যাটির ঘাড় বরাবর! কেন তুমি আমাকে দেখনি সেদিন ? যাক প্রভু, হাত জোড় করে তোমার কাছে বড় আর মেজ মেয়ের প্রাণভিক্ষা চাইছি। শুধু তা-ই নয়, তাদের জীবনটা যাতে সুখে আর স্বস্তিতে ভরে ওঠে, ভরে থাকে―এই আশীর্বাদও চাইছি তোমার কাছে। আর যদি কখনও তাদেরকে শাস্তি দিতে ইচ্ছে করে তোমার, সেই শাস্তি আমাকে দিয়ো ঈশ্বর। ওদেরকে নয়। তোমাকে হাজার-কোটি প্রণতি প্রভু। আমার মেয়ে দুটিকে তুমি দেখে রেখ ঈশ্বর।

সে-রাতে বিশাল এক প্রশান্তি নিয়ে ছাদ থেকে নেমে এসেছিলেন মুকুন্দবাবু।

পাঁচ

ঈশ্বরের কাছে মেয়ে দুটোর কল্যাণ প্রার্থনা করে গেলেও দিশা আর নিশা কিন্তু মুকুন্দ বাবুর স্বস্তি কেড়ে নিয়েছিল। সে আরও বেশ কয়েক বছর পরের কথা। তার আগেও কিছু ঘটনা আছে।

দিশা ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ার। সায়েন্সে। চট্টগ্রাম কলেজে। বেশ ভালো ছাত্রী দিশা। ইংরেজিতে তুখোড়। কিন্তু ম্যাথমেটিক্সটা কিছুতেই কব্জা হচ্ছে না। এমনিতে যে সে অংক বোঝে না, তা নয়। কিন্তু শুধু বুঝলে তো হবে না, ভালো করে আয়ত্তে আনতে হবে। ম্যাথমেটিক্স তার কম্পোলসারি সাবজেক্ট। অন্যান্য বিষয় ভালো করে ম্যাথমেটিক্সে কম নম্বর পেলে টোটাল রেজাল্টে সে পিছিয়ে যাবে। দিশার মতো ভালো ছাত্রী তা মেনে নেবে কেন ?

বান্ধবী সুজাতা বলল, তুই এক কাজ কর দিশা, টিউটোরিয়াল হোমে ভর্তি হয়ে যা।

দিশা বলল, টিউটোরিয়াল হোমে ভর্তি হব! কেন ?

ম্যাথে তোর যে দুর্বলতা, তা কয়েক মাসেই কেটে যাবে।

তা কোন টিউটোরিয়াল হোমের কথা বলছিস তুই ? জিজ্ঞেস করল দিশা।

বি.আর টিউটোরিয়াল হোম।

বি.আর মানে ? জানতে চায় দিশা।

বি.আর মানে বিশ্বপতি রায়। সরকারি কলেজের ম্যাথের অধ্যাপক ছিলেন। রিটায়ারমেন্টের পর হোমটি খুলেছেন। খুব নাম করেছে হোমটি। শুধু ম্যাথ পড়ানো হয়। ঝাঁকে ঝাঁকে স্টুডেন্টস। চান্স পাওয়া মুশকিল। উৎসাহের সঙ্গে বলে গেল সুজাতা।

দিশা এবার মৃদু কণ্ঠে বলল, চান্স পাওয়া মুশকিল মানে, আমি চাইলে ভর্তি হতে পারব না। এই তো ?

আরে না না! তোর জন্য কোনও সমস্যা হবে না। আমি ব্রজেন ডায়াস স্যারকে বললে তোকে ভর্তি করিয়ে নেবেন।

ভর্তি করিয়ে নেবেন! কেন ?

তুই তো ভালো স্টুডেন্ট। ভালো স্টুডেন্টের প্রতি হোমগুলোর আগ্রহ বেশি। তাদের রেজাল্ট দিয়েই তো হোমগুলো প্রতিষ্ঠা পায়। তাছাড়া …। বলে থেমে গেল সুজাতা।

চমকে সুজাতার দিকে তাকাল দিশা। কৌতূহলী চোখে বলল, তাছাড়া! কী বলতে চাস তুই ?

বলছিলাম তুই যা সুন্দরী, তোকে ভর্তি না করিয়ে ছাড়বেন না ব্রজেন ডায়াস স্যার। দিশার গায়ে চিমটি কেটে বলল সুজাতা।

দিশা বলল, মারব এক থাপ্পড়। ফাজিল মেয়ে কোথাকার! তারপর কণ্ঠকে নিচু করে জিজ্ঞেস করল, সেই প্রথম থেকেই ব্রজেন ডায়াস ব্রজেন ডায়াস করে যাচ্ছিস! হোমটা তো বিশ্বপতি স্যারের বললি! তো এই ব্রজেন ডায়াস এলেন কোত্থেকে ?

সুজাতা কৌতুকী কণ্ঠে বলল, ভর্তি হবার আগে এত কিছু জেনে নেওয়ার আগ্রহ কেন তোর ? আগে ভর্তি হয়ে নে। তার পর সবকিছু জানতে পারবি। তবে এটা জেনে রাখ, বিশ্বপতি স্যারের বয়স হয়ে গেছে। একা সামাল দিতে পারেন না। তাই ব্রজেন ডায়াস স্যারকে এপয়েন্টমেন্ট দিয়েছেন। দুর্দান্ত পড়ান ডায়াস স্যার। তার পড়ানোর ধরন দেখে মুগ্ধ হয়ে যাবি তুই। এ ব্যাপারে আমি গেরান্টি দিচ্ছি তোকে।

বাবার সঙ্গে কথা বলে বি.আর টিউটোরিয়াল হোমে ভর্তি হয়ে গিয়েছিল দিশা।

দিশা দেখেছিল, ব্রজেন ডায়াস সত্যিই একজন ওস্তাদ শিক্ষক, ম্যাথমেটিক্সে।

ব্রজেন ডায়াস মেডিকেলে পড়ে। থার্ড ইয়ারে। ছাত্র ভালো। কিন্তু পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। পড়ার খরচ চালানো মুশকিল। ডাল-শাক-ডিম দিয়ে খেয়ে পেটকে ফাঁকি দেওয়া যায়, কিন্তু বইপত্র না কিনে মেডিকেলকে ফাঁকি দেওয়া যায় না। বইপত্রের দাম তার কাছে আকাশচুম্বী। দিশা হারাতে বসে ব্রজেন। ওই অবস্থায় একদিন বিশ্বপতি স্যারের কথা মনে পড়ে যায় তার। একসময় বিশ্বপতি স্যারের ছাত্র ছিল  ব্রজেন ডায়াস। এক বিকেলে গিয়ে দেখা করল স্যারের সঙ্গে।

বলল, বড় কষ্টে আছি স্যার। কোনও একটা কাজ দেন। বিশ্বপতি রায় তাঁর এই ছাত্রটিকে বেশ পছন্দ করতেন। ব্যাচের সেরা স্টুডেন্ট ছিল ব্রজেন। যে অংকে মাঝেসাঝে তিনি ঠেকে যেতেন, ব্রজেন অবলীলায় তার সমাধান বের করে ফেলত। তিনি জানতেন, মাধ্যমিক আর উচ্চ মাধ্যমিকে চমকে দেওয়া রেজাল্ট ব্রজেনের। ম্যাথে তার দুর্দান্ত দখল। ব্রজেনের কথা শুনে বিশ্বপতি রায়ের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গিয়েছিল। ব্রজেনকে এই হোমের দু-একটা ব্যাচের ম্যাথ করানোর দায়িত্ব দিলে কেমন হয় ? ও যে খুব ভালো পড়াবে, এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ বিশ্বপতি রায়।

প্রস্তাব দিয়েছিলেন ব্রজেনকে, দেখ ব্রজেন, তোকে মাসিক বেতনের পার্মানেন্ট কোনও চাকরি দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি নিজেও যে একজন বেকার মানুষ। হাসতে হাসতে বলেছিলেন বিশ্বপতি রায়। তবে একটা কথা বলতে পারি তোকে, এই হোমে তুই ম্যাথমেটিক্সটা পড়াতে পারিস। সব ব্যাচে পড়িয়ে কুলিয়ে উঠতে পারবি না। দু-তিনটা ব্যাচে পড়ালেই হবে। তার জন্য মাসে দুহাজার করে দেব তোকে। আশাকরি, ওই টাকাটা তোর কাজে লাগবে।

ব্রজেন হাতে চাঁদ পেয়েছিল। এই টাকা তার পড়াশোনার পথ অনেকটাই সুগম করে দেবে। হোক না দু’হাজার টাকা! এই দিনে দুহাজার টাকার মূল্য কম কিসে ? রাজি হয়ে গিয়েছিল ব্রজেন ডায়াস। বলেছিল, আমার ভীষণ উপকার হবে স্যার। স্বগত কণ্ঠে বলেছিল, বড় টানাটানির সংসার স্যার আমাদের!

ব্রজেন ডায়াসের মা নার্স। মেডিকেল সেন্টার হাসপাতালের। প্রাইভেট হাসপাতাল। এ ধরনের হাসপাতালে চিকিৎসাখরচ অনেক। কিন্তু যারা সেবা-শুশ্রƒষা দেয়, তাদের বেতন কম। সেই কম বেতনের একজন সুশীলা ডায়াস। সুশীলা আগে গনজালভেজ ছিল। ননীগোপাল দাশকে বিয়ে করে সুশীলা গনজালভেজ থেকে সুশীলা দাশ মানে ডায়াস হয়েছে। ইংরেজগন্ধটা গায়ে ধরে রাখবার জন্য সুশীলা পদবি দাশ লেখে না, ডায়াস লেখে। মায়ের সূত্রে ব্রজেনও ব্রজেন ডায়াস।

সুশীলারা বাঙালি। বরিশালের। একসময় বরিশালে খ্রিস্টান হওয়ার ধুম পড়েছিল। নিম্ন আয়ের মানুষদের মধ্যে কনভার্টেড হবার প্রবণতা বেশি। কনভার্টেড হলে একটা চাকরি পাওয়া যায়। সন্তানদের পড়াশোনা করানোর সুযোগ মেলে। এই সুযোগটাই নিয়েছিল বরিশালের কিছু কিছু অঞ্চলের মানুষেরা। মেহেন্দিগঞ্জ সেরকম একটা অঞ্চল। মেহেন্দিগঞ্জের যদুনাথ একদিন সপরিবারে খ্রিস্টান হলো। বাড়ি ছেড়ে যদুনাথ গনজালভেজ একদিন চট্টগ্রামে চলে এল।  কর্ণফুলীর ওপাড়ে, খ্রিস্টানপল্লিতে আশ্রয় পেল যদুনাথ। ওই এলাকায় তখন খ্রিস্টানদের রমরমা। সেন্ট প্লাসিডস স্কুলে একটা চাকরিও পেয়ে গেল যদুনাথ।

তিন মেয়ে এক ছেলে যদুনাথ গনজালভেজের। মাস্টারির মাহিনা দিয়ে সংসার চালানো দায়। অভাবের মধ্যেও সন্তানদের পড়ালেখা চালিয়ে গেল যদুনাথ। বেশিদূর এগোতে পারল না তারা। বড় মেয়েটিরই সবচাইতে বেশি লেখাপড়া। উচ্চ মাধ্যমিক পাস। গির্জায় যাতায়াত করত খুব। মা-বাবা ভেবে নিয়েছিল, বড় ধর্মভীরু মেয়ে ফ্লোরা। রবিবার রবিবার গির্জায় যায়। আসলে প্রার্থনা করবার জন্য ফ্লোরা গির্জায় যেত না। যেত রুপার্ট সরকারের টানে। রুপার্টের বাবা ব্যবসায়ী। বাবার একমাত্র ছেলে রুপার্ট। গির্জার এক অনুষ্ঠানে ফ্লোরার সঙ্গে রুপার্টের পরিচয়। পরিচয় থেকে ঘনিষ্ঠতা। রুপার্ট এক রবিবার প্রস্তাব দিয়ে বসেছিল, উইল ইউ মেরি মি। মামকে বলেছি। মাম পাপার কানে তুলেছে। পাপার আপত্তি নেই। এখন তোমার মা-বাবার আপত্তি না থাকলে হলো। ফ্লোরা রুপার্টের হঠাৎ-প্রস্তাবে ভেবাচেকা খেয়ে গিয়েছিল প্রথমে। তারপর আনন্দে ফেটে পড়েছিল, উহ্ রুপার্ট, হাউ নাইস ইউ আর! আই লাভ ইউ রুপার্ট। বলতে বলতে বুকের কাছে টেনে নিয়েছিল রুপার্টকে। রুপার্ট তার নিজের ঠোঁট ফ্লোরার ঠোঁটে ডুবিয়ে দিয়েছিল সেই সন্ধ্যায়।

রুপার্ট আর ফ্লোরার বিয়েটা হয়ে গিয়েছিল।

যদুনাথের ছেলেটি বখে গিয়েছিল। নাইনে উঠে আর স্কুলে যায়নি। যদুনাথের শত আহাজারিতেও স্কুলমুখী হয়নি সে। খ্রিস্টানপল্লিতে মদের অভাব নেই। পাড়ার বখাটেদের সঙ্গে মিশে ওই মদেই গা ভাসিয়েছিল সঞ্জয় গনজালভেজ। মেজ মেয়ে সুশীলা মাধ্যমিক পাস করে নার্সিংকোর্সে ভর্তি হয়েছিল। পাস করে ওই মেডিকেল সেন্টার হাসপাতালে চাকরি নিয়েছিল সুশীলা।

খ্রিস্টান হলে কী হবে, বাঙালি নারীর মায়া-মমতা- ভালোবাসা-আন্তরিকতা সবই সুশীলার মধ্যে ছিল। আর মায়া-মমতা-স্নেহ-সহনশীলতা একজন নার্সের আসল গুণ। সুশীলার এই গুণে মুগ্ধ হাসপাতালের রোগীরা। ভালো হয়ে ফিরে যাওয়ার সময় রোগীরা ডাক্তারের চেয়ে সুশীলারই প্রশংসা করে বেশি। ননীগোপাল প্রশংসার চেয়ে আরও অধিক কিছু করে ফেলেছিল।

ননীগোপালরা খুব যে ধনী, এমন নয়। তবে সাধারণ মধ্যবিত্তের চেয়ে একটু বেশি সচ্ছল। বাবা পরিমল দাশের মাছের আড়ত। কর্ণফুলীর পাড়ে লাম্বুর হাটে পরিমলের আড়তটি। পরিমলের বাবা এক সময় কর্ণফুলীতে মাছ ধরত। পাতনি জাল দিয়ে। অভাবের সংসারে পরিমল বড় হয়েছে। বাবার জাতপেশা ত্যাগ করল পরিমল। তবে জল ও মাছ থেকে দূরে সরতে পারল না। লাম্বুর হাটে জেলেদের কাছ থেকে মাছ কেনা শুরু করল সে। প্রথমে অল্পস্বল্প, পরে পরে হাটে-আসা সব মাছ। সস্তায় কিনে বেশি দামে শহরের আড়তে চালান দিয়ে একসময় পরিমল ফুলেফেঁপে গেল।

ননীগোপালকে একদিন দুরারোগ্য রোগে ধরল। স্থানীয় ডাক্তাররা পরামর্শ দিলেন, শহরের বড় ডাক্তার দেখান। যুবক তখন ননীগোপাল। পরিমলের বুকের ধন, সোনার টুকরা। বেশ কয়েক মাস ট্রিটমেন্ট করেও ভালো হলো না ননীগোপাল। ডাক্তার সুযত পাল বললেন, আমি খুব ভালো বুঝছি না। আপনি এক কাজ করুন পরিমলবাবু, ছেলেকে মেডিকেলে ভর্তি করিয়ে দিন। আপনার কপাল ভালো হলে সুস্থ হয়ে ফিরেও যেতে পারে বাড়িতে।

পরিমল ডাক্তার পালের কথার ইঙ্গিত বুঝতে পারল। ননীগোপালের ব্যাধিটা যে জটিল ভীষণ, বুঝতে অসুবিধা হলো না পরিমলের।

ননীগোপালকে মেডিকেল সেন্টার হাসপাতালে ভর্তি করালো পরিমল।

ঘটনাচক্রে ননীগোপালের দেখভালের দায়িত্ব পড়ল সুশীলা গনজালভেজের ওপর। হাসপাতালের বড় ডাক্তার সুশীলাকে ডেকে বললেন, ননীগোপাল আমাদের জন্য বড় একটা চেলেঞ্জ সুশীলা। চট্টগ্রামের নামকরা ডাক্তাররা ফেল মেরেছেন। নিরুপায় হয়ে ননীগোপালের বাবা ননীগোপালকে আমাদের হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন। যেকোনো মূল্যে ননীগোপালকে ভালো করে তুলতে হবে সুশীলা। যদি ননীগোপালকে সুস্থ করে তুলতে পারি, আমাদের হাসপাতালের সুনাম কত উঁচুতে উঠবে ভেবে দেখ। ননীগোপালের দায়িত্ব তোমাকে দিলাম। তাকে সুস্থ করে তোলার মিশনের তুমি একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।

সেদিন কোনও কথা বলেনি সুশীলা। স্যারের কথা চুপ করে শুনে গিয়েছিল।

সেদিনের পরে ননীগোপালই সুশীলার ধ্যান-জ্ঞান হয়ে উঠেছিল। মেডিকেল বোর্ডও অনেক চিন্তাভাবনা করে ননীগোপালের ওষুধ সিলেকশন করেছিল। যথার্থ ওষুধই সিলেকশন করেছিলেন বোর্ডের ডাক্তাররা।

ওষুধের গুণে এবং সুশীলার শুশ্রƒষায় দিনসাতেকের মধ্যে চোখ খুলে তাকিয়েছিল ননীগোপাল। পনের দিনের মাথায় সুস্থ মানুষের মতো হাঁটাচলা শুরু করেছিল। কুড়িদিন পর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছিল ননীগোপাল।

হাসপাতাল থেকে বেরোবার আগ মুহূর্তে এক কাণ্ড করে বসেছিল ননী। বাবা তখন কাউন্টারে বিল মিটাচ্ছে। সুশীলা রুমে ননীর কাপড়চোপড় ব্যাগে ঢোকাচ্ছে। ওই সময় হঠাৎ সুশীলার হাত ধরে ফেলেছিল ননীগোপাল। লাজলজ্জা ত্যাগ করে বলে উঠেছিল, আমি তোমাকে ভালোবাসি সুশীলা। তোমাকে বিয়ে করতে চাই।

অসহায় দুর্বল রোগীর প্রলাপ ভেবে ননীগোপালের কথাটি উড়িয়ে দিয়েছিল সুশীলা।

কিন্তু এক মাস পরে ননীগোপাল যখন তার সামনে উপস্থিত হয়েছিল, এড়িয়ে যেতে পারেনি সুশীলা।

একদিন বিয়ে হয়েছিল তাদের। খেসারত দিতে হয়েছিল ননীগোপালকেই বেশি। পরিমল ননীগোপালকে ত্যাজ্যপুত্র করেছিল। তাতে ভড়কে যায়নি ননীগোপাল। পাথরঘাটার কলাবাগিচায় দুজনে সংসার শুরু করেছিল। ননীগোপাল চট্টলা প্রেসে চাকরি পেয়েছিল, মেশিন চালানোর চাকরি। ওই দিয়ে দিব্যি চলে যাচ্ছিল দুজনের। একদিন সুশীলার কোল জুড়ে ব্রজেন এল।

পরিমল ওদের নিতে এসেছিল। অভিমানী ননীগোপাল ফিরে যায়নি।

মেছো ননীগোপাল আর খ্রিস্টান সুশীলার একমাত্র সন্তান ব্রজেন ডায়াস।

এই ব্রজেন ডায়াস বি.আর টিউটোরিয়াল হোমে ম্যাথমেটিক্স পড়াতে শুরু করল একদিন।

ছয়

আর সেই টিউটোরিয়াল হোমে পড়তে এল দিশা মুহুরি।

শেষ বেঞ্চির ডান দিকের মাথায় চুপচাপ বসেছিল দিশা। পাশে সুজাতা। ক্লাস করতে এসে থমকে গিয়েছিল ব্রজেন ডায়াস। এত চটপটে মুখর ব্রজেন সেদিন মুখের কথা হারিয়ে বসেছিল। নিজের হৃৎকম্প টের পেয়েছিল ব্রজেন। তবে এ রোমান্টিক হৃৎকম্প নয়। রোমান্টিক হৃৎকম্প অন্য জিনিস। কী রকম যেন ভয়-ভয় উৎকণ্ঠা, ভেতরে কীরকম যেন ত্রস্ত ভাব! এই উৎকণ্ঠা আর ত্রস্ততা তাকে কাহিল করতে শুরু করে। তার এরকম অনুভবের কোনও কারণ খুঁজে পায় না সে। আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে আসতে চায় তার। না না, এরকম অবশ হলে তো চলবে না―দ্রুত ভেবে গেল ব্রজেন। মনে মনে নিজের মাথার পেছনে জোর একটা চাটি মারল। দৃষ্টিকে শিক্ষকসুলভ করে সামনের দিকে প্রসারিত করল। সেই দৃষ্টি দিশাতে আটকে থাকল। ও যে দিশা, আগেই জেনে গিয়েছিল ব্রজেন। সুজাতা ওকে নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেছিল, হোমে ভর্তির ব্যাপারে। ভর্তি প্রক্রিয়াটি তার হাতে ছেড়ে দিয়েছেন বিশ্বপতি রায়। তখন তার রুমে বেশ ভিড়ভাড় ছিল। তিন-চারজন ছাত্রছাত্রী ম্যাথের কয়েকটি প্রোবলেম নিয়ে তার সঙ্গে পার্সোনালি দেখা করতে এসেছিল। ওই ভিড়ের মধ্যেই দিশার ভর্তির কাজটি সম্পন্ন করেছিল ব্রজেন। দিশার দিকে তাকাবার অবকাশ পায়নি তখন সে।

দিশা ফকফকা ফরসা নয়। বরং কিছুটা চাপার দিকেই রং তার। অন্য দশজন বাঙালি তরুণীর মতন হাইট তার। ছিপছিপে গড়ন। চোখ দুটো টানাটানা। চোখে ঢলানি নেই। কিন্তু এমন কিছু একটা আছে, যা ব্যাখ্যাতীত। একটা লাজুকতা দিশাকে বৃত্তাকারে ঘিরে রেখেছে বলে মনে হলো ব্রজেন ডায়াসের। দিশাকে দেখে ব্রজেনের মনে হলো, বেশ তেজি আর স্পিরিটেড মেয়ে এই দিশা।

ব্রজেন তৎক্ষণাৎ স্থির করল―স্টুডেন্টদের আজ সে ম্যাথ পড়াবে না। পড়াবে অন্যকিছু। নতুন কিছু বলে ছাত্রছাত্রীদের স্টোনিসড করবার বড় ইচ্ছে জাগল মনে তার।

ব্রজেনের কণ্ঠস্বর এমনিতে আকর্ষণীয়। আজ সেই কণ্ঠস্বরে আরও পরিশীলন যুক্ত করল। বলল, আজ তোমাদের আমি ম্যাথ পড়াব না।

পড়াবেন না! কেন ? তাহলে কী পড়াবেন ? ইত্যাকার নানা জিজ্ঞাসা গুঞ্জরিত হলো ক্লাসজুড়ে।

ব্রজেন আলতো করে ডান হাতটা উঁচুতে তুলল। মৃদু কণ্ঠে বলতে শুরু করল, এতদিন আমি তোমাদের জটিল জটিল অংকগুলো করিয়েছি। যে সংখ্যা নিয়ে গণিত, সেই সংখ্যাগুলো সম্পর্কে কথা বলিনি কখনও। আজ সেই সংখ্যা এবং তাদের নিয়ে যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগের যে আবর্ত, সে সম্পর্কে বলতে চাই। তার আগে তোমরা বল। বলে একটু থামল ব্রজেন। আড়চোখে দিশাকে দেখে নিল। দেখল, বিমুগ্ধ চোখে দিশা তার দিকে তাকিয়ে আছে।

তার আগে তোমরা বল, ভারতবর্ষের সবচাইতে বড় গণিতপণ্ডিত কে ? একটু আগের অসম্পূর্ণ বাক্যের সঙ্গে কথাগুলো যোগ করল ব্রজেন।

ব্রজেনের প্রশ্নের উত্তর কোনও ছাত্রছাত্রী দিতে পারল না। সবাই উসখুস করতে লাগল। দিশার চোখেমুখে কৌতূহল।

ব্রজেন বলল, সেই গণিতজ্ঞ মহাপণ্ডিতের নাম রামানুজন। তার পুরো নাম জান কি ? ও সরি, তাঁর সংক্ষিপ্ত নামই তো জান না তোমরা! পুরানাম জানবে কোত্থেকে ?

শেষ বেঞ্চি থেকে আস্তে করে উঠে দাঁড়াল দিশা। ব্রজেনের চোখে পড়ল তা। সে স্মার্টলি জিজ্ঞেস করল, তুমি কিছু বলতে চাইছ বোধহয় দিশা ?

স্যারের প্রশ্নের উত্তর দিলো না দিশা। শুধু বলল, শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার রামানুজন।

দিশার উত্তরটি ব্রজেন ডায়াসের ইগোতে লাগল। সে ধরে নিয়েছিল, ক্লাসভর্তি ছাত্রছাত্রীদের কেউই রামানুজনের পুরো নামটি জানবে না। কিন্তু ওই মেয়েটি তার জানার অহংকারের দেয়ালে মৃদু ধাক্কা দিলো বলে মনে হলো ব্রজেনের। পুরো নাম বলে মেয়েটি তাকে অবাক করল ঠিক, কিন্তু হতমান কি করল না ? করল তো বটেই! মেয়েটিকে জিততে দেওয়া যাবে না।

দিশাকে লক্ষ্য করে ব্রজেন জিজ্ঞাসা করল, রামানুজনের মা আর বাবার নাম কি ?

দিশা নিশ্চুপ থাকল। রামানুজনের মা-বাবার নাম সে জানে না। মূলত রামানুজনের নামটি ছাড়া তাঁর সম্পর্কে আর কিছুই জানে না দিশা।

ব্রজেনের মনে স্বস্তি ফিরে আসতে লাগল। তৃপ্তির একটা শ্বাস ফেলল সে।

নরম গলায় বলল, তুমি বস দিশা। বলছি, আমি রামানুজনের মা-বাবার নাম বলছি। বলে ছাত্রছাত্রীর ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিল।

একটু ভারী কণ্ঠে ব্রজেন বলল, রামানুজনের মায়ের নাম কমললতাম্মাল আর বাবার নাম শ্রীনিবাস। ব্রাহ্মণ ওঁরা। মাদ্রাজের কুম্বকোণমে জন্ম রামানুজনের। ১৮৮৭ সালের ২২ ডিসেম্বর। সূর্য ডুবোডুবো সময়ে। মা-বাবার ছয় সন্তানের একজন রামানুজন। দরিদ্র খুব। দারিদ্র্যের মধ্যে রামানুজনের লেখাপড়া। অঙ্ক বিষয়ে তাঁর অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে ভড়কে যেতেন শিক্ষকরা। উত্তর দিতে পারতেন না। দুর্গম পথ বেয়ে কলেজে যেতেন। কুম্বকোণমের সরকারি কলেজে। সকাল হলেই কলেজের উদ্দেশে রওনা দিতে হতো। কাবেরি নদীর পাড় দিয়ে কুড়ি মিনিটের হাঁটা পথ। তার পর ফেরি। ফেরির পয়সা পকেটে না থাকলে সাঁতরে নদী পার হতেন। এই-ই রামানুজন, এভাবেই রামানুজন। বলতে বলতে আবেগপ্রবণ হয়ে উঠল ব্রজেন। নিজেকে সামলে নেবার জন্য থামল একটু।

তার পরে ব্রজেন বলল, ভারতের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে এসেছেন আয়েঙ্গার। কলেজ-ফেল এই যুবকটি বেশিদিন বাঁচেননি। মাত্র বত্রিশ বছর। বত্রিশ বছরের জীবনকালে কালাকোলা এই যুবকটি গণিতজগতে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর মেধা ছিল অনন্য, সারল্য ছিল অকৃত্রিম। গণিতই রামানুজনের ঈশ্বর ছিল। তাঁর জীবনে অঙ্ক ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তিনি ছিলেন অঙ্কময়। যাক, তোমরা বড় হলে এই মহাগণিতবিদের কথা আরও বেশি করে জানতে পারবে।

একটু থমকে গিয়ে ব্রজেন বলল, বলতে গেছিলাম অন্যকথা। রামানুজন এসে জায়গা নিয়ে নিলেন।

এই সময় মোজাম্মেল বলল, স্যার, সংখ্যা নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিলেন আপনি।

ঠিক তাই। ঠিকই বলেছ তুমি। রামানুজন এসে গেলেন। তিনি যে গণিতের কত বড় পণ্ডিত, বলে শেষ করা যাবে না। স্টুডেন্টস, তোমরা বিরক্ত হওনি তো আমার কথা শুনে ?

সবাই বলল, না স্যার। রামানুজন সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলাম আমরা। আপনাকে ধন্যবাদ স্যার।

ছাত্রছাত্রীর কথা শুনে চেহারাখানা উদ্ভাসিত হয়ে উঠল ব্রজেনের।

ব্রজেন বলল, সংখ্যা তো নয়টি, জান তোমরা।

এক ছাত্র বলে উঠল, স্যার সংখ্যা নয়টি হতে যাবে কেন ? সংখ্যা তো দশটিই, শূন্যসহ।

ব্রজেন বলল, তুমি ঠিক বলেছ, সংখ্যা দশটিই। তবে এই সেদিন পর্যন্ত সংখ্যা নয়টিই ছিল। শূন্য আবি®কৃত হয়েছে পরে। রোমানদের গণিতের দিকে তাকাও। তাদের গণিতে শূন্য ছিল না। পুরনো দিনের ঘড়ির ডায়াল দেখলে আমার কথার প্রমাণ পাবে। অহংকারের কথা এটা যে ভারতবর্ষের এক পণ্ডিত প্রথম শূন্যের ধারণা দেন। তাঁর নাম আর্যভট্ট। তিনিই শূন্য সংখ্যার জনক।

দিশার পাশে বসা সুজাতা বলল, এই তথ্যের কিছুটা আমাদের মধ্যে অনেকেরই জানা স্যার। তবে সবটা নয়। বিশেষ করে শূন্য বিষয়ক তথ্যটি আমাদের জানা ছিল না।

আরও জানা নেই যা, মানে সংখ্যা নিয়ে ভাবনি যা, তা-ই বলছি। শোন। ব্রজেনের কণ্ঠ একটু কঠিন শোনালো। সে আবার বলতে শুরু করল, সংখ্যারা বড় শান্ত গোবেচারা ধরনের। যেখানে ফেলে রাখবে অসহায় অবস্থায় পড়ে থাকবে। কিন্তু দুটো সংখ্যাকে যখন পাশাপাশি বসাবে, কথা বলে উঠবে। গলায় জোর ঢেলে বলবে, আমি এখন নিরীহ নই। আমার গায়ে-গলায় এখন অনেক শক্তি। এই দেখ, এক আর দুই―আমরা দুজন আলাদা আলাদা ছিলাম যখন, গায়ে শক্তি ছিল না। দুটোকে পাশাপাশি বসালে যখন, আমাদের শক্তি-সামর্থ্য কুড়ি-একুশগুণ বেড়ে গেল। এটা কি অঙ্কের ধুন্ধুমার কাণ্ড নয় ? কী বল তোমরা ?

ব্রজেন স্যারের কথায় ছেলেমেয়েরা বেশ মজা পেল। উৎসুক চোখে স্যারের দিকে তাকিয়ে থাকল অনেকে। কিন্তু অনেকে তাকিয়ে থাকলে তো হবে না! দিশার তাকানোটাই আসল এবং সেই তাকানোতে প্রশংসাটাই কাম্য ব্রজেনের। কৃত্রিম উদাস চোখে দিশার দিকে তাকাল ব্রজেন। দেখল, দিশার দুচোখে কৌতূহল আর মুগ্ধতা।

উৎসাহ বেড়ে গেল ব্রজেনের। বলল, আমি তো এতক্ষণ পাশাপাশি বসার কথা বললাম। এবার যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগের কথা বলি। যোগ যেন কুবেরের ভাণ্ডার। শুধু বাড়তে থাকে। যোগের দরজা দিয়ে শুধু ঢোকা যায়। বেরিয়ে যাওয়ার পথ নেই। গণিতে বেরিয়ে যাওয়ার দরজার নাম বিয়োগ। যত বেরিয়ে যাবে যোগের ভাণ্ড তত খালি হতে থাকবে।

দিশা সুজাতাকে উদ্দেশ করে চাপা গলায় বলল, ভারি ইন্টারেস্টিং তো! গণিতকেও এ রকম গল্পের মতো করে বোঝানো যায়, জানতাম না তো!

সুজাতা বলল, সেজন্যই তো তোকে বলেছিলাম ব্রজেন ডায়াসের তুলনা নেই!

ওদের কথাবার্তা ব্রজেন লক্ষ্য করল। চোখমুখ দেখে বুঝল যে ওরা তার প্রশংসাই করছে।

ব্রজেন বলল, ভাগের অপর নাম হলো দা। দা-এর কাজ কী ? কুচি কুচি করে কাটা। বাবা দা দিয়ে একটা লম্বা বাঁশ টুকরা করা শুরু করল। দা-এর আঘাতে লম্বা জিনিসটা ছোট হয়ে গেল। ঠিক তেমনি ভাগের খপ্পরে পড়ে বড় বড় সংখ্যাগুলো ক্ষুদ্র হতে থাকে।

স্টুডেন্টদের ভাববার সময় দেওয়ার জন্য কয়েক মুহূর্ত থামল ব্রজেন। তারপর বলল, গুণটা ভাগের ঠিক উল্টো। গুণের পাল্লায় পড়লে সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে। যেমন সতেরো দু গুণে চৌত্রিশ, তিন সতেরো একান্ন। মনে রেখ―যোগে সংখ্যা হাসে, বিয়োগে নেতিয়ে পড়ে। ভাগে কাঁদে, গুণে লাফায়।

ভেরি মাচ অ্যামিউজিং। নিজের অজান্তে দিশার মুখ থেকে বাক্যটি বেরিয়ে এল।

ক্লাস এখানেই শেষ। হঠাৎ বলে উঠল ব্রজেন। তার যা লক্ষ্য ছিল আজ, সিদ্ধি হয়ে গেছে।

গট গট করে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল ব্রজেন ডায়াস।

যতই ক্লাসের সংখ্যা গড়ালো, দিশার মুগ্ধতা বাড়ল। আর বাড়ল ব্রজেন ডায়াসের কথার কুহক। অঙ্কের সংখ্যাগুলো তার কথায় যেন ওঠবস করে। এত এত কঠিন ম্যাথের সমাধান হেলায় বের করে ফেলে ব্রজেন। দশমিক,  রুট ওভার, সাইনটিটা, কসটিটার জটিলতা ব্রজেনের হাতে পড়ে জলবৎ হয়ে যায় স্টুডেন্টদের সামনে। এরকম একজন স্যারকে ভালো না বেসে কি পারা যায় ? যায় না তো! দিশা মুহুরিও পারল না। ব্রজেন ডায়াসকে ভালোবেসে ফেলল দিশা মুহুরি। ওদিক থেকেও যে নিবিড় একটা আগ্রহ আছে, সময়ান্তরে বুঝতে পারল দিশা। ব্রজেন ভাবে-ইঙ্গিতে বুঝিয়েও দিতে লাগল। দুজনের ভাববিনিময়টা চলল অত্যন্ত সন্তর্পণে। কেউ জানল না, কেউ বুঝল না। ওরা দুজনেই বুঝল শুধু।

সংগোপনে আর একটা ঘটনা ঘটতে লাগল। যতই দিন গড়াতে লাগল, বাহারের হৃৎকম্প, উৎকণ্ঠা বাড়তে লাগল। বাহার এই টিউটোরিয়াল হোমেরই ছাত্র। দিশাদের ব্যাচেই পড়ে। বসে দিশার বেঞ্চের ঠিক উল্টো দিকের বেঞ্চে। মাথাটা ডান দিকে সামান্য ঘোরালেই দিশার মুখখানা নজরে আসে। প্রথম দিনেই কেন জানি, বাহারের নজরটা দিশার মুখখানিতে আটকে গিয়েছিল। সেদিন যতবার সুযোগ পেয়েছে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দিশাকেই দেখে গেছে বাহার। পরের পরের ক্লাসগুলোতে সকল স্টুডেন্ট যখন নিষ্পলক চোখে ব্রজেন স্যারকে শুনছে, বাহার তখন দিশাকে গিলছে। এই ঘটনাটি সবার অলক্ষ্যে দিনের পর দিন ঘটে যেতে লাগল। একদিন বাহারের হৃদয়াবেগ প্রবল হয়ে উঠল।

সেদিন দিশা ঠিক করেছে, হেঁটে বাড়ি ফিরবে। বাড়িটা হোম থেকে বেশি দূরে নয়। এক মাইলের মধ্যে। এমনিতে রিকশায় যাতায়াত করে দিশা। সেদিন সুজাতাকে বলল, আজ হেঁটেই বাড়ি যাব আমি।

সুজাতা বলল, হেঁটে বাড়ি যাবি ?

শুধু আমি নই, তুইও আমার সঙ্গে যাবি।

আমি তোর সঙ্গে যাব! কোথায়! আমার বাড়ি তো তোর বাড়ির উল্টো দিকে! তোর লাভ লেনে, আমার চন্দনপুরায়।

আজ তুই আমার বাড়িতে যাবি। আমার সঙ্গে খাবি। সমস্ত দুপুর দুজনে গল্প করে কাটাব।

না রে দিশা। ঠিকসময়ে না ফিরলে মা খুব চিন্তা করবে।

তুই চিন্তা করিস না সুজাতা। আমাদের বাড়ি থেকে তোর মাকে ফোন করে জানিয়ে দিবি, তুই আমাদের বাড়িতে এসেছিস।

সুজাতা বলল, আচ্ছা, সে না হয় হলো! কিন্তু হেঁটে যাবি কেন ? তুই তো কখনও হেঁটে বাড়ি ফিরিস না!

দিশা বলল, আমরা লাভ লেনের বাড়িতে এসেছি অনেক দিন হয়ে গেল। আশপাশের কিছুই চিনি না। রিকশা থেকে কতটুকুই-বা চেনা যায়। আজ ঠিক করেছি, দুপাশটা দেখতে দেখতে যাব। কোন দোকান থেকে আমাদের চাল-ডাল-নুন-তেল যায়, কোন জায়গাটায় ওষুধের দোকান, কোথায় লন্ড্রি, তা দেখার ইচ্ছা তো আমার জাগতে পারে, কী বলিস ?

তা-তো জাগতেই পারে! সুজাতা বলল।

দিশা বলল, আজ সেই ইচ্ছা পূরণ করব।

সাত

বাহার যে এবারই প্রথম দিশার প্রেমে পড়েছে, তা নয়। এর আগে বহুবার অনেকের প্রেমে পড়েছে বাহার। সেই কিশোর বয়স থেকে। খালাতো বোন রেহানা, স্কুল সহপাঠী নাসরিন, বুয়ার মেয়ে মাসুদা, পাশের বাড়ির আব্দুল চাচার ছোট মেয়ে ঝর্না―কার না প্রেমে পড়েছে বাহার! সব প্রেম একতরফা। বরাবর একা একাই প্রেমে পড়েছে সে। যাদের প্রেমে পড়েছে, তাদের কেউই বাহারের প্রেমের কথা জানতে পারেনি। তবে এই কথাটি পুরোপুরি ঠিক নয়। আব্দুল চাচার মেয়ে ঝর্না জানতে পেরেছিল। একদিন ঝর্নাকে বাহার চিঠি লিখে ফেলেছিল একটা। সেটাই তার প্রথম প্রেমপত্র। প্রেমপত্র কীভাবে লিখতে হয়, কী বলে সম্বোধন করতে হয়, চিঠির শেষেই-বা কী লিখলে প্রেমিকা খুশি হবে, কিছুই জানা ছিল না বাহারের। শুধু ক্লাসের ইচড়েপাকা অবিনাশের কাছে শুনেছিল, প্রেমিকাকে চিঠি লিখতে হয় নীল খামে। খামের ভেতর চিঠি জড়িয়ে দু-চারটা গোলাপের পাপড়ি দিলে প্রেমিকার আনন্দের সীমা থাকে না। এ অবিনাশের জীবনাভিজ্ঞতা। এভাবেই সে মহিম দাশ রোডের সমীরণবাবুর মেয়েকে পটিয়েছে।

বাহার জিজ্ঞেস করেছিল, কী বলে চিঠি শুরু করেছিলি তুই ?

অবিনাশ বলেছিল, সে তোর যা মন চায়। প্রিয়তমা, জান, ওগো, প্রাণেশ্বরী―এসবের যেকোনো একটা দিয়ে শুরু করতে পারিস তুই।

অবিনাশের কথামতো রিয়াজউদ্দিন বাজারের বই-খাতার দোকান থেকে নীল প্যাড আর নীল খাম কিনে এনেছিল বাহার। কিনবার সময় একটু শরম আর ভয় যে লাগেনি বাহারের, হলফ করে বলা যাবে না। ধুম করে দোকানির কাছ থেকে এই দুটো জিনিস চেয়ে বসেছিল। তারপর শুরু হয়েছিল বুকের কাঁপুনি। দোকানি যদি জিজ্ঞেস করে বসে খোকা এই বয়সে নীল খাম আর নীল প্যাড দিয়ে কী করবে ? কী বলবে সে তখন! ভয়ে কুঁকড়াতে শুরু করেছিল বাহার তখন। হঠাৎ ভেতরটা শক্ত করে ফেলল সে। মনে মনে উত্তরটা ঠিক করে নিল―সে আপনার দরকার কী ? বেচবেন কি না দেখেন। বেচলে দেন। না বেচলে অন্য দোকানে যাই। দোকানের কি অভাব আছে নাকি ? মনে মনে কথাগুলো দু’একবার আওড়েও ফেলল বাহার।

দোকানি কিন্তু সেদিকে গেল না। শুধু জিজ্ঞেস করল, খাম কয়টা।

বাহারের মাথায় চট করে একটা বুদ্ধি খেলে গেল। প্রেমপত্রটি যদি লেগে যায়, তাহলে তো ঝর্নাকে আরও আরও আরও চিঠি লিখতে হবে। বার বার আসার চেয়ে কয়েকটা একসঙ্গে কিনে নিয়ে গেলে ভালো হবে।

দোকানদারকে উদ্দেশ করে ডানে বাঁয়ে তাকিয়ে বাহার বলল, ছয়টা। খাম আর প্যাড একটা কাগজে মুড়িয়ে দিয়েছিল দোকানি।

বাহারদের আর আব্দুল চাচার বাড়ি পাশাপাশি। সীমানা দেয়াল একটা আছে বটে, তবে তা মাথাতোলা নয়, বুক সমান। এবাড়ির ওবাড়ির মানুষদের অবাধে দেখাশোনা হয়।

রাত জেগে বেশ কয়েকবার কাটাকুটির পর চিঠি একটা দাঁড় করিয়েছিল বাহার। ভয়ে চিঠির শেষে নিজের নামটা দেয়নি।

সেদিন রবিবার বন্ধের দিন। আব্দুল চাচা বক্সিরহাট চলে গেছে সকাল সকাল। আজকে কাস্টমারের চাপ বেশি। আয়শা চাচি ঘরকন্না নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু যাকে চিঠি দেওয়ার, সেই ঝর্না একবারের জন্যও উঠানের দিকে আসছে না। ঘরের ভিতর কী করছে কে জানে! অস্থিরভাবে দেয়ালের পাশ ঘেঁষে বেশ কবার হাঁটাহুঁটি করল বাহার। নিজের বাড়ির দিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হচ্ছে বাহারকে। কখন কে আবার দেখে ফেলে!

এই সময় হুট করে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল ঝর্না। হাতে ধোয়া কাপড়ের বালতি। উঠানের তারে মেলে দেবে। তারে কাপড় মেলে দিতে দিতে দেয়ালের ওপাশে উৎসুক নয়নের বাহারকে দেখতে পেয়েছিল ঝর্না। চোখাচোখি হতেই হাত-ইশারা করেছিল বাহার। ঝর্না কাছে এলে খামটি হাতে ধরিয়ে দিয়ে দ্রুত সরে পড়েছিল।

পরদিন সকালে বাহারদের উঠানে আব্দুল চাচার হাঁক, খান সাহাব বাড়িত আছেননি ?

খানসাহাব সকালের নাস্তাশেষে সবে পানটি মুখে পুরেছেন। আব্দুলের ডাক শুনে খানসাহাব বিরক্ত মুখে বউকে বললেন, কসাইটা এই সকালে আমার এখানে কী চায়!

বউ ঠোঁট উল্টে বলে, আঁই কী জানি! হে কীয়ল্লাই আইছে! বহু বছর খান সাহাবের সঙ্গে ঘর করলেও বাহারের মা নিজ অঞ্চলের ভাষা ছাড়তে পারেনি।

বউয়ের ঝাঁঝানিতে মেজাজটা বিগড়ে গেল খান সাহাবের। সীমানা নিয়ে আগে থেকেই আব্দুলের ওপর রুষ্ট সে। ওই মেজাজ নিয়েই দরজায় এসে দাঁড়াল খানসাহাব। চোখেমুখে বিরক্তি আর প্রশ্ন।

আপনার লগে একখান দরকারি কথা কইতে আইছি খানসাহাব। কথাখান একান্তে কওন লাগব।

কিছু না বলে খানসাহাব দরজা ছেড়ে দাঁড়াল। নোংরা চটিসহ ঘরে ঢুকে পড়ল আব্দুল কসাই। সোফায় বসতে বসতে বলল, আপনার পোলা কই ? বাহার ?

দাঁড়ানো অবস্থাতেই একটু রুক্ষ কণ্ঠে খানসাহাব বলল, ও তো ইস্কুলে গেছে। তা বাহারকে কেন দরকার আপনার ?

খানসাহাবের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ডান হাতের তর্জনীটা মুখের মধ্যে পুরে চিবানো পানের চূর্ণ দাঁতের ফাঁক থেকে বের করতে করতে অস্পষ্ট কণ্ঠে আব্দুল বলল, ভালা ভালা। লেখাপড়া করা বহুত ভালা কাম খানসাহাব। আরে বসেন না! দাঁড়াইয়া আছেন কেলা ?

অগত্যা খানসাহাব সামনের চেয়ারে বসে পড়ল। সে ভেবে কূল পাচ্ছে না, এই কসাইটার উদ্দেশ্য কী ? কোনও একটা মতলবে যে এসেছে, সেটা আন্দাজ করতে পারছে। কিন্তু মতলবটা কী, ধরতে পারছে না।

এই আব্দুলটা সহজ মানুষ নয়। মাইগ্রেটেড বিহারি সে। সাতচল্লিশের দেশভাগের পরপরই আব্দুলের আব্বা পূর্ব পাকিস্তানে চলে এসেছিল। সৈয়দপুরে অন্য অনেক বিহারির সঙ্গে ঘাঁটি গেঁড়েছিল সপরিবারে। শুধু ঘাঁটি গাঁড়লে তো চলবে না! বেঁচে থাকার জন্য কিছু একটা তো করতে হবে! কসাইগিরি শুরু করেছিল আব্দুলের বাপ। ওপারে যে সে কসাইগিরি করত, তা নয়। কয়েকদিন ভাবার পর বুঝে গিয়েছিল, এই ব্যবসাটা পূর্ব পাকিস্তানে চলবে ভালো।

বাপের কাছে তালিম নিয়েছিল আব্দুল। বাপের মৃত্যুর পর সৈয়দপুর ছেড়ে মা-বউকে নিয়ে অধিক সুখের আশায় ঢাকা চলে এসেছিল আব্দুল। পুরনো ঢাকায় ঠাঁই নিয়ে দেখল, তার মতো বহু বিহারি সেখানে গিজ গিজ করছে। আর যাই চলুক, এতজনের ভিড়ে কসাইয়ের ব্যবসা চলবে না এখানে। বয়স্ক এক বিহারির পরামর্শে একদিন সে চট্টগ্রামে পাড়ি দিয়েছিল। তাও বহু বছর আগের কথা। প্রথমে সস্তামতন একটা ঘর ভাড়া নেওয়া। তারপর বক্সিরহাটে কসাইগিরি শুরু করা। টাকা জমলে খানসাহাবের পাশের জলো জায়গাটা কিনেছিল আব্দুল। তারপর এই ঘরদোর। সীমানা নির্ধারণের সময় খানসাহাবের সঙ্গে ঝটিঘটি লেগে গিয়েছিল।

পাকিস্তানি মেজাজে আব্দুল খানসাহাবকে বলেছিল, বেশি ঝুটঝামেলা কইরেন না খানসাহাব। আখেরে আপনারই ক্ষতি হবে।

আমার ক্ষতি হবে! কী ক্ষতি করবেন আপনি ? কী ক্ষতি করবেন ? তেড়ে-গলায় বলেছিল সেলিম খান।

শুনেন খানসাহাব, আপনি যতই নামের শেষে খান ফান লেখেন না ক্যান, আপনি ত একজন বাঙালি। সেলিম খান আপনার নাম। আমরা হইলাম এই পাকভূমির আসল বাসিন্দা। মেদামারা বাংলাতে কথা কই না আমরা। উর্দুই আমাদের ভাষা। এই দেশের প্রকৃত মালিক উর্দুভাষীরা। চোখ গরম করে বলেছিল আব্দুল।

পাড়াপড়শির মধ্যস্থতায় সেদিন রফা হলেও ক্রোধটা রয়ে গিয়েছিল উভয়ের মনে। পরে পরে দেখাসাক্ষাতে সালাম বিনিময় হলেও কেউ কাউকে আপন করে নিতে পারেনি।

আজ বাহারের চিঠি সেই সুপ্ত ক্রোধে ঘি ঢালল। কিন্তু আব্দুল চতুর মানুষ। ঘটনাটা চার কান করলে তারই ক্ষতি হবে বেশি। মেয়ে বলে কথা। শহরে ঝর্নার বদনাম রটে যাবে। শাদি দেওয়া কঠিন হয়ে যাবে তখন।

দোহারা গড়ন আব্দুলের। দেখার মতো ভুঁড়ি। গায়ের টাইট গেঞ্জিটা সেই ভুঁড়িকে কামড়ে আছে। আব্দুল সেই কামড়ে থাকা গেঞ্জিটা উপর দিকে তুলে লুঙ্গির কোঁচড় থেকে নীল খামটা বের করল।

নির্লিপ্ত গলায় বলল, ধরেন। আপনার পোলার প্রেমপত্র। আমার মাইয়ারে দিছে। আপনার পোলা তাবাল হইয়া উঠছে খানসাহাব। ভালা একখান মাইয়া দেইখা শাদি করাইয়া দেন। ওঁয়া ওঁয়া নাতি-নাইত্যান কোলে লইয়া উডানে ঘুইরা বেড়াইতে পারবেন। বলে ঝট করে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল আব্দুল। দরজার দিকে পা বাড়ানোর আগে ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল, পোলারে কইবেন, আমার মাইয়ার দিকে তাকাইলে চোখের পোতলা দুইটা গাইল্যা দিমু। আব্দুল কসাই আমার নাম। থপথপে পায়ে বেরিয়ে গিয়েছিল আব্দুল।

এর পাঁচদিনের মাথায় সীমানাপ্রাচীর মাথা ছাড়িয়ে উঁচু হয়ে গিয়েছিল। বাহারের শাস্তির বর্ণনা এখানে না দেওয়াই ভালো। তবে এটা বলা যায় যে ওই ঘটনার পর থেকে বাহার দাঁড়ির মতো সোজা হয়ে গিয়েছিল।

অনেক বছর পর বাহারের মনে আবার প্রেম জেগেছে। দিশাকে ঘিরে। চিঠিটিঠির ধার ধারল না এবার বাহার। সরাসরিই কথা বলতে চাইল দিশার সঙ্গে। মওকাও জুটে গেল সেদিন।

তোমার সঙ্গে আমার একটু কথা ছিল দিশা। পেছন থেকে বলল বাহার। ডিসি হিল রোডের প্রশস্ত ফুটপাত ধরে এগোচ্ছিল দিশা আর সুজাতা। পাশাপাশি। প্রথমে বাহারের কথা খেয়াল করেনি কেউ। দুজনে গল্পে মশগুল।

দিশা, তোমাকে বলছি। এবার গলা বেশ উঁচুতে তুলে বলে উঠেছিল বাহার।

থমকে গিয়েছিল দুজনেই। ঘাবড়েও গিয়েছিল। রাস্তার পাশে ফুটপাতে তার নাম ধরে ডাকবে কেউ, ভাবেনি দিশা। তাই তার দিশেহারা ভাব। দিশা ঘাড় ফেরানোর আগেই সুজাতা পেছন ফিরেছিল। দেখেই চিনেছিল বাহারকে। বলেছিল, তুমি বাহার না ? বাহার তো!

কাঁচুমাচু হয়ে বাহার বলেছিল, হ্যাঁ, বাহার। তোমাদের ব্যাচে পড়ি।

তা তো জানি বাছা! হঠাৎ পেছন থেকে ডাকলে যে ?

তোমাকে না। দিশাকে। আগের ভাবটা বাহারের চোখমুখ থেকে উবে যায়নি তখনও।

তাও তো শুনেছি! কিন্তু দিশাকে কেন ? আমাকে নয় কেন ? চোখে ঝিলিক তুলে বলেছিল সুজাতা। তার কণ্ঠে যে উপহাস আছে, বুঝতে পারার ক্ষমতা নেই বাহারের।

বলে হাঁটতে শুরু করেছিল সুজাতা। সঙ্গে দিশা। দিশা নিশ্চুপ। দুজনের পাশে পাশে বাহারও হাঁটতে লাগল।

হাঁটতে হাঁটতে বলল, আমার বাড়িও লাভ লেনে। আমিও ওদিকে যাব।

তা যান না। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে কেন ? বলল সুজাতা।

ভিরমি খেল বাহার। এলেবেলে কণ্ঠে বলল, তোমরাও তো ওদিকে যাচ্ছ! তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে না হয় একটু হাঁটলাম!

সুজাতা বলল, ফুটপাত সরকারের। এখানে হাঁটার অধিকার সবার আছে।

বাহার বলল, ওই যে দোকানটা দেখছ, পানের, ওটা আমাদের।

তাই নাকি! ওখানে লেখা আছে―খানের পানদোকান। তা তোমরা খান নাকি ? বলল সুজাতা।

বাহার গর্বিত ভঙ্গিতে বলল, হ্যাঁ, আমরা খান। আমার বাবার নাম সেলিম খান।

ও! তোমরা বাঙালি খান! পাকিস্তানি খানের পা-চাটা কুকুর তোমরা! শেষের কথাটি স্বগত বলল সুজাতা। শেষে বলল, বেশ মজার ব্যাপার তো! খানের পান। খান পান, পান খান। বেশ ছন্দ ছন্দ! বলে চট করে দাঁড়িয়ে পড়ল সুজাতা। বাহারের চোখে চোখ রেখে বলল, দেখ বাহার, আজ আমরা রাস্তার দুপাশটা দেখে দেখে যাব বলে হাঁটা শুরু করেছিলাম। তুমি সেখানে ভিলেন হয়ে উপস্থিত হলে। আমাদের দেখায় এবং হাঁটায় ব্যাঘাত হচ্ছে। আমাদের ছেড়ে তুমি এগিয়ে গেলে ভালো হয়।

সুজাতার চোখা চোখা কথা শুনে বেশ মর্মাহত হলো বাহার। অসহায় চোখে একবার দিশার দিকে তাকাল। দেখল, দিশার চোখমুখ নির্লিপ্ত।

মাথা নিচু করে দু’কদম এগিয়ে গেল বাহার।

পেছন থেকে সুজাতা ডাকল, বাহার, শুনে যাও। তুমি যে কথাটা দিশাকে বলবে বলে ঠিক করে এত দূর পেছন পেছন এসেছ, তা না বলাই ভালো। দিশা বড়দের জন্য, তোমার মতো পুঁচকেদের জন্য নয়। বলে দিশার হাত ধরে হনহনে পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল।

ভেবাচেকা মুখ নিয়ে ফুটপাতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকল বাহার।

দূর থেকে সুজাতা-দিশার খিলখিলে হাসির ঢেউ এসে দিশেহারা বাহারের কানে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

প্রেমের উত্তেজনা ধীরে ধীরে নেতিয়ে পড়ল বাহারের।

আট

তিশা।

মুকুন্দ মুহুরির এই মেয়েটি বড্ড চঞ্চল। যেন ঘাসফড়িং, যেন প্রজাপতি! কেবল লাফালাফি, কেবল ওড়াউড়ি। বিশাল এক চঞ্চলতা তাকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে তো হচ্ছেই! তার বুকভরা উথালপাথাল বাতাস। এখন-তখন সেই বাতাসে ঘূর্ণি ওঠে। ওই ঘূর্ণির তোড়ে মুহুরিবাড়ির সবকিছু এলমেলো হয়ে যায়। ছোটবেলা থেকেই এই অভ্যেস তিশার। তার পায়ের তলায় যেন সর্ষে। লাটিমের মতো বাড়িময় ঘুরতে থাকে সে। দোতলা থেকে একতলা। একতলা থেকে এক দৌড়ে ছাদ। ছাদে গিয়ে অবিরত হারাধনের পেছন পেছন ঘোরা। আর অবিরাম জিজ্ঞেস করে যাওয়া―এটা কী ফুল ? ওটা কী গাছ ? এটার নাম আতা গাছ বলছ ? তাহলে তোতা পাখি কোথায় ? কবি যে লিখেছেন―আতা গাছে তোতা পাখি, ডালিম গাছে মৌ! আচ্ছা হারাধন কাকা, মৌ মানে কী ? হারাধন আমতা আমতা করে উত্তর দিতে প্রস্তুত হয়। কিন্তু সেই উত্তর শোনার সময় কোথায় তিশার হাতে! এক দৌড় সিঁড়িঘরের দিকে। তারপর ধুপধাপ ধুপধাপ সিঁড়ি ভাঙা। মাথার দুপাশে বেণি দুটো তখন পাখির পাখার মতো বাতাসে উঠছে আর নামছে। অল্পক্ষণের মধ্যে রান্নাঘরে উদয় হয় তিশা। রান্নাঘরের চুলায় মীরা দিদিমা তখন লুচি ভাজছেন। শীতকাল বলে একটা চাদর জড়িয়েছেন দিদিমা গায়ে। বিড়াল-পায়ে দিদামার নিকটে এগিয়ে যায় তিশা। ডান হাতের খোলে ঠাণ্ডা জল। বুড়ো আঙুলের ওপর দাঁড়িয়ে সেই জল ঝুপ করে দিদিমার ঘাড়ে ঢেলে দিল তো দিলই। অমনি দিদিমার ঊর্ধ্বলম্ফ। মুখে―ও মারে! খিল খিল হাসিতে গড়িয়ে পড়ছে তখন তিশা। একদিন দেখা গেল মায়ের ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে সাজুগুজুতে ভীষণ ব্যস্ত তিশা। মুখে পাউডারের গভীর আস্তর, ভ্রুতে টেরাবেঁকা কাজলের টান। দুই ঠোঁটে লিপস্টিকের গাঢ় প্রলেপ। সেই প্রলেপ চিকন দুটো ঠোঁট ছাড়িয়ে চিবুক পর্যন্ত ছড়ানো। হরিপদ বাজারে যাচ্ছে দেখলে অমনি বাজারে যেতে বায়না ধরা। হরিপদ যতই না না করে, তিশার জেদ ততই বাড়তে থাকে। মা, দিদিমা এত করে বোঝান, ছোটদের বাজারে যাওয়া ঠিক নয়, তখন হাজারো প্রশ্ন―কেন ছোটদের বাজারে যাওয়া ঠিক নয় ? ছোটরা বাজারে গেলে কী হয় ? আচ্ছা, বাজারে কী কী পাওয়া যায় ? তার আগে বল, বাজার মানে কী ? এসব প্রশ্নে বাধাদানকারীদের মাথা আউলাঝাউলা করে ছাড়ে তিশা।

ছোটবেলা থেকেই নাচের প্রতি ভীষণ ঝোঁক তিশার। সুদীপা সেন নাচের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন তিশাকে। নবনীতা ব্যানার্জি নৃত্যাঙ্গন নামে নাচের একটি স্কুল চালান। জুবিলি রোডের নিজ বাড়িতেই স্কুলটি। নবনীতাদি শান্তিনিকেতন পাস। বিয়ে করেননি। স্কুলটিই তাঁর সংসার।

দিনসাতেক বাদে নবনীতাদি বললেন, আপনার মেয়ের হবে।

সুদীপা বলেন, চঞ্চলতা বেশি।

ওই চঞ্চলতাই তিশার মূলধন। চঞ্চলতাই নৃত্যকে পূর্ণতা দেয়। বললেন নবনীতাদি।

সুদীপা আর কী বলবেন! চুপ করে থাকেন।

নবনীতাদি অনেকটা আপনমনে বললেন, বহুদিন পর একজন উত্তম ছাত্রী পেয়েছি বলে মনে হচ্ছে।

কথাটা শুনলেন সুদীপা। এই মেয়েটির ওপর তাঁর ভরসা কম। বড় মেয়ে দিশা যেরকম ধীর-স্থির, মেধাবান, তিশা সেরকম নয়। তার মধ্যে স্থিরতা নেই, গাম্ভীর্য নেই। শুধুই হইহই, শুধুই হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো। না জানি মেয়েটি লেখাপড়ায় কতটুকু এগোবে!

নবনীতাদি যেন সুদীপা সেনের মনের কথাগুলো পড়তে পারলেন। সারা মুখে প্রশান্ত হাসি ছড়িয়ে বললেন, অত ভাবছেন কেন তিশাকে নিয়ে ? হয়তো আপনি এই মুহূর্তে আরেকজনের সঙ্গে তুলনা করে হতাশ হচ্ছেন। কিন্তু হতাশ হওয়ার তো কিছু নেই ভাই! শিক্ষিত পরিবার। এই পরিবারের মেয়ে তো বিএ এমএ পাস করবেই। সব শিক্ষিত বাড়ির মেয়েরা কিছু না কিছু লেখাপড়া তো করেই! কিন্তু মনে রাখবেন সব বাড়ির মেয়েরা নাচতে জানে না, গাইতে জানে না। আজ আপনি তিশাকে যার সঙ্গে তুলনা করে আফসোস করছেন, বলেন তো সেই মেয়েটি নাচতে জানে কি না ? বলে একদৃষ্টিতে সুদীপার দিকে তাকিয়ে থাকলেন নবনীতাদি।

সুদীপা সেন ডানে বামে মাথা নাড়লেন। বললেন, আপনি অন্তর্যামী কিনা জানি না। তবে আপনি ঠিকই ধরেছেন, আমি আমার বড় মেয়ে দিশার সঙ্গে তিশার তুলনা করছিলাম মনে মনে। দিশা নাচতে জানে না।

আরে না না! আমি অন্তর্যামী হতে যাব কেন! আমি তো আপনারই মতো একজন নারী। আপনার চোখমুখ দেখে একটু অনুমান করেছি এই যা। হাসতে হাসতে বললেন নবনীতা ব্যানার্জি।

বড় একটা তৃপ্তি নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন সুদীপা, সেদিন।

রাতের খাবারটেবিলে স্বামীকে সব কথা খুলে বলেছিলেন সুদীপা। সব শুনে খুশি খুশি মুখ করে স্ত্রীর দিকে তাকিয়েছিলেন মুকুন্দ মুহুরি।

বলেছিলেন, আমি তোমাকে বলেছিলাম না, আমার এই মেয়েটিকে নিয়ে মোটেই চিন্তা কোরো না তুমি। বলেছিলাম না, সে কিছু একটা হয়ে দেখাবে! আজ নবনীতাদির কথা শুনে বুঝলে তো তিশা আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবে।

সুদীপা চট করে দিশার দিকে তাকালেন। দিশা তখন আপনমনে খেয়ে যাচ্ছে। মনোযোগ দিয়ে মা-বাবার কথা শুনছে বলে মনে হলো না।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সুদীপা বললেন, শুধু নেচে নাম কুড়ালে তো হবে না, লেখাপড়াও তো করতে হবে! দিশার মতো পড়াশোনায় তেমন ঝোঁক নেই তিশার।

আরে হবে হবে! ঝোঁক হবে! কোন উঁচু ক্লাসেই-বা পড়ছে যে তিশা, তাকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলে! তার চেয়ে তুমি এক কাজ কর। তিশাকে আর্যসঙ্গীতে ভর্তি করিয়ে দাও। আমাদের পরিবারে কোনও গায়ক-গায়িকা নেই। দেখ, তিশা আমাদের পরিবারের সেই খামতিটা মিটিয়ে দিতে পারে কিনা!

শেষ পর্যন্ত তিশাকে আর্যসঙ্গীতে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

নাচের মতো গানে তেমন ভালো করতে পারেনি তিশা। পাঁচ মাস পার হয়ে যাবার পর  বিদ্যাবিনোদ আচার্যের সঙ্গে দেখা করেছিলেন সুদীপা। বিদ্যাবিনোদ আর্যসঙ্গীতের কর্ণধার। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে খ্যাতিমান। একসময় দেবী সরস্বতী তাঁর কণ্ঠে  আসন গ্রহণ করে থাকতেন। এখন বয়স হয়েছে তাঁর। বিশেষ বিশেষ কয়েকটি ক্লাস এটেন্ড করেন শুধু। অন্যগুলো পুত্র আর পুত্রবধূ সামলায়। কষ্ট হলেও সদ্য ভর্তি শিক্ষার্থীদের তিনি নিজে তালিম দেন। ওই সময়টুকুতে বুঝে নেন কার হবে আর কার হবে না।

একটি উঁচুমতন আসনে বসেছেন বিদ্যাবিনোদ আচার্য। যোগাসনে। সামনের একটা আসনে সুদীপা সেন।

বিদ্যাবিনোদবাবুর বয়স তিরাশি। এখনও বেশ শক্তপোক্ত। মাঝারি মেদহীন কেঠো চেহারা।

সর্দি লেগেছে বোধহয়। কথার মাঝখানে মাঝখানে বার বার নাক টানছেন। ওই অবস্থাতেই বললেন, বলেন কী জানতে চাইছেন ?

আমি…। সুদীপা তাঁর পরিচয় বলতে চাইলেন।

আপনার পরিচয় দিতে হবে না আমাকে। আমি আপনাকে বিলক্ষণ চিনি। মুকুন্দবাবুকে এই শহরে না-চেনেই-বা কে ? বলতে বলতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন বিদ্যাবিনোদবাবু।

কিছুক্ষণ পর খাঁকারি দিয়ে গলাটা পরিষ্কার করলেন। বললেন, মুকুন্দ মুহুরি না হলে আজ আমি কোথায় ভেসে যেতাম! কোথায় যেত আর্যসঙ্গীত ভবন, কী হতো আমার পরিবারের!

ঘটনা কী সুদীপা কিছুই জানেন না। দিশার বাবার কত মামলা-মোকদ্দমা! কোনওটাতে হারেন, কোনওটাতে জেতেন। এসবের তো কিছুই জানা নেই সুদীপার। কোর্টকাছারির ব্যাপার বাড়ি পর্যন্ত টেনে আনার লোক নন দিশার বাবা। হয়তো কোনও একসময় বিদ্যাবিনোদবাবুর কোনও উপকারে লেগেছেন তাঁর স্বামী মুকুন্দ মুহুরি। সেই উপকারের কথা বলতে গিয়ে বিদ্যাবিনোদবাবু ওই কথাগুলো বলেছেন।

আর্যসঙ্গীত ভবনটি একটা টিলামতন জায়গায়। একসময় গাছগাছড়াও ছিল চারপাশে। ধীরে ধীরে জায়গাগুলো বেচাকেনা হতে শুরু হলো। কে সি দে রোডের ধারের হাজারি গলির সোনার ব্যবসাটা রমরমিয়ে উঠার পর থেকে আশপাশের জায়গার দাম হু হু করে বেড়ে গেল। সিনেমা প্যালেসের ম্যানেজার ইব্রাহিম সাহেব আর্যসঙ্গীত ভবনের গা-ঘেঁষা জায়গাটা কিনে ফেললেন। বিল্ডিং করতে গিয়ে বিদ্যাবিনোদবাবুর সঙ্গে ঝটাঝটিটা লাগল। ফটকের বেশ কিছু জায়গাসহ দেয়ালের ভেতরের অনেকটা অংশ দাবি করে বসল ইব্রাহিম। ইব্রাহিমের হাতে অনেক গুণ্ডাপাণ্ডা। কেউ টিকিট ব্লেকার, কেউ পথোমাস্তান।

বাধা দিলে চোখ গরম করে বিদ্যাবিনোদ বাবুর সামনে দলিল আর সিট বিছিয়ে ইব্রাহিম বলল, এই দেখেন, আরে ওদিকে কী, এই দিকে, এইখানে দেখেন। এই যে পেন্সিলের টানটা দেখছেন, অম্বিকা জমিদারের নাতির নাতি বলেছে, ওই পর্যন্ত আমার জায়গা। আর আমিন তো আপনার সামনেই মাপজোখ করল। নিজের চোখে তো দেখলেন! তা বিনোদবাবু, যত শিগগির সম্ভব দেয়াল ভেঙ্গে ভেতরের জায়গাটা আমাকে বুঝিয়ে দেন।

সেদিন আর কথা বাড়াননি বিদ্যাবিনোদ বাবু। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন।

পট করে ইব্রাহিম বলে উঠেছিল, আচমকা উঠে পড়লেন যে! কখন ছাড়ছেন আমার জায়গা বলে যান।

বিদ্যাবিনোদবাবু এবার ভেতরটা শক্ত করলেন। বললেন, আগে ওটা আপনার জায়গা কিনা দেখি। আপনি যে দলিলটা দেখালেন, তা জাল না আসল, তাও ভাবব আমি।

ছেলে পেছন থেকে বলে উঠল, থাক বাবা, থাক। তুমি মাথা গরম কর না। ঝুট ঝামেলায় জড়িয়ো না।

ছেলের কথায় কান দিলেন না বিদ্যাবিনোদ আচার্য। দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, শোনেন ইব্রাহিম সাহেব, বংশপরম্পরায় আমরা এই জায়গায় বসবাস করে আসছি। যে অম্বিকাবাবুর কথা বললেন আপনি, সেই জমিদারের খাজাঞ্চি ছিলেন আমার জ্যেষ্ঠ প্রপিতামহ। ওই সময় থেকে আমার পিতৃপুরুষরা এখানে বাস করে আসছেন। আর হ্যাঁ, দলিল শুধু আপনার আছে এটা তো নয়! দলিল আমারও আছে। পাক্কা দলিল। বছর বছর খাজনা দেওয়া দলিল।

ইব্রাহিম ভাবেনি, এরকম প্রতিরোধের মুখোমুখি হবে। একটু ভড়কে  গেল সে।

ওই সময় বিদ্যাবিনোদবাবু শক্ত গলায় আবার বলে উঠেছিলেন, কোর্টে দেখা হবে।

ইব্রাহিমের সঙ্গে যতই আকাঁপা কণ্ঠে কথা বলেন না কেন, ভেতরে ভেতরে যে বিদ্যাবিনোদ বাবু ভয় পাননি, তেমন নয়। মুকুন্দ মুহুরির কাছে ছুটে গিয়েছিলেন।

দুই মিছিলেই মুকুন্দ বাবু প্রমাণ করে দিয়েছিলেন ইব্রাহিমের দলিলটি জাল।

সেই থেকে পাকাপোক্তভাবে আর্যসঙ্গীত ভবনটি কাটাপাহাড় রোডের পূর্বপাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

সেই কথা মনে রেখেছেন বিদ্যাবিনোদ আচার্য। আজ মুহুরিবাবুর স্ত্রীকে সামনে পেয়ে সেদিনের কথা স্মরণে এল তাঁর। সেই উপকারের কথাটি উদাত্ত কণ্ঠে বলতে চাইলেন তিনি।

সুদীপা বিনীতভাবে বললেন, আমি আমার মেয়ে তিশা সম্পর্কে জানতে এলাম আপনার কাছে। ওর হবে তো ?

স্থির চোখে সুদীপার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন বিদ্যাবিনোদবাবু। তারপর মৃদু কণ্ঠে বললেন, দেখুন, আপনাকে ব্যথা দিতে চাই না আমি। তারপরও কথাটা না বললে হবে না।

কী, কী না বললে হবে না আচার্যমশাই ? জানতে চাইলেন সুদীপা।

আপনার মেয়ের কণ্ঠস্বরটা গানের নয়।

গানের নয়!

না। গত পাঁচ মাস আমি নিজে তাকে তালিম দিয়েছি। অবশ্য নবাগতদের আমি তা-ই করি। নবাগতদের মধ্য থেকেই তো রত্ন পেয়ে যাই!

তার পর ? মরা গলায় বললেন সুদীপা।

আপনার মেয়ের কণ্ঠে সুরটা আসে না। বার বার কেটে যায়। আপনি খেয়াল করেছেন কিনা জানি না, তিশার গলাটা ভাঙা ভাঙা। একটু উঁচুতে উঠলে স্বরটা ফেটে যায়।

তাহলে!

দুঃখিত আমি। আপনার মেয়েকে  দিয়ে গান শেখা হবে না। জোর করে শিখলেও খুব বেশিদূর এগোতে পারবে না সে। থেমে থেমে কথাগুলো বলে গেলেন বিদ্যাবিনোদ আচার্য।

আপনি এককাজ করুন। আবার বললেন বিদ্যাবিনোদবাবু। নাচটাতে জোর দিন। তিশার সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, নবনীতার কাছে ও নাচ শেখে।

সুদীপা বললেন, আপনি ঠিকই শুনেছেন আচার্যমশাই। নবনীতাদির বিশ্বাস, তিশা ভালো নাচিয়ে হবে।

আমি আশীর্বাদ করি, ও যেন খ্যাতি পায়। দুহাত ওপরদিকে তুলে বিদ্যাবিনোদ আচার্য বলেছিলেন। সেদিনের পর তিশা আর আর্যসঙ্গীত ভবনে যায়নি।

নয়

নবনীতা ব্যানার্জির বাবা অমিয় ব্যানার্জি। পূর্বপুরুষদের পৌরহিত্যের পেশা। অমিয়বাবুর বাবাও যজমানি করে সংসার চালালেন। আধুনিককালের বামুনদের মতো ভিক্ষুকের মনোভাব ছিল না নন্দদুলাল ব্যানার্জির। বেশ ব্যক্তিত্ব ছিল তাঁর। গ্রামের মানুষ মানিগণ্যি করত যথেষ্ট। দু-চার দশকানি জমিজমাও ছিল। দুই ছেলের একজনকে শাস্ত্রপাঠ, পুজোপার্বন, মন্ত্র-আহ্নিকের দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন নন্দদুলাল ব্যানার্জি। ছোট ছেলে অমিয়কে পাঠিয়েছিলেন স্কুলে। অমিয় বিএ পাস করবার পর কাস্টমসে চাকরি পেয়ে গিয়েছিল। যতদিন মা-বাবা জীবিত ছিলেন শহর-গ্রাম করেই চাকরিটা করেছেন। মা-বাবা মারা যাওয়ার পর গ্রামের পাট চুকিয়ে দিয়েছিলেন অমিয়বাবু। শহরে ভাড়াবাড়িতে উঠেছিলেন প্রথমে। বেশ ক’বছর পর হাতে টাকা জমলে জুবিলি রোডের এই জায়গাটি কিনেছিলেন। স্ত্রীর পছন্দমতো দ্বিতল বাড়িও করেছিলেন। ঘর আলো করে নবনীতা এসেছিল। আর সন্তান হয়নি তাঁদের। ছোটবেলা থেকে গানের প্রতি ঝোঁক নবনীতার। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর গান শেখার জন্য নবনীতাকে শান্তিনিকেতনে পাঠিয়েছিলেন ব্যানার্জিদম্পতি। পাঁচ বছরের কোর্স। ওই সময়ে মা মারা যান নবনীতার। ফিরে আসতে চেয়েছিল। অমিয়বাবু রাজি হননি। পড়া শেষ করে যখন ফিরল নবনীতা, অমিয়বাবু রিটায়ারমেন্টে চলে এসেছেন।

মেয়ের বিয়ের জন্য তৎপর হয়ে উঠেছিলেন ব্যানার্জিবাবু। কী কারণে কে জানে, নবনীতা রাজি হয়নি।

বলেছিল, আমার একটা নাচের স্কুল দেওয়ার ইচ্ছা বাবা।

বাবা বলেছিলেন, তাতে আমার তো কোনও আপত্তি নেই মা! দোতলা বাড়ি। আমরা তো ওপরতলায় থাকি! নিচতলাটা খালি পড়ে আছে। লোক লাগিয়ে গুছিয়ে নিলে দিব্যি স্কুল হয়ে যাবে।

খুশির চোটে বাবাকে জড়িয়ে ধরেছিল নবনীতা। বলেছিল, তুমি আমার সোনার বাবা, লক্ষ্মীবাবা!

এবার তুই বিয়েটা কর মা। ওপর থেকে তোর মা শান্তি পাবে। বলে ওপর দিকে তাকিয়েছিলেন অমিয় ব্যানার্জি। একটু দম নিয়ে বলেছিলেন, শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার একটু আগে আমার হাতটা টেনে নিয়ে বলেছিল, আমার মেয়েটাকে ভালো একটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ো।

হঠাৎ আনমনা হয়ে পড়েছিল নবনীতা। আপন মনে আওড়েছিল, ভালো ছেলে!

সংবিতে ফিরে বলেছিল, স্কুলটা একটু গুছিয়ে নিই বাবা। তোমাকে দিয়েই উদ্বোধন করাব। স্কুলটা চালু হয়ে গেলে যা বলবে, তা-ই করব।

নাচের স্কুলটি অমিয়বাবু উদ্বোধন করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু মেয়ের বিয়েটা দিয়ে যেতে পারেননি। এক সকালে নাস্তার টেবিলে হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল তাঁর। হাসপাতাল থেকে জীবন্ত ফিরতে পারেননি।

অমিয় ব্যানার্জির বাসনাটা অপূর্ণ থেকে গিয়েছিল। অপূর্ণ থাকত না যদি রঞ্জন বিট্রেটা না করত। রঞ্জন মাজি আর নবনীতা একই ইয়ারে পড়ত, শান্তিনিকেতনে। বছর গড়াতে ভাব জমে উঠেছিল উভয়ের মধ্যে। কেউ কাউকে মুখ ফুটে না বললেও দুজনে বিশ্বাস করত, একদিন ওরা বিয়ে করবে। তাদের ঘনিষ্ঠতা শান্তিনিকেতনীদের অজানা থাকেনি। মা-বাবা, বাংলাদেশের বাড়ির ঠিকানা―সবকিছু রঞ্জন জানলেও নবনীতা তেমন করে রঞ্জন সম্পর্কে জানত না কিছুই। নিজের সম্পর্কে জানাতে আগ্রহও বোধ করত না রঞ্জন। কী জানাবে সে, নবনীতাকে ? উত্তর চব্বিশ পরগণার প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক অজগাঁয়ে তার জন্ম। সেই গ্রামের মানুষেরা ইটের বাড়ি দেখেনি কক্ষনও। ভাঙাচোরা মেটেরাস্তা। ইলেকট্রিসিটি নেই। ছনে ছাওয়া বেড়ার ঘরে বাস করে তার মা-বাবা আর বোনটি। তার বাবা যে অন্যের জমিতে খেটেখাওয়া দিনমজুর―বলে কী করে নবনীতাকে! প্রচণ্ড এক সংকোচে নিজের কথা তেমন করে কোনওদিন বলেনি রঞ্জন। নবনীতারও জানবার তেমন কোনও আগ্রহ ছিল না। রঞ্জনকে তো জেনেছে সে! রঞ্জন যে অতুলনীয়! প্রয়োজনে পরে না হয় জানা যাবে সব!

চতুর্থ বর্ষে যখন, আচমকা কোথায় হারিয়ে গেল রঞ্জন মাজি। কাউকে কিছু না বলেই শান্তিনিকেতন ছেড়েছিল সে। অনেক চেষ্টা করেও রঞ্জনের ব্যাপারে কোনও তথ্য জানতে পারেনি নবনীতা।

মনে গভীর ক্ষত নিয়ে শান্তিনিকেতনের পড়াশোনা শেষ করেছিল নবনীতা। তার পর তো নাচের স্কুল দেওয়া। নৃত্যাঙ্গনের যশ চারদিকে ছড়িয়ে পড়া।

অনেকদিনের পরের একদিন গোটা নৃত্যাঙ্গন দেখল, মাঝবয়সী এক লোক স্কুলের উঠানে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। মুখভর্তি দাড়ি। পাঞ্জাবি গায়ে। পায়ে চটি। কাঁধে শান্তিনিকেতনী থলে।

সোলেমান জিজ্ঞেস করেছিল, কারে চান ?

শান্ত গলায় লোকটি বলেছিলেন, এটা ব্যানার্জি বাড়ি না ? ৩৯ নম্বর জুবিলি রোড ?

এইটা কোনও বেনারজি বাড়ি না। এইটা ইস্কুল। নাচের ইস্কুল। নবনীতাদিদিমণির ইস্কুল এইটা। বলেছিল সোলেমান। সে এই স্কুলের দারোয়ান কাম দপ্তরি।

লোকটির চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। বলেছিলেন, অই নবনীতা দিদিমণির সঙ্গে দেখা করতে চাই আমি। কোনদিকে গেলে তাকে পাব বলতে পার ?

প্রতিদিন দিদিমণির সঙ্গে কত মানুষই দেখা করতে আসে! এই লোকটিও সেরকম কেউ ভেবে নিচতলার একটা কক্ষের দিকে আঙুল তুলেছিল সোলেমান।

শ্লথ পায়ে ঘরটির দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন লোকটি।

সবে তিশাদের ক্লাস শেষ করে চেয়ারে এসে বসেছেন নবনীতা। তিশারা এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। উঁচু ক্লাসের ছাত্রী তারা। প্রাইমারি লেসনগুলো শেখা হয়ে গেছে তাদের। এখন নাচের জটিল স্টেপ আর হাতের ভঙ্গিগুলো শিখছে তারা।

ঢাকা জলের গ্লাসটির দিকে হাত বাড়িয়েছেন মাত্র, অমনি শুনতে পেলেন, আমি একটু ভেতরে আসব ?

দরজার দিকে মুখ তুলেছিলেন নবনীতা ব্যানার্জি। লোকটিকে চিনতে পারেননি। চেনার কথাও নয়। মাথায় কাঁচাপাকা চুল, মুখভর্তি দাড়িগোঁফ।

ইতস্তত কণ্ঠে নবনীতা বলেছিলেন, আসুন।

টেবিলের ওপাশে নবনীতার সামনের চেয়ারে বসেছিলেন লোকটি। আহ্ বলে একটি স্বস্তির আওয়াজ মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল তাঁর।

জলখাওয়া শেষ করে  লোকটির দিকে তাকিয়ে নবনীতা বলেছিলেন, আমি আপনাকে ঠিক…।

মুখের কথা কেড়ে নিয়েছিলেন লোকটা। অপরাধী কণ্ঠে বলেছিলেন, আমি রঞ্জন, রঞ্জন মাজি।

মুহূর্তেই স্তব্ধ নিথর হয়ে গিয়েছিলেন নবনীতা। পাথর যেন! নিষ্পলক তাকিয়েছিলেন রঞ্জনের দিকে।

চোখাচোখি হতেই মাথা নামিয়েছিলেন রঞ্জন মাজি। তাঁর যে কিছু বলার নেই! বলার যে কিছু ছিল না তাঁর, তা নয়। কিন্তু এই মুহূর্তে নবনীতার সামনে বসে নিজেকে অপরাধী ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না তাঁর।

সেই বিকেলে চিঠি এসেছিল একটা। বাড়ি থেকে। কাঁপা হাতে লেখা।

শিগগির বাড়ি আয় খোকা। দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। এই দুটি লাইনই শুধু লেখা ছিল। গোটা পোস্টকার্ড ফাঁকা। মনটা কুডাক ডেকে উঠেছিল। সেই সন্ধ্যাতেই ট্রেনে চড়েছিল। কাউকে কিছু বলে আসার অবকাশ পায়নি রঞ্জন। বাড়িতে পৌঁছে জানতে পেরেছিল, তার বাবা খুন হয়ে গেছে। কালিদাস মিত্তিরের জমিতে দিনমজুর খাটত শিবনাথ। কালিদাস এ অঞ্চলের কেষ্টবিষ্টু। জমিতে জলসেঁচার ব্যাপার নিয়ে শিবনাথ একটু মুখ করেছিল কালিদাস মিত্তিরের সঙ্গে। ঘুরিয়ে এক চড় কষিয়েছিল কালিদাস। দশাসই মানুষ সে। চড়ের ওজনও কম ছিল না। শিবনাথ ঘুরে পড়ে গিয়েছিল জমিতে। পুলিশ পর্যন্ত যেতে দেয়নি শিবনাথের বউকে কালিদাস। রঞ্জন পৌঁছার আগেই নিজ উদ্যোগে শ্মশানক্রিয়া সম্পন্ন করে ফেলেছিল। পুলিশের মুখ কীভাবে বন্ধ করতে হয়, থানাকে কীভাবে বশ করতে হয়, জানা আছে কালিদাস মিত্তিরের। রঞ্জন প্রতিবাদ করলে তাকে জেলের ঘানি টানার ব্যবস্থা নিয়েছিল কালি মিত্তির। দেড় বছর পর বেরিয়ে রঞ্জন দেখল, তার মা স্বর্গে গেছে। বোনটি পাশের দত্তবাড়িতে বাসন মাজছে।

অন্যরকম এক সংগ্রাম শুরু হয়েছিল রঞ্জনের জীবনে। বোনটি বিয়ের উপযুক্ত হলে দেখেশুনে ভালো একটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। নিজেদের ভিটেয় দুজনকে থিতু করে কাঁধের ঝোলাটা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। এত ঝড়জলের মধ্যেও ভোলেননি বাড়ির ঠিকানাটা―৩৯ জুবিলি রোড, চট্টগ্রাম। ছোট শহর তখন চট্টগ্রাম। বাড়িটি খুঁজে পেতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি রঞ্জনকে।

মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে অনেকটা সময় নিয়ে মৃদু কণ্ঠে বৃত্তান্তটা বলে গিয়েছিলেন রঞ্জন।

ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠতে চেয়েও কী বুঝে মেজাজ ঠাণ্ডা রেখেছিলেন নবনীতা। রঞ্জনের কথার মাঝখানে একটি শব্দও করেননি। প্রথমদিকে চোখ খোলা রাখলেও একটা সময়ে চোখ দুটো বুজে ফেলেছিলেন। শেষের দিকে দুচোখ ভাসিয়ে অশ্রুর বন্যা নেমেছিল। কখন যে বুকটা ভিজে গিয়েছিল, টের পাননি নবনীতা।

শেফালি নবনীতাদির সঙ্গে দেখা করতে এসে থমকে গিয়েছিল। জানালা দিয়ে নবনীতাদির ওপর হঠাৎ চোখ পড়েছিল তার। স্তম্ভিত চোখে তাকিয়ে দেখেছিল, নবনীতাদি কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন। তাঁর সামনে চুলদাড়িতে ভরা এক মধ্যবয়সি মাথা নত করে বসে আছেন। এই এতটা দিন এই নৃত্যাঙ্গনে নাচ শেখাচ্ছে শেফালি, কোনওদিন কাঁদতে দেখেনি দিদিকে। কাঁদা তো দূরের কথা বিষণ্নও দেখেনি কখনও! কিন্তু আজ কী হলো দিদির ? এরকম করে অঝোরে কেঁদে যাচ্ছেন কেন ? সামনের লোকটিই-বা কে ? লোকটিকে কোনওদিন দেখেছে বলে মনে পড়ে না শেফালির! লোকটি কি দিদিকে অপমান করেছেন ? করেছেন তো নিশ্চয়ই! নইলে দিদি কাঁদবেন কেন ? এখন তার কী করা উচিত―দ্রুত ভেবে গেল শেফালি। ঢুকে পড়বে রুমে ? চিৎকার করে জিজ্ঞেস করবে, এত সাহস হলো কী করে আপনার, আমাদের দিদিকে অপমান করেন ? তার এটা করা কি ঠিক হবে ? ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়া হবে না তো ? যদি দিদি রেগে গিয়ে বলেন, আমাদের মধ্যে নাক গলাতে কে বলেছে তোমাকে শেফালি ? তেমন যদি দরকার হতো তোমাদের ডাকতাম না ? থাক বাবা। এখান থেকে সরে যাওয়াই ভালো। গিয়ে রেশমাদির সঙ্গে কথা বলি। তিনি আমার চেয়ে বয়সে বড়। নাচও শেখাচ্ছেন এখানে বহু বছর ধরে। তিনি একটা সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন।

বহুক্ষণ পরে চোখ খুলেছিলেন নবনীতা ব্যানার্জি। নিজেকে জিজ্ঞেস করলেন, কাঁদলে কেন ? ভেতরটা বলল, প্রথমে ক্রোধে কেঁদেছি, পরে মমতায় কেঁদেছি। সবশেষে কেঁদেছি বাবার জন্য। বাবা চেয়েছিলেন, তিনি বেঁচে থাকতে থাকতে তোমার বিয়েটা হোক। পরে পরে বলে তুমি তোমার বাবাকে প্রতারণা করে গেছ। সেই অপরাধের তাড়নায় তুমি আজ কাঁদলে নবনীতা। এইরকম করে কেঁদে তুমি বেশ করেছ। কাঁদলে ভেতরটা হালকা হয়। মনের ভারী ভারী কষ্টগুলো তখন তখনই ও-ই দূরদিগন্তে ভেসে যায়।

সজল চোখ দুটো ধীরে ধীরে প্রশান্ত হয়ে এসেছিল নবনীতার। স্নেহস্নিগ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন, মুখ তোল রঞ্জন। আমার দিকে তাকাও।

এই ঘটনার দিনদশেক পরে রঞ্জন মাজি আর নবনীতা ব্যানার্জিতে বিয়ে হয়েছিল। কোনও আড়ম্বর করেননি ওঁরা। দু-দশজন অভিভাবক, পাঁচ-ছজন বন্ধুবান্ধব বিয়েতে উপস্থিত থেকেছিলেন। চট্টেশ্বরী কালীমন্দিরে মালা বদল করে বিয়েটা সম্পন্ন হয়েছিল। বড় তৃপ্তি নিয়ে রাতের খাবার খেয়েছিলেন অতিথি-অভ্যাগতরা।

নৃত্যাঙ্গন গড়ার কাজে দুজনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। রঞ্জনবাবু তাঁর জানাটা নৃত্যাঙ্গনের পেছনে উজাড় করে দিয়েছিলেন। স্কুলটির খ্যাতি খুব দ্রুত চট্টগ্রাম ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

নানা প্রতিযোগিতায় নৃত্যাঙ্গন অংশগ্রহণ করে। কোনও যজস্বী ব্যক্তিত্বের সংবর্ধনায়, কোনও কালচারাল ফাংশানে কিংবা কোনও প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক সম্মেলনে নৃত্যাঙ্গনের ছাত্রছাত্রীরা নাচলে সেই অনুষ্ঠান প্রাণময় হয়ে ওঠে।

নাচিয়েদের মধ্যে সবার আগে চোখে পড়ে তিশাকে। তিশা এখন ক্লাস নাইনে পড়ে। তার হাত-পা এখন আর আগের মতন চিকনচাকন নয়, ভরাভরা। তার স্তনযুগল এখন আর অদৃশ্যমান নয়। স্পষ্ট এবং পুরুষ্টু। সবকিছুর মধ্যে উল্লেখ্য তার চাহনি। অতল চোখে সে যখন কটাক্ষ হানে, দর্শকরা নিজের বাহুতে চিমটি কাটে। হুঁশে আছে তো! মেডেলে, প্রশংসাপত্রে ঘর ভরে ওঠে তিশার।

বাবা একদিন বলেন, এবার একটু রাশ টান মা। সামনে তোর মাধ্যমিক ফাইনাল। পরীক্ষাও তো পাস করতে হবে মা! কলেজে পড়বে না তুমি ?

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিশার চাঞ্চল্যও স্তিমিত হয়ে এসেছে অনেকটা। আগে হলে বাবার এই কথার প্রতিবাদ করত। আজ করল না।

মুকুন্দবাবু আবার বললেন, তোমার মা গিয়ে নবনীতা ব্যানার্জিকে বলে আসবে বাছা বাছা অনুষ্ঠানে যাতে তোমাকে ডাকেন।

পড়ালেখায় মন দিয়েছিল তিশা। মাধ্যমিকটা ভালোভাবেই উতরে গিয়েছিল।

মুহুরিবাড়িতে তখন বিপুল আনন্দ। বড় মেয়ে দিশা তখন বিএসসিতে, মেজ তিশা ইন্টারমিডিয়েটে।

মেয়েদের জন্য গাড়ি কিনেছেন তখন মুকুন্দ মুহুরি।

কিন্তু মুহুরিবাড়ির আনন্দ খুব বেশিদিন স্থায়ী হলো না।

দশ

ভোরসকালে মূল গেট খুলে দারোয়ান আঁতকে উঠল, একী! ওয়াক, থু!

গোটা বাড়ি জুড়ে হইচই। তুলকালাম কাণ্ড। এ কাজ কে করল! এ তো সৃষ্টিছাড়া কাজ! জঘন্য!

মীরা পিসি বলল, রাম রাম, রাম রাম। এত বড় কুৎসিত কাণ্ডটা কে ঘটালো! অ মুকুন্দ, তুই কিছু বলছিস না যে! কার বুকের এত বড় পাটা যে মুকুন্দ মুহুরির গেটের সামনে বিষ্টা ছিটিয়ে যায়!

দারোয়ান মতিলাল রাত পৌনে বারোটার দিকে ভেতর থেকে ফটকে তালা লাগিয়ে নিজের রুমে চলে গিয়েছিল। সর্বক্ষণের দারোয়ান মতিলাল। মুহুরিবাড়িতেই থাকে, খায়।

গত রাতে শেষ ক্লায়েন্টটি যেতে যেতে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছিল। জটিল কেস বোধহয়। নইলে এত দেরি হবে কেন ? বুড়োমতন লোকটি মাথা নিচু করে গাড়িতে উঠেছিলেন। হাতে একতাড়া কাগজপত্র। চেহারাটা বড় বিষণ্ন ছিল লোকটির। গেটের বাইরে রাখা কার, উঠেই ড্রাইভারকে বলেছিলেন, চল শরীফ।

এসব দেখার আর শোনার কোনও আগ্রহ নেই মতিলালের। উকিলবাবুর কাছে কত লোক আসে আর কত লোক যায়। প্রথম প্রথম খুব আগ্রহ দেখাত মতিলাল। শেষের দিকে আসা-যাওয়ার মানুষদের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। কী হবে সব দেখেশুনে! গতরাতের লোকটির প্রতিও তার কোনও মনোযোগ দেওয়ার কথা নয়। কিন্তু মাথা নিচু করে লোকটির হাঁটার ভঙ্গিটি তার চোখকে আটকে দিয়েছিল। কাছে এলে মতিলাল বুঝতে পেরেছিল, তিনি বেশ বনেদিবাড়ির মানুষ। তাঁর চোখ-মুখ-হাঁটার ভঙ্গি―সবতাতেই বনেদিয়ানা। ধুম করে নমস্কারও দিয়ে বসেছিল একটা। ম্লান মিষ্টি একটু হেসে মাথা নেড়েছিলেন ভদ্রলোক। তারপর তো গেটে তালা লাগানো। নিজের রুমের দিকে যাওয়া তার।

ভোরে মেইন গেট খুলেই বিপত্তি। ইয়াক থু! গেটের সামনের চাতাল জুড়ে পায়খানা ছড়ানো-ছিটানো। ঘন। ছাড়া ছাড়া। মাঝখানে মাঝখানে তরল। দড় আর নরমের সহাবস্থন। পেটগুলানো, মাথা ঝিম ঝিম করে উঠা দুর্গন্ধ। ষষ্ঠীর ভাত গলা দিয়ে বের হয়ে আসতে চাইছে মতিলালের। এক ঝটকায় গেট বন্ধ করল সে। তারপর দে দৌঁড়। বেশিদূর যেতে পারল না। ও পাশের নালায় বসে পড়ল। তারপর গলগল গলগল।

সেদিন মুহুরিবাড়ির প্রতিদিনকার রুটিন লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। মুকুন্দ বাবু কোর্টে গেলেন না। দিশা-তিশা কলেজে গেল না। হরিপদ বাজারে গেল না। মীরা পিসি কুলদেবতার পুজো করতে বসলেন না। সুদীপা নাকে আঁচল চেপে এঘর ওঘর করলেন। দুর্গন্ধ যে ভেতরবাড়ি পর্যন্ত আসছে তা নয়, আর ওই বিষ্ঠা যে তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন তাও নয়। মতিলালের বর্ণনা শুনেই বারবার বিবমিষা জাগছে সুদীপা সেনের।

হরিপদকে ডাকলেন মুকুন্দবাবু, এখন কী করা হরিপদ ?

এর একটা বিহিত তো আপনাকে করতেই হবে কর্তা! কে এত বড় দুষ্কর্মটা করল খুঁজে বের করতে হবে। বলল হরিপদ।

মুকুন্দবাবু বললেন, সে তো পরের কথা! এখন কী করবে বল! ওগুলো সাফ না করলে আমরা বেরোব কী করে ?

হরিপদ বলল, সকালটা আর একটু পষ্ট হলে জানাজানি হয়ে যাবে। আশপাশের মানুষদের সবাই তো আর বন্ধু নয়! এই ঘটনাকে কেচ্ছা করে বাজারে ছেড়ে দেবে।

মুকুন্দ মুহুরি বললেন, আমার মাথায় কিছু আসছে না এখন। তুমি শিগগির ওগুলো পরিষ্কার করার ব্যবস্থা কর।

হরিপদ বলল, ধাঙড়পাড়ার একজনের সঙ্গে পরিচয় আছে আমার। দুখন লাল তার নাম। তাকে ডেকে আনছি। দুখনরা গর্তেপড়া মানুষদের চুষে নেয়। তার রেট শুনে রাগবেন না। রাজি হয়ে যাবেন। কাজ শেষে আমি দেখব।

হরিপদ দেয়াল টপকে রাস্তায় নামল।

মুহুরিবাড়ির উত্তর-পশ্চিম দিকে আবেদিন সাহেবের বাড়ি। ডিসি অফিসের বড়কর্তা ছিলেন এই জয়নাল আবেদিন সাহেব। আবেদিন সাহেবের বাড়ি যে কোন জেলায়, হলফ করে বলতে পারে না কেউ। অনেকে বলে, সাতচল্লিশের দেশভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তানে চলে এসেছিলেন তিনি। মুর্শিদাবাদের দিকে নাকি বাড়ি ছিল জয়নাল আবেদিনের। কোনও হিন্দুর সঙ্গে একচেঞ্জ করে আসেননি তিনি। বলা যায়, লোটাকম্বল নিয়েই এদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন। টাকাপয়সা না থাক আবেদিন সাহেবের, পেটে এলেম ছিল। সেই সময়ের বিএ ফেল ছিলেন তিনি। কী জানি কেন বর্ডার পার হয়ে সটান চট্টগ্রামে চলে এসেছিলেন। জেলা প্রশাসকের অফিসে ক্লার্কের চাকরিটা পেতে তেমন বেগ পেতে হয়নি তাঁকে। সেই সময়ের পাকিস্তান সরকার এপারে চলে আসা মুসলমানদের চাকরি-বাকরির অশেষ সুবিধা দিয়ে রেখেছিল। বিদ্যাবান ছিলেন বলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে বড়কর্তার পদে উন্নীত হয়েছিলেন জয়নাল আবেদিন।

এক সময় জয়নাল আবেদিনের মনে জায়গা কেনার ইচ্ছা জাগল। ডিসি অফিসে কাজ করেন বলে শহরের কোথায় খাসজমি পড়ে আছে, জানতেন তিনি। লাভ লেনের জায়গাটি পছন্দ হয়ে গিয়েছিল তাঁর। টিলামতন। জঙ্গুলে বলে জায়গাটি কারও নজরে পড়েনি তখনও পর্যন্ত। রাস্তার লাগোয়া ঘরবাড়িগুলো জৌলুশময়। জায়গাগুলিও বেশ দামি। কিন্তু পেছনদিকের আড়াল মতন জায়গা বলে বেশ সস্তাদামে পেয়ে গেলেন আবেদিন সাহেব। প্রথমে টিনের ঘর। পরে পরে বিল্ডিং। ততদিনে সংসারটা বড় হয়ে গেছে আবেদিন সাহেবের। আশপাশে দ্রুত সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল তাঁর। ছেলেরা বড় হয়ে বড় বড় চাকরি পেয়েছে। আবেদিন সাহেব রিটায়ারমেন্টে এসেছেন। খালি জায়গায় নানা কিসিমের ঘরবাড়ি তুলেছেন। দামি আর সস্তা। ধীরে ধীরে ভাড়াটেরা জুটেছে। কালক্রমে কলোনির মতন হয়ে গেল। মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল―আবেদিন কলোনি।

আবেদিন কলোনির গা ঘেঁষে, একটু নিচের দিকে ধাঙড়দের থাকতে দিল সরকার। তখন ধাঙড়দের খুব দরকার এদেশের শহরগুলোতে। অন্যান্য শহরের মতন চট্টগ্রাম শহরও তখন ক্রমবর্ধমান। রুজিরোজগারের আশায় গ্রামের সাধারণ মানুষেরা, চাকরির আশায় শিক্ষিত-আধাশিক্ষিতরা শহরে আসা শুরু করেছে। যত মানুষ, তত আবর্জনা। বাড়িতে বাড়িতে বাংলা পায়খানা। উঁচুমতন পা-দানির নিচে পাতিটিন পাতা। সারাদিনমান এবং রাতজুড়ে সেই পাতিটিনে টুপটাপ বিষ্টা পতন। ভোরসকালে বিষ্ঠাভর্তি পাতিটিন ধাঙড়রা নিয়ে যায়। খালি-পাতিটিন ভর্তি-পাতিটিনের জায়গা নেয়। বাঁকের র্দুমাথায় গু-ভর্তি পাতিটিন ঝুলিয়ে ধাঙড়রা দ্রুত এগিয়ে যায়। তাদের মুখে মাঝে মাঝে হাঁক ওঠে―হেই বাবুরা সাবধান। তফাতে চল। ওরা না থাকলে শহর বিষ্ঠাময়। আবর্জনায় সয়লাব। মিউনিসিপালিটির কাছে ওদের কদর অনেক। শহরেই রাখতে হবে ওদের। কিন্তু ভদ্রপাড়ায় নয়। একটু দূরে, একটু আড়ালমতন নোংরা স্যাঁতসেঁতে জায়গা হলে চলবে।

আবেদিন কলোনির অনতিদূরের ওই স্যাঁতসেঁতে জায়গাটা ধাঙড়দের বসতির জন্য নির্বাচন করল চিটাগং মিউনিসিপাল করপোরেশন। জয়নাল আবেদিন সাহেব বিরোধিতা করেছিলেন। বাড়ির পাশে ধাঙড়পাড়া হলে মানমর্যাদা সব যাবে। পরিবেশ নষ্ট হবে। ধন্নাও দিয়েছিলেন মিউনিসিপাল অফিসে। কিন্তু তাঁর অনুরোধ ধোপে টেকেনি। যত উঁচু পদেই চাকরি করুন না কেন, রিটায়ার করলে কদর কমে। আবেদিন সাহেবও মিউনিসিপাল অফিসে সমাদর পাননি।

ওই ধাঙড়পাড়াতেই ঢুকেছিল হরিপদ। দ্রুত পায়ে। কোনওদিন আগে আসেনি সে এখানে। আজই প্রথম এল। দুখনের সঙ্গে পরিচয় হওয়া একটা ঘটনা বটে। ধাঙড়পাড়ার অদূর দিয়ে মোমিন রোড। পূর্ব পশ্চিমে লম্বালম্বি। সকাল সাতটা থেকে নটা পর্যন্ত বাজার বসে মোমিন রোডের দুধার ঘেঁষে। হরিপদ আগে রেয়াজউদ্দিন বাজার, বক্সিরহাট যেত। মোমিন রোডের অস্থায়ী বাজারটি চালু হবার পর থেকে এখান থেকেই মাছ-মাংস-আলু-পটল-শাকসবজি কেনে হরিপদ। সেদিন সদাইপাতি তার শক্তির তুলনায় বেশিই হয়ে গিয়েছিল। একার পক্ষে তিন তিনটে ব্যাগ বাড়ি পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বড় সংকটে পড়ে গিয়েছিল হরিপদ। হঠাৎ কোথা থেকে দুখন এসে হাজির হয়েছিল হরিপদের সামনে।

বলেছিল, বাবু আমি বয়ে দিয়ে আসি ?

পঞ্চাশ পেরোনো শরীর দুখনের। হাড়গিলে চেহারা। গাল দুটো বসে গিয়ে বেঢপভাবে হনু বেরিয়ে পড়েছে। ক্ষয়াটে চোখ। পরনে জীর্ণ লুঙ্গি। রঙচটা হাফশার্ট গায়ে। খোঁচাটে মুখের দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছিল হরিপদ। নিরুপায় তখন সে। দুখনের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গিয়েছিল। ভারী থলে দুটো কাঁধে-হাতে তুলে নিয়েছিল দুখন। ছোট থলেটি নিয়ে পাশে পাশে হরিপদ। যেতে যেতে জেনেছিল লোকটির নাম দুখন। ওই ধাঙড়পাড়ায় থাকে। কৌলীন্য চাগিয়ে উঠেছিল হরিপদের মনে। খেয়েছে! একী করল সে! মেথর দিয়ে সবজি-আনাজের ব্যাগ বইয়ে আনল! মীরা পিসি জানতে পারলে দক্ষযজ্ঞ করে ছাড়বেন! গেটের সামনে ব্যাগ দুটো নামিয়ে নিয়েছিল হরিপদ। কোঁচড়ে বাদবাকি যা ছিল দুখনকে দিয়ে তাড়াতাড়ি বিদেয় করেছিল।

যেতে যেতে দুখন বলেছিল, কোনওদিন দরকার হলে স্মরণ কইরেন বাবু। পাড়ার ভিতর শিবমন্দিরের পাশের ঘরটি আমার।

দুখনকে খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয়নি হরিপদকে। একজনকে জিজ্ঞেস করলে ঘরটি দেখিয়ে দিয়েছিল।

হরিপদকে দেখে দুখন বুঝে নিয়েছিল মামলা জটিল। না হলে বাবুবাড়ির এই লোকটি সাতসকালে তাকে খুঁজছে কেন ?

অনেক ঝটকাঝটকির পর চারশ টাকায় রফা হয়েছিল।

বাজারমূল্যে এ অনেক টাকা। বিপদের গুরুত্ব হিসেব করে টাকার দিকে তাকালে ভুল হবে। দ্রুত ভেবেছিল হরিপদ। নিরুপায় হয়ে তাতেই রাজি হয়ে গিয়েছিল হরিপদ।

বালতি-জগ-ঝাড়ু হাতে দুখন হাজির হয়েছিল মুহুরিবাড়ির গেটে।

কিছুক্ষণের মধ্যে জায়গাটি আবার ঝকঝক করে উঠেছিল। পঞ্চাশ টাকা বেশি দিয়েছিলেন মুকুন্দ বাবু। নরকযন্ত্রণা থেকে বাঁচা গেল বলে।

দুখন বিদায় নিলে প্রশ্নগুলো চেপে ধরল মুকুন্দ মুহুরিকে। এরকম জঘন্য কাজ কে করল ? কেন করল ? কোনও শত্রু করেছে কি ? তার তো কোনও শত্রু নেই! এ তল্লাটের সবার সঙ্গে তাঁর ভালো সম্পর্ক। এখানকার কেউ এ কাজ করেছে বলে মনে হলো না মুকুন্দবাবুর। তাহলে দূরের কেউ করেছে ? কে সে দুশমন ? যার সমূহ ক্ষতি করেছেন তিনি! ভাবতে ভাবতে কূলকিনারা পেলেন না তিনি।

হরিপদকে ডেকে পাঠালেন। হরিপদ এবাড়ির পুরনো লোক। পূর্বাপর দুঃখসুখের সঙ্গে জড়িত।

আচ্ছা হরিপদ, কাজটি কে করেছে বলে তোমার মনে হয় ? জিজ্ঞেস করলেন মুকুন্দ মুহুরি।

তা তো সঠিক বুঝতে পারছি না কর্তা! তবে আপনার কোনও শত্রু যে একাজটি করিয়েছে, তা পষ্ট বুঝতে পারছি।

করিয়েছে বলছ কেন ?

হাসবার চেষ্টা করল হরিপদ। বলল, আপনার শত্রু তো নিজ হাতে আর বিষ্ঠার ভাণ্ড নিয়ে গেটে উপস্থিত হয়নি! বিষ্ঠা নিয়ে কাজ কারবার যাদের, তাদের কাউকে দিয়ে এই দুষ্কর্মটি করিয়েছে।

চমকে উঠলেন মুকুন্দবাবু। তুমি তো ঠিকই বলেছ হরিপদ! ধাঙড়পাড়ার কেউ এই কাজে জড়িত। কিন্তু কে সে ?

আপনি বললে আমি দুখনকে লাগাতে পারি। ও ঠিকই বের করে ফেলবে।

তাই কর হরিপদ। অপমানে ভেতরটা আমার জ্বলে যাচ্ছে!

দুখন বলেছিল, পয়সা খরচ করতে হবে বাবু। অন্তত দুই বোতলের টাকা দিতে হবে। কাম হয়ে গেলে দুশো টাকা।

মুকুন্দবাবু তখন উন্মাদপ্রায়। টাকা যা লাগে লাগুক, শত্রুকে চিহ্নিত করতেই হবে।

দুদিনের মাথায় ভজনকে নিয়ে হাজির হয়েছিল দুখন, মুকুন্দবাবুর সামনে।

ভজন আগাগোড়া উগড়ে দিয়েছিল। সিনেমা প্যালেসের ম্যানেজার ইব্রাহিমই তাকে কাজে লাগিয়েছিল। দুই বোতল বাংলা আর তিনশটি টাকা হাতে দিয়ে বাড়িটা চিনিয়ে দিয়েছিল। মদ আর টাকার লোভে এই অশিষ্ট কাজটি করেছি বাবু। আমাকে ক্ষেমা করে দেন। বলেছিল ভজন।

ওখানে থেমে থাকেননি মুকুন্দ মুহুরি। আদালত পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন ইব্রাহিমকে। সাক্ষী দিতে ভজনের গলা কাঁপেনি। এই গর্হিত কাজের জন্য এক মাসের জেল হয়ে গিয়েছিল ইব্রাহিমের।

কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ইব্রাহিম বলেছিল, এই মুহুরি আমার বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছিল একদিন। বিদ্যাবিনোদের পাশে না দাঁড়ালে এতদিনে আর্যসঙ্গীত ভবনটি আমার হয়ে যেত।

ভয় পেয়ে গেলেন মুকুন্দ মুহুরি! গাঢ় অন্ধকারময় ভয় ধীরে ধীরে তাঁকে চেপে ধরতে লাগল। তাঁর বিশ্বাস ছিল, অন্যান্য পেশার মতো ওকালতিও একটা পেশা। ওকালতিতে শত্রু তৈরি হয়, এটাও মানেন তিনি। পরাজিত মক্কেলরা ভাবে, বিপরীত পক্ষের উকিলের কারসাজিতেই তাদের পরাজয় ঘটেছে। ফলে ওই উকিলের সঙ্গে গালাগাল, খেপাখেপি করে। সব উকিলের সঙ্গে এরকম করতে সাহস করে না পরাজিতরা। বিশেষ করে মুকুন্দ মুহুরির মতো খ্যাতিমান উকিলদের সঙ্গে। এতদিন এরকমই ভাবতেন মুকুন্দবাবু। কিন্তু ইব্রাহিম তাঁর সেই বিশ্বাস টলিয়ে দিয়েছে। তাঁর মনের শান্তি, তার পারিবারিক নিরাপত্তা ধূলিসাৎ হতে বসল। তিনি কেঁপে উঠলেন। যে ইব্রাহিম এরকম জঘন্য কাজ করতে পারে, ছাড়া পেয়ে সে আরও যে হিংস্র হয়ে উঠবে না, তার তো কোনও গ্যারান্টি নেই!

সে যদি দিশা-তিশার কোনও ক্ষতি করে বসে! যদি…। আর ভাবতে পারলেন না মুকুন্দ বাবু। তিনি মনে মনে ঠিক করলেন, দিশার বিয়েটা এবার দিয়ে দেবেন। তারপর তিশার কথা ভাববেন।

এগারো

এক বিকেলে স্ত্রী আর পিসিকে নিয়ে বসলেন মুকুন্দ বাবু।

দিশা তখন তার রুমে। বিএসসির রেজাল্ট হয়ে গেছে তার। বিশ্ববিদ্যালয়ে এডমিশনের ঘোষণা এখনও হয়নি। তাই বলে সে যে একেবারে ঘর থেকে বের হয় না, এমন নয়। মাঝেমধ্যে বের হয়। ব্রজেন ডায়াসের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ এখনও অব্যাহত আছে। এমবিবিএস পাস করে সরকারি হাসপাতালে চাকরির চেষ্টা করে যাচ্ছে ব্রজেন।

তিশা প্রাইভেট পড়তে গেছে। ইংরেজি। হারুন স্যারের কাছে। সামনে উচ্চ মাধ্যমিক ফাইনাল। তিশা ঠিক করেছে, বাংলায় অনার্স পড়বে। তার আগে তো আইএটা পাস করতে হবে! ইংরেজিতে নড়বড়ে বলে সারা বছর ধরে প্রাইভেটটা চালিয়ে যাচ্ছে সে।

বিয়ের কথা বলব বলে তোমাদের ডেকেছি। বললেন মুকুন্দ বাবু।

স্বামীর মুখ থেকে কথাটি বের হতে না হতেই সুদীপা বলে উঠলেন, বিয়ে! কার বিয়ে!

হা হা করে হেসে উঠলেন মুকুন্দবাবু। বহুদিন পরে প্রাণ খুলে হাসলেন তিনি। পিসির দিকে একপলক দেখে নিলেন। বললেন, তোমার কোনও ভয় নেই সুদীপা। বয়স হয়ে গেছে আমার। ও-পথ মাড়াচ্ছি না আর।

মীরা পিসি বলে উঠলেন, রাম! রাম! কী অলক্ষুণে কথা বলছিস মুকুন্দ! তাহলে কার বিয়ের কথা বলছিস তুই ? একটু থেমে আবার বললেন পিসি।

পিসি, তুমিও একসুরে গাইতে শুরু করলে! সুদীপার সঙ্গে একটু ঠাট্টা করতে চাইলাম। সিরিয়াস হয়ে গেল সে। তুমিও সুদীপার পথেই হাঁটলে! যাক গে, যে কথা বলবার জন্য তোমাদের ডেকেছি, বলি।

ভাইপোর কথায় পিসি লজ্জা পেলেন। সুদীপা গম্ভীর হয়ে থাকলেন। মুকুন্দ মুহুরি বললেন, আসলে দিশার বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে তোমাদের আজ এখানে ডেকেছি।

পিসি আর সুদীপার মুখ খুশিতে ভরে গেল।

সুদীপা কৃত্রিম রাগের কণ্ঠে বলল, তা-ই বল! আসল কথা না বলে রাজ্যের ধানাইপানাই। আমি ভাবলাম, বুড়োর আবার ভীমরতি হলো নাকি!

দেখেছ, দেখছ পিসি! আমাকে বুড়ো বলছে! দু’চার গাছি চুল পেকে গেছে না হয়! ডানপাশের মাড়ির দাঁতটা একটু নড়বড় করছে বলে কি আমি বুড়িয়ে গেছি পিসি ?

মীরা পিসি এবার না হেসে পারলেন না। থাক বাবা, থাক। আর ঠাট্টা-মশকরার দরকার নেই। দেখছিস না বউমা রেগে যাচ্ছে! যা বলতে চাইছিলি, তা-ই বল।

ঠিক আছে, ঠিক আছে পিসি। আসল কথাটাই বলি। তারপর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটু হাসলেন মুকুন্দ বাবু। বললেন, দেখ সুদীপা, আমাদের বড় মেয়ে দিশা বড় হয়ে গেছে। গ্রেজুয়েশনটাও নেওয়া হয়ে গেছে তার। এবার তার বিয়ের কথা ভাবলে কেমন হয় ?

সুদীপা কিছু বলার আগে মীরা পিসি সোৎসাহে বললেন, এ তো বড় আনন্দের সংবাদ রে মুকুন্দ! এই মুহুরিবাড়ির, মানে মুকুন্দ মুহুরির বাড়ির প্রথম বিয়ে! ধুমধামের সঙ্গে হওয়া চাই।

তা তো বটেই। আমার বড় মেয়ের বিয়ে বলে কথা! গোটা শহরকে আমার বাড়িতে জড়ো করব না আমি! এমন খাবারের আয়োজন করব, যেন দীর্ঘ দীর্ঘদিন নিমন্ত্রণের কথা না ভোলে অতিথিরা! উচ্ছ্বাসভরা গলায় বললেন মুকুন্দবাবু।

সুদীপা ঠাণ্ডা গলায় বললেন, মেয়েটাকে কি আর পড়াবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছ ?

তা বলছ কেন ? পড়াব না কে বলেছে ? ডিগ্রিটা পাস করেছে। বিয়ের বয়স হয়ে গেছে মেয়ের। এই সময়টাতে বিয়ে না দিলে ভুল হবে। তাছাড়া এমএসসিটা সে শ্বশুরবাড়িতে গিয়েও পড়ে নিতে পারবে।

তোমার একথা ঠিক নয়। আমার বেলায় সেটা হয়নি। ইন্টারমিডিয়েট পাস করে এবাড়িতে এসেছিলাম। ডিগ্রিটাই পাস করা হয়নি! এমএ তো দূর অস্ত! ব্যঙ্গের কণ্ঠ সুদীপার।

স্ত্রীর কথা শুনে মুকুন্দবাবু চুপসে গেলেন। আনমনে জানালার ওপারে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, তুমি তো আমার কথা জানতে সুদীপা! অর্থনৈতিক অবস্থা আমার ভালো ছিল না। সস্তাদামের ভাড়াবাড়িতে থাকতাম। ওই সময় আমাদের বিয়ে হলো। তারপরও তোমাকে পড়াতাম না, তা নয় কিন্তু। দিশা তোমার পেটে চলে এল। হঠাৎ করে থেমে গেলেন মুকুন্দ বাবু।

সুদীপা ঘাবড়ে গেল খুব। আহা রে! তাঁর কথায় দিশার বাবা যে ব্যথা পেলেন! এরকম করে আঘাত দিতে চাননি তিনি। দিশা পেটে আসার পরও তিনি তাগিদ দিয়ে গেছেন ডিগ্রি পরীক্ষাটা প্রাইভেটে দেওয়ার জন্য। তিনি নিজেই তো কোনও আগ্রহ দেখাননি তখন! আর আজ বিনা অপরাধে স্বামীকে দোষী সাব্যস্ত করতে চাইলেন মাসির সামনে!

তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, আমার কথায় তুমি কষ্ট পেয়ো না দিশার বাপ। হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল কথাটি। তুমি আমায় ক্ষমা কর। বলতে বলতে সুদীপার চোখ সজল হয়ে উঠল।

আচমকা কেন মেয়ের বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগলেন মুকুন্দবাবু, তা তো আর মুখ ফুটে এঁদের বলা যাবে না! সেদিনের পর থেকে তাঁর কেন জানি বারবার মনে হচ্ছে, তাঁর পরিবারের ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে যাবে এবং এই ঝড় তুলবে ইব্রাহিম। সে প্রথমে তাঁর সবচেয়ে প্রিয়, সবচেয়ে স্নিগ্ধ জায়গায় আঘাত হানবে। আর মুকুন্দ মুহুরি তো জানেনই, তাঁর সবচাইতে নরম অথচ পবিত্র বস্তু কী! তাঁর কাছে তাঁর দুটো মেয়েই তো স্বর্গের চেয়ে প্রিয়, গঙ্গার চেয়ে পবিত্র! অকল্যাণের হাত থেকে মেয়েদের বাঁচানোর জন্যই তো দিশার বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি!

মুকুন্দবাবু ভয়কে বুকের তলায় চেপে রাখলেন। মায়াভরা কণ্ঠে স্ত্রীকে উদ্দেশ করে বললেন, তুমি ওরকম উতলা হচ্ছ কেন সুদীপা ? এই কথা তো তুমি আজকেই প্রথম বললে না। আমাকে চটাবার জন্য আগেওতো মাঝেমধ্যে বলেছ। গত বেশ ক’বছর ধরে খোঁটাটা অবশ্য দাওনি তুমি! যাক ওসব কথা, এখন বল বিয়েতে  তোমার মত আছে কিনা।

এক গাল মিষ্টি হেসে সুদীপা বলল, কে না চায় তার উপযুক্ত মেয়ের বিয়ে হোক ?

এতক্ষণ চুপ থাকা মীরা পিসি বলে উঠল, ঠাকুর, ঠাকুর। এই তো ভালো কথাটা বউমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল!

তারপর মুকুন্দ মুহুরির দিকে ফিরে বললেন, তা ছেলে কি তোর হাতে আছে মুকুন্দ ?

একেবারে নির্দিষ্ট কোনও ছেলে যে হাতে আছে, তেমন নয়। দু’চারটা ছেলের খোঁজ-খবর আছে। তোমরা আজ রাজি হলে, কাল থেকে ছেলে খোঁজায় জোর কদমে নেমে পড়ব।

তা বেশ, তা বেশ! বলি কি মুকুন্দ, দিশাকে একবার জিজ্ঞেস করলে হতো না! মীরা পিসি বললেন।

সুদীপা বললেন, আমারও একই মত, সুদীপার মতামতটা জেনে নেওয়া দরকার।

মুকুন্দবাবু আকাশ থেকে পড়লেন যেন! অবাক কণ্ঠে বললেন, দিশাকে জিজ্ঞেস করে বিয়ের আয়োজন করব! দিশা কি দ্বিমত করবে বলে তোমাদের মনে হয় ?

না, তা নয়। শিক্ষিত মেয়ে তারও তো একটা মত থাকতে পারে!

তুমি শিক্ষিত ছিলে না সুদীপা ? বিয়ে দেওয়ার সময় তোমার বাপ-মা কি তোমার মত জানতে চেয়েছিলেন ?

পিসি চটজলদি বলে উঠলেন, তোদের সময়ের সঙ্গে বর্তমানকে মিলালে চলবে না মুকুন্দ। সেকাল আর একালে বড় তফাত রে মুকুন্দ!

মুকুন্দ মুহুরি কণ্ঠে অভিমান মিশিয়ে বললেন, তোমরা দুজনেই বলছ যখন, তোমাদের কথা ঠেলব না আমি। দেখ দিশার সঙ্গে কথা বলে। ওর মতামত জেনে নাও।

তার জন্য তুই আবার অপেক্ষা করে থাকিস না মুকুন্দ। কথায় কথায় কথা উঠল বলে দিশাকে জিজ্ঞেস করা। আমার বিশ্বাস, তোর কথা ফেলবে না দিশা। দিশা তোকে ভীষণ ভালোবাসে রে বাপ!

সুদীপা বললেন, পিসিমা ঠিকই বলেছেন, আমরা দু’একদিনের মধ্যে দিশার সঙ্গে কথা বলে নেব। তুমি আয়োজন শুরু কর। বিয়ে বলে কথা, একদিনে তো আর সব কিছু জোগাড়যন্তর হয়ে যাবে না!

সোনাদানা কি আছে কিছু ঘরে ? কৌতুকী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন মুকুন্দবাবু।

ও নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। সে আমি অনেক আগেই দুজনের জন্য অর্নামেন্ট সেট তৈরি করে রেখেছি। খাট-পালঙ্ক-ড্রেসিং টেবিল এসবের কথা ভাব তুমি। চাইলেই তো তৎক্ষণাৎ আর মনের মতো আসবাবপত্র পাওয়া যাবে না! বানাতে হবে। দিনও লাগবে অনেক।

আমি কালকেই একজন কার্পেন্টারকে ডেকে নেব ক্ষণ। ফিরিঙ্গিবাজার এলাকায় নামকরা কার্পেন্টার আছে শুনেছি।

ঠিক পরের দিন কার্পেন্টার আসেনি। তার পরের দিন এসেছিল। ওই দিন রোববার। সরকারি ছুটির দিন। কোর্টকাছারি বন্ধ। মুকুন্দ মুহুরি ঘরে। দিশা বেরিয়ে পড়েছিল, কোন বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করবে বলে। তিশা যথারীতি প্রাইভেটে। বাড়িজুড়ে চাপা আনন্দ। সুদীপা সেন মালতি আর লক্ষ্মীকে দিয়ে বাড়ির ভেতরটায় সাফসুতরায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। রঙমিস্ত্রিকে খবর দেওয়া হয়েছে। বহু বছর বাড়িটি রং করানো হয়নি। মুকুন্দ বাবু ঠিক করেছেন, বাড়ির আগের রঙটি পাল্টে ফেলবেন। গৈরিক রং তাঁর পছন্দ। ওই রঙে পবিত্র পবিত্র ভাব।

বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে কার্পেন্টার এল। হরিপদই যোগাযোগ করেছিল তাঁর সঙ্গে। কুঁজো মতন বুড়োটে চেহারা কার্পেন্টারের। দাড়ি আছে। যত্ন নিয়ে পেছন দিকে চুল আঁচড়ানো। দাড়িও এলেবেলে নয়। পরনে হেঁটো ধুতি। গায়ে দুই জেবওয়ালা ফতুয়া।

হরিপদই নিয়ে এল সামনে। মুকুন্দবাবু তখন নিজ চেম্বারে। কাল-পরশু কি আগামী সপ্তাহে তেমন কোনও জটিল কেস নেই। তবুও অভ্যেসবশত আইনের মোটা একটি বই নাড়াচাড়া করছেন।

কর্তা, ছুতার এসেছে। দরজা থেকে বলল হরিপদ।

মাথা না তুলে মুকুন্দবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কে! ততক্ষণে বইটির একটা পৃষ্ঠায় চোখ আটকে গেছে তাঁর। সেখানে জটিল একটা আইনের ব্যাখ্যা।

আজ্ঞে, ছুতার। ডাকতে বলেছিলেন। ডেকেছি। এসেছে।

ছুতার মানে! বলে চোখ তুললেন মুকুন্দবাবু।

আজ্ঞে, পেন্নাম কর্তা। আমি কার্পেন্টার। কুঁজোমতন লোকটি বলল।

ও হো হো করে হেসে উঠলেন মুকুন্দবাবু। ইংরেজি বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে আর আদালতে ইংরেজিতে আর্গুমেন্ট করতে  করতে মাতৃভাষাই ভুলতে বসেছি। কার্পেন্টার যে ছুতার, তাও ভুলে গেছি! বলে উঠলেন মুকুন্দ মুহুরি। হাসি হাসি মুখ করে জিজ্ঞেস করলেন, তা তোমার নাম কি ?

হরিপদ নিজের কাজে চলে গেল। লোকটি ঘরের ভেতর সরে এল।

আজ্ঞে আমার নাম লক্ষ্মণ। বলল লোকটি।

রামের ভাই লক্ষ্মণ ? কৌতুক করতে ইচ্ছে করল মুকুন্দবাবুর।

আজ্ঞে না। আমার বড় ভাইয়ের নাম দশরথ, ছোট ভাইয়ের নাম অর্জুন।

আর স্ত্রীর নাম ? তোমার ? কৌতুক যেন থামতেই চায় না মুকুন্দবাবুর।

লক্ষ্মণ সোজা সরল মানুষ। মুকুন্দবাবুর ঠাট্টাটা ধরতে পারল না। বলল, আজ্ঞে আমার ইস্তিরির নাম কুন্তী।

এবার হা হা থেকে ঠাঠা। হাসতে হাসতে দম আটকে যাওয়ার অবস্থা মুকুন্দবাবুর। কোনও রকমে হাসি থামিয়ে বললেন, রামায়ণ মহাভারতের অপূর্ব সম্মিলন। তোমার বাবার প্রশংসা করতেই হয় লক্ষ্মণ।

আজ্ঞে আমার বাবাও নাম করা ছুতার ছিল। আমার যা কিছু শিক্ষা তার কাছ থেকে। বলে বাবার উদ্দেশে জোড়হাত কপালে ঠেকালো লক্ষ্মণ।

আমার মেয়ের বিয়ে লক্ষ্মণ। ফার্নিচার বানাতে হবে। পারবে তো তুমি ? কাজের কথায় এলেন মুকুন্দবাবু।

পারব কর্তা। কাজের হাত। নিজের হাত দুটো তুলে দেখালো লক্ষ্মণ। এই হাতে আর্ট আছে কর্তা। একটু থেমে আবার বলল লক্ষ্মণ, বার্মা সেগুনের দুইটা বিম আছে হাতে। ডিজাইন দিলে বানিয়ে দিতে পারি। পালঙ্ক, সঙ্গে ডেকোরেটিভ হেডবোর্ড আর বুককেস। একশ বছরের গ্যারান্টি। কাজ করতে করতে ইংরেজি শব্দগুলি সড়গড় হয়ে গেছে লক্ষ্মণের মুখে।

তা না হয় হলো। আরও তো জিনিস লাগবে!

তা তো লাগবে কর্তা! ড্রেসিং টেবিল, আলনা, ওয়ার্ড্রব, ডাইনিং টেবিল, ছখানা ডিজাইন করা চেয়ার।

মুকুন্দবাবু লক্ষ্মণকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে লক্ষ্মণ। এগুলো ছাড়াও আরও যা যা লাগে সব বানিয়ে দেবে। কোনও গোঁজামিল দিতে পারবে না। সার কাঠ চাই আমি। আমার প্রথম মেয়ের বিয়ে।

আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন কর্তা। ওই দুই কাণ্ড দিয়ে সব ফার্নিচার হয়ে যাবে।

দরদাম ? জানতে চাইলেন মুকুন্দবাবু।

সে নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না কর্তা। গাছের দাম বাদে আমাকে মজুরিটুকু দিলেই হবে।

সময় কিন্তু বেশি নেই লক্ষ্মণ। টেনেটুনে একমাস। ওই এক মাসের মধ্যে করে দিতে হবে। হরিপদকে দিয়ে কিছু টাকা এডভান্স পাঠিয়ে দেব।

প্রণাম জানিয়ে লক্ষ্মণ বেরিয়ে গেল।

বারো

রাতের খাবার খেতে বসেছেন সবাই। প্রান্তের চেয়ারে মুকুন্দবাবু। তাঁকে ঘিরে অন্যরা। ডানে দিশা-তিশা। বামে প্রথমে সুদীপা, পরে মীরা মাসি। সুদীপা দিশা মুখোমুখি।

মালতি আর লক্ষ্মী খাবারটেবিল সাজিয়ে দিয়েছে। এ বাড়িতে এখন এবেলার রান্না ওবেলায় খাওয়া হয় না। প্রতি বেলা নতুন রান্না।

আজ রাতের খাবারে আছে রূপচাঁদা ফ্রাই, মাখা মাখা করে তপসে মাছ, লাল শাক দিয়ে চিক্কা ইচা। একটা নতুন রান্না হয়েছে আজ এ বাড়িতে। রান্নাটা মীরা মাসির আবিষ্কার। ছুরি শুঁটকির সঙ্গে কাঁচা সিমের বিচি। তাতে সেদ্ধ ডিম। ঝাল ঝাল করে রাঁধা। সঙ্গে একটা-দুটো টমেটো। কম ঝোলের এই রান্নাটির নাম দিয়েছেন খাঁইস্যা, মীরা মাসি।

এ বাড়িতে নিজের হাতে নিজের পছন্দের খাবার বেড়ে নিতে হয়। কেউ কাউকে পাতে কিছু তুলে দেন না। প্লেটে প্লেটে ভাত নেওয়া হয়ে গেছে। দিশা তার প্রিয় খাবার রূপচাঁদা পাতে তুলে নিয়েছে। মুকুন্দবাবু খাঁইস্যা দিয়েই শুরু করেছেন। অন্যরা যাঁর যাঁর পছন্দমতো। নীরবে খাবার শুরু করেছেন সবাই। খাওয়া বেশ কিছু দূর এগিয়েছেও।

আলতো কণ্ঠে সুদীপা বললেন, তোর সঙ্গে একটা কথা ছিল দিশা।

চট করে মাথা তুললেন মুকুন্দবাবু। বললেন, এখানে কেন ? এখন কেন ?

ব্যাপারটা যখন এই পরিবারকে ঘিরে, তাই কথাটা সবার সামনে পাড়া ভালো নয় কি ? বললেন সুদীপা।

মুকুন্দবাবু চুপ করে গেলেন।

পিসি বললেন, খাওয়াটা শেষ করে বললে হতো না বউমা ?

আমার আর আপনার উপর দায়িত্ব পড়েছিল। নানা কাজের চাপে দিশাকে বলতে পারছিলাম না। আজ আমরা সবাই এখানে আছি। আমার মনে হলো, সবার সামনে দিশাকে কথাটা বললে ভালো হবে।

তিশা চঞ্চল কণ্ঠে বলল, তা মা, কী কথা! বলে ফেল না!

দিশা একদৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। সে কিছু আন্দাজ করতে পারছে, আবার পারছেও না। তার চোখেমুখে দোলাচাল।

সুদীপা বললেন, আমি তোর বিয়ের কথা বলছি দিশা। ডিগ্রিটা হয়ে গেছে তোর। বর্তমানের রীতিতে তোর বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। আমরা তোর বিয়ের ব্যবস্থা করছি।

আর একটু পরে করলে হতো না ? আমার এমএসসিটা!

মুকুন্দবাবু উৎসাহের গলায় বললেন, তোর পড়াশোনাটা থেমে যাবে না মা। এমএসসিটা কমপ্লিট করতে পারার ব্যবস্থা নেব আমি।

তার পরও বাবা…। কথা শেষ না করে মাথা নিচু করল দিশা।

মীরা পিসির খুশির অন্ত নেই। তিনি বলে উঠলেন, তুমি না কোরো না দিশা। তোমার বাবার কাছে একটা ভালো ছেলের সন্ধান আছে। তুমি রাজি হলে তোমার বাবা ছেলেপক্ষের সঙ্গে কথা ফাইনাল করবে।

পিসি তিশাকে তুই করে বললেও দিশাকে তুমি বলে। তিশার চেয়ে দিশা গম্ভীর, শান্ত।

দিশা চুপ করে থাকে। জবাব দেয় না। তবে তার চোখমুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে, নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলে যাচ্ছে সে। কোনও একটা সিদ্ধান্তের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে যেন! আস্তে আস্তে তার চোখমুখ স্থির হয়ে এল। শান্ত চোখে বাবার দিকে তাকাল দিশা।

মৃদু কণ্ঠে বলল, আমি একজনকে পছন্দ করি বাবা। সেও আমাকে ভালোবাসে। আমাকে বিয়ে করতে আপত্তি নেই তার। ডাক্তার সে। সরকারি চাকরির চেষ্টা করে যাচ্ছে। এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে গেল দিশা।

অদ্ভুত চোখে দিশার দিকে তাকিয়ে আছেন মুকুন্দবাবু। কী বলবেন স্থির করতে পারছেন না। তিশার চোখেমুখে বাহবার আভা। তার বলতে খুব ইচ্ছে করল, সাবাশ দিদি! নিজের মনের কথা খুলে বলতে পারলি তুই! সুদীপার চোখ ছানাবড়া। মুখের ভাত চিবোতে ভুলে গেলেন তিনি।

শুধু মীরা পিসি ধীর-স্থির। তাঁর মুখে বিরক্তি বা বিহ্বলতার চিহ্ন নেই। ব্যাপারটাকে হালকা করবার জন্য মীরা পিসি দ্রুত বলে উঠলেন, তা বেশ দিশা। ছেলে যদি ভালো হয়, পরিবার যদি বনেদি হয়, সর্বোপরি তোমার পছন্দের হয়, মুকুন্দের আপত্তি থাকার কথা নয়। মেয়ের পছন্দের ব্যাপারটিকে অবশ্য গুরুত্ব দেবে ভাইপো। কী বাবা, গুরুত্ব দিবি না ?

পিসির প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো মনের অবস্থা এখনও হয়ে উঠেনি মুকুন্দ বাবুর। ভেতরটা অশান্ত। চোখমুখ কঠিন। তাঁর মেয়ে প্রেম করেছে! তাও কার না কার সঙ্গে! গত পরশু তিমির সেনের সঙ্গে তাঁর মোটামুটি কথা হয়ে গেছে। তিমিরবাবুর ছেলে বাবার বিরাট ব্যবসা সামলায়। বেশ কটি বাড়ি, এই শহরে, তিমিরবাবুর। ছেলেটা দেখতে রাজপুত্তুর। তাঁর জবানের কী হবে ? তিমিরবাবুকে কী বলবেন তিনি ? বলবেন, মেয়ে প্রেম করেছে একজনের সঙ্গে! তার সঙ্গেই মেয়ের বিয়ে দিতে হবে আমায়! আমাকে মাফ করবেন তিমিরবাবু! ছি ছি ছি! মুখ লুকাবেন কোথায় তিনি! ঘৃণা-বিরক্তি-হতাশা মুকুন্দ মুহুরির চোখেমুখে মাখামাখি।

ভাইপোর মনের আলোড়নটা বুঝতে পারলেন পিসি। চটজলদি বললেন, তা ছেলের নাম কী ?

ব্রজেন। ব্রজেন ডায়াস।

ডায়াস! ডায়াস মানে কী! প্রায় চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলেন সুদীপা সেন।

ও খ্রিস্টান মা। আকাঁপা গলায় বলল দিশা।

ভিরমি খেলেন পিসি। অদ্ভুতুড়ে ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, খিরিস্টান!

হ্যাঁ দিদিমা। ব্রজেনের মা খ্রিস্টান। বাবা জেলে। বলল দিশা।

সুদীপা আহত কণ্ঠে বললেন, এসব কী বলছিস তুই!

দিশা নিজের মধ্যে বেশ একটা শক্তি অনুভব করল। ভয় না পাওয়ার শক্তি। এরকম করে কথা বলবে বলে আগেই স্থির করে রেখেছিল দিশা, তা কিন্তু নয়। এই মুহূর্তে তার মুখ দিয়ে এরকম কথা বের হচ্ছে কেন, কে জানে।

স্পষ্ট গলায় দিশা বলল, ব্রজেনের মায়ের নাম সুশীলা গনজালভেজ, বাবা ননীগোপাল দাস। ননী গোপালবাবুর বাবা পরিমল দাস কর্ণফুলীতে মাছ ধরতেন। একটু থামল দিশা। তারপর বাবার দিকে তাকাল। বলল, ব্রজেন বড় ভালো ছেলে বাবা। ওর সঙ্গে আমার বিয়ে দিলে আমি সুখী হব বাবা।

এই সময় চোখ কুঁচকে গলায় রাজ্যের ঘৃণা ঢেলে সুদীপা বললেন, অপূর্ব কম্বিনেশন। জেলে-খিরিস্টান! তার সঙ্গে মুহুরিবাড়ির মেয়ে! বলতে বলতে সুদীপার কণ্ঠ বাষ্পাচ্ছন্ন হয়ে এল।

কভি নেহি। নেভার। কখনও না। টেবিলে প্রচণ্ড এক ঘুষি মেরে দাঁড়িয়ে পড়লেন মুকুন্দ মুহুরি। আমার প্রাণ যাবে, তবুও এ বিয়ে হতে দেব না আমি। আমি জাত খোয়াব ? খিরিস্টানির বেহাই হব ? জাইল্যার ঘরে মেয়ে দেব ? বলতে বলতে কণ্ঠ বুজে এল মুকুন্দবাবুর।

দ্রুত পায়ে এঁটো হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন মুকুন্দবাবু। সুদীপা সেনও চলে গেলেন। বসে থাকলেন মীরা দিদিমা। সামনে দিশা-তিশা। নিশা ভেবাচেকা। খ্রিস্টান, জেলে, বনেদি, ডায়াস―এসব ভালো করে বুঝে উঠতে পারছে না সে। তবে ব্যাপারটার মধ্যে যে বেশ মজা আছে, বুঝতে পারছে। রহস্য রহস্য, রাগ-অনুরাগ। প্রেম-পছন্দ। ভাবতে বেশ মজা পাচ্ছে তিশা। খাওয়া শেষ হবার পরও তাই সে রয়ে গেল। তার জানার আগ্রহ প্রবল।

ব্যাপারটা তুমি যত সহজ ভাবছ, আদতে তা ওরকম নয় দিশা। বড় জটিল। ছেলেটি গরিব হলে কোনও অসুবিধা ছিল না। তোমার মা-বাবাকে বোঝাতাম। কিন্তু ব্যাপারটা যে ঘোরালো! জাতপাতের ব্যাপার। তাও দে, সরকার, পাল, হালদার হলেও কথা ছিল। একেবারে খিরিস্টান। সেখানেই শেষ নয়, সঙ্গে জেলেও আছে। দিদিমার কণ্ঠে উদ্বেগ।

ব্রজেনকেই বিয়ে করব আমি। ওকে বিয়ে করা ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই দিদিমা। বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল দিশা।

মীরা দিদিমা আহত গলায় বললেন, তুমি আর একবার ভেবে দেখ দিশা। তোমার মা-বাবাকে কষ্ট দিয়ো না। তোমার ছোট আরেক বোন আছে। তুমি যদি বেজাতে বিয়ে কর, এই বোনটি অচল হয়ে যাবে। তিশার দিকে ইঙ্গিত করে কথা শেষ করলেন দিদিমা।

আমার ওই এককথা দিদিমা। ব্রজেনকেই বিয়ে করব আমি।

তোমার মা-বাবা যে ব্রজেনকে মানবে না!

আমি নিরুপায়। তাহলে আমাকে অন্য পথ বেছে নিতে হবে।

অন্য পথ! কী পথ! কী পথ বেছে নিবি তুই! দিশা হারালেন মীরা দিদিমা। তুমি থেকে তুই-তে নামলেন।

দিশা কোনও উত্তর দিল না। এক পা দুই পা করে মুখ ধোয়ার বেসিনের দিকে এগিয়ে গেল।

মুখধোয়া শেষ করে ডাইনিংরুমের বাইরে পা রাখবার আগে ঘুরে দাঁড়াল দিশা। কঠোর কণ্ঠে বলল, সেই পথ সম্পর্কে তোমরা নাই-বা জানলে।

মীরা পিসি হতভম্ব হয়ে গেলেন। এই বাড়িতে এসেছেন অবধি দেখে আসছেন, মুকুন্দের এই মেয়েটি বড়ই বাধ্য। কথা বলে কম। নিতান্ত নিরীহ গোবেচারি ধরনের। বাবা-মার সঙ্গে কখনও কোনওদিন তর্কে জড়িয়েছে বলে মনে পড়ে না। কোনও হইচইয়ে নেই। নিজের ঘরেই থাকতে ভালোবাসে। আজ কী হলো এই মেয়েটির ? বাপের চোখের সামনে চেটাং চেটাং কথা বলে গেল! মায়ের মুখে মুখে তর্ক! গলাটা একবারের জন্যও কাঁপল না তার! এত সাহস পেল কোত্থেকে মেয়েটি! নিশ্চয়ই ব্রজেন না টজেন নামের ওই খিরিস্টান ছেলেটিই মাথা গুলিয়ে দিয়েছে দিশার। শুনে তো মনে হলো হাভাইত্যার ঘরের ছেলে! জাইল্যার পোলা আর কতটুকু ভালো হবে! লোভী লোভী! মুকুন্দের ধনসম্পদের কথা তো এই শহরের কারও অজানা নয়! নিশ্চয়ই সম্পত্তির লোভে পেয়ে বসেছে ওই খিরিস্টানটাকে। তার মূল উদ্দেশ্য তো দিশাকে বিয়ে করা নয়, মুকুন্দের ঘরবাড়ি-সম্পদ হাতিয়ে নেওয়া। না, এ কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না। দরকার হলে জোর করে বিয়ে দিতে হবে ওর। নইলে যে মান যাবে, জাত যাবে, বংশকৌলীন্য যাবে! কালকেই সুদীপা আর মুকুন্দের সঙ্গে এ ব্যাপারে সিরিয়াস আলোচনা করতে হবে। রাম রাম রাম!

রাত গভীর। দূর থেকে কুকুরের ডাক ভেসে আসছে। রাস্তার বাতিগুলোও যেন আলো ছড়াতে ছড়াতে ঝিমিয়ে পড়েছে। জানালা খোলা। বাতাসে মৃদু ঠাণ্ডার ছোঁয়া। সেই ঠাণ্ডাছোঁয়া বাতাস দিশার চোখেমুখে এসে লাগছে।

দ্বিতীয় তলার দক্ষিণ পাশ ঘেঁষে দিশার রুমটি। দিশা ঘুমায়নি। বাতি নিবিয়ে বিছানায় বসে বাইরে তাকিয়ে আছে সে।

বার বার ব্রজেনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে তার। টিউটোরিয়াল হোমের পরিচয়ের পর ওদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে। এখানে ওখানে দেখাও করেছে তারা। ব্রজেনের সঙ্গে দেখা করবার জন্য বারবার মেডিকেলে গেছে দিশা। একসময় সে উপলব্ধি করেছে, ব্রজেন তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাবা মারা গেছে ব্রজেনের। মাকে নিয়ে কলাবাগিচার ঘিঞ্জি এলাকা থেকে বেরিয়ে এসে চন্দনপুরায় বাসা নিয়েছে। সুশীলা ডায়াসের বয়স হয়ে গেছে। তার পরও চাকরিটা ছাড়েনি।

ব্রজেন অনেকবার বলেছে, মা, তুমি চাকরিটা ছেড়ে দাও। এখানে ওখানে টুকটাক যা আয় করছি, দুজনের চলে যাবে।

মুখ উজ্জ্বল করে সুশীলা বলেছে, তুই আগে চাকরিটা পেয়ে নে বাপ। তারপর চাকরিটা ছেড়ে দেব আমি। ঘরে বউ আসবে। নাতি-নাতনি নিয়ে আনন্দের দিনগুলি কেটে যাবে আমার।

ব্রজেন কথা বাড়ায়নি।

ব্রজেনের বাসাবাড়িটা চিনে দিশা। ব্রজেনের মা থাকে না যখন, তখন যায়। দোতলার নির্জন বাসায় মুখোমুখি অনেকটা সময় পার করে ওরা।

গত পরশু একই রকমভাবে সামনাসামনি বসেছিল দিশা আর ব্রজেন।

কী হয়েছিল কে জানে, ব্রজেন ডান হাতটা আচমকা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। দিশা নিজেকে ধরে রাখেনি। ব্রজেনের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়েছিল।

ঝাপটে বুকের কাছে টেনে নিয়েছিল ব্রজেন। দিশার বুকের তলায় ঝড় উঠেছিল। এই ঝড় তাকে উন্মুখ করেছিল, স্পন্দিতও। বিছানায় এলিয়ে পড়েছিল দিশা। তার ঠোঁট বরাবর ব্রজেনের লালাযুক্ত লালায়িত ওষ্ঠাধর নেমে এসেছিল। তারপর উন্মাতাল সুরভিত উদ্দাম উতরোল বিছানায়, দুজনের দেহ-মনে।

কী লজ্জা! কী লজ্জা! নিজের অজান্তে অধরে আঙুল ছোঁয়াল দিশা। স্তন দুটোর বোঁটা শক্ত হয়ে উঠেছে ততক্ষণে। দিশার মুখ দিয়ে হঠাৎ ব্রীড়াধ্বনি বেরিয়ে এল―আহ্! এ সুখের ধ্বনি, এ শীৎকার। এ শিহরণ রাখে কোথায় সে!

সহসা ঘুমিয়ে পড়ল দিশা। চোখে চিবুকে গালে তৃপ্তির আভা।

তের

পরদিন খুব ঝগড়া হয়ে গেল দিশা আর মুকুন্দ মুহুরিতে। জলখাবারের টেবিলে কথাটা শুরু হয়েছিল আবার। প্রথমে মুকুন্দবাবুর সঙ্গে দিশার। পরে পরে সবাই জড়িয়ে গেলেন। প্রথমে জিজ্ঞাসা, তারপর কথা কাটাকাটি। এরপর বিবাদ। মতান্তর থেকে মনান্তর। রাগারাগি থেকে গালাগালিতে গিয়ে ঠেকল শেষ পর্যন্ত।

তুই কী ভাবলি ?

মুকুন্দবাবু তাঁর মেয়েদের কখনও তুই করে বলেন না। আজ বললেন। গত রাতের ঘটনায় মনটা বিষিয়ে আছে মুকুন্দবাবুর। তারই বহিঃপ্রকাশ দিশাকে তুই সম্বোধনে।

দিশা বাবার প্রশ্নটা খেয়াল করেনি। আজানভোরে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল তার। আর ঘুম আসেনি। সেই সময় থেকে আনচান। সে জানে, আজ দিনটা তার জন্য শুভ নয়। তাকে ঘিরে ঝড় বইবে। মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে রাখল দিশা। এমনিতে আটটা-সাড়ে আটটা পর্যন্ত ঘুমায়। ভোরে ঘুম ভেঙেছে বলে মাথার ভেতর ঝিমঝিম। তার ওপর টেনশন। দুটোর চাপে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল দিশা। খাচ্ছিলও না। নাস্তা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল।

শুনতে পাচ্ছিস না তুই ? কী বলছি ?

বাবার ধমকে দিশার চটকা ভাঙল। ত্রস্ত চোখে বাবার দিকে তাকাল।

কী বলছিলে বাবা ? খেয়াল করিনি।

মীরা পিসি কৃত্রিম হেসে বললেন, তোমার বিয়ের বিষয়ে জানতে চাইছে বোধহয়! তাই না মুকুন্দ ?

সকালে তিনজনের মধ্যে কথা হয়েছে। তিনজন মানে মুকুন্দ মুহুরি, সুদীপা সেন আর মীরা পিসি। আলাপটা দিশার বিয়ে নিয়ে। ক্ষিপ্ত মুকুন্দ মুহুরির এককথা। এই বিয়ে কিছুতেই হতে দেবেন না তিনি। ছোটজাতের ঘরে মেয়ে বিয়ে দেবেন না। শহরে মুখ দেখাতে পারবেন না। মুহুরিবাড়ি নিয়ে সমাজে ঢিঢি পড়ে যাবে। জোর করে হলেও অন্য জায়গায় দিশার বিয়ে দেবেন। সুদীপাও স্বামীর সঙ্গে একমত। জেলে-খিরিস্টানের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে হলে গলায় দড়ি দেবেন তিনি।

মীরা পিসি বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন, তোমরা এরকম অবুঝ হলে তো চলবে না! যুগ পাল্টে গেছে। ছেলেমেয়ের মতামতকেও গুরুত্ব দিতে হয়।

তাই বলে অজাতের সঙ্গে বিয়ে! কী বল তুমি পিসি! ঝাঁঝিয়ে উঠেছিলেন মুকুন্দবাবু।

সুদীপাও বলেছিলেন, আপনি ওকথা বলছেন কী করে পিসি! মেয়ের গোঁয়ারামির জন্য এই শহরে একঘরে হব নাকি আমরা ? হারামজাদি পিরিত করেছে! ছেলে পায়নি আর! শেষের কথাগুলো চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করেছিলেন সুদীপা সেন।

মীরা পিসি বুঝে গিয়েছিলেন, দিশার প্রেম আর বিয়েকে কিছুতেই মেনে নেবে না মুকুন্দ-সুদীপা।

পরে নাস্তার টেবিলে আবার যখন কথা উঠল, সমস্যাটার শুভ সমাধানের আশায় মীরা পিসি আলাপে অংশ নিলেন।

বললেন, তোমার বিয়ের বিষয়ে…।

দিশা বলল, আমার কথা আমি তো কালকে বলেছি। এর বাইরে আমার কিছু বলার নেই।

এত ফাজলামি করছিস কেন তুই ? গোঁয়ার মেয়ে কোথাকার! ক্ষেপে গেলেন সুদীপা।

মীরা পিসি তৎক্ষণাৎ বলে উঠলেন, অত খেপছ কেন বউমা ? ওকে ভাববার একটু সময় দাও।

দিশা শক্ত গলায় বলল, ভাববার তো তেমন কিছু নেই দিদিমা! বলেছি, যদি বিয়ে করতে হয়, ব্রজেনকেই করব।

না হলে ? আবার ধমকে উঠলেন সুদীপা।

না হলে বিয়ে করব না মা। দিশার শান্ত কণ্ঠ।

এতক্ষণ চুপ করে থাকা মুকুন্দবাবু বলে উঠলেন, বিয়ে তোকে করতেই হবে এবং আমার পছন্দের ছেলের সঙ্গেই বিয়ে হবে তোর। ওই খেরেস্টানটার সঙ্গে নয়।

আমি নিরুপায় বাবা! ঘাড় নেড়ে বলল দিশা।

সুদীপা হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, নিরুপায় মানে! নিরুপায় মানে কী! এরকম হাজার লক্ষ ছেলেমেয়ে প্রেম করছে। সবাই বিয়ে করছে নাকি ?

আমাকে করতে হবে মা। ব্রজেনকে আমার বিয়ে করতেই হবে। ব্রজেনের সঙ্গে যে তার দেহের সম্মিলন ঘটে গেছে, তা বলতে পারছে না দিশা। ব্রজেনকে গভীরভাবে ভালোবাসে সে। মা-বাবার চাপে সে কিছুতেই তার প্রেমকে অপবিত্র করতে পারবে না। ব্রজেনের সোহাগস্নিগ্ধ দেহটাকে অন্যপুরুষের হাতে তুলে দেয় কী করে সে ?

দিশা চেয়ার ছেড়ে উঠতে চাইল।

মুকুন্দবাবু গর্জন করে উঠলেন, বস। তারপর নিজেকে সংযত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেলেন তিনি। পারলেন না। চোখ রাঙিয়ে বললেন, শোন, আগামী দশদিনের মধ্যে বিয়ে হবে তোর। তিমির বাবুর ছেলের সঙ্গেই হবে। তিমিরবাবুর সঙ্গে দেখা করতে বেরোচ্ছি আমি। আজ থেকে তোর বাইরে যাওয়া নিষেধ করলাম আমি।

ঝট করে চেয়ার থেকে উঠে পড়লেন মুকুন্দ মুহুরি। ভারী চেয়ারটা আওয়াজ তুলে মেঝেতে ধুম করে পড়ে গেল। সবাই আঁতকে উঠলেন। মুকুন্দবাবুর এরকম রুদ্রমূর্তি আগে এবাড়ির কেউ দেখেননি।

যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লে অনেকটা চুপিসারে দিশা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল। সেদিন ব্রজেনের মাকেও পেয়ে গেল বাসায়।

লাজ ত্যাগ করে সকল কথা খুলে বলল ব্রজেনের মাকে। জাতপাতের কথাটা বেশি করে তুলে ধরল। শেষে ব্রজেনের দিকে তাকিয়ে দিশা জিজ্ঞেস করল, এখন আমি কী করব ?

ব্রজেন কোনও উত্তর না দিয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকালো।

ফাঁপড়ে-পড়া মুখ তখন সুশীলার। এই শহরে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছে সুশীলা। শহরের গণ্যমান্য লোকদের অনেকের নাম তার জানা। মুকুন্দ মুহুরি এই শহরের শুধু ধনী মানুষ নন, নামকরা আইনজীবীও। তাঁর নাম সুশীলার অজানা নয়। সে এও জানে, মুকুন্দ বাবুর মতো জাঁদরেল উকিল আইনের ফাঁদে ফেলে তাদের সর্বনাশ করার ক্ষমতা রাখেন। একদিকে ছেলের ভালোবাসা, অন্যদিকে মহাবিপদের আশঙ্কা―কোনটাকে গুরুত্ব দেবে সে ? নিরুপায় চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কোনও উপায় থাকল না সুশীলার।

মাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে ব্রজেন বলল, মা, তুমি কিছু বলছ না যে! প্লিজ মা, কিছু একটা বল তুমি! কী করব আমরা, পথ দেখাও মা।

সুশীলা অত্যন্ত শান্ত সমাহিত কণ্ঠে বলল, তুমি যা ভেবেছ, তাই কর দিশা। বলে আস্তে করে সেখান থেকে উঠে গেল।

বিকেলের চা-টা করছিলেন সুদীপা সেন। বিকেলের জলখাবারটা লক্ষ্মীই করে। আজ হঠাৎ সুদীপার করতে ইচ্ছে করল। বহুদিন পিঁয়াজু খাওয়া হয়নি এ বাড়িতে। দুপুরে লক্ষ্মীকে ডালটা পিষে রাখতে বলেছিলেন। পিঁয়াজ, ধনেপাতা, কাঁচামরিচ, মশলাগুড়া, লবণ, সামান্য হলুদের ছিটা দিয়ে কাঁইটা বানিয়ে ফেলেছেন সুদীপা। মনে মনে ভেবে রেখেছেন, আজ বিকেলের নাস্তা হবে পিঁয়াজু, পাপড়, সঙ্গে মুড়ি।

তেলটা কড়াইতে ঢেলেছেন মাত্র, আচমকা কে যেন পেছন থেকে তাঁকে জড়িয়ে ধরল!

ভয় পেলেন সুদীপা। গ্রামে জন্ম, গ্রামে বড় হওয়া। মাধ্যমিকটাও গ্রামের স্কুল থেকে পাস করা। উচ্চ মাধ্যমিক পড়েছেন শহরের চট্টগ্রাম মহিলা কলেজে। পাহাড়ের খাঁজে কলেজটি। মূল শহরের একটু বাইরে। গাছ-গাছড়ায় ভর্তি কলেজ এবং কলেজের আশপাশটা। হোস্টেলে থাকতেন। প্রীতিলতা হলটা একটেরে। সন্ধ্যা হলেই গা ছমছম। রুমমেট ছিল বিমলা। তার ছিল ভূতের ভয়। রাত গভীরে বানিয়ে বানিয়ে ভূতের গল্প বলত। বড় জানালার ধারে দাঁড়িয়ে জঙ্গুলে টিলার দিকে আঙুল তুলে ফিসফিসিয়ে বলত, দেখ, দেখ সুদীপা। ওই শ্যাওড়া গাছটার নিচে দেখতে পাচ্ছিস ? আরে দেখছিস না, সাদা কাপড় পরা ভূতটাকে ? ওই লম্বা লম্বা পা ফেলে গাছে উঠতে চাইছে! মাথা নেই কিন্তু ওর। ওরা কবন্ধ। ভেরি ডেঞ্জারাস।

মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম হতো সুদীপার। দ্রুত বিছানায় এসে নাকেমুখে কম্বল চাপা দিত। আর তারস্বরে চিৎকার করত, জানালা বন্ধ কর বিমলা। তোর পায়ে পড়ি, জানালা বন্ধ কর।

একসময় বিমলা পাগল হয়ে গিয়েছিল। তা মা-বাবা তাকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। ভূত বলে আদতে কিছু নেই, জেনেছে সুদীপা। তার পরও এত বয়স হলো তার, ভূতের ভয়টি গেল না।

একমনে রান্নাঘরে কাজ করে যাচ্ছিলেন। মাঝে মাঝে মনটা যে ছটফট করে উঠছিল না, তা নয়। গত রাতে দিশার বদ আচরণ, সকালের অবাধ্যতা বার বার মনে পড়ে যাচ্ছিল সুদীপার। একাগ্রতা আর মনে বিচ্ছিন্নতার টানাপড়েনের সময়টাতে ধুম করে কে যেন জড়িয়ে ধরল তাকে, আচমকা!

প্রথমেই দিশার বাবার কথা মনে এসেছিল সুদীপার। তাঁর স্বামীটি এই পড়ন্ত বিকেলে জড়িয়ে ধরলেন না তো! মনটা ছি ছি করে উঠল। ধুর! দিশার বাপ এই কাজ করতে যাবেন কেন ? ঘরভর্তি মেয়েরা, ঝিরা, পিসি! এঁদের মাঝখানে স্বামী তাঁর এরকম অসভ্যতা করতে যাবেন কেন ? হ্যাঁ, বিকেলটা একসঙ্গে শয্যায় কাটান তাঁরা। আদর-সোহাগও উছলে ওঠে কখনওসখনো। কিন্তু সেটা তো একান্ত নিজেদের ঘরে, বিছানায়। তাছাড়া আজ দুপুরে খাবারটেবিলে তিনি তো বলেছেনই, বিকেলে সবাইকে নিজ হাতে পিঁয়াজু বানিয়ে খাওয়াবেন। তিনি যে বিকেলে রান্নাঘরে থাকবেন, ইঙ্গিতে বলেছেন তো দিশার বাপকে! তাহলে এখন এই মুহূর্তে এরকম  করে কে ঝাপটে ধরল পেছন থেকে ? দ্রুত ভেবে গেলেন সুদীপা সেন।

একঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পেছন ফিরলেন তিনি। নিজের বুকে থু থু ছিটিয়ে বললেন, উ! তুমি ?

হ্যাঁ মা, আমি। বলে মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল দিশা।

আড়ষ্ট হয়ে গেলেন সুদীপা। নিজেকে দিশার বাঁধন থেকে ছাড়িয়ে নিতে মৃদু চেষ্টা করলেন।

দিশা সোহাগী কণ্ঠে বলল, আমি তোমায় ছাড়ব না মা। তারপর মায়ের বুকে মুখ রেখে জোরে একটা শ্বাস টানল দিশা। বলল, তোমার বুকে যা মিষ্টি গন্ধ না মা! এই গন্ধটা আমি বহুদিন পাইনি মা। বহুদিন তুমি আমাকে বুকে জড়াওনি মা। বলতে বলতে কেঁদে দিল দিশা। ওই অবস্থাতেই বলল, তুমি যতই আমাকে দূরে ঠেলে দাও না মা, আমি কিন্তু তোমাকে ছাড়ব না মা। তোমাকে কিছুতেই ছাড়ব…। কান্নার দমকে আর কথা বলতে পারল না দিশা।

সুদীপার মাতৃহৃদয়টা উদ্বেলিত হয়ে উঠল। চোখের জল ধরে রাখা তাঁর পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়াল। মেয়েকে নিয়ে পাশের টুলে বসলেন তিনি।

করুণ কণ্ঠে বললেন, তুই তোর বাপকে চিনিস মা। একগুঁয়ে। যা বলে ফেলে, জান গেলেও সেই কথা  থেকে সরে আসে না। তুই ব্রজেনকে ভুলে যা মা। আমাদের কথা মেনে নে।

মা, আমি যদি বলি, তুমি বাবাকে ভুলে যাও, ভুলতে পারবে ?

তা কী করে হয়! আঁতকে বলেন সুদীপা।

হয় না এই জন্য যে তুমি বাবাকে ভালোবাস। মানি, তুমি বাবাকে ভালোবেসে বিয়ে করনি। তোমাদের বিয়েটা অ্যারেঞ্জ বিয়ে ছিল। সংসার করতে করতে বাবাকে তুমি গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলেছ।

তুইও সংসার করতে করতে তিমিরবাবুর ছেলে সমীরকে ভালোবাসবি।

তা হবে না মা। ওই ভালোবাসা আসল হবে না। কৃত্রিম হবে। ব্রজেনের ভালোবাসা ওই ভালোবাসার মাঝখানে ভিলেন হয়ে দাঁড়াবে। বিয়ের আগে তোমার কোনও প্রেম ছিল না। বিয়ের পরে বাবাকে ভালোবাসতে  তোমার মনে কোনও দ্বিধা থাকেনি। আমার মনে যে হাজারো দ্বিধা মা। ব্রজেনকে ছাড়া স্বামী হিসেবে আর কাউকে ভাবতেই পারি না।

তাহলে কী করবি ? তোর বাবা খ্রিস্টানজাতের ওই ছেলেকে কিছুতেই মেনে নেবে না। ম্রিয়মান কণ্ঠে বললেন সুদীপা।

কী করব, বুঝতে পারছি না মা। মা নাকি সন্তানের শেষ আশ্রয়স্থল। নিরুপায় হয়ে তোমার কাছে এসেছি মা। আমাকে একটা পথ দেখাও।

হু হু করে কেঁদে উঠলেন সুদীপা। দিশার জন্য তাঁর বুকের তলায় যে ক্রোধ জমাট বেঁধে ছিল, তা চোখের জলে ধুয়ে যেতে লাগল।

অনেকক্ষণ কাঁদলেন তিনি। দিশাকে নিজের বুকের একেবারে কাছে টেনে নিলেন। গাঢ় কণ্ঠে বললেন, শান্তনু নামে এক ছেলেকে ভালোবাসতাম আমি। হাই স্কুলে একসঙ্গে পড়তাম। সেই ভালোবাসার কথা মুখ ফুটে কাউকে বলতে পারিনি কোনওদিন। মা-বাবা মুকুন্দ মুহুরির সঙ্গে বিয়ে ঠিক করলে প্রতিবাদ করতে পারিনি। নীরবে সংসার করতে এসেছি। আজ সেই শান্তনু কোথায় কে জানে ? গভীর নিবিড় একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল সুদীপার বুক চিড়ে।

দিশা ত্বরিত বলে উঠল, আমি আমার ব্রজেনকে হারিয়ে যেতে দেব না মা। তুমি শান্তনুকে হারিয়ে যে কষ্ট পাচ্ছ, আমি সেই কষ্ট পেতে রাজি নই মা। তুমি আমাকে আশীর্বাদ কর মা। বলে মায়ের দুই পা স্পর্শ করে হঠাৎ প্রণাম করে বসল দিশা।

সুদীপার চোখের জল তখনও শুকায়নি।

চৌদ্দ

দুদিন পর মুহুরিবাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল দিশা। এই দুদিন নিজের ঘর থেকে বের হয়নি তেমন। খিল তুলে রেখেছিল। খাবারের সময় নিচে নেমেছিল। নাকেমুখে দু’এক গ্রাস গুঁজে দিয়ে নিজ-ঘরে উঠে গিয়েছিল।

এই দু’দিন, দু’রাত নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে গিয়েছিল দিশা। নিভৃত মুহূর্তে দুঃখ-অস্থিরতা তাকে ঘিরে ধরেছিল। তার বেদনার শেকড় কোথায়, হদিস নেওয়ার চেষ্টা করে গেছে দিশা। তার প্রেম, না বাবার একগুঁয়ে সিদ্ধান্ত―কোনটা তার জীবনে ঝড় তুলেছে ? ব্রজেন, না বাবা ? তার প্রেম, না সমাজের কুটিলজটিল প্রথা-বিশ্বাস ?

একটা সময়ে স্থির হয়ে এসেছিল তার মন। সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ব্রজেনের কাছে চলে যাবে সে। আত্মহত্যার কথাও যে ভাবেনি, তা নয়। মুহূর্তেই সেই ভাবনা থেকে সরে এসেছে দিশা। আত্মহত্যা করবার মতো সাহস তার নেই। তাছাড়া আত্মহত্যা করবেই-বা কেন ? ব্রজেনকে ভালোবেসে সে তো কোনও অপরাধ করেনি। অপরাধ না করে কেন মৃত্যুর মতো শাস্তিকে প্রশ্রয় দেবে সে ?

প্রত্যুষে জেগে গিয়েছিল দিশা। রাতেই ছোট একটা হাতব্যাগে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি গুছিয়ে নিয়েছিল। হাতমুখ ধুয়ে শাড়ি পরেছিল। দিশা শাড়ি পরে না, সালোয়ার-কামিজ পরে। আজ সকালে হলুদে-সবুজে মেশানো শাড়ি পরেছিল। কপালে হলদে টিপ লাগিয়েছিল। খোলা চুলে ক্লিপ দিয়েছিল। বড় মিষ্টি লাগছিল দিশাকে। পায়ে জুতো গলিয়ে নিচে নেমে এসেছিল।

দিশা জানে, এই সময়টাতে মা-বাবা ঘুমিয়ে থাকেন। মীরা দিদিমা স্নান ঘরে। তিশা উপুড় হয়ে শুয়ে মাথার ওপর বালিশচাপা দিয়ে বিছানায়। ওরকম করেই শোয় তিশা। হরিপদদা বাজারে। শুধু দারোয়ান থাকবে গেটে।

ধীর পায়ে গেট পর্যন্ত হেঁটে গেল দিশা। পেছন ফিরে বাড়িটার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল। দীর্ঘ একটা শ্বাস বেরিয়ে এল দিশার বুক ফেড়ে। চোখ নামিয়ে নিল দিশা। পকেট-গেটের দিকে পা বাড়াল।

মতিলাল তখন বেদিশে। এরকম সময়ে বড়দিদিমণি তো কখনও দোতলা থেকে নামেন না! এরকম করে শাড়ি পরে কোথায় যাচ্ছেন তিনি! তাও আবার ব্যাগ হাতে! এরকম চেহারা কেন দিশা দিদিমণির! কাঁদো কাঁদো! মলিন!

অতি ভোরে যদি এ বাড়ির কাউকে বেরোতে হয়, কর্তা বা গিন্নিমা রাতের বেলা বলে দেন, মতিলাল, কাল বড়বাবু ভোরে ভোরে বেরোবেন। সকালের ট্রেন। তাড়াতাড়ি গেট খোল। কিন্তু গত রাতে তো সেরকম কিছু বলেননি কেউ, তাকে!

মতিলালের ওরকম ভাবনার মধ্যেই পকেট গেটটা পেরিয়ে গেল দিশা। মতিলাল চুপ থাকতে পারল না। বিনীত গলায় বলল, কোথাও যাচ্ছেন দিদিমণি ? এই সাতসকালে ?

দিশা পেছন ফিরে মিষ্টি হেসে বলল, আমি গেলাম মতিলালদা।

একটা রিকশা এসে থামল গেটে। দিশা উঠে বসল। রিকশাওয়ালা হুড তুলে দিলে। সামনের দিকে এগিয়ে গেল রিকশাটা।

সামনে চিরকুটটি নিয়ে বসে আছেন মুকুন্দবাবু। মুখ আঁধার। ছন্নছাড়া দৃষ্টি। ডান হাতটা টেবিলে ছড়ানো। হাতের পাশে কাগজের টুকরাটি। তাতে দিশার হাতেলেখা কয়েকটি পঙ্ক্তি।

ব্রেকফাস্টের জন্য ডাইনিং টেবিলে সবাই চলে এসেছিল যথাসময়ে। টেবিলে লুচি, আলুভাজি, ডিমপোচ, পাউরুটি, জেলি, কলা, আঙুর, পেঁপে, কমলা সুন্দর করে সাজানো। যার যার রুচি মতন তুলে নেবেন প্লেটে।

মুকুন্দবাবু বলেন, সবাইকে দেখছি, দিশা এল না যে! বুকের তলায় যত কষ্টই জমে থাকুক না কেন, যতই ক্ষোভ-অভিযোগ থাকুক না কেন দিশার বিরুদ্ধে, সকালের নাস্তাটা তাকে ছাড়া খান কী করে!

সুদীপা বললেন, আছে নিশ্চয়ই ওপরে। ঘুম থেকে হয়তো দেরিতে উঠেছে। আস্তে-ধীরে নামবে। ও একটু পরে খেলে অসুবিধা নেই। আমরা শুরু করি।

তিশা বলে উঠল, মা, গত কদিন ধরে দিদিকে খুব মনমরা দেখছি। আপনমনে কীসব বিড়বিড় করে। গতরাতে বহুক্ষণ ওর ঘরে বাতি জ্বলতে দেখেছি। আমি যাই মা, দিশাদিকে ডেকে  আনি! তিশা অত ছোট নয় যে বাড়ির টালমাটাল অবস্থাটা বুঝতে পারছে না। দিদির প্রেমের ব্যাপারটা নিয়ে বাড়িতে যে বেশ একটা জটিল অবস্থা তৈরি হয়েছে, স্পষ্ট বুঝতে পারছে তিশা।

মুকুন্দবাবু বললেন, তোমার যাওয়ার দরকার নেই। ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, মালতি, তুমি যাও। দিশাকে তার ঘর থেকে ডেকে আন।

মালতি এসে বলল, বড়দিদি ঘরে নেই।

সুদীপা বললেন, বাথরুমটা দেখেছ ?

বাথরুম, বারান্দা―সবটা দেখেছি বউদিমণি।

ছাদটা ? ছাদটা দেখেছিলে ?

মাঝে মাঝে বাগানে একা একা হাঁটে দিশা। পাশে বসা পিসি বলে উঠলেন।

মালতি কাঁচুমাচু মুখ করে বলে, না, ছাদটা দেখিনি। যাচ্ছি।

তিশা দ্রুত বলল, তোমাকে যেতে হবে না মালতি মাসি। আমি যাচ্ছি। বলে একঝটকায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। দুদ্দাড় সিঁড়ি ভেঙে ছাদে উঠে গেল তিশা।

যে গতিতে গিয়েছিল, সে গতিতে ফিরে এসে বলল, দিদি ছাদে নেই। আনাচকানাচটা খুঁজে দেখেছি। পানির ট্যাংকের পাশেও। ছাদ থেকে নিচের বাগানটাতে চোখ বুলিয়েছি। কোথাও নেই দিদি।

কী! কী বলছিস! তড়াক করে দাঁড়াতে গেলেন মুকুন্দবাবু। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল তাঁর। ঝট করে টেবিলের কোনাটা আঁকড়ে ধরলেন। স্বামীর টেবিলের কোনাটা আঁকড়ে ধরার ব্যাপারটা চোখ এড়ালো না সুদীপা সেনের। তাঁরও হঠাৎ অস্থির অস্থির লাগল। বুকের তলায় কু-ডাক শুনতে পেলেন তিনি। কিন্তু এই সময় অশান্ত হলে চলবে না। নিজেকে দ্রুত বোঝালেন সুদীপা।

স্বামীকে লক্ষ্য করে বললেন, তুমি অস্থির হয়ে উঠলে কেন! বস তুমি। খাওয়া শুরু কর। আমি ওপরে যাচ্ছি।

মুকুন্দবাবু খাওয়া শুরু করলেন না। সুদীপা ওপর থেকে না নামা পর্যন্ত তিনি উচাটনে থাকলেন।

কিছুক্ষণ পর মরাপায়ে সুদীপা এলেন। তাঁর চোখমুখ শুকিয়ে কাঠ। গলা শুকিয়ে গেছে তাঁর। কথা বেরোচ্ছে না মুখ দিয়ে। নিস্তেজ হাতে একটা কাগজের টুকরা মুকুন্দবাবুর সামনে রাখলেন।

মীরা পিসি বলে উঠলেন, কী! কী ওটা!

সুদীপার জবাব দিতে ইচ্ছে করল না।

মীরা পিসি আতঙ্কিত গলায় বললেন, কিছু বলছ না কেন বউমা! দিশা কোথায় ? তাকে দেখছি না তো!

সুদীপা ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়লেন। তাঁর গলা চিড়ে বেরিয়ে এল―ও মারে!

মুকুন্দ মুহুরি তখন এক দৃষ্টিতে সামনে রাখা খোলা চিরকুটটির দিকে চেয়ে আছেন। পলক ফেলতে ভুলে গেছেন তিনি। শ্বাস কি পড়ছে তাঁর ? বোঝা যাচ্ছে না। আস্তে আস্তে কোমরটা বাঁকা হয়ে এল মুকুন্দবাবুর। চেয়ারের হেলানে নিজের শরীরটা সমর্পণ করে চোখ বন্ধ করলেন তিনি।

চিরকুটে লেখা―

বাবা,

আমি চলে যাচ্ছি। তোমরা জাগলে হইচই বাধাবে বলে খুব ভোরেই বেরিয়ে যাচ্ছি আমি। জামাই হিসেবে যে ব্রজেনকে তুমি মেনে নেবে না কোনওদিন, সেই ব্রজেনের কাছেই গেলাম। আমার জন্য ভেবো না তুমি। আমি সুখে থাকব। আমি এডাল্ট বাবা। কোনও আইনি ব্যবস্থা নিলে তুমি জয় পাবে না। মাকে দেখ বাবা।

দিশা

ধুকপুকে বুকে মীরা পিসি বললেন, কী মুকুন্দ, কী বউমা, তোমাদের দুজনের কেউই কিছু বলছ না কেন! আমাকে আর আতঙ্কে রেখ না তোমরা। কী হয়েছে, ঘটনা কী খুলে বল আমায়।

সুদীপা জলভরা চোখে মালতির দিকে তাকালেন। মালতি বুঝতে পারল, বউদি তাকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলছেন। বেরিয়ে গেল মালতি।

আকুল কান্নায় ভেঙে পড়লেন সুদীপা। আহত কণ্ঠে বললেন, দিশা এ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।

চলে গেছে! চলে গেছে মানে কী ? ও মুকুন্দ, বউমা কী বলছে এসব ?

মুকুন্দবাবুর থুতনিটা ঝুলে পড়েছে ততক্ষণে। চোখ অনেকটাই দেবে গেছে। বহু দূর থেকে ভেসে আসা কণ্ঠে মুকুন্দ মুহুরি বললেন, হ্যাঁ পিসি, হারামজাদি এই বাড়ি ছেড়ে ওই খিরিস্টানটার কাছে চলে গেছে। ওরই বয়ান লেখা আছে এখানে। বলে চিরকুটটা আস্তে করে ওপর দিকে তুলে ধরলেন।

গোটা কক্ষ জুড়ে শ্মশানের নিস্তব্ধতা নেমে এল। কারও মুখ দিয়ে কোনও কিছু বেরোল না আর। না হা-হুতাশ, না ধিক্কার। সবাই নাস্তার প্লেট সামনে নিয়ে নির্বাক নিশ্চল হয়ে বসে থাকলেন।

বহুক্ষণ পরে মুকুন্দবাবুর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, মুহুরিবাড়িতে দিশা নামের কেউ ছিল না। আজ থেকে সে এই বাড়িতে মৃত, এই বাড়িতে নিষিদ্ধ। টলোমলো পায়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।

মতিলাল, মতিলাল তো ছিল গেটে! সে বাধা দিল না কেন ? মুহুরিবাড়ির এত বড় সর্বনাশ হতে দিল কেন মতিলাল ? বিলাপের সুরে বলে গেলেন মীরা পিসি।

সুদীপার মনে হলো, সত্যিই তো! মতিলাল দিশাকে যেতে দিল কেন ? সে তো এই বাড়ি থেকে বেলা করে বের হয়নি! নিশ্চয়ই ভোরসকালে বেরিয়ে গেছে! একজন যুবতি, যে এ বাড়ির বড় মেয়ে, চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল, আর তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল মতিলাল! সে জিজ্ঞেস করল না, এত ভোরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে কেন ?

সকল দোষ মতিলালের ওপর গিয়ে পড়ল।

মতিলাল, ম-তি-লাল। হরিপদ, হরিপদবাবু। চেঁচিয়ে উঠলেন সুদীপা সেন।

অতদূর থেকে সুদীপার ডাক মতিলালের শুনতে পাওয়ার কথা নয়। শুনলও না। কিন্তু হরিপদ শুনল। সে সামনের বাগানে জল দিচ্ছিল। আর একমনে গুনগুন করে যাচ্ছিল―

হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো

পার কর আমারে!

তুমি পারের কর্তা জেনে বার্তা

তাই ডাকি তোমারে!

হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো

পার কর আমারে!

নিজের কণ্ঠস্বরে নিজেই বিভোর ছিল হরিপদ। গিন্নিমার হঠাৎ চিৎকারে আত্মমগ্ন ভাবটা কেটে গেল। হাতের মগটা রেখে দ্রুত পায়ে ডাইনিংরুমের দিকে এগিয়ে এল সে।

সামনে আসতেই আগের মতো রাগী গলায় সুদীপা বললেন, মতি কোথায় ? মতিলাল ? শিগগির তাকে ডেকে আনো।

হরিপদ খবর দিলে ত্রস্ত পায়ে হাজির হলো মতিলাল। তার চোখেমুখে উৎকণ্ঠা। সে দ্রুত ভেবে যাচ্ছে, সকাল থেকে এখন পর্যন্ত কী অন্যায় করেছে ?

সকালে তুমি গেটে ছিলে ? কর্কশ কণ্ঠ সুদীপার।

মতিলাল করুণভঙ্গিতে বলল, ছিলাম গিন্নিমা।

তোমার সামনে দিয়ে কেউ বেরিয়ে গেছে সকালে ?

হ্যাঁ গিন্নিমা। বড়দিদি হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

তোমার কাজ কী ?

আজ্ঞে, গেট খোলা, গেট বাঁধা। কোনও অপরিচিত মানুষ এলে পরিচয় জিজ্ঞাসা করা।

আর পরিচিত হলে ? এ বাড়ির যদি কেউ হয় ?

গিন্নিমার প্রশ্নে ভেবাচেকা খেয়ে গেল মতিলাল।

পরিচিত মানুষকে কী জিজ্ঞেস করবে সে! এ বাড়ির মানুষকে পরিচয় জিজ্ঞেস করবে, না কোথায় যাচ্ছেন, জানতে চাইবে!

এ তো মস্তবড় বেয়াদবি হবে! চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে তখন! গিন্নিমার কথার আগাপাছতলার কিছুই বুঝতে পারল না মতিলাল। জবাব না দিয়ে কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।

সুদীপা গর্জে উঠলেন, কী, শুনতে পাচ্ছ না মতিলাল ? জবাব দিচ্ছ না কেন ?

মতিলাল বলল, আমি আপনার কথার মানে বুঝতে পারছি না গিন্নিমা।

এত সকালে এই বাড়ির বড় মেয়েটি যে বেরিয়ে গেল, বাধা দিলে না কেন ?

এতক্ষণে মতিলাল তার অপরাধটা বুঝতে পারল। দিশাদিদিমণি সকালবেলা বেরিয়ে গেছেন বলেই গিন্নিমার এত রাগ! কিন্তু এ বাড়ির কেউ যদি বাইরে যান, সে সকালে বা সন্ধ্যায়, রাত্রে বা বিকালে, সে বাধা দেওয়ার কে ? কেন যাচ্ছেন, তা জিজ্ঞেস করারও কি কোনও অধিকার আছে তার ?

আমার কি সেই অধিকার আছে গিন্নিমা ? আমি একজন সাধারণ দারোয়ান। বাড়ির কাউকে যাতায়াতে বাধা দেওয়ার শক্তি কি আমার আছে ? শেষের দিকে মাঝবয়সী মতিলালের কণ্ঠ বুজে এল।

সুদীপা তাঁর ভুল বুঝতে পারলেন। না, বলছিলাম কী, তুমি তো দিশাকে জিজ্ঞেস করতে পারতে, এত ভোরে কোথায় যাচ্ছে ? নরম কণ্ঠে বললেন সুদীপা।

জিজ্ঞাসা করেছি গিন্নিমা। হাতে ব্যাগ দেখে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করেছি―এই সাতসকালে কোথায় যাচ্ছেন দিদিমণি ?

উত্তরে তিনি বললেন, আমি গেলাম মতিলালদা।

অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে সুদীপা বললেন, ঠিক আছে মতিলাল, তুমি যাও এখন। বলে বুকবিদীর্ণ করা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সুদীপা সেন।

পনেরো

১৬/১৭ লাভ লেনের মুহুরিবাড়িটি থেকে দিশা মুহুরির নাম মুছে গেল।

এ বাড়িতে প্রকাশ্যে কেউ দিশার নাম উচ্চারণ করে না। মুকুন্দ মুহুরি বলে দিয়েছেন, ওই নামের কেউ এ বাড়িতে ছিল, ভুলে যাওয়া তোমরা। ও নামের আমার কোনও সন্তান ছিল না। নিশা মরে আমাকে কাঁদিয়েছে, ওই মেয়েটি মরে আমার বংশের মুখে চুলকালি মেখেছে। পালিয়েছে না সে, মরেছে মরেছে মরেছে! বলতে বলতে ডুকরে উঠেছিলেন মুকুন্দ মুহুরি। নিকট আত্মীয়ের কেউ মরলে মানুষ যেভাবে কাঁদে, ঠিক ওভাবেই কেঁদে গিয়েছিলেন তিনি।

তাঁর এই ব্যাকুলতা দেখে বাড়ির সবাই ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। এর আগে এ বাড়িতে কেউ তাঁকে এরকম অস্থির হয়ে উঠতে দেখেননি। সবাই সতর্ক হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁদের মনেও কি কম ঘৃণা ? তাঁদেরও তো লজ্জার সীমা-পরিসীমা নেই! মীরা পিসি ভেবে কূল পান না, দিশা কেন এরকম কাজটি করল ? কেন তাঁর ভাইপোটিকে এরকম বেকায়দায় ফেলল দিশা ? একটা খিরিস্টান ছেলের প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে বাবার সামাজিক মর্যাদা ধুলোয় মিশিয়ে দিল! কী আছে খিরিস্টান ছোকরাটার মধ্যে ? যার জন্য মুহুরিবাড়ির চোখধাঁধানো ঐশ্বর্য ত্যাগ করে চলে গেল দিশা! এই শহরে তার বাপের মুখ তুলে কথা বলার পথটি চিরতরে বন্ধ করে দিয়ে গেল মেয়েটি। ছি ছি! রাম রাম!

সুদীপা সেন তাঁর আকুলতা, বিতৃষ্ণা নিজের মধ্যে চেপে রাখেন। এই বাড়িতে আগের মতো ঘরকন্না তিনি করে যাচ্ছেন বটে, কিন্তু তাঁর চলাফেরায়, কথাবার্তায় কীসের যেন তীব্র এক ঘাটতি! প্রাণের ঘাটতি ? উচ্ছ্বাসের খামতি ? বুঝতে পারেন না কেউ। তিনিও কি মুকুন্দবাবুর মতন ঘৃণা করেন দিশাকে ? দিশার নাম মুখে নিতে তাঁর বুক বেদনায় কেঁপে ওঠে, না বিতৃষ্ণায় রি রি করে ওঠে ? ঠিকঠাক মতো অনুধাবন করতে পারেন না সুদীপা খোদ নিজে!

তিশা নিজেকে এঁদের মধ্য থেকে, এই ঘটনা থেকে একটু দূরে দাঁড় করিয়ে সমস্ত কিছু দেখে যেতে থাকে।

মুহুরিবাড়ি থেকে দিশার নাম মুছে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গন্ধ কি মুছে দেওয়া গেছে ? যদি যায়, তাহলে মীরা পিসি ঠাকুরঘরে রাধাগোবিন্দজির সামনে হাত জোড় করে কাতরকণ্ঠে বিড় বিড় করে কেন বলেন, ঠাকুর, তুমি দিশাকে সুমতি দাও। তার কোমল মতি। ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা হয়নি এখনও ওর। অন্ধ আবেগে সে ভুলটা করে ফেলেছে। তুমি তাকে ফিরিয়ে আনো প্রভু। আমার ভাইপোর মুখের দিকে তাকাতে পারছি না আমি ঈশ্বর। মুকুন্দ আজকাল কারও সঙ্গে নিজ থেকে কথা বলে না। কিছু জিজ্ঞেস করলে হুঁ হ্যাঁ করে জবাব দেয়! জানি না, আদালতে কী অবস্থা! শুনেছি, উকিলসমাজ তাকে খুব মর্যাদা দেয়। এখন কি দেয়, কে জানে! মেয়ের পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি কি এতদিনে আর গোপন আছে ? রাষ্ট্র হয়ে গেছে। ঘরপালানো মেয়ের মা-বাপের সমাজে যে কী অমর্যাদা, সে আমি জানি ঠাকুর। জানি আমি, আজকাল আমার ভাইপোটি মাথা তুলে আদালতে কথা বলতে পারে না। আড়ালে আবডালে গোটা আদালতপাড়া যে তাকে নিয়ে ঠাট্টা-উপহাস করে! তুমি মুকুন্দকে বাঁচাও প্রভু। দিশা ফিরে এলে মুকুন্দকে বোঝাব আমি। জাঁকজমকের সঙ্গে অন্য জায়গায় তার বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করাব ঈশ্বর। মীরা পিসি এসব বলেন আর নীরবে চোখের জল ফেলেন।

দোতলায় কেউ যখন থাকে না, সুদীপা দোতলায় উঠে যান। চোরের মতো এদিক ওদিক তাকান। টুপ করে দিশার ঘরে ঢুকে পড়েন সুদীপা। জোরে শ্বাস টানেন। কীসের গন্ধ যেন বুক পূর্ণ করে টেনে নিতে চান তিনি। কীসের গন্ধ ? দিশার গন্ধ ? তার গায়ের গন্ধ ? কাপড়েচোপড়ে জড়িয়ে থাকা বড় কন্যাটির সুঘ্রাণ বুক ভরে গ্রহণ করতে চান সুদীপা ? তাই-ই তো! নইলে কেন তিনি দিশার পোশাক-আশাক শুঁকবেন! মুখে যত কথাই বলুন, বাস্তবে তাহলে দিশাকে ভুলতে পারছেন না তিনি! নইলে কেন দিশার বালিশে, বিছানায়, পড়ার টেবিলে, চেয়ারে মায়ের সোহাগমাখা হাতটি বোলাবেন তিনি ? কেন আঁচল দিয়ে ঘন ঘন চোখ মুচবেন ? তিনি কি কাঁদছেন ? কাঁদছেন নিশ্চয়ই। নইলে কেন এরকম করে তাঁর আঁচলটি ভিজে উঠবে ?

মুহুরিবাড়ি দিশার আর কোনও খোঁজ রাখল না। দিশা যে ও-বাড়িতে সাদরে গৃহীত হয়েছে, সুশীলা যে তাকে তার বুকের মধ্যিখানে টেনে নিয়েছে, খবর রাখেনি মুহুরিবাড়ি। প্রাচুর্যের জীবন থেকে বেরিয়ে গিয়ে অসচ্ছল জীবনের সঙ্গে দিশা যে দিব্যি মানিয়ে নিয়েছে, জানে না মুহুরিবাড়ি। ব্রজেন ডায়াস যে সরকারি হাসপাতালে চাকরি পেয়েছে, বান্দরবান সদর হাসপাতালে যে তার ফার্স্ট পোস্টিং হয়েছে, ডক্টরস কোয়ার্টারে যে সে সপরিবারে আনন্দের সংসার শুরু করেছে, সংবাদ রাখেনি মুকুন্দবাবুর পরিবার।

তিশাকে আঁকড়ে ধরল গোটা পরিবার। মুকুন্দ মুহুরি, সুদীপা সেন তিশাময় হয়ে গেলেন। তাঁরা বিশ্বাস করতে শুরু করলেন, তাঁদের একটাই মেয়ে, তার নাম তিশা মুহুরি।

তিশা এখন অনার্সে পড়ে। বাংলায়। দ্বিতীয় বর্ষে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রথম দিকে বাড়ি থেকে যাতায়াত করত। এখন ইউনিভার্সিটি হোস্টেলে থাকে।

ব্যাখ্যাতীত সুন্দরী। চিটাগং ইউনিভার্সিটির হার্টথ্রব বলা হয় তিশাকে। তার নাচে আর রূপে বিভোর গোটা বিশ্ববিদ্যালয়। সে যে-পথে যায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় তার পিছু পিছু ধায়।

কত যে প্রেমপত্র আসে তিশার কাছে! গ্রহণ করে সব, কোনওটার উত্তর দেয় না। অর্ধেন্দু রুদ্র লেখে, তোমাকে ছাড়া বাঁচব না তিশা।

বিভাগের সামনে রুদ্রের দেখা পেলে তিশা চোখমুখ করুণ করে বলে, আআমিও বাঁ বাঁচব না রুরু…! দিব্যেন্দু তোতলা।

ঘাবড়ে গিয়ে তিশার সামনে থেকে দ্রুত সটকে পড়ে রুদ্র।

মাহবুবুল নীল খাম পাঠায়। সঙ্গে লাল গোলাপ। মাহবুবুল হক ক্লাসের সেরা ছাত্রদের একজন। সামনের বেঞ্চে বসে। সিরাজ স্যার ক্লাসে ঢোকার আগে আগে মাহবুবের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় তিশা। গলা উঁচিয়ে সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, তোমার গোলাপে গন্ধ নেই মাহবুব। তুমি যে চিঠিতে লিখেছ― ওই মেয়েটির কাছে, সন্ধ্যাতারা আছে। কবিতার লাইনটি তোমার নাকি ? না অন্যজনের কাছ থেকে মেরে দিয়েছ ?

লজ্জায় বেঞ্চিতে মাথা নোয়ায় মাহবুব।

সিরাজ স্যার ক্লাসে ঢোকেন। তিনি মেঘদূত পড়ান। আজ পড়াচ্ছেন উত্তরমেঘ। উত্তরমেঘের ৭১ নম্বর শ্লোকটি দিয়ে শুরু করলেন সিরাজ স্যার। প্রথমে তিনি নিমীলিত চোখে মূল সংস্কৃত শ্লোকটি আবৃত্তি করেন। তারপর চোখ খুলে বাংলা অনুবাদ। বুদ্ধদেব বসুর ‘কালিদাসের মেঘদূত’ মুখস্থ তাঁর। বইটি সঙ্গে করে আনেন তিনি। খোলেন না। না খুলেই আবৃত্তি করেন―

নীবীবন্ধোচ্ছ্বসিতশিথিলং যত্র বিম্বাধরাণাং

ক্ষৌমং রাগাদনিভৃতকরেষŸাক্ষিপৎসু প্রিয়েষু।

অর্চিস্তুঙ্গানভিমুখমপি প্রাপ্য রত্নপ্রদীপান্

হ্রীমূঢ়ানাং ভবতি বিফলপ্রেরণা চূর্ণমুষ্টিঃ ॥

চোখ উন্মিলিত করেন সিরাজ স্যার। ক্লাসভর্তি ছাত্রছাত্রীদের দিকে তাকান। কণ্ঠে মধু ঢেলে বলেন―

আকুল প্রণয়ীরা আবেগভরে যেথা উচ্ছ্বসিত হাতে সহসা

নীবির বন্ধন খসিয়ে, ক’রে দেয় ক্ষৌম অংশুক স্রস্ত,

বিম্বাধরাগণ, বিমূঢ় লজ্জায়, তখনই কঙ্কুমচূর্ণ,

যদিও ছুঁড়ে দেয় দীপ্ত মণিদীপে, বিফল হয় সেই চেষ্টা।

গোটা ক্লাস অভিভূত। তিশা নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে। অনেকের উচ্চারণ শুনেছে সে, সিরাজ স্যারের মতো কেউ না। তাঁর উচ্চারণ মনোলোভা, তৃষ্ণা জাগানিয়া―চোখের পলক না ফেলে ভেবে যায় তিশা।

আবৃত্তি শেষ করে সিরাজ স্যার তখন বলছেন, তোমাদের আগেও বলেছি, বাংলা সাহিত্যের অনেকেই ‘মেঘদূত’-এর অনুবাদ করেছেন, তাঁদের মধ্যে, আমার বিবেচনায় বুদ্ধদেব বসু সেরা। এককথায় দুর্দান্ত তিনি, অসাধারণ। মজার ব্যাপার এটা যে একেবারে সাদামাঠা বাংলায় তিনি কালিদাসের শ্লোকগুলোর অনুবাদ করেননি। তাঁর হয়তো মনে হয়েছিল, তাতে ‘মেঘদূত’ অত্যন্ত খেলো হয়ে যাবে, সহজ হয়ে যাবে। এই ভেবেই হয়তো তিনি তাঁর অনুবাদে এমন এমন শব্দরাজি ব্যবহার করেছেন, যেগুলো চলতি বাংলার নয়। একটু তৎসম ঘেঁষা, একটু অপ্রচলিত অথচ ভারী শব্দ সমাহারে ‘মেঘদূত’কে বাংলায় এনেছেন তিনি।

সিরাজ স্যারের প্রতিটি শব্দ ঝরনার নুড়ি হয়ে, প্রতিটি বাক্য কবিতা হয়ে তিশার কানে এসে পৌঁছাতে লাগল।

আশপাশের ছাত্রছাত্রীরা স্যারের কথাগুলো নোট করতে ব্যস্ত। আর তিশা শুধু তাকিয়েই থাকল।

সিরাজ স্যার বলছেন, এই ৭১ নম্বর শ্লোকের অনুবাদেও বুদ্ধদেব বসু সে-রকম বেশ কিছু শব্দ ব্যবহার করেছেন। এই শব্দগুলোর চলনভঙ্গি রহস্যময়। শব্দগুলো এখানে নিস্তেজ পড়ে আছে ঠিক, যখন মুখে তুলে নিলে, অমনি বিভাময় হয়ে উঠল, ঝংকৃত হয়ে উঠল। যেন নূপুর পায়ে কোনও কিশোরী গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে নেচে নেচে যাচ্ছে।

তিশার ভেতরটা ঝরনা হয়ে গেল। সেই ঝরনায় থিরিথিরি জলের সঞ্চরণ। জলে সাঁতার কেটে কেটে এগিয়ে চলেছে নুড়ি। সেই নুড়িগুলো গায়ে গা লাগিয়ে পরস্পরের দেহসুখ মিটাচ্ছে। আর মৃদু কণ্ঠে বলছে, ভালোবাসি, ভালোবাসি তোমায় আমি।

স্যারের কথা শুনে তিশা সংবিতে ফিরে। সিরাজ স্যার তখন বলছেন, যেমন ধর নীবি, ক্ষৌম, অংশুক, স্রস্ত, কুঙ্কুম―এসব শব্দ। এগুলো গতানুগতিক নয়। কিন্তু একেবারে অপ্রচলিতও না। কাছে থেকেও যেন ওরা দূরের। একটু ওজনদার, একটু অন্যরকম। বিচিত্র অলংকার যেমন নারীর সৌন্দর্য পাল্টে দেয়, এ শব্দগুলোও যেন এক একটা বৈচিত্র্যময় অলংকার। বাক্যকে এই শব্দগুলো অধিকতর রূপময়ী করে তুলেছে। এজন্যই বুদ্ধদেব বসু ‘মেঘদূতে’ অনন্য।

পাশ থেকে অবন্তী কলমের খোঁচা মেরে বলে, কী রে তিশা! স্যারের লেকচারের কিছুই ভালো লাগেনি তোর ?

তিশা লজ্জা লজ্জা কণ্ঠে বলল, লাগেনি আবার! লেগেছে তো!

তাহলে সবাই লিখল কিছু না কিছু! তুই তো কলমের ঢাকনাটাই খুললি না!

তোরা কাগজের খাতায় লিখেছিস। আমি মনের খাতায় লিখে নিয়েছি।

অবন্তী সোজাসহজ মেয়ে। তার মনে অত ঘোরপ্যাঁচ নেই। তিশার হেঁয়ালি ধরতে পারল না সে। চোখ কুঁচকে বলল, কী বলছিস ওসব ? বুঝতে পারছি না তো!

তোর অত বুঝে কাজ নেই। সুবোধ বালিকার মতো লিখতে থাক। না লিখেই দেখবি আমি ঠিকই পাস করে যাব! এখন আমাকে খেতে দে।

অবন্তী বিভ্রান্ত কণ্ঠে বলল, কী খেতে দেব! আমার ব্যাগে তো কিছু নেই তিশা! ক্লাস শেষ হোক। কেন্টিনে নিয়ে গিয়ে খাওয়াব তোকে।

ধুর বোকা!

ভয় পেয়ে গেল অবন্তী। বোকামির কী করেছে, ধরতে পারল না সে। ভেবাচেকা চোখে বান্ধবীর দিকে তাকিয়ে থাকল অবন্তী। বাষ্পাচ্ছন্ন হয়ে এল তার গলা। বুঝতে পারল তিশা।

সিরাজ স্যার চলে গেলে অবন্তীর ডান হাতটা ধরে তিশা বলল, চল।

অবন্তী কাঁচুমাচু হয়ে জিজ্ঞেস করল, কোথায় ?

তিশা আচমকা হাসিতে গড়িয়ে পড়ে বলল, আরে চল না! এরকম করে হঠাৎ হেসে উঠতে তিশাই পারে কেবল। হাসির ছন্দ কণ্ঠ থেকে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই তিশা বলল, চল না ভাই! আজ তোকে কাটলেট খাওয়াব।

অবন্তীর মুখের মেঘ কেটে গেল। ফিক করে হেসে দিল সে।

সিরাজ স্যারের বাড়ি বরিশালের দিকে। তাঁর পুরো নাম সিরাজ-উদ্-দৌলা চৌধুরী। পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চির মতো। পিলে চমকে দেওয়ার মতো ফরসা। ইউরোপিয়ানদের মতো। চোখ জ্যোতির্ময়। চলন-বলন-চেহারা এমন যে, একবার দেখার পর তাঁকে ভালো না বেসে পারা যায় না।

বিবাহিত তিনি। সংসারে সুখ নেই। কবিতায় সুখ খোঁজেন সিরাজ-উদ্-দৌলা। তাঁর স্ত্রী সুখ খোঁজে সংসারের দৈনন্দিনতায়।

সিরাজ গান শোনেন, আধুনিক গান। স্ত্রী সদ্যকেনা শাড়িটি এগিয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে, দেখ তো শাড়িটা কেমন ? সুন্দর না ?

সিরাজ গান থেকে কান না সরিয়ে বলেন, মন্দ না।

স্ত্রী উষ্ণ কণ্ঠে বলেন, মন্দ না কী বলছ! পুরো দুই হাজারে কিনেছি!

জানালার বাইরে তাকিয়ে সিরাজ তাঁর বিরক্তি লুকান। পেঁয়াজ-রসুন-আলু-শাড়ির জীবন ভালো লাগে না সিরাজ-উদ্-দৌলার।

ষোলো

কয়েকটা বছর কেটে গেল।

তিশা এম এ ফাইনাল ইয়ারে। মাসতিনেক পরেই পরীক্ষা।

মুকুন্দ মুহুরি এখন আর আগের মতো প্রতিদিন কোর্টে যান না। তাঁর ডিমান্ড যে কমে গেছে, তা নয়। সিরিয়াস মামলাগুলোতে এখনও তিনি অপরিহার্য। তিনি যে অন্যান্য এডভোকেট থেকে অনেক বেশি দাবি করেন, আমলে নেয় না ক্লায়েন্টরা। টাকা যা লাগে লাগুক, মুকুন্দ মুহুরিকে তাদের চাই। তার পরও কোর্টে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন মুকুন্দবাবু। এখন কোর্টে যেতে তাঁর আর ভালো লাগে না। না পারতে দু’একটা কেস নেন তিনি। যেদিন যেদিন ডেট পড়ে, যান। অন্যান্য দিন বাড়িতে থাকেন। টাকার কোনও অভাব নেই মুকুন্দবাবুর। যা রোজগার করেছেন, আগামী তিনপুরুষের জীবন হেলায়-খেলায় চলে যাবে।

মুকুন্দ মুহুরির বয়স বিকেলের দিকে। শরীরটায় প্রবীণতা স্পর্শ করেছে বেশ ক’বছর আগে। মনের জোরও আগের চেয়ে কমে গেছে। বুকের ভেতর মাঝেসাঝে বিষাদের বীণা বেজে ওঠে। কেন এই হাহাকার, বুঝতে পারেন মুকুন্দবাবু। কিন্তু সেই বুঝতে পারার ব্যাপারটা কাউকে বুঝতে দেন না। কোনও কোনওদিন স্ত্রীকে কাছে ডাকেন মুকুন্দবাবু। তাঁর সঙ্গটা তখন ভীষণভাবে কামনা করেন তিনি। এই বয়সের মানুষদের মধ্যে দেহটা ফুরিয়ে যায়, বেড়ে ওঠে প্রিয়জন সান্নিধ্যের কামনা। মুকুন্দবাবুরও তা-ই হয়েছে। সময়ে-অসময়ে স্ত্রী-নৈকট্য পেতে চান। স্ত্রীর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলবার জন্য মুখিয়ে উঠেন তিনি। ডেকে পাঠান তিনি সুদীপা সেনকে।

সুদীপা এসে বলেন, কী জন্য ডেকেছ ? বল।

মুকুন্দবাবু সংকুচিত হয়ে বলেন, এমনি এমনি।

এমনি এমনি মানে! এই সাতসকালে কেউ কাউকে এমনি এমনি ডাকে!

স্টাডিরুমে বসেছিলেন মুকুন্দবাবু। রিভলবিং চেয়ারে পিঠ এলিয়ে দিয়ে বলেন, কেন, এমনি এমনি বউকে ডাকতে নেই ?

সুদীপা স্বামীর মনের কথা বুঝতে পারেন না। মিষ্টি একটু হেসে বলেন, দেখ, রান্নাঘরে কাজ করছিলাম। তুমি ডেকে পাঠালে। কেন বলবে তো!

কাজ! রান্নাঘরে তুমি কেন কাজ করতে যাবে! মালতি-লক্ষ্মী নাই ?

আছে তো! কী কী রাঁধা হবে আজ, তা ওদের বুঝিয়ে দিতে হবে না! বলেন সুদীপা দেবী।

আচ্ছা, সে না হয় পরে করবে। এখন একটু বস তো। এই আমার পাশের চেয়ারটিতেই বস।

চমকে স্বামীর মুখের দিকে তাকান সুদীপা। তাঁর স্বামীর কণ্ঠস্বর এত বিষণ্ন মনে হচ্ছে কেন ? কিছু হয়েছে ? চেয়ারটা সামান্য সরিয়ে বসলেন তিনি।

সুদীপার মনের কথা বুঝতে পারলেন যেন মুকুন্দবাবু। বললেন, তুমি যা ভাবছ, তা নয়। কিছু হয়নি আমার। এমনি এমনি ডেকেছি তোমাকে। কোনওদিন তো তেমন করে সময় দিইনি তোমাদের! নিজের কাজে ডুবে থেকেছি। আজ আমার মনে হচ্ছে, তোমার ওপর ভীষণ অন্যায় করেছি আমি এতদিন। তোমার আর আমার মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে তুমি ভাবছ, আমি তোমাকে অকারণে ডাকিনি। সত্যি বিশ্বাস কর তুমি সুদীপা, আজ শুধু তোমার সঙ্গ পাওয়ার জন্য তোমাকে ডেকেছি। শুধু দু’চারটি কথা, শুধু পাশে বসে থাকা। নিজের অজান্তে মুকুন্দ বাবু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

সুদীপা প্রশান্ত চোখে স্বামীর মুখের দিকে তাকালেন। দেখলেন, মুকুন্দবাবুর কপালজুড়ে তিন তিনটি ভাঁজ। বয়সের বলিরেখা। মুখের চামড়া কোথাও কোথাও কুঁচকানো। গলার নিচের অংশটা মাংসল হয়ে ফুলে ঝুলে গেছে। সাদা চুল পাতলা হয়ে গেছে। চোখের নিচে বার্ধক্যের ছোঁয়া। গাল বসে গিয়ে হনু দুটো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এরকম করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে স্বামীকে আগে কখনও দেখেননি সুদীপা। সংসারের দৈনন্দিনতায় নিজেকে এমনভাবে জড়িয়ে ফেলেছেন যে স্বামীর দিকে মমতার চোখে তাকাবার ফুরসত পাননি তিনি।

আমি বড় অন্যায় করে ফেলেছি এতদিন, তোমাদের ওপর। বিশেষ করে তোমার ওপর। আবার বললেন মুকুন্দ বাবু।

সুদীপা তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, আমিও কি কম অন্যায় করেছি! তোমার সঙ্গে শুধু প্রয়োজনের কথাগুলিই বলে গেছি। কোনওদিন তো তেমন করে জিজ্ঞেস করিনি, কেমন আছ তুমি। তোমার দিকে প্রয়োজনের চোখে তাকিয়েছি শুধু, ভালোবাসার চোখে তাকাইনি। আমাকে মাফ করে দাও তুমি। বলতে বলতে ভেউ ভেউ করে কেঁদে দিলেন সুদীপা সেন।

মুকুন্দবাবু সুদীপাকে কাঁদতে বাধা দিলেন না। তাঁর মনে হলো, তিনিও যদি সুদীপার মতো কাঁদতে পারতেন, তাহলে তাঁর এতদিনের অন্যায়-অবিচার কিছুটা লাঘব হতো।

নিষ্পলক চোখে তাকালেন তিনি। দেখলেন, তাঁর পাশে বসা সুদীপা এখন পূর্ণযৌবনা নন। তাঁর শরীরেও কখন বার্ধক্য বাসা বাঁধতে শুরু করেছে, খেয়াল করেননি তিনি। ভারী রোগাভোগা হয়ে গেছেন সুদীপা। কপালের দিকের বেশ ক’গাছি চুল পেকে গেছে। গলার চামড়া কুঁচকানো।

এই সুদীপা যখন প্রথম তার বাড়িতে এসেছিল, বড় রূপময়ী ছিল। কী দীর্ঘ চুল ছিল তার! অনেকটা কপালকুণ্ডলার মতো। তার দেহজুড়ে বিভোর করা সুরভি। শীতের স্নিগ্ধ সকালটা সুদীপার ত্বকে বিরাজমান ছিল। না, কোনও অহংকার ছিল না সুদীপার। বিয়ে যখন হয়, বড় অভাবের সংসার তখন মুকুন্দ মুহুরির। সুদীপার বাবা তার তুলনায় অনেক ধনী। সুদীপার চোখেমুখে ধনৈশ্বর্যের অহংকার দেখতে পায়নি কোনওদিন। কোনও ঝগড়া নেই, মতান্তর নেই। সুদীপা জানতই না কী করে ঝগড়া করতে হয়। সে নিজে কারণে-অকারণে বকাঝকা চেঁচামেচি করত। সুদীপা রা কাড়ত না। তখন তো সে নিতান্ত একজন দরিদ্র উকিল। প্রচণ্ড টানাটানির মধ্যে সংসারটাকে চালাত সুদীপা। মুখে কোনও বিরক্তি নেই, ভ্রুকুটি নেই। বরং কেমন যেন ভয়ে ভয়ে থাকত সুদীপা। আজ সুদীপার দিকে তাকিয়ে পুরনো দিনের এসব কথা ভেবে গেলেন মুকুন্দবাবু।

দুই প্রবীণ-প্রবীণা পাশাপাশি বসে থাকলেন অনেকক্ষণ। কেউ কথা বললেন না। বহু বহু দিন পর দুজন মানুষ নিজের মধ্যে অন্যজনকে গভীরভাবে অনুভব করে যেতে লাগলেন।

হঠাৎ মুকুন্দবাবু চাপা কণ্ঠে বললেন, আমি তোমাকে ভালোবাসি সুদীপা।

স্বামীর কথা শুনে সুদীপার গণ্ড লাল হয়ে গেল।

দিন পনেরোর পরের ঘটনা। মন খারাপ করে বাড়ি ফিরলেন মুকুন্দ মুহুরি। বেশ বিচলিত দেখাচ্ছিল তাঁকে। ক্লান্ত বিষণ্ন। ভেঙেপড়া চোখমুখ। ঘাবড়ে গেলেন সুদীপা দেবী। এরকম বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে তো তাঁর স্বামী কখনও আদালত থেকে ফেরেননি! এরকম বসা বসা চোখ! মুখখানা শুকিয়ে আমসি যেন! সকালে বেরোবার সময়ে তো উৎফুল্ল ছিলেন বেশ। অনেকদিন পরে কোর্টে যাচ্ছিলেন তিনি। যাওয়ার সময় হাসতে হাসতে বলেছিলেন, আজ আমি মজুমদারের পিলে চমকে দেব। ওঁর দৃঢ় বিশ্বাস আজকের কেসটা উনিই জিতে যাবেন। টাইম-টেবিল-ঘটনা এমন নিখুঁতভাবে সাজিয়ে জজের সামনে তুলে ধরেছেন যে বাদীপক্ষ ধরে নিয়েছে, জয় হবে ওদেরই। কিন্তু আমার নামও তো মুকুন্দ মুহুরি! কীভাবে সত্যকে টেনে বের করতে হয়, জানি আমি। আসলে বের করেও ফেলেছি। শুধু শুধু নিরপরাধী ছেলেটাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে সৎমা। ভাড়াটে গুণ্ডা দিয়ে স্বামীকে খুন করিয়ে ছেলেটার নামে কেস করেছে। এডভোকেট মজুমদারের ধারণা, জজসাহেব তাঁর পক্ষে রায় দেবেন। কিন্তু তা হতে দেব না আমি। খুনিকে সাসপেক্ট করতে পেরেছি আমি। বাদীপক্ষের হয়ে সে নিয়মিত সাক্ষ্য দিতে আসছে কোর্টে। তাকে অ্যারেস্ট করাতে বেগ পেতে হবে না আমার।

কোনওদিন একনাগাড়ে এত কথা বলেন না মুকুন্দ মুহুরি। বিশেষ করে কোর্টকাছারির কথা তো নয়ই। কিন্তু আজ বলে গেলেন। সুদীপা বেশ অবাক হলেও বাইরে দেখালেন না। উপরন্তু বললেন, এডভোকেট মজুমদার কে ?

আর বোলো না। আস্ত একটা নচ্ছার। টাকার লোভে আজেবাজে কেস নেন। হেরে ভূত হন। তারপরও শিক্ষা হয় না তাঁর। এবার তাঁর খুব বিশ্বাস, কেসটা তিনিই জিতবেন।

তুমি কিন্তু বলনি, মজুমদার কে ?

ও হো! বলছি, বলছি। নিখিলচন্দ্র মজুমদার। আমাদের সমসাময়িক। তার মাথাভর্তি ওপর চালাকি! ধুরন্ধর সে। ধান্ধাবাজরা শাইন করতে পারে না। মজুমদারও পারেনি। আজও কুপোকাত হবে সে। দেখে নিয়ো তুমি। তাচ্ছিল্যের কণ্ঠে বলেছিলেন মুকুন্দবাবু।

প্রসন্নতা নিয়ে বেরিয়েছিলেন আজ, বাড়ি থেকে। কিন্তু ফিরলেন বিমর্ষ চেহারা নিয়ে। কেসে হেরে যাননি তো! নিখিল মজুমদার উপহাসের কণ্ঠে বলে ওঠেননি তো―কেমন মজা! খুব আত্মবিশ্বাস মুহুরিবাবু আপনার, তাই না ? আজ হেরে হাঁদারাম হলেন তো! দর্প চূর্ণ হলো তো আজ আপনার ?

মুকুন্দবাবু বেডরুমে জামাকাপড় চেঞ্জ করছেন। ভয়ে ভয়ে কাছে গেলেন সুদীপা দেবী। বললেন, কী হয়েছে ? হেরে গেছ ?

মুকুন্দবাবু বললেন, না।

তাহলে! তোমাকে এরকম কাহিল দেখাচ্ছে!

হারলে ভালো হতো। হারার চেয়ে খারাপ খবর আছে।

হারার চেয়েও খারাপ খবর! বুঝতে পারছি না। আমি আর টেনশন নিতে পারছি না। খুলে বলবে ?

এখন না।

কখন ?

দুপুরের খাওয়া শেষ করি। খাওয়ার আগে খবরটা তোমাকে বলতে চাই না আমি।

চট করে স্বামীর মুখের দিকে তাকালেন সুদীপা দেবী। কী দেখলেন কে জানে, আস্তে করে ঘাড় নামিয়ে বললেন, ঠিক আছে। আমি নিচে যাচ্ছি। তুমি হাতমুখ ধুয়ে নেমে এসো।

অনেকদিন পর স্বামীর এত কাছাকাছি বসেছেন সুদীপা সেন। ঠিক বসা নয়, আধশোয়া। স্বামীর পাশে বিছানায় আধশোয়া হয়ে মুকুন্দবাবুর বুকে হাত বোলাচ্ছেন তিনি। এরকম বিকেলে কত আনন্দ-উল্লাসে মাততেন তাঁরা! সেই স্মৃতিতে এখন আস্তর পড়েছে। দিশা চলে যাবার পর বিকেলের উল্লাসের কথা ভুলে গেলেন মুকুন্দবাবু। আসলে ভুলে তো যাননি! ভেতরের স্ত্রী-সান্নিধ্যের আবেগটুকু মরে গেছে শুধু। আনন্দ উদযাপনের জন্য চাই স্বস্তিময় জীবন। দিশা তাঁর জীবন থেকে স্বস্তি আর সুখ ―দুটোই কেড়ে নিয়েছে। স্ত্রী-সম্ভোগ তিনি করেন কখনও সখনো। সে রাতের বেলা। বহুদিন পর পর শরীর জাগলে স্ত্রীকে আহ্বান করেন। স্ত্রী সাড়া দেন। কিন্তু অপরাহ্ণের আহ্লাদটুকু মুকুন্দবাবু এখন আর উদযাপন করেন না।

নরম গলায় সুদীপা সেন বলেন, কী বলবে বলেছিলে।

হারিয়ে যাওয়া কণ্ঠে মুকুন্দবাবু বলেন, উঁ।

সুদীপা স্বামীর বুকে মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে বলেন, এ-ই! কোথায় হারিয়ে গেলে তুমি!

কিছু বলছ ?

এবার সুদীপা গলা একটু উঁচুতে তোলেন, কোর্ট থেকে বেজারমুখে ফিরলে! খারাপ খবর খারাপ খবর বলে মনটা উচাটনে ভরিয়ে দিলে! বললে খাওয়ার পর বলবে। কই কিছুই তো বলছ না এখন!

মুকুন্দবাবু শোয়া থেকে বিছানায় সোজা হয়ে বসলেন। থম মেরে বসেই থাকলেন।

ততক্ষণে সুদীপা স্বামীর মুখোমুখি।

বড় একটা শ্বাস ফেলে মুকুন্দবাবু বললেন, রাধানাথ দত্ত আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দুর্দিনে অনেক সাহায্য করেছে আমায়। প্রথম দিকে আমার হাতে কোনও কেস আসত না। এই রাধানাথ নিজের কেস আমাকে দিয়ে দিয়ে আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। সেও এখন রেগুলার কেস লড়তে আসে না। তার ছেলে আসে। ছেলেও নামকরা এডভোকেট। রাধানাথ মাঝেসাঝে আসে। আজও এসেছিল। আদালত শেষে সে আমার সঙ্গে একান্তে বসতে চাইল। দূরের টেবিলে মুখোমুখি বসলাম আমরা।

সুদীপা সেন কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না, খারাপ খবরের সঙ্গে রাধানাথবাবুর মুখোমুখি বসার সম্পর্ক কী ? জিজ্ঞেসও করতে চাইলেন তা। কী ভেবে চুপ থাকলেন।

মুকুন্দবাবু বলে চলেছেন, রাধানাথ বেশ কয়েকবার আমাদের বাড়িতে এসেছে। দেখেছ তুমি তাকে। ফাউকথা বলবার লোক সে নয়।

তারপর কণ্ঠকে একেবারে খাদে নামিয়ে আনলেন মুকুন্দবাবু। বললেন, ইন্ডিয়া থেকে রাধানাথের মেসো এসেছেন। সমুদ্র দেখার আগ্রহ তাঁর। পতেঙ্গার সি-বিচে নিয়ে গেল রাধানাথ মেসোকে। সঙ্গে তার ভাইপো, পুত্রবধূ, আর ভাইঝি। ভাইঝিটি চিটাগং ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। তিশারই বয়সী।

হঠাৎ করে বুকটা কেঁপে উঠল সুদীপা দেবীর। কোনওরকমে অস্ফুটে বললেন, তারপর ?

ভাইঝিটি একটু দূরের একটি পাথর খণ্ডের দিকে আঙুল উঁচিয়ে হঠাৎ রাধানাথকে বলেছিল, জেঠা, ওই যে মেয়েটি দেখছেন, তিশা। আপনার বন্ধু মুকুন্দ জেঠার মেয়ে। রাধানাথ নাকি কৌতূহলে জিজ্ঞেস করেছিল, পাশের লোকটি কে রে ? ভাইঝি বলেছিল, ওরই ডিপার্টমেন্টের টিচার― সিরাজ-উদ্-দৌলা। বিবাহিত নাকি।

সুদীপা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলেন। শ্বাস ফেলতে ভুলে গেলেন তিনি।

মুকুন্দ মুহুরি হল্লা-চেচামেচি করলেন না। মৃদুকণ্ঠে বললেন, তিশার বিয়ে দেব আমি।

সতেরো

নিখিল ভৌমিক। ধ্যার-ধ্যারে লম্বা। ছফুট পেরোনো হাইট। মেদ নেই বললে চলে। শ্যামলার দিকে রং। ঢ্যাঙ্গা ঢ্যাঙ্গা পা। এক একটা হাত যেন আঁকশি। মুখটাও ছুঁচালো টাইপের। ওপর পাটির সামনের দাঁত দুটোর মাঝখানে চোখেলাগা ফাঁক। এ নিয়ে ছোটবেলায় বন্ধুরা খেপাত, এই নিখিল, তোর দাঁতের ফাঁক দিয়ে কবুতর ঢুকে পড়বে। মুখ বন্ধ কর। খেলায় নিতে চাইত না ওকে। বলত, তুই তাল গাছের মতো লম্বা। তোকে খেলায় নিলে তোর ওই কাউয়ার ঠ্যাং দুটো দিয়ে গোল করে ভূত বানাবি আমাদের। সেদিন থেকে বন্ধুরা তাকে আর নিখিল ডাকে না, ডাকে তালগাছ বলে। ভিড়ের মধ্য থেকে চিকন গলায় বাদল ডেকে ওঠে, তা-লু। সেই থেকে বন্ধুদের কাছে নিখিল আর নিখিল নয়, তালগাছ, মানে তা-লু। ওই বয়সের ছেলেপুলেরা যা হয়, ব্যঙ্গের লক্ষ্যবস্তু নির্ধারিত হলেই হলো। একেবারে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। নিখিলের ক্ষেত্রেও তাই হলো। রাস্তাঘাটে বের হওয়াই সংকট হয়ে দাঁড়াল তার। স্কুলের পথে পা দিয়েছে তো অমনি আড়াল থেকে আওয়াজ ওঠে, তা-লু। মা রাস্তার মোড় থেকে সদাই করতে পাঠাল। মুদির দোকানে গদাইয়ের সঙ্গে দেখা। গদাই ভালো মানুষের মুখ করে জিজ্ঞেস করে, কী কিনতে এসেছিস রে তালু ? এসব শুনে-দেখে মরে যেতে ইচ্ছে করে নিখিলের। কিন্তু মরবার সাহস নেই তার। ছোটবেলা থেকেই ভীতু ধরনের নিখিল। প্রতিদিন পাড়ায়, রাস্তায়, স্কুলে উপহাসের খোঁচা খেতে খেতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল নিখিল।

নিখিল ভৌমিক যে মেধাবী ছাত্র, তা নয়। চলনসই যাকে বলে, ঠিক সেরকম। ফেল করে না সে। কাঁটায় কাঁটায় পাস করে কোনওরকমে বার্ষিক পরীক্ষা উতরে যায়। এক সন্ধ্যায় বন্ধুদের চ্যালেঞ্জ দিয়ে বসল নিখিল, তোদের মুখে ঝামা ঘষে দেব আমি। আগামী বার্ষিক পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে তোদের থোঁতা মুখ ভোঁতা করে ছাড়ব। এই চ্যালেঞ্জের সময় বন্ধুরা অবশ্য সামনে ছিল না। ফুটবল খেলার মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে অন্ধকারের দিকে আঙুল উঁচিয়ে কথাগুলো বলেছিল নিখিল।

সেই সন্ধ্যায় বড় একটা শ্বাস ফেলে ভেতরের ভীতু ভাবটাকে মাঠে ছুড়ে ফেলেছিল নিখিল। আরেকটা শ্বাস টেনে নিজের বুকের মধ্যে জেদটাকে ভরে নিয়েছিল।

বাড়ি ফিরে বইখাতা নিয়ে সেই বেলাতেই বসে গিয়েছিল।

কার অপমান যে কখন কার মগজে ধাক্কা দেয়, কেউ বলতে পারে না। কার কখন উত্থান হবে বা কার পতন হবে ঈশ্বরও জানেন না বোধহয়। মানব জীবনটা এমনই গোলমেলে, রহস্যময়। নিখিলের ক্ষেত্রেও সেরকম কিছু একটা হলো। ওই সন্ধ্যাতেই তার মগজে গেঁথে গেল, বন্ধুদের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার একমাত্র পথ ভালো রেজাল্ট করা। এমন ভালো রেজাল্ট করা, যা দেখে শুধু বন্ধুরা কেন, তাদের অভিভাবকরাও বলবে, নাহ্, নিখিল একটা জিনিয়াস। এতদিন ছাইচাপা ছিল। বাতাস লেগে ওপরের ছাইগুলো সরে গিয়ে দগদগে আগুন দেখা যাচ্ছে এখন। মেধার আগুন। শুধু বন্ধু বা অভিভাবকদের তাজ্জব করে দেবে না সে, গোটা পৃথিবীকে জানান দেবে হেলাফেলার নয় সে। মেধাবান, মেধাবান সে।

পড়াশোনায় এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল নিখিল, যার গুণে এতদিনকার জড়তা দ্রুত কেটে গেল। লেখাপড়ায় তেমন ভালো ছিল না নিখিল। কিন্তু অধ্যবসায়ে অনেক দুর্লভ বস্তুও যে হস্তগত হয়, ঘষামাজাতে জংধরা তলোয়ারও যে ঝলসে ওঠে, নিখিল তার প্রমাণ। মাধ্যমিকের টেস্টে সে সেকেন্ড হলো। দুই নম্বরের জন্য ফার্স্ট প্লেসটা অধরা থেকে গেল। কিন্তু নিখিলের লক্ষ্য টেস্ট পরীক্ষার ওসব ফার্স্ট প্লেসটেøস নয়। তার লক্ষ্য আরও উঁচুতে। মাধ্যমিকের বোর্ড পরীক্ষায় সে প্রথম পাঁচজনের একজন হলো। অহংকার তাকে স্পর্শ করল না। কিন্তু তার জন্য তার গ্রামের মানুষেরা অহংকার করতে লাগল। গরিব মা-বাবা। শহরের কলেজে পড়ানোর হিম্মত নেই। স্কলারশিপের টাকার ওপর নির্ভর করে শহরের নামকরা কলেজে ভর্তি হয়ে গেল। সহপাঠীদের সঙ্গে মেসে থাকা শুরু করল। কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটি। ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট নিখিলের। ইতিহাস বিষয়ে অনার্স এমএ করল। ডিপার্টমেন্ট তাকে ডেকে নিল। লেকচারার হিসেবে যোগদান করে গত চার বছর ধরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে যাচ্ছে নিখিল।

ভালো টিচার হিসেবে তেমন নাম ছড়ায়নি নিখিলের। কিন্তু গবেষক হিসেবে তাকে অনেকে শ্রদ্ধা করা শুরু করল। তার গবেষণার বিষয় চট্টগ্রামের সমাজ ইতিহাস। সারাক্ষণ লেখাপড়ায় ডুবে থাকে নিখিল। লাইব্রেরিই তার ঘরবাড়ি হয়ে উঠল। ব্যাচেলার শিক্ষকদের কোয়ার্টারে থাকে নিখিল। এর মধ্যে তার মা গত হয়েছে। বাবা ছোট ভাইয়ের সঙ্গে গ্রামে থাকে। ক্ষেতখামার দেখে।

এই নিখিল ভৌমিকের সঙ্গে এক সন্ধ্যায় মুকুন্দ মুহুরির দেখা হয়েছিল।

প্রত্যেক বছর চট্টগ্রাম বার এসোসিয়েশনের উদ্যোগে এডভোকেটদের বার্ষিক সম্মিলন হয়। আয়োজকরা এক এক বছর এক একজন গুণী মানুষকে ওই সম্মিলনে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আহ্বান করেন। আমন্ত্রিত মানুষটি তাঁর পছন্দের বিষয়ের ওপর ঘণ্টাখানেক কথা বলেন। সেবার আয়োজকরা নিখিল ভৌমিককে আমন্ত্রণ জানালেন।

নিখিল ভৌমিক নির্ধারিত তারিখে দর্শকভরা হলরুমে বক্তৃতা দিল। তার বলার বিষয় ছিল―সেকালের ইংরেজ বিচার : চট্টগ্রাম। স্পন্টেনিয়াসলি দেড় ঘণ্টা বলে গেল নিখিল। গোটা হলরুম স্তব্ধ হয়ে শুনল তার বিচার-বিশ্লেষণমূলক তথ্যসমৃদ্ধ কথা। শ্রোতার মনে কোনও একঘেঁয়েমি জাগল না। দীর্ঘ বক্তৃতার অজুহাত দেখিয়ে উসখুসও করলেন না কেউ। বক্তৃতা শেষে হাততালিতে হলরুম ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হলো।

সেই অনুষ্ঠানে মুকুন্দ মুহুরি উপস্থিত ছিলেন। ওখানে বসেই মনে মনে ঠিক করলেন, সুযোগ পেলে এই ছেলেটির সঙ্গেই তিশার বিয়ে দেবেন তিনি।

সেই বিকেলে ‘তিশার বিয়ে দেব আমি’ বলার পরই নিখিল ভৌমিকের কথা মনে পড়ে গেল মুকুন্দবাবুর। স্ত্রীর কাছে কীভাবে নিখিলের কথা তুলবেন, ভাবছেন তিনি।

ঠিক ওই সময় সুদীপা দেবী বললেন, কোনও ছেলের সন্ধান আছে, তোমার হাতে ?

আছে। বলে থেমে গেলেন মুকুন্দবাবু। এই মুহূর্তে নিখিল সম্পর্কে আর বিশেষ কিছু বলতে চান না তিনি। জানেন, কথাগুলো দ্রুত পাঁচ কান হয়ে যাবে। সুদীপা গিয়ে মীরা পিসিকে বলবেন। আনন্দের চোটে মীরা পিসি কথাটা মালতি-লক্ষ্মী পর্যন্ত ছড়িয়ে দেবেন। মালতি থেকে হরিপদ মতিলাল পর্যন্ত কথাটা রাষ্ট্র হতে বেশি সময় লাগবে না। লক্ষ্মী কম কথা বললেও মালতির পেট পাতলা। তাতে কোন ঝামেলা থেকে আবার কোন ঝামেলা তৈরি হয়! দিশার কথা চট করে মনে পড়ে যায় মুকুন্দ মুহুরির। তিনি দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন, এর বেশি আর কিছু সুদীপাকে জানাবেন না এই মুহূর্তে। পরে না হয় সব খুলেমেলে বলবেন!

সুদীপাকে কথা বাড়ানোর সুযোগ না দিয়ে মুকুন্দবাবু তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করলেন, তিশার ফাইনালটা কখন ?

সুদীপা বললেন, বলেছিল তো সেপ্টেম্বরে শেষ হবে!

তাহলে এখন জুলাই। আগস্ট সেপ্টেম্বর―আর দুইমাস।

আমি তোমাকে বলে রাখছি সুদীপা, অক্টোবরেই আমি তিশার বিয়ে দেব। তারপর একটু চুপ করে থাকলেন মুকুন্দবাবু। মৃদুকণ্ঠে আপন মনে বললেন, মুখে আর চুনকালি মাখতে রাজি নই আমি।

স্বামীর শেষ লাইনটি স্পষ্ট করে শুনতে পেলেন সুদীপা সেন। কত বড় বেদনার জায়গায় দাঁড়িয়ে তাঁর স্বামীটি যে এই কথাটি বললেন, অনুধাবন করতে পারলেন তিনি। তিশার বাড়াবাড়ি কিছুতেই মেনে নেবেন না তিনি। স্বামী তাঁর যাকেই তিশার বর হিসেবে নির্বাচন করুন, আপত্তি করবেন না।

দম বন্ধ করে চোখের পাতা না ফেলে সুদীপা বললেন, তোমার সঙ্গে আমি একমত। তিশাকে কোনওভাবেই বাড়াবাড়ি করতে দেওয়া যাবে না। প্রয়োজনে গলায় পা দেব।

আহ হা হা! ওরকম করে বল না সুদীপা। দেখ না কোথাকার জল কোথায় গড়ায়! এই কদিনে আমি একটু খোঁজখবর নিই। যোগাযোগের চেষ্টা করি তার সঙ্গে।

মেয়েলি কৌতূহলে সুদীপা বলে উঠলেন, কার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করবে ? ছেলেটির সঙ্গে নাকি ?

তার মা-বাবার সঙ্গেও তো যোগাযোগ করা দরকার! বলে দ্রুত স্ত্রীর দিকে তাকালেন মুুকুন্দবাবু। বললেন, ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। চিটাগং ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। এর বেশি এখন আর জানতে চেয়ো না তুমি। হলফ করে বলতে পারি, তোমার মেয়ে ঠকবে না।

তিশাও যে দিশার মতো একজনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে এবং এটা যে ভীষণ এক সমস্যা, স্বামী-স্ত্রী দুজনেই প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেলেন।

নিখিল ভৌমিকের সঙ্গেই বিয়েটা হলো তিশার।

স্ত্রীর সঙ্গে আলাপের পরদিন থেকে খোঁজখবর নিতে শুরু করেছিলেন মুকুন্দ বাবু। জুনিয়র দিলীপ দস্তিদারকে ফোন করে বাসায় ডেকেছিলেন। নিখিল সম্পর্কে সুলুকসন্ধান করতে বলেছিলেন। দিলীপ করিৎকর্মা ছেলে। দিনসাতেকের মধ্যে নিখিল সম্বন্ধে সকল তথ্য হাজির করেছিল। নিখিলের গ্রামের নাম সুলুকবহর। মা নেই। বাবা ছোট ভাই অখিলের সঙ্গে থাকে। অখিল ছোটখাটো একটা মুদির দোকান চালায়। বাবা সিদ্ধেশ্বর ভৌমিক আগে খেতখামারে কাজ করত। এখন জীর্ণ শরীর। কোনও কাজ করে না এখন। নিখিল বাপকে শহরে নিয়ে আসতে অনেক চেষ্টা করেছে। সিদ্ধেশ্বর গ্রামের মায়া ছাড়তে রাজি নয়। ছোটবেলায় নিখিল মেধাবী ছিল না। মাধ্যমিকের আগে আগে তার মেধা স্ফুরিত হয়েছে। সহজসরল ছেলে। একটু ভীতু টাইপের। অগাধ জ্ঞান। বই, পড়া আর পড়ানো ছাড়া অন্য কিছু বোঝে না। সিদ্ধেশ্বরের বংশে নিখিলই একমাত্র বিদ্যাবান। তবে ছেলেটা বেমানান রকমের ঢ্যাঙ্গা। এইসব তথ্য মুখস্থ করার মতো করে বলে গেল দিলীপ দস্তিদার।

সব শুনে চুপ করে থাকলেন একটু মুকুন্দবাবু। তারপর উজ্জ্বল মুখ করে দিলীপকে জিজ্ঞেস করলেন, তিশার জন্য কেমন হবে ছেলেটা ?

উত্তর দিতে দিলীপ কিছুটা সময় নিল। তারপর অসহায় গলায় বলল, তিশাদির জন্য এই ছেলে মানানসই নয়। তালগাছের মতো লম্বা। চেহারাটাও তেমন আহামরি না। তিশাদিদি অসাধারণ রূপসী। রূপসী নারীদের চয়েজ কড়া। আমার মনে হয় না স্যার তিশাদি ছেলেটাকে পছন্দ করবেন।

চমকে দিলীপের মুখের দিকে তাকালেন মুকুন্দ মুহুরি। পরে বললেন, সে আমি দেখব দিলীপ। তোমাকে যে কী বলে ধন্যবাদ জানাব, বুঝে উঠতে পারছি না।

দিলীপ বিনীত ভঙ্গিতে বলল, লজ্জা দেবেন না স্যার। আপনি আমার সিনিয়র। আপনার কাছ থেকেই তো আমার যা কিছু শেখা!

নিজে উপযাচক হয়ে নিখিলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন মুকুন্দবাবু। নিখিল রাজি হয়ে গিয়েছিল। মুকুন্দ মুহুরির সুখ্যাতির কথা আগে থেকেই জানত সে। আর তিশার রূপের কথা ইউনিভার্সিটির ছাত্র-শিক্ষক নির্বিশেষে কে না জানেন ? নিখিল ভৌমিকও জানত। তিশাকে বিয়ের প্রস্তাবটা পেয়ে মনে মনে গর্ববোধ করতে লাগল সে। গ্রামে গিয়ে ব্যঙ্গকারী বন্ধুদের ডেকে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করল, দেখ তোরা, ছোটবেলায় যার চেহারা নিয়ে উপহাস করতিস, সে এখন কাকে বিয়ে করছে দেখে যা। তোদের রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়ার মতো রূপ তিশার।

এক সকালে সুদীপা দেবী আর মুকুন্দবাবু সুলুকবহরে গিয়েছিলেন। প্রস্তাব শুনে বেজায় খুশি হয়েছিল গোটা পরিবার।

বিয়ের সব আয়োজন গুছিয়ে এনেছিলেন মুকুন্দবাবু। অক্টোবরের প্রথমদিকে তিশা ১৬/১৭-র লাভ লেনের বাড়িতে চলে এসেছিল। ফাইনাল পরীক্ষার পর ছাত্রছাত্রীদের হোস্টেলে থাকার নিয়ম নেই।

কয়েকদিন পরের এক সন্ধ্যায় তিশার সামনে কথাটা পেড়েছিলেন সুদীপা দেবী। মীরা পিসিও সেখানে ছিলেন।

তোর বিয়ে দিতে চাই আমরা। আলতো গলায় বলেছিলেন সুদীপা।

চমকে মাথা তুলেছিল তিশা। কী যেন একটা বলবার জন্য ছটফট করে উঠেছিল। উদ্গ্রীব চোখে তিশার দিকে তাকিয়ে ছিলেন সুদীপা দেবী। মায়ের উৎকণ্ঠিত চোখমুখ দেখে চোখের আলো নিভে গিয়েছিল তিশার। তার ভালোবাসার কথাই তো বলতে চাইছে তিশা! কিন্তু যাকে ভালোবাসে, তাকে নিয়ে তো ঘর করা অসম্ভব! সে তো বিবাহিত! নারী হয়ে সে অন্য একজন নারীর সংসার ভাঙে কী করে! বেশ কিছুদিন আগে থেকেই সিরাজ থেকে সরে আসতে চাইছিল তিশা। ভালোই হলো, বিয়েটা সিরাজের সঙ্গে তার দূরত্বটা দুর্লঙ্ঘ্য করে তুলবে। তাই মায়ের প্রস্তাবে কোনও কথা বলল না তিশা। মাথা নিচু করে থাকল।

মীরা পিসি বুড়ো হয়ে গেছেন অনেকটা। ভালো করে চোখে ঠাহর করতে পারেন না এখন। কথা বলতে গেলে গলাটাও কেঁপে কেঁপে ওঠে ইদানীং। কাঁপা কণ্ঠে পিসি বলে উঠেন, দিশা এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার পর মুহুরিবাড়ির সকল আনন্দ মুছে গিয়েছিল। তিশার বিয়েতে সেই আনন্দ ফিরে আসবে। আমার ভাইপোর বুকের ক্ষত কিছুটা হলেও শুকাবে।

গভীর এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছিলেন মীরা পিসি।

আঠারো

লোকটি মানুষ না অন্যকিছু! মানুষ হলে লোভ থাকত, ক্ষুধা-ক্লান্তি থাকত, থাকত অপমানবোধ। শুধু একটিতেই তার লোভ আর ওই একটিতেই খিদে। বই। বই পেলে তার সব ক্ষুধা-তৃষ্ণা মিটে যায়। বইয়ের পোকা যেন সে। এই বই তার সকল বিমর্ষতা-বিষণ্নতা ভুলিয়ে দেয়। তার জীবনে যেন দুটি কাজ। পড়া এবং পড়ানো। সংসারের যাতনা-অতৃপ্তি তাকে ছুঁতে পারে না কিছুতেই। হাঁস যেমন পাখনা ঝেড়ে দেহ থেকে জল সরায়, এই লোকটিও তেমনি দৈনন্দিনের অপমান-কষ্ট এক ঝটকায় মন থেকে ঝেড়ে ফেলে। এই মানুষটাকে নিয়েই ঘর করতে হচ্ছে তিশাকে। গত চার বছর। এই চার বছরে তিশার মনে হয়েছে নিখিল হয় এক দুর্বোধ্য পুরুষ, না হয় অবোধ ছেলেমানুষ।

বিয়েটা নীরবে মেনে নিয়েছিল তিশা। বিদ্রোহ করতে পারত, করেনি। এরকম বেঢপ চেহারার একজনের সঙ্গে কেন আমার বিয়ে দিচ্ছ―জিজ্ঞেস করতে পারত, করেনি। করেনি মানে করতে ইচ্ছে করেনি। সিরাজের সঙ্গে সম্পর্কটা আর টানতে পারছিল না সে। বিবাহিত একজনের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে তার একসময় মনে হচ্ছিল, এ অন্যায়, একটা সংসার ভাঙার খেলা ছাড়া আর কিছুই নয় এটি। সিরাজও উচ্ছ্বাস হারাচ্ছিল। দুজনের মাঝখানে বিশাল লোমশ এক অস্বস্তি এসে দাঁড়াচ্ছিল বারবার।

নিখিল ভৌমিককে তিশা ইউনিভার্সিটিতে দেখেনি, এমন নয়। দেখেছে। ইতিহাস বিভাগ আর বাংলা বিভাগ পাশাপাশি। বিভাগ থেকে নিখিল বেরোলেই করিডরে দাঁড়ানো বাংলা বিভাগের মেয়েরা হাসাহাসি শুরু করত। এই হাসিতে উপহাস থাকত। নিখিলের ঢ্যাঙ্গাপনা নিয়ে মেয়েদের প্রথমে চাপা হাসি, পরে খিল খিল। সঙ্গে গা টেপাটেপি, ইশারা-ইঙ্গিত। এই ঠাট্টা-উপহাসে তিশাও যোগ দিয়েছে দু’একবার। মনে মনে বলেছে, হা ঈশ্বর, এরকম বেছাঁচের লোকও হয়!

সেই বেছাঁচের নিখিলের সঙ্গে বিয়েটা মেনে নিয়েছিল তিশা। মা-বাবা, দিদিমা খুশি হন যদি তাতে। ওঁরা বেজায় খুশি হয়েছিলেন। ওঁদের ওই আনন্দটুকুই তিশার কাছে মহার্ঘ বলে মনে হয়েছিল তখন।

প্রথম প্রথম খুব গা রি রি করত তিশার। রাতের বিছানায় নিখিল যখন তার দিকে সোহাগের ডান হাতটা বাড়াত, তিশার মনে হতো বীভৎস এক অক্টোপাস যেন তাকে গিলে খেতে চাইছে! ভয়ে ঘৃণায় কুঁকড়ে থাকত সে। বুঝতে পারত না নিখিল। তিশার কুচযুগলের মাঝখানে হনু-উঠা মুখটা নামিয়ে আনত। বাধা দিত না তিশা। কীরকম এক অশ্রদ্ধা আর বিতৃষ্ণায় চোখমুখ কুঁচকে থাকত। নিখিল ততক্ষণে স্তনবোঁটায় মুখ ঘষা শেষ করে অধরে নিজের ঠোঁট চুবিয়ে দিয়েছে। এক সময় ঝড় থেমেছে। কয়েক মিনিটের ঝড়ে তিশা তখন বিধ্বস্ত।

ওদের একটা বাচ্চা হয়েছে। ছেলে। অরিন্দম নাম রেখেছে। অরিন্দম দেখতে বেশ সুন্দর হয়েছে। রূপকথার রাজপুত্তুর যেন! কিন্তু একেবারে নিখুঁত হয়ে জন্মেনি অরিন্দম। তার অণ্ডকোষে একটা অণ্ড নেই। জন্মের বেশ কয়েক মাস পরে বুঝতে পেরেছিল তিশা। তিশা অরিন্দমকে কোলে নিয়ে ভাবত, তার দোষেই অরিন্দম এরকম হয়েছে। সঙ্গমকালে সে তো সহজ থাকেনি! নিখিল যখন তার দেহ নিয়ে উন্মাদপ্রায়, তখন সে চোখকপাল কুঁচকে, মনে বিপুল বিতৃষ্ণা ঢেলে নিষ্ক্রিয় থেকেছে। দেহ থেকে নিখিল উঠে যাবার পরও তার বিরক্তি-বিতৃষ্ণা মন থেকে সরেনি, দেহ থেকে উবে যায়নি। চট করে মহাভারতের কথা মনে পড়ে যায় তিশার। মা মৎস্যগন্ধার অনুরোধে ব্যাসদেব অনুজপত্নী অম্বিকা আর অম্বালিকার সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হলেন। ব্যাস মানে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন। অত্যন্ত কদাকার ছিলেন। মাথাভর্তি জটাময় চুল। সেই চুলে বোটকা গন্ধ। গোল গোল চোখ, যেন আগুনের গোলা এক একটা। কোনও আদর নয়, প্রীতিময় সম্ভাষণ নয়। সরাসরি উন্মত্ত সঙ্গম। ফল কী হলো ? জন্ম নিল ধৃতরাষ্ট্র, জন্মাল পাণ্ডু। এই জন্মানোর সঙ্গে ভালোবাসা জড়িয়ে ছিল না, জড়ানো ছিল ভয় আর বিতৃষ্ণা। শাশুড়ি মৎস্যগন্ধা বিধবা পুত্রবধূদের কড়া নির্দেশ দিয়েছিলেন, ভাশুরের সঙ্গে মিলিত হতে হবে তোমাদের। কুরুবংশ রক্ষা করার জন্য আমার নাতি চাই। শাশুড়ির নির্দেশ না-মানার সাহস ছিল না অম্বিকা-অম্বালিকার। মিলিত হয়েছিল ভাশুরের সঙ্গে। দেহে জড়তা নিয়ে, মনে একরাশ ঘৃণা নিয়ে। তাই যে দুজন জন্মাল, তাদের একজন জন্মান্ধ, অন্যজন রোগা, নপুংশক। তারও তো তা-ই হয়েছে―ভাবে তিশা। সেও তো স্বামীসঙ্গমে সহজ থাকেনি। দেহে নিষ্ক্রিয়তা ছিল, মনে ছিল বিতৃষ্ণার কিলবিলানি। এই জন্যই তো অরিন্দম ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডুর মতো হয়েছে! খুঁত নিয়ে জন্মেছে সে। ভাবতে ভাবতে বুকে চেপে ধরে সে অরিন্দমকে। মনে মনে বলে, আমাকে ক্ষমা করে দে রে অরিন্দম! আমাকে মাফ করে দে রে বাছা!

বিয়ের আগে আগে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিল নিখিল। ছবুর ম্যানশনে। ছ’তলার পুরনো দিনের বাড়ি। নিখিলরা তেতলায়। মুখোমুখি ফ্ল্যাটে কামেশ্বর মৈত্র সপরিবারে থাকেন। ওপর তলায় সাজ্জাদ সাহেব। তাঁর সামনের ফ্ল্যাটে আজিজুল হক। আজিজুল হক সাংবাদিক। একটি স্থানীয় পত্রিকার সহকারী সম্পাদক। বিয়ে করেছেন ছবুর ম্যানশনের ছবুর সাহেবের মেজ মেয়েকে। ভাড়াটিয়া নাকি ঘরজামাইয়া বলতে পারে না কেউ। আজিজুল হকের স্ত্রী আশা বেশ সংস্কৃতিমনস্ক। নানা অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেন, কবিতা আবৃত্তি করেন। ষষ্ঠ তলাটা খালি পড়ে আছে। পঞ্চমতলায় থাকেন জগমোহন মজুমদার। জগমোহনবাবুর মুখে সর্বদা জয় জগন্নাথ। আড়ালে মানুষেরা তাকে জে জগন্নাথবাবু বলে ডাকে। জে জগন্নাথবাবুর উল্টোদিকের ফ্ল্যাটে স্বপনবাবু। স্বপন সোম পোস্ট অফিসে চাকরি করতেন। নাস্তিক ধরনের মানুষ। স্ত্রী প্রচেতার আবার দেবদ্বিজে অপারভক্তি। এককোনায় ঠাকুরঘর। সেখানে নানা দেবদেবীর ছবি, মাটির মূর্তি, পাথরের খণ্ড। ওঁদের দুই ছেলেমেয়ে। ছেলের পিতার মতো ঠাকুর দেবতায় শ্রদ্ধা নেই। কন্যাটির পুজো-আচ্চায় ক্লান্তি নেই। নিচের তলার দুই ফ্ল্যাট জুড়ে ছবুর সাহেবের সংসার। দুই বউ তাঁর। ছেলেপিলের কমতি-ঘাটতি নেই দুই ঘরে।

এরকম একটা বাড়িতে এসে খেই হারিয়ে ফেলার মতো অবস্থা তিশার। চারদিকে হইচই। গিজগিজ মানুষজন। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে নামতে ধাক্কা খাওয়ার উপক্রম। দেখা হলেই কেমন আছেন ? নমস্কার। নিখিলদা কোথায় ? দেখছি না যে! কারও আবার আগবাড়ানো প্রশ্ন, এই সাতসকালে কোথায় চললেন বউদি ? উত্তর দিতে দিতে প্রাণ ওষ্ঠাগত। এই বাড়িতে ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু নেই যেন! কোথায় যাবে, কোত্থেকে আসবে, তাও যেন গোটা বিল্ডিংকে জানিয়ে যেতে হবে! এ যে ব্যক্তিগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ নয়, এ যে গভীর এক আন্তরিকতা, প্রথম প্রথম বুঝতে পারেনি তিশা। বহু লোকের মাঝে জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা নেই তার। বিশাল মুহুরিবাড়িতে তার বড় হয়ে ওঠা। মাঝখানের কয়েকটি বছর হোস্টেলে। সেখানে একজন মাত্র রুমমেট। কোনওদিন ব্যক্তিগত ব্যাপারে ইন্টারেস্ট দেখাত না শ্রুতি। নিজের বাড়িতেও সদস্য সংখ্যা নেহাত কম ছিল না। মা-বাবা, দিদি-দিদিমা, হরিপদ। কিন্তু কেউ কারও ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করতেন না। সেইরকম পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা তিশা এরকম রইরই মার্কা পরিবেশে এসে ভেবাচেকা খেয়ে গিয়েছিল। পরে পরে অবশ্য সবকিছুর সঙ্গে, সবার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পেরেছিল তিশা। সবার সঙ্গে একটা সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তার। বিশেষ করে সামনের ফ্ল্যাটের মৈত্র বউদির সঙ্গে তার নিবিড় এক ভালোবাসার সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।

তিশার সঙ্গে সবার সম্পর্ক সহজতর হলে কী হবে, নিখিল ভৌমিক দূরের মানুষ হয়েই থেকে গিয়েছিল। সিঁড়ি দিয়ে নামতে উঠতে কারও সঙ্গে কথা বলে না সে। মাথা নিচু করে সিঁড়ি ভাঙে। প্রথম দিকে যারা কথা বলতে আগ্রহী হয়ে উঠেছিল, নিখিলের হাবভাব দেখে দূরে সরে গেছে। নানা জনকে বলতে হয়েছে, ও ওরকমই। কারও সঙ্গে তেমন কথা বলে না।

মৈত্র বউদি মুচকি হেসে বলেন, তোমার সঙ্গেও ?

ঠিক তাই বউদি। আমার সঙ্গেও তেমন করে কথা বলে না। ওর যত কথা বইয়ের সঙ্গে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে তিশা।

হরবালা বউদি মনে মনে ভাবেন, এ কীরকম জীবন! এক ঘরে থাকে, এক বিছানায় শোয়! পারতপক্ষে কথা বলে না বলছে! স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কত কথা! কিছুই বলে না লোকটা! এ বড় তাজ্জবের ব্যাপার তো!

আস্তে আস্তে সব গা-সওয়া হয়ে গেছে তিশার। নিখিলের নিশ্চুপতা, প্রতিবেশীদের হাউকাউ, কিউরেসিটি―সবকিছুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে সে।

এমন একজন মানুষের সঙ্গে ঘর করতে হবে সারাজীবন, ভাবতেই কান্না পেত প্রথমদিকে। দিশা খুঁজে পেত না কোনও। সকল কথায় হুঁ হ্যাঁ। ভাত খাবে ? হুঁ। আগামীদিন ইউনিভার্সিটি আছে ? হ্যাঁ। কাল আমি বাপের বাড়ি যাব। হুঁ। ভার্সিটি থেকে ফিরবার সময় আমাকে নিয়ে এসো। বই থেকে মাথা না তুলে হয়তো বলল, ঠিক আছে। পাগল হয়ে যাবার মতো অবস্থা হলো তিশার। মন বলল, মাকে বল তিশা। তোর বাপকে বলছিস না কেন ? বেশ তো বিয়ে দিয়েছে ইউনিভার্সিটির এই বোবা অধ্যাপকটির সঙ্গে! এখন তোর যে এই ছটফটানি, তোর যে এই দমবন্ধ হয়ে আসা―সবটা মুকুন্দ মুহুরিকে বলছিস না কেন! মনকে ধমকায় তিশা, ওরকম করে বলো না তুমি আমায়। আমি বাবাকে কষ্ট দিতে পারব না। আমার দিদি বাবার অন্তরে যে ঘা-টা দিয়ে গেছে, সেখান থেকে রক্তক্ষরণ এখনও বন্ধ হয়নি। আমি বাবার ওই ক্ষতটায় আর আঘাত দিতে পারব না। বাবার বিশ্বাস, নিখিলের সঙ্গে আমি সুখে আছি। বাবার ওই বিশ্বাসটা ভাঙতে চাই না আমি। মাকেও আর কষ্ট দেব না। দিদির কষ্ট মা এখনও ভুলতে পারেনি।

তিশা সংসার করে আর ধীর-স্থির-নিরুত্তাপ নিখিলকে দেখে যায়। নিজের যন্ত্রণা বাইরে প্রকাশ করে না। শুধু নিখিলের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে তার ভেতরটা বোঝবার চেষ্টা করে।

মন যখন ভারী হয়ে ওঠে, অরিন্দমকে কোলে নিয়ে মুহুরিবাড়িতে যায় তিশা। বাড়িতে খুশির জোয়ার আসে তখন। নাতিকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে সুদীপা দেবী চুমুতে চুমুতে গাল-চিবুক-কপাল ভরিয়ে তোলেন। মুকুন্দবাবু ‘আমাকে দাও আমাকে দাও’ বলে সুদীপার দিকে হাত বাড়ান। সুদীপা দেবী ধমক দিয়ে বলেন, আহ্, ওরকম করছ কেন তুমি! আমাকে একটু আদর করতে দাও না। বলতে বলতে ফুঁপিয়ে ওঠেন। আনন্দের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে কেন যে সুদীপা দেবী কেঁদে দিলেন, অন্যরা বুঝতে না পারলেও তিশা বোঝে। অরিন্দমকে আদর করতে করতে হয়তো মায়ের দিশাদির সন্তানের কথা মনে পড়ে গেছে। হয়তো মা এই সময়ে ভাবছেন, এরকম একটা সন্তান দিশারও হয়েছে।

বিশাল বারান্দার রেলিংঘেঁষা আরামকেদারায় মীরা পিসি আধশোয়া হয়ে আছেন তখন। আশি ছুঁই ছুঁই। মুখে অগুনতি বলিরেখার চিহ্ন। ঘোলাটে একজোড়া চোখ। বড়পাড়ের সাদা শাড়ি পরনে। বুক পর্যন্ত দামি চাদর টানা। মাঘ গেছে, শীতটা যায়নি এখনও। পিসি আর ফিরে যাননি ছেলেদের কাছে। ভাইপো মুকুন্দ তাঁকে অশ্রদ্ধা করেননি কখনও। মায়ের মর্যাদায় তাঁকে রক্ষণাবেক্ষণ করে যাচ্ছেন। মীরা পিসি এখন আর তেমন করে চলাফেরা করতে পারেন না। তাঁকে দেখভাল করার জন্য জানকী নামের এক আয়া রেখেছেন মুকুন্দবাবু।

সুদীপা দেবী আর মুকুন্দবাবু যখন নাতিকে নিয়ে খুনসুুটি করছিলেন, মীরা পিসি সেদিকে তাকিয়েছিলেন। তেমন যে দেখতে পাচ্ছিলেন, তা নয়। কিন্তু আন্দাজ করতে পারছিলেন ভাইপো-ভাইপোবউ নাতিকে নিয়ে মশগুল হয়ে পড়েছেন। তৃষিত চোখ দিয়ে ওদিকে তাকিয়ে ছিলেন পিসি।

খেয়াল করে তিশা। মায়ের কাছে গিয়ে অরিন্দমকে চেয়ে নেয়। তারপর একপা দুইপা করে মীরা দিদিমার দিকে এগিয়ে যায়।

দিদিমার বুকে অরিন্দমকে জড়িয়ে দিয়ে তিশা বলে, দিদিমা, অরিন্দম। আমার ছেলে, আশীর্বাদ কর।

মীরা দিদিমা ঘোলাটে চোখ দুটো দিয়ে অরিন্দমের দিকে তাকায়। সেই তাকানোতে স্নেহ-মায়া-মমতার মাখামাখি। পরম ভালোবাসায় অরিন্দমের গায়ে-মাথায় হাত বোলাতে থাকেন দিদিমা। অদ্ভুত এক প্রশান্তি দিদিমার সারা অবয়বে ছড়িয়ে-জড়িয়ে।

ওই সময় আ আ করে অরিন্দম তার কচি ডান হাতখানা দিয়ে মীরা দিদিমার গালের ইকড়িমিকড়িগুলোতে চাপড় মারতে থাকে।

হেসে দেয় দিশা। বলে, দেখেছ দিদিমা, আমার ছেলে তোমাকে বলছে, তুমি এত তাড়াতাড়ি বুড়ো হয়ে গেলে কেন ? এখন তাকে কোলে নিয়ে বাড়িময় ঘুরবে কে ?

ওই সময় দ্রুত এগিয়ে আসেন মুকুন্দবাবু। বলেন, কেন ? আমি ঘোরাব আমার নাতিকে! ছাদে নেব, বাগানে নেব। মুকুন্দ বাবুর কণ্ঠস্বর শিশুকণ্ঠ হয়ে যায়।

একটু তফাতে দাঁড়িয়ে আঁচল দিয়ে চোখ মোছেন সুদীপা সেন।

অরিন্দম হামাগুড়ি দিল। হাঁটতে শিখল। প্রথমে মায়ের হাত ধরে ধরে। পরে নিজে নিজে। এক দুই তিন করে অরিন্দম চারে পড়ল। নিখিলের সামনেই চারে পড়ল অরিন্দম। নিখিল ভৌমিক ছেলের বড় হয়ে ওঠা খেয়াল করল না তেমন করে। বিশেষ একটি গ্রন্থ রচনায় ব্যস্ত তখন নিখিল―চট্টগ্রামের ইতিহাস।

উনিশ

একটা সময়ে হাঁপিয়ে উঠল তিশা। এটার নামই কি দাম্পত্যজীবন ? দুবেলা রান্নার আয়োজন, অরিন্দমের দেখভাল, রাতে নিখিলের ক্ষুধা মিটানো। নিখিল আছে তার জগৎ নিয়ে। তিশার নিজস্ব জগৎ কোথায় ? সকালে চা-নাস্তার জোগাড়যন্তর, বিমলা ঝিকে আনাজ-তরকারির কাটাকুটি দেখিয়ে দেওয়া। একসময় ঠিকাঝি বিমলার বিদেয় নেওয়া, নিখিলের ভার্সিটির উদ্দেশে বেরিয়ে পড়া। যাওয়ার সময় একটু জড়িয়ে ধরা নয়, চুমু দেওয়ার আকুতি নয়, মিষ্টি একটি হাসিও নয়। শুধু কেঠো মুখে ‘গেলাম’ বলা। ছেলেকে একটু আদর করা নিখিলের স্বভাবে নেই। শুধু জন্ম দিতে হবে বলেই যেন সে অরিন্দমকে জন্ম দিয়েছে!  কোনওদিন ইউনিভার্সিটিতে বেরোনোর সময় বলে না, অরিন্দমকে দেখ তিশা। বারান্দায় রেলিং নেই। সাবধান। এরকম নিস্পৃহতা আর ভালো লাগছে না তিশার! রক্তমাংসের মানুষ তো নিখিল! সেও তো জন্মেছে মায়ের জঠরে! বাপ তো তাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করেছেন! মায়া-মমতা-প্রেম-বাৎসল্য কাকে বলে তার তো না জানার কথা নয়! অন্তত বইপুস্তকী জ্ঞান তো আছে তার! কামের কথা যেমন আছে বইতে, প্রেমের কথাও তো আছে! নিখিল কামটা বোঝে, প্রেমটা বোঝে না কেন ?

তিশা এরকম করে ভাবে আর ক্লান্ত হয়। দাম্পত্যজীবনে কীসের গুরুত্ব বেশি―কামের না প্রেমের ? কামের উত্তেজনা ক্ষণস্থায়ী। বুদ্বুদের মতো রক্তক্ষণিকায় জেগে উঠল, তারপর ফুটুস করে ভেঙে পড়ল। মানুষের দেহে রমণেচ্ছার স্থায়িত্ব কতক্ষণের ? বড় জোর পনেরো-কুড়ি মিনিট। তারপর তো শীতলতা, শিথিলতা! কিন্তু প্রেম তো এই কামেরই মূলীভূত উপাদান! প্রেমবিহীন কাম তো ধর্ষণেরই নামান্তর! সে কী প্রতিরাতে ধর্ষিত হচ্ছে না ? হচ্ছেই তো! নিখিলের দেহ জাগল, চড়াও হলো। কোথায় আদর-সোহাগ, কোথায় প্রীতি সম্ভাষণ! ধর তক্তা মার পেরেকের মতো তার সেক্সুয়াল লাইফ। তিশা এসব চিন্তা করে আর ভেতরে ভেতরে রক্তাক্ত হতে তাকে। নিখিলকে বোঝার হাজার চেষ্টা করেও ঠিকঠাক মতো বুঝতে পারে না তিশা।

এক রাতে নতুন ঘটনা ঘটে। ঢাকা গেছে নিখিল। দিনচারেকের জন্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কী যেন কাজ আছে। রাত দশটায় ফেরার কথা। ট্রেনে। দশটা বেজে গেছে অনেক আগে। নিখিল ফিরেনি। ট্রেন হয়তো লেট। অরিন্দম ঘুমিয়ে পড়েছে। তাকে শুইয়ে দিয়ে মশারি টাঙিয়ে দিয়েছে তিশা।

ফাঁকা বাড়ি। অরিন্দম যতক্ষণ জেগে ছিল, কলরব ছিল। এখন সুনসান। শুধু অরিন্দমের ঘুমিয়ে পড়ার কথা ভাবছে কেন তিশা, নিখিল বাড়ি থাকলেও তো এরকম সুনসান! নিখিল তো বোবা! বইয়ের সমুদ্রে ডুবে থাকে সে।

ড্রইংরুমে সোফায় আলতো হেলান দিয়ে বসে আছে তিশা। উদ্গ্রীব হয়ে আছে কখন ডোরবেল বাজবে। সকালের তরকারি গরম করে নিখিলকে খেতে দেবে। সঙ্গে ডিম ভেজে দেবে। সন্ধ্যার দিকে ভেবেছিল, একটা নতুন মেনু বানাবে। শেষ পর্যন্ত ইচ্ছে হলো না। বানিয়ে কী লাভ ? এসবের কোনও দামই নেই নিখিলের কাছে। ভালোও বলবে না, মন্দও বলবে না। খেয়ে নেবে। যে কাজের প্রশংসা বা নিন্দা কিছুই নেই, সেই কাজ করতে যাবে কেন সে ?

তিশার হাই উঠছে বার বার। আলস্যে শরীর লুটিয়ে পড়তে চাইছে। সোফায় নিজকে সম্পূর্ণ এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজল তিশা।

ঠিক ওই সময় ডোরবেল বেজে উঠল। ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল তিশা। নিখিল ফিরেছে।

ঘরে ঢুকে তিশার দিকে একটু তাকাল না পর্যন্ত নিখিল। হাতে বড় একটা ব্যাগ। তিশা নিশ্চিত জানে, ওই ব্যাগে তার জন্য কোনও উপহার নেই, অরিন্দমের জন্য খাবারদাবার নেই। আছে শুধু বই। হাতমুখ ধোয়ার সময়টুকু নেই যেন নিখিলের হাতে। ব্যাগ থেকে গাদাগাদা বই বের করে টেবিলের ওপর রাখতে লাগল। এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করতে করতে স্বামীর জন্য একধরনের মমতা অনুভব করতে শুরু করেছিল তিশা। এখন নিখিলের কাণ্ড দেখে মেজাজ বিগড়ে যেতে বসল।

অধৈর্য হয়ে বলল, ওসব পরে করলে হয় না ? এত দূর থেকে এলে! স্নানটান কর। ফ্রেশ হও। খাবার খাও। তারপর না হয় কর ওসব।

মুখ তোলে নিখিল, আগে বইগুলো গুছিয়ে রাখি। তারপর যাচ্ছি বাথরুমে। বুঝলে, এবার অনেকগুলো মূল্যবান বই পেয়ে গেছি। নিখিলের কণ্ঠে খুশির ছোঁয়া।

বইয়ে ইন্টারেস্ট নেই তিশার। নির্বিকার কণ্ঠে বলে, আমার ঘুম পেয়েছে খুব।

নিখিল বলল, আচ্ছা যাচ্ছি।

কিচেনে চলে যায় তিশা। হালকা জ্বালে দুপুরের তরকারি গরম করতে করতে ভাবে―ঘরে ঢুকে একটিবার তো তাকে জড়িয়ে ধরতে পারত নিখিল! মিষ্টি একটু হাসতে পারত! জিজ্ঞেস করতে পারত, অরিন্দম কোথায় ? ঘুমিয়েছে ? এসবের কিছুই করল না সে! বই গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল! এমন নিরাসক্ত মানুষ সংসার করল কেন ?

মনটা রে রে করে উঠল, কী বলছিস তুই! নিখিল নিরাসক্ত ? পাগলা হয়ে গেছিস তুই ? ও যদি নিরাসক্ত হয়, তাহলে প্রতিরাতে তোর ওপর এরকম হামলে পড়ে কেন ? কামড়ে আঁচড়ে ছিঁড়েখুঁড়ে এরকম ছারখার করে কেন তোকে ? দেখিসনি, যেরাতে তুই রাজি হোস না, সেরাতে কীরকম হিংস্র হয়ে ওঠে সে ?

আমার ওসব ভালো লাগে না সবসময়।

ওর তো লাগে!

আমার লাগে না। প্রতিরাতের ওসবকে আমার অসভ্যতা বলে মনে হয়। তিশা বিড় বিড় করে।

মন বলে, কী চাস তুই ?

একটু প্রেম, একটু ভালোবাসা। সোহাগে আদরে ভরিয়ে তুলুক সে আমাকে। হাসি হাসি মুখে কথা বলুক সে আমার সঙ্গে। ওখানেই তো জীবন, দাম্পত্যজীবন!

মন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, ওটা তোর কপালে হয়তো নেই রে তিশা! প্রেম ছাড়া কাম নিয়েই হয়ত তোকে কাটাতে হবে সারা জীবন!

ডিমটা কাপে ফাটাতে ফাটাতে এরকম করে ভেবে যায় তিশা। কখন যে জ্বালে দেওয়া তরকারি ধরে গেছে, খেয়াল করেনি। হঠাৎ উৎকট গন্ধে হুঁশে ফিরে সে। দ্রুত চুলা বন্ধ করে।

রান্নাঘরে আসে নিখিল। ভীষণ চমকে ওঠে তিশা। কোনওদিন তো নিখিল রান্নাঘরে ঢোকে না! আজ ?

তিশা মাথা না তুলে আলতো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, কিছু বলবে ?

হ্যাঁ। না না। হ্যাঁ। আচ্ছা পরে বলব। ইতস্তত ভঙ্গি নিখিলের।

ইচ্ছে করলে বলতে পার। আমার কোনও অসুবিধা নেই।

না থাক। এখন না। আনন্দের সংবাদ পরে বললেও চলে। শেষের লাইনটা অনুচ্চ কণ্ঠে বলল নিখিল।

তিশা শুনল তা। কোনও প্রতিক্রিয়া দেখাল না। আনন্দের সংবাদটা কী অনুমান করতে অসুবিধা হচ্ছে না তিশার। হয় কোনও নামী প্রকাশক তার কোনও বই প্রকাশ করতে রাজি হয়েছে, নয় কোনও ইউনিভার্সিটিতে বক্তৃতার আহ্বান পেয়েছে। অথবা তার প্রমোশন হবে। এগুলোর কোনও একটা হবে। এসবে কোনও আগ্রহ নেই তিশার। তাই শুনতে পেয়েও আনন্দের সংবাদটা কী, জানতে চাইল না তিশা। নির্বিকার থাকল।

ডিম মামলেটটা চুলা থেকে নামাতে নামাতে বলল, তুমি টেবিলে গিয়ে বস। আমি খাবার নিয়ে আসছি।

নিখিল বলল, ঠিক আছে।

ভাত খেতে খেতে নিখিল বলল, তোমার দিদির সঙ্গে দেখা হলো ট্রেনে।

ক্লান্ত ভঙ্গিতে পাশের চেয়ারে বসেছিল তিশা। দিদির কথা শুনেই সোজা হয়ে বসল। অবাক চোখে বলল, দিদির সঙ্গে দেখা তোমার ? কোন দিদি ?

দিশা মুহুরি। গ্রাস মুখে পুরতে পুরতে বলল নিখিল।

তুমি দিদিকে চিনলে কী করে ?

উনিই চিনেছেন আমাকে। ঢ্যাঙ্গা বলে হয়তো দৃষ্টি কেড়েছিলাম আমি তাঁর। সরাসরি এসে বললেন, আপনি নিখিল ভৌমিক না ? প্রফেসর ?

আমি মৃদু মাথা নেড়েছিলাম। বিস্মিত হইনি। এরকম চলতিপথে অনেক ছাত্রছাত্রী অভিভাবকের সঙ্গে দেখা হয়। মনে করেছি, হয়তো আমার কোনও ছাত্রী হবে।

তারপর! তিশার কণ্ঠ থেকে বিস্ময় কাটে না।

একটা ছেলে আছে সাত-আট বছরের। শুভেন্দু নাম। বেশ ছটফটে। তোমার দিদির হাজবেন্ডটিও দেখতে বেশ। ভদ্রলোকও আগবাড়িয়ে কথা বললেন আমার সঙ্গে।

কী কথা ? তিশার অপার আগ্রহ।

তোমার মা-বাবা কেমন আছেন ? তুমি কেমন আছ ? মীরা পিসি কেমন আছেন ? আমাদের বিয়ের তারিখ জানতেন তাঁরা। অপমানের ভয়ে বিয়েতে আসেননি―এসব।

দিদি কেমন আছে ? দিশাদি ?

দেখে তো মনে হলো সুখে আছেন বেশ। শাশুড়ি মারা গেছেন গত বছর। ডাক্তার ডায়াসের প্রোমেশন হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে পোস্টিং পেয়েছেন। বান্দরবানের পাট চুকাবার জন্য চট্টগ্রামে ফিরছেন।

শুনতে শুনতে তিশার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এর মধ্যে নিখিলের খাওয়া শেষ হয়েছে। মুখ ধোয়ার জন্য বেসিনে গেল নিখিল।

নিজের থালায় ভাত নিতে নিতে তিশা বলল, এই তোমার আনন্দের সংবাদ ?

নাহ্। আরও সংবাদ আছে। বলে ডাইনিং টেবিলে এসে বসল নিখিল।

আজ যেন বিস্ময়ের পর বিস্ময়ের দিন। খাওয়ার পর কখনও ডাইনিং টেবিলে বসে না নিখিল। সরাসরি স্টাডিরুমে চলে যায়। আজ বসল। এটা ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রম বলেই বিস্ময়ের। তাই বিস্মিত হয়ে স্বামীর দিকে চোখ তুলল তিশা। বলল, কী সংবাদ ?

তুমি শিক্ষকতা করবে ? অধ্যাপনা ?

মাখাভাত মুখে পুরেছে তখন তিশা। নিখিলের কথা শুনে ওই অবস্থাতেই ভিরমি উঠল তিশার। দম বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হলো। বাথরুমের দিকে ছুটে গেল সে। সেখানে উগরে দিল সব। চোখেমুখে পানি ঝাপটাল বেশ কিছুক্ষণ। আঁচলে মুখ মুচতে মুচতে নিখিলের সামনে ফিরে এল।

নিখিল স্বভাবসুলভ নির্জীব গলায় বলল, সিটি কলেজের নাম শুনেছ তুমি। আইস ফ্যাক্টরি রোডে। বহু বছর আগের কলেজ। বেসরকারি। বেসরকারি হলে কী হবে, রেজাল্টে বছর বছর সরকারি কলেজগুলোকে টেক্কা দেয়।

তিশা এই প্রথম বোধহয় নিখিলের কথা শুনে বিরক্ত হচ্ছে না। অদ্ভুতভাবে স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছে।

নিখিল মৃদুস্বরে বলে, ঢাকায় ওই কলেজের প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা আমার। ওঁর মেয়ে ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ে। ইতিহাসে। আমিও হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে গেছিলাম। কাকতালিয়ভাবে ওখানেই দেখা প্রিন্সিপাল সাহেবের সঙ্গে। আমার পরিচয় পেয়ে বললেন, তাঁর কলেজে বাংলায় একটা লেকচারের পোস্ট খালি হয়েছে। টিচার চান। আমার জানাশোনা কোনও ক্যান্ডিডেট আছে কিনা জানতে চাইলেন। আমি ইশারা-ইঙ্গিতে তোমার কথা বলেছি। পরেরটা তোমার সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে।

পূর্ণশশী হাতে পাওয়ার আনন্দের মতো উদ্বেলিত হয়ে ওঠে তিশা। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে প্রায় চিৎকার করে বলে, আমি করব। আমি অধ্যাপনা করব। তুমি ব্যবস্থা কর প্লিজ।

নিখিল নিরুত্তাপ গলায় বলে, পোস্টিং বিশেষ একটা প্রসেসের মধ্য দিয়ে হবে। নির্বাচক কমিটি হবে একটা। অনেক ক্যান্ডিডেটের মধ্যে তুমিও একজন হবে। তোমার উত্তরে কমিটি যদি সন্তুষ্ট হয়, চাকরিটা তোমারই হবে।

অবুঝ শিশুর গলায় তিশা বলে, ওসব আমি বুঝি না। সিটি কলেজে তুমি আমার চাকরির ব্যবস্থা কর।

নিখিল বলে, রাত অনেক হয়েছে। খাওয়া শেষ কর। শুতে চল।

আমি আর খাব না। তুমি বেডরুমে যাও। রান্নাঘর সামলে আমি আসছি―খুশিতে আটখানা হতে হতে তিশা বলে।

সেরাতেও বিছানাতে ঝড় উঠেছিল।

বিধ্বস্ত হতে মন্দ লাগেনি তিশার, সেরাতে।

সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ

——————–

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button