লিটল ম্যাগ
ফারুক সুমন
‘সাম্প্রতিক সময়ে বাংলা প্রবন্ধ-শাখায় আকাল চলছে।’ এমন নেতিবাচক মন্তব্যের বিপরীতে আশাজাগানিয়া ‘প্রবন্ধ-সংখ্যা’ প্রকাশ করেছে সাহিত্যের ছোটকাগজ বুনন। বৃহৎ কলেবরের এই সংখ্যাটি নিশ্চয় একদিন সময়ের স্মারক হিসেবে চিহ্নিত হবে। এখানে সন্নিবেশিত প্রবন্ধগুলো শিল্পসাহিত্য ও সংস্কৃতির নানাপ্রান্ত ছুঁয়েছে। সমাজ, সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্যসহ বিভিন্ন বিষয় নবীন-প্রবীণের লেখায় সমৃদ্ধ। এটি বুনন-এর অষ্টম সংখ্যা। করোনা মহামারির দুঃসময়ে নানা সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও সম্পাদক-কবি খালেদ উদ-দীন বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের কাজ অব্যাহত রেখেছেন। এই সংখ্যার জন্যে তিনি আশাতীত প্রবন্ধ পেয়েছেন। সম্পাদকীয়তে এই প্রসঙ্গের ইঙ্গিত রয়েছে :
‘বুনন প্রবন্ধ সংখ্যার জন্য কাক্সিক্ষত প্রায় সব লেখা আমরা পেয়েছি এবং সংখ্যায় তা ছিল অনেক বেশি। সব লেখা কোনওভাবেই ছাপানো সম্ভব ছিল না। অনেক লেখা নতুন এ সংখ্যার ভাবনার সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। আমরা এমন অনেক লেখা পেয়েছি যা ছাপাতে পারলে নিঃসন্দেহে বুনন আরও ঋদ্ধ হতো। নানান সীমাবদ্ধতায় তা সম্ভব হলো না। আগামী সংখ্যাগুলোতে প্রবন্ধগুলো প্রকাশের চেষ্টা থাকবে। সম্মানীয় লেখক, সে পর্যন্ত অপেক্ষার দাবি থাকল।’
মূল আয়োজন প্রবন্ধকেন্দ্রিক হলেও সময়ের অভিঘাত নিয়ে লেখা নিবন্ধও স্থান পেয়েছে। পত্রিকার শুরুতে সূচিবদ্ধ হয়েছে আশির দশকের কবি কামরুল হাসানের লেখা ‘ভাইরাসের জগতে একচক্কর’। তিনি সরস গদ্যে ভাইরাস সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। বিজ্ঞানের বিষয়কে সাহিত্যের পেলবতা দিয়ে উপস্থাপনে তাঁর মুন্সিয়ানা প্রশংসা পাওয়ার দাবি রাখে। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। অথচ করোনা ভাইরাসের প্রাবল্যে তারা অসহায় হয়ে দিনাতিপাত করছে। লেখকের ভাষায় :
‘একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীব করোনা ভাইরাস পুরো বিশ্ব দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, গোটা পৃথিবী তার ভয়ে কাঁপছে। শক্তিশালী মানুষ তার ভয়ে দরজা জানালা কপাট লাগিয়ে ঘরের ভেতর লুকিয়েছে। সৃষ্টির সেরা জীবকে কোনও গ্রাহ্যের মধ্যেই আনছে না এই ভাইরাস। মানুষের সমরাসূত্র, যুদ্ধবিমান, যুদ্ধজাহাজ, পারমাণবিক বোমা, সাবমেরিন, মিসাইল, মেশিনগান, কামান- কোনও কিছুই কাজে আসছে না। এক বিপুল হন্তারক হয়ে উঠেছে এই শয়তান ভাইরাস।’
‘আত্মকথা’ পর্বে কলম ধরেছেন বরেণ্য কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী, কবি মলয় রায়চৌধুরী, কবি হাফিজ রশিদ খান এবং কবি অমলেন্দু বিশ্বাস। কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর লেখা ‘তিন ভুবনের চাঁদ’ শীর্ষক কাব্যময় গদ্যে উপস্থাপিত হয়েছে তিন প্রজন্মের ঈদ উদযাপন, কথকতা। কবি স্বয়ং, তাঁর পুত্র-কন্যা এবং নাতি-নাতনিদের ঈদ-অনুভব লেখায় ধরতে চেয়েছেন। লেখকের ভাষায় : ‘আমার কিংবা আমাদের অবস্থানের প্রেক্ষিত বিবেচনায় আমার সন্তানদের ঈদ-উৎসব ও ঈদ-ভাবনা ভিন্নতর। আবার আমার সন্তানদের সন্তানেরা যেভাবে এখন ঈদ-আনন্দে অবগাহন করছে তাতে তাদের অভিভাবকদের প্রতিচ্ছায়া বিদ্যমান। … চাঁদের ভাষার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে উদ্ভাসিত হয় আনন্দের রূপ। ধর্ম ও মর্ম অনন্তস্রোতে আমাদের অবগাহন করুক।’
ষাটের দশকের কবি মলয় রায়চৌধুরী। বাংলা সাহিত্যে ‘হাংরি জেনারেশন’ সাহিত্য-আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা। তিনি লিখেছেন ‘আমার প্রথম কবিতার বই’ শীর্ষক আত্মকথা। ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কবিতার বই শয়তানের মুখ। কবি ও কথাশিল্পী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘কৃত্তীবাস প্রকাশনী’ থেকে বইটি প্রকাশ করেছিলেন। তবে তার আগে (১৯৬২) প্রকাশিত হয়েছে গদ্যগ্রন্থ মার্ক্সবাদের উত্তরাধিকার। মলয় রায়চৌধুরীর ভাষ্যমতে, এই বইটি প্রকাশে সহযোগিতার নামে অসহযোগিতা করেছিলেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। তিনি অভিমানে-দুঃখে সেই বই শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের উল্টোডাঙার বস্তিবাড়ির সামনে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন। এমনতর স্মৃতিকথায় উঠে এসেছে সেই সময়ের অনেক অজানা অধ্যায়। এসব সবিস্তারে জানতে লেখাটি পড়া যেতে পারে।
কবি ও আদিবাসী গবেষক হাফিজ রশিদ খান লিখেছেন আত্মকথা ‘আমার কবিতার আদিবাসীপর্ব’। দারিদ্র্যলাঞ্ছিত ও অধিকারবঞ্চিত আদিবাসীদের জীবনসংগ্রামের বৃত্তান্ত নিজের কবিতায় কীভাবে এসেছে। সে-সম্পর্কে সবিস্তারে লিখেছেন তিনি। তাঁর ভাষায় : ‘শ্রমময় জুমচাষে ওদের যৌথ অংশগ্রহণ, রোদ-বৃষ্টির তোয়াক্কা না-করা নিবিড় কর্মস্পৃহা নমনীয় করে তোলে আমার মন ও মেজাজ। পাহাড়ের খাড়া ঢালে নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোরের কাজের ভিড়েও এক অপার প্রশান্ত নীরবতা অনুভব করে নিঃসঙ্গতার বিরল অভিজ্ঞতায়ও ঋদ্ধ হয়েছি। ছায়াকুঞ্জে চারপাশের দৃষ্টি এড়ানো তরুণ-তরুণীর হৃৎকথনের বিনিময় লক্ষ্য করে পার্থিব ভালোবাসায় নমিত হতে শিখেছি।’
অনুরূপভাবে নিজের কাব্যভ্রমণের অন্তরঙ্গ আলাপ উপস্থাপন করেছেন কবি অমলেন্দু বসু। ‘আমার কবিতা পড়া ও কবিতা লেখা’ শিরোনামের আত্মকথায় যেমন আছে শৈশবকৈশোর কিংবা যৌবনের কাব্যমগ্নতার কথা। তেমনই ক্রমশ কবিতার সচেতন সরণি ধরে হাঁটার অভিজ্ঞতাও এসেছে হার্দিক কাব্যগন্ধী গদ্যে। তাঁর কবিমানস গঠনে কীভাবে জীবনানন্দ দাশ, বিনয় মজুমদার, শক্তি চট্টোপাধ্যায় কিংবা আল মাহমুদ এসেছেন। সে-সম্পর্কে করেছেন অকপট উচ্চারণ।
সমাজ, সাহিত্য ও দর্শনবিষয়ক প্রবন্ধ লিখেছেন যথাক্রমে মতিন বৈরাগী, রায়হান রাইন, কামরুল আহসান, মযহারুল ইসলাম বাবলা, আজিজ কাজল, ওয়াহিদ সারো, ফকরুল চৌধুরী এবং সৌম্য সালেক। কবি মতিন বৈরাগীর ‘অলস সময়ের হাওয়া’ এবং কবি রায়হান রাইনের ‘শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্করের দর্শন’ নিবিড় অভিনিবেশনির্ভর চমৎকার দুটি প্রবন্ধ। ‘অলস সময়ের হাওয়া’ শিরোনামের প্রবন্ধে মানবজীবনের ব্যাপ্তি, অন্তর্গত ভাবব্যঞ্জনা এবং সমাজ-রাজনীতির দার্শনিক ভিত্তি একজন কবির চোখে আমরা যাচাই করে দেখতে পারি। যেমন তিনি বলেন : ‘মানুষ নিজেকে নিয়ে খুশি থাকতে পারে খুবই কম। কারণ তার চারপাশের যে জগৎ সেখান থেকে প্রতি মুহূর্তে যে মায়া বিচ্ছুরিত হয় এবং তার ইমেজ মানুষের মনে ধরা পড়ে ও তাকে প্রলুব্ধ করে। নীরব বস্তু তখন তার মনের মধ্যে যে ক্রিয়া ঘটায় সেখান থেকে তৈরি হয় রূপান্তর এবং এই রূপান্তর দৈনন্দিন জীবনে নানান লাভ/লোভ হয়ে তার মধ্যে বিরাজ করতে শুরু করে, কারণ এই রূপান্তর ক্রিয়া বদল ঘটে আর্থিক সুবিধার যা বিনিময়ের মাধ্যমে এবং এর মধ্যেই থাকে একজন মানুষের প্রভাব-প্রতিপত্তি, অস্তিত্ব-অনস্তিত্ব সফলতা-বিফলতা।’ রায়হান রাইন তাঁর ‘শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্করের দর্শন’ শীর্ষক প্রবন্ধে রায়হান রাইন অতীশ দীপঙ্করের দর্শনভিত্তি আবিষ্কারের প্রয়াস রেখেছেন। দার্শনিক নাগার্জুন, মৈত্রেয়নাথ, চন্দ্রকীর্তি এবং শান্তরক্ষিতের দর্শনগত বোধ আলোচনার সমান্তরালে অতীশ দীপঙ্করের দর্শনপ্রয়াসকে পরিচিত করেছেন। তিনি তাঁকে মাধ্যমিকবাদী দার্শনিক হিসেবে অভিহিত করেছেন। যেটা অনেকের কাছে ‘শূন্যবাদ’ হিসেবে প্রচলিত।
ইতিহাস-ভিত্তিক দুটি অনবদ্য প্রবন্ধ লিখেছেন যথাক্রমে মাহফুজ পারভেজ (‘দেশভাগের পরেও দেশান্তরের স্রোত’) এবং আসিফ আযহার (প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও ওসমানীয় সাম্রাজ্য)। মাহফুজ পারভেজ তাঁর ‘দেশভাগের পরেও দেশান্তরের স্রোত’ প্রবন্ধে মূলত মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের দেশত্যাগের ব্যাপারটি ইতিহাসের নিরিখে শনাক্ত করতে চেয়েছেন। দেশত্যাগ, উদ্বাস্তু জীবন, নিপীড়ন ও খুন-ধর্ষণ সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন।
বুনন-এর প্রবন্ধ সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি স্থান পেয়েছে কবি ও কবিতাবিষয়ক প্রবন্ধ। তুলনায় সাহিত্যের অন্য মাধ্যমগুলোর স্বল্পতা চোখে পড়ে। যেমন গল্প-উপন্যাস, নাটক, সংগীত, ছড়া এবং চিত্রকলা বিষয়ক আরও কিছু প্রবন্ধ সংযোজিত হলে বোধ করি ভালো হতো। কবি ও কবিতাবিষয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন যথাক্রমে তৈমুর খান, ফকির ইলিয়াস, সন্তোষ ঢালী, মজিদ মাহমুদ, মামুন মুস্তাফা, সুহিতা সুলতানা, মাহফুজ আল-হোসেন, আনোয়ার কামাল, মনসুর আজিজ, বাবুল আনোয়ার, ফারুক সুমন, উদয় শংকর দুর্জয়, মোরশেদুল আলম, আজির হাসিব, বঙ্গ রাখাল, জাকারিয়া প্রীণন এবং সঞ্জয় রায়।
‘কবিতাভাবনা’ পর্বটি বেশ উপভোগ্য। কবি ফরিদ আহমেদ দুলাল, কবি শিবলী মোকতাদির, মুহম্মদ আবদুল বাতেন, জব্বার আল নাঈম, এমএইচ মোবারক ওয়াহিদ, ওয়াহিদ রোকন এবং হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় কবি ও কবিতা নিয়ে নিজেদের সৃজনবেদন বিজড়িত ভাবনা চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন। সবার মতামতের সাথে সহমত পোষণ করা সম্ভব না হলেও পর্বটি কবিতামোদী পাঠকের মনে নতুন ভাবনার খোরাক জোগাবে।
‘পাঠ-মূল্যায়ন’ পর্বে অনবদ্য কয়েকটি প্রবন্ধ সংযোজিত হয়েছে। লিখেছেন গোলাম কিবরিয়া পিনু, শহীদ ইকবাল, স্বপন নাথ, মোস্তাক আহমাদ দীন, সাহেদা আখতার, পিয়াস মজিদ, সোলায়মান সুমন, জয়নাল আবেদীন শিবু, ইমরান মাহফুজ এবং মোহাম্মদ বিলাল উদ্দিন। তাঁদের লেখা বিভিন্ন লেখকের ব্যক্তি ও সৃষ্টিবৈভবের অন্দরমহল উন্মোচিত হয়েছে। ‘ঐতিহ্য’ অংশে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ সন্নিবেশিত হয়েছে। ‘মণিপুরি ভাষা ও সাহিত্য : পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ শিরোনামে তথ্যসমৃদ্ধ প্রবন্ধ লিখেছেন এ কে শেরাম। এই প্রবন্ধে মণিপুরি ভাষা, মণিপুরি লিপি, এবং মণিপুরি ভাষা-সাহিত্যের যুগবিভাজন সম্পর্কে একটা স্পষ্ট রূপরেখা পাওয়া যাবে। ‘নাগরীলিপির প্রত্যাবর্তন’ শিরোনামে প্রবন্ধ লিখেছেন মোস্তফা সেলিম। আমিনুর রহমান সুলতানের ব্যতিক্রমধর্মী একটি প্রবন্ধ ‘শোলাশিল্প’। এই প্রসঙ্গটি আমাদের অনেকের কাছেই হয়তো নতুন। কিন্তু শোলা ব্যবহার করে দৃষ্টিনন্দন খেলনা ও প্রয়োজনীয় উপকরণ তৈরিতেও রয়েছে শিল্পশোভা। লেখক প্রবন্ধে সে-সবের অনুপুঙ্খ আলোচনা করেছেন। বাংলাদেশের শোলাশিল্প নিয়ে পুঁথিসাহিত্য নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ লিখেছেন জালাল খান ইউসুফী। ‘পুঁথিসাহিত্যের অতীত ও বর্তমান’ প্রবন্ধে পুঁথিসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ লেখক এবং সেই সময়ের নানা পরিপ্রেক্ষিত বর্তমানের সাহিত্যযাত্রার আলোকে পর্যালোচনা প্রয়াস রয়েছে।
এছাড়া অনুবাদ, পাঠ ও পঠন, গল্পকথা, চলচ্চিত্র ও গান, বিদেশি সাহিত্য এবং এই সময়ের কবিতা শিরোনামে স্বতন্ত্র অধ্যায় সংযোজিত হয়েছে। যেখানে প্রথিতযশা নবীন-প্রবীণের লেখা স্থান পেয়েছে। সর্বোপরি, সমকালীন শিল্পপরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় বুনন-এর প্রবন্ধ-সংখ্যাটি নিঃসন্দেহে অনন্য শিল্পপ্রয়াস। শিল্পসাহিত্যের সমঝদার যে কেউ সংখ্যাটি সংগ্রহ করতে পারেন।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক
—————–