আর্কাইভজীবনকথা

যে জীবন আমার ছিল – সপ্তম পর্ব

ধারাবাহিক জীবনকথা

ইমদাদুল হক মিলন

শ্বের ক্ষুদ্রতম মুদিদোকানটি ছিল মেজোনানির। ছোট একটা টিনের কৌটায় তিনচার প্যাকেট বিড়ি, কয়েকটা ম্যাচবক্স, আর একটা মালশায় খানিকটা তামাক, এই ছিল দোকান। নানাকে দিয়ে বিড়ি আর ম্যাচবক্স পাইকারি দরে কিনে আনাতেন মাওয়ার বাজার থেকে। তামাকটা নিজেই তৈরি করতেন। তামাক পাতা কুচি কুচি করে কেটে রাবে মাখিয়ে মালশায় রেখে দিতেন। এক পয়সায় একমুঠো তামাক বিক্রি করতেন। সব মিলিয়ে তার মূলধন ছিল দেড় দুটাকা। মাসে হয়তো আয় হতো ছয়আনা আটআনা। দোকানের ‘গাহেক’ ছিল হাজামবাড়ির মানুষজন আর আশপাশের বাড়ির চউরারা। নানির দোকানের পয়সা নিয়মিত চুরি করত জাহাঙ্গির মামা, আলমগির মামা। ধরাও পড়ত। ধরা পরার পর মারটা নানি দিতেন না, দিতেন নানা। গরু চড়াবার লাঠি নিয়ে ‘বউয়ার পো’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়তেন ছেলেদের ওপর। ছেলেরা ‘বাবাগো বাবাগো’ বলে ত্রাহি ডাক ছাড়ত। দুই-একদিন পর মারের কথা ভুলে আবার চুরি করত।

বিল, মাঠঘাট থেকে বর্ষার পানি সরে যেত শরতের শুরুতে। আশ্বিন কার্তিক মাসের সেই সব দিনে মাঠঘাটে প্যাঁচপ্যাঁচে পানি কাদা। না নৌকা চলে, না ভালো মতন হাঁটা যায়। হাঁটু পর্যন্ত লুঙ্গি তুলে বাড়ির পুরুষ মানুষরা হাট বাজারে যেতেন। গোয়ালিমান্দ্রার হাটে ওই সময় পাওয়া যেত আনাজপাতির চারা। বেগুন, টমেটো, পেঁয়াজ মরিচের চারা। তামাক চারাও পাওয়া যেত। দশ মুঠোর দাম হয়তো এক আনা দুআনা। সেই সব চারা কিনে এনে বাড়ির নামার দিকে লাগাত গৃহস্থরা। ছোট ‘কোলায়’ লাগাত। বুজি লাগাতেন আমাদের ঘাটপারের দিকটায়। কয়েকদিনের মধ্যেই লম্বা লম্বা বেগুন ধরতো, বড় বড় টমেটো পেকে টকটকে লাল হত।

বুজি তামাক চারা লাগাতেন না, লাগাতেন মেজোনানি। একটা সময়ে তামাক পাতা শুকিয়ে ‘সাদা পাতা’ করতেন। শুকনো তামাক পাতা কুচি কুচি করে কেটে রাব মিশিয়ে ভাত তরকারি মাখাবার মতো করে মাখাতেন। সেই তামাকই এক মুঠো বিক্রি করতেন এক পয়সায়।

মেজোনানির মুদিদোকানটি আমার অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়াল। আমিও ওরকম একটা মুদিদোকান দিতে চাই। কিন্তু বিড়ি ম্যাচবাতি তামাক বিক্রি করব না। বিক্রি করব লজেন্স বিস্কুট মুড়লি ভাজা, এই সব। শুনে বুজি হাসলেন। আমার বেশিরভাগ কথাই তিনি রাখেন। মূলধন হিসেবে আটআনা পয়সা দিলেন। মাওয়ার বাজারে গিয়ে জিনিসগুলো কিনে আনলাম। বাড়িতে এনে তিনটা ছোট বয়ামে রাখলাম লজেন্স বিস্কুট মুড়লি ভাজা। প্রথম প্রথম এক দুদিন বাড়ির পোলাপান এক পয়সা দুপয়সার জিনিস কিনলো। তাদের কাছে যতটা জিনিস বিক্রি করি তারচেয়ে অনেক বেশি নিজে খেয়ে ফেলি। দুআনা না তিনআনা যেন সাকুল্যে তুলতে পেরেছিলাম। পাঁচআনাই লস।

এই মুদিদোকানের স্মৃতি ব্যাপকভাবে আক্রান্ত করত সাতষট্টি সালের সেই সব দুঃখের দিনে। আব্বার চাকরি নেই। অনাহারে অর্ধাহারে আমাদের দিন কাটে। আমি আর মণি পড়ি ক্লাস সেভেনে। দাদা ক্লাস নাইনে। ছোটভাই বোনরাও একেকজন একেক ক্লাসে। মুরগিটোলার জীবন। দিশেহারা আব্বা সাদা কাগজে নোট লিখে পঞ্চাশ টাকা একশ টাকা ধার আনেন কারও কারও কাছ থেকে। সেই সব পাওনাদার বাড়িতে এসে এমন হৈ চৈ করে, এমন মারমুখো ভঙ্গি তাদের, ভয়ে আমরা কাঁপতে থাকি। ছেলেমেয়েদের সামনে আব্বাকে কি মারবে? নানা রকমভাবে লোকগুলোকে বুঝ দেওয়া হয়। হয়তো সারাদিনে বাড়িতে একবার রান্না হচ্ছে সন্ধ্যার দিকে। চুলার পাড়ে বসে মা কাঁদছেন। চুলায় ভাত টগবগ করে ফুটছে আর মা বারবার আঁচলে চোখ মুচছেন। ‘পয়সা’ গ্রামে পৈতৃক সূত্রে আব্বা যেটুকু জমিজিরাত বা ভিটেমাটি পেয়েছিলেন সেই সব বিক্রি হয়ে গেছে আগেই। এখন আছে শুধু মায়ের দিককার, মেদিনীমণ্ডলের সামান্য কিছু জমি। নানা জমি রেখে গিয়েছিলেন বিস্তর। বিশ পঁচিশ কানি তো হবেই। পাঁচ বিঘায় এক কানি। মা আম্মার বিয়ের জন্য জমি কিছু বিক্রি করেছেন বুজি। পরে বিক্রি করেছেন ছোট জামাইকে পড়াবার জন্য আর তারও পরে আমাদের জন্য। পাঁচ ছয় বছর বয়সকালে দেখেছি ঘোরতর বর্ষা আর বৃষ্টির দিনে বড় একটা কেরায়া নৌকা করে ভোরবেলা আমরা রওনা দিয়েছি দিঘলী বাজারে। সেখানে সাবরেজিস্ট্রি অফিস। জমি বিক্রি করতে চলেছেন বুজি। সঙ্গে আমি আছি। জমি হয়তো কিনে নিচ্ছেন মায়ের ফুফাতো ভাইয়েরা কেউ বা চাচারা কেউ বা দূরসম্পর্কের কেউ। নৌকায় তাঁরাও আছেন। তাঁদের বসে থাকা বা কথা বলার ভঙ্গিতে ফুটে আছে তীব্র অহংকারি ভঙ্গি। যেন গোষ্ঠীর যে মানুষটি, আলতাব উদ্দিন সারেং একদা তাদের সবাইকে টেনে তুলেছেন, জাহাজে চাকরি দিয়ে পায়ের তলার মাটি শক্ত করে দিয়েছেন, তাঁর পরিবারের দুর্দিন দেখে ওই সব মানুষ ভিতরে ভিতরে খুবই আনন্দিত। অন্যদিকে বুজি আছেন বিষণ্ন হয়ে। কালো মেঘের মতো দুঃখ বেদনা ছায়া ফেলেছে তাঁর মুখে।

নৌকা চলছে চক ঢেকে রাখা ধানক্ষেতের উপর দিয়ে। লগিতে ‘খোচ’ দিচ্ছে মাঝি আর ধানপাতায় খসর খসর শব্দ তুলে এগোচ্ছে নৌকা। দিঘলী বাজারে পৌঁছাতে সকাল ন’টা সাড়ে ন’টা বেজে যাবে। কাজ সেরে ফিরতে ফিরতে বিকেল। দুপুরে খাওয়ার জন্য ভাত রেঁধে নিয়েছেন বুজি। ইলিশ মাছ ভেজে নিয়েছেন বা মুসরি ডালের ভর্তা। ওসব খেতে আমার ভালো লাগে না। আমি যাচ্ছি মিষ্টির লোভে। জমি বিক্রি হয়ে গেলেই এক হাঁড়ি মিষ্টি কেনা হবে। রসগোল্লা লালমোহন আমৃত্তি বালুসা। ফেরার সময় গভীর আনন্দ নিয়ে একটার পর একটা মিষ্টি খাব আমি। আর বুজিকে দেখবো উদাস হয়ে কোনদিকে যে তাকিয়ে আছেন বোঝা যায় না। মুখটা হয়ে আছে করুণ। জমি হারানোর দুঃখে ম্লান হয়ে আছেন মানুষটি। বুজির সেই বিষণ্ন মুখ আমি ভুলতে পারি না। দুই মেয়ের সংসার সামলাতে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলেন মানুষটি। নাতি নাতনিরা কী খেয়ে বাঁচবে সেই আতঙ্কে দিশেহারা হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত পাগল হয়ে পানিতে ডুবে মারা গেলেন আমাদের ওই মুরগিটোলার জীবনে।

আম্মার কাছে আমাদের রেখে মা আব্বা গেছেন মেদিনীমণ্ডলে জমি বিক্রি করতে। দাদা আর মণি বীণাখালাদের বাড়িতে। আমরা মুখ শুকনা করে বারান্দায় বসে আছি। সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। দুপুরের পর আমাদের অনাহারি শুকনো মুখ আম্মা আর সহ্য করতে পারলেন না। এমন অসহায় ভঙ্গিতে কাঁদতে লাগলেন! তার দেখাদেখি আমরাও কাঁদি। বাড়ির একতলা দালানটির লাগোয়া পুবদিকে নূর ইসলামদের বাড়ি। বাড়িতে কয়েকটা ছাপড়া ঘর। নূর ইসলামের বিধবা মা মোটাসোটা জাঁদরেল মহিলা। ছাপড়া ঘরগুলো ভাড়া দিয়ে সংসার চালান। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। একমাত্র ছেলে নূর ইসলামকে নিয়ে তাঁর জীবন। আম্মার কান্নার শব্দটা তিনি পেলেন। উদ্বিগ্ন মুখে ছুটে এলেন। তাঁর সঙ্গে আশপাশের বাড়িঘরের আরও দুতিনজন মহিলা। কাঁদতে কাঁদতে আম্মা কোনও রকমে নূর ইসলামের মাকে ঘটনা বললেন। কিছুক্ষণের মধ্যে দেখি নূর ইসলামের মা এলুমিনিয়ামের একটা গামলায় করে দু তিন সের চাল নিয়ে এসেছেন। কেউ এনেছেন কয়েকটা ডিম, গোলআলু আর ডাল। খিচুড়ি রান্না করে চোখের জলে ভাসতে ভাসতে আম্মা আমাদের খাওয়ালেন।

পাওনাদারদের ভয়ে বাসায় থাকতে পারতেন না আব্বা। কোথায় কোথায় গিয়ে যে থাকতেন আমরা জানতামও না। একটা জায়গার কথা শুধু জানতাম। কুলোটোলার কোণার দিককার মসজিদ আর মসজিদের উল্টো দিককার পির সাহেবের বাড়ি। আব্বা সেই পিরের মুরিদ ছিলেন। পাওনাদারদের ভয়ে ওখানকার মসজিদে শুয়ে রাত কাটাতেন। পির সাহেবের বৈঠকখানায় শুয়ে থাকতেন। এই দুটো জায়গার কথা পাওনাদাররাও কেউ কেউ জেনে গিয়েছিল। তখন আব্বা রাত কাটাতে চলে যেতেন অন্যত্র। ভোররাতে উঠে ধোলাইখালের খেয়া পার হয়ে বাসায় আসতেন। মার হাতে একটা দুটো টাকা গুঁজে দিয়ে চলে যেতেন।

বুজির জমি বিক্রির টাকা থেকে শ’দেড়েক টাকা মূলধন করে আব্বা একটা মুদিদোকান দিলেন এসময়। মুরগিটোলাতেই। ওই দোকান ঘরের মালিকও আফতাব মিয়া, যার বাড়িতে আমরা ভাড়া থাকতাম। মাসিক ভাড়া বিশ না তিরিশ টাকা যেন। তেল লবণ চিনি সাবান সোডা বিড়ি সিগ্রেট পেঁয়াজ আদা রসুন মরিচ লজেন্স বিস্কুট যা যা থাকে মুদি দোকানে ওসবই। সূত্রাপুরের একটা পাইকারি দোকান থেকে চাঙারি ভরে মাল নিয়ে আসতাম আমরা। দাদা এসবের ধারে কাছেও নেই। সে থাকে মিন্টু মামাদের সঙ্গে, তাদের বাড়িতে। আব্বার সঙ্গে আছি আমি। যতক্ষণ স্কুলে থাকি ততক্ষণ আব্বা চালান দোকান। বাকি সময়টা আমি। ওই দোকানে বসে বসেই বিক্রিবাটার ফাঁকে স্কুলের পড়াটা পড়ি। বহুদিন বেতন দেওয়া হয় না স্কুলের। স্যাররা প্রায়ই বেতনের কথা বলেন। বন্ধুদের কাছে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারি না। আব্বা একদিন ¤ান মুখে আমাদের স্কুলে গেলেন। অনুনয় বিনয় করে হেড স্যারকে নিজের অসহায়ত্বের কথা বলে এলেন। একদিন চিনি ভেবে এক কাস্টমারকে লবণ দিয়েছিলাম। খানিকপর লোকটা ফিরে এসে পোটলাটা আমার মুখে ছুড়ে মেরেছিল। আক্ষরিক অর্থেই মুখে। লবণের রোয়ায় আমার মুখ আর শরীর ভরে গিয়েছিল।

আরেকদিন গভীর উৎসাহ নিয়ে সূত্রাপুর বাজারে দোকানের মাল কিনতে যাচ্ছি আব্বা আর আমি। তেল-মিলের ওখানটায় আব্বাকে ধরল সেলিমগুণ্ডা। সে এক পাওনাদারের টাকা তুলে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে। মূলত এই গুণ্ডাটির ভয়ে আব্বা বাসায় থাকতে পারতেন না। আব্বার গায়ে লোকটি একবার হাতও তুলেছিল। যেখানে যেখানে বসে সেলিমগুণ্ডা আড্ডা দিতো, আব্বা ওদিকটা এড়িয়ে চলতেন। সেদিন বোধহয় বেখেয়ালে ছিলেন। সেলিম তাঁর পথ রোধ করে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে আব্বার মুখটা শুকিয়ে এই এতটুকু হয়ে গেল। ছেলের সামনে অপদস্থ হওয়ার ভয়ে আমাকে বললেন, ‘বাজান, তুমি কাঠেরপুলের ওই পাড়ে গিয়া খাড়াও। আমি আইতাছি।’

আব্বাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছিল না। তারপরও গেলাম। বেশিক্ষণ ওখানটায় দাঁড়াতে হলো না। শুকনো অসহায় মুখে আব্বা এলেন। ‘লও বাজান’। আমি আব্বার সঙ্গে হাঁটতে লাগলাম। সারাটা পথ আব্বা আর একটাও কথা বললেন না। যে পাইকারি দোকান থেকে মাল কিনি, দোকানের প্রধান কর্মচারীটি আমাকে খুব পছন্দ করে। দু দশ টাকা বাকিও দেয়। সে লোকটির সঙ্গে আব্বা কথা বললেন। আমি জেনে গেলাম আব্বার সঙ্গে মাল কেনার যে টাকাটা ছিল পুরোটাই সেলিমগুণ্ডা রেখে দিয়েছে। বাকিতে সামান্য কিছু মাল আমরা আনতে পেরেছিলাম।

রাতের বেলা ওই দোকানটাতেই আমি থাকতাম। এক ফাঁকে বাসায় এসে ভাত খেয়ে যেতাম।    রাস্তায় ইলেকট্রিসিটি আছে। গরিব ধরনের বাড়িগুলোতে নেই। আমাদের দোকানটায়ও ছিল না। হারিকেন জ্বালিয়ে সওদা বিক্রি করতাম। হারিকেনের আলোতেই পড়তাম। রাত দশটার দিকে দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে শুয়ে পড়তাম। একা একা সেই প্রায় দম বন্ধ করা দোকান ঘরটির ভেতর তেল চিটচিটে কাঁথা বালিশের বিছানায় শুয়ে থাকতাম। রাতের অন্ধকারে ঝাঁক বেঁধে বেড়াত তেলাপোকা। মুখ মাথা বুক পেট আর হাত পায়ের ওপর দিয়ে চলাচল করত। তেলাপোকার উৎপাতে ঘুমাতে পারতাম না। সেই বীভৎস গরমের দিনে তেলাপোকার হাত থেকে বাঁচবার জন্য পাতলা একটা কাঁথা মুড়ি দিতাম। অন্ধকার দোকানঘরে কাঁথার তলায় শুয়ে কত রাত যে নিঃশব্দে কেঁদেছি! কাঁদতে কাঁদতে ভাবতাম, কবে শেষ হবে আমাদের এই দুঃখের কাল ?

মাসসাতেক পর দোকানটি বন্ধ হয়ে যায়। অভাবি সংসারের পেটে চলে গেছে মূলধন।

জার্মানি থেকে ফিরে এলাম একাশি সালের অক্টোবরে। যাওয়ার আগে জুনিয়র রিপোর্টারের চাকরি নিয়েছিলাম সাপ্তাহিক রোববার পত্রিকায়। বেতন ছিল চারশ টাকা। জার্মানিতে যাওয়ার আগে রোববার-এর একটি বিশেষ সংখ্যায় উপনায়ক উপন্যাসটি লিখেছিলাম। তীব্র এক অভিমানের ছোঁয়া ছিল সেই উপন্যাসে। রোববার-এর সম্পাদক ছিলেন আবদুল হাফিজ নামে মালিক পক্ষের এক ভদ্রলোক। তাঁর কিছু অনুবাদের বই ছিল। ভদ্রলোক নামেই মাত্র সম্পাদক। দুচার মাসে একবার অফিসে আসতেন। আমাদের সঙ্গে বসে গল্প করে আর চা খেয়ে চলে যেতেন। নির্বাহী সম্পাদক রফিক আজাদ, পত্রিকার মালিক ব্যারিস্টার মঈনুল সাহেবের স্ত্রী সাজু হোসেন। সার্বিক দায়িত্বে রাহাত খান। জার্মানি থেকে ফিরে আসার পর আবার জয়েন করতে চাইলাম রোববারে। রাহাত খান আর রফিক আজাদ এক সন্ধ্যায় আমাকে নিয়ে গেলেন ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন সাহেবের বাড়িতে। সব শুনে তিনি তাঁদের দুজনকে বললেন, ‘কোনও অসুবিধা নাই। জয়েন করিয়ে দেন।’ আমার দিকে তাকালেনও না।

আগের মতোই জুনিয়র রিপোর্টারের পদ। জার্মানিতে যাওয়ার আগে পত্রিকার শুরু থেকে ‘আশেপাশে’ নামে এক পৃষ্ঠার একটা কলাম লিখতাম। আমার বন্ধু শাইখ সিরাজ বলল, ‘তুই তো থাকবি না, কলামটা আমি লিখতে চাই। রফিক ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দে।’

ফরিদুর রেজা সাগর আর শাইখ সিরাজ তখন স্টেডিয়ামের উল্টোদিককার হামদর্দের লাগোয়া ‘খাবার দাবার’ রেস্টুরেন্টটি চালায় আর বিটিভিতে টুকটাক প্রোগ্রাম করে। আমরা নিয়মিত আড্ডা দিতাম ‘খাবার দাবার’-এ।

শাইখকে রফিক আজাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। একটি ছেলের লেখালেখির অভিজ্ঞতা নেই, শুরুতেই সে এরকম একটি পত্রিকায় কলাম লিখবে, রফিক ভাই দোনোমনো করলেন, তারপর রাজি হলেন। যেহেতু আমার বন্ধু শাইখ, তাঁকে ফেরান কেমন করে?

শুরু হলো শাইখ সিরাজের লেখালেখি। কালক্রমে আমার এই বন্ধুটি হয়ে উঠলেন কিংবদন্তি। বাংলাদেশের কৃষিতে বিপ্লব ঘটিয়ে দিলেন। বিটিভিতে তাঁর অনুষ্ঠান ‘মাটি ও মানুষ’ বাংলাদেশের কৃষিজীবী মানুষের হৃদয় হরণ করল। চ্যানেল আইয়ের ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ শাইখকে নিয়ে গেল অন্য আরেক স্তরে। চ্যানেল আইয়ের প্রতিষ্ঠাতাদেরও একজন তিনি। কৃষিতে বিপ্লব ঘটানো এই নায়ক দেশে বিদেশে শত শত পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার সবই পেয়েছেন। দেশের বড় দৈনিকগুলোতে সপ্তাহে তিন চারটা করে কলাম লিখতে শুরু করলেন। শ্রম আর নিষ্ঠা একজন মানুষকে কোথায় পৌঁছে দিতে পারে আমার বন্ধু শাইখ সিরাজ তার প্রমাণ। ভাবতে ভালো লাগে তাঁর লেখার জায়গাটি তৈরি করার ক্ষেত্রে আমার একটুখানিভূমিকা ছিল। সত্তর আশিটি বই বেরিয়েছে শাইখের। বেশির ভাগই কৃষিবিষয়ক। সেই সব বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে আমার খুব ভালো লাগে।

দ্বিতীয়বার রোববারের চাকরিটা আমি মাসখানেকও করতে পারিনি। ইত্তেফাকের মোড়ে ট্রাকচাপায় দিনদুপুরে এক পথচারীর মাথা রুটির মতো চ্যাপ্টা হয়ে গেল। ইত্তেফাক ভবনের তিনতলার রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখেছিলাম। ওই নিয়ে প্রতিবেদন লিখলাম পরের সংখ্যায়। পুলিশদের নিয়ে একটা বেফাঁস মন্তব্য করে ফেললাম লেখায়। সেই অপরাধে চাকরি তো গেলই, পুলিশ বাহিনীও ক্ষিপ্ত হলো। ভয়ে বাড়িতে থাকতে পারি না। বন্ধুবান্ধবদের বাসায় গিয়ে থাকি, রফিক আজাদের বাসায় গিয়ে থাকি। করোটিয়া কলেজে রফিক আজাদের ছাত্র ছিলেন আরেফিন বাদল। বাদল ভাই তখন সেক্রেটারিয়েটে বসেন। সরকারি পত্রিকা প্রতিরোধ এর সম্পাদক। নিজে গল্প লেখেন, গল্পগ্রন্থ সম্পাদনা করেন। পরবর্তীকালে তারকালোক পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেন। ‘তারকালোক ভবন’ তৈরি করেন। তাঁর মালিকানাধীন কিশোর পত্রিকা কিশোর তারকালোক এর প্রথম সম্পাদক হয়েছিলাম আমি। নব্বই থেকে একানব্বই সাল এই এক বছর সম্পাদকের চাকরিটা করেছি।

বাদল ভাইয়ের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন লেখক আবুল খায়ের মুসলেউদ্দিন। মুসলেউদ্দিন সাহেব পুলিশের এডিশনাল আইজি। বাদল ভাই একদিন আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে গেলেন। মুহূর্তে মুসলেউদ্দিন ভাই আমাকে পুলিশি ঝামেলা থেকে মুক্ত করে দিলেন। এই ভদ্রলোক খুব ভালোবাসতেন আমাকে। যতদিন বেঁচেছিলেন প্রায় নিয়মিত তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল।

রোববার থেকে চাকরি যাওয়ার পর খুবই করুণ অবস্থায় পতিত হলাম। সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াই। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিই। টুকটাক লেখালেখি করি। কিন্তু পকেটে রিকশা ভাড়ার টাকাটাও থাকে না। বিকেলবেলা নিয়মিত আড্ডা দিতে যাই শাহবাগ এলাকায়। সেখানে পশ্চিম পাশের ফুটপাত ঘেঁষে রাগিবের ‘রেখায়ন’। রাগিব আহসান ছবি আঁকে, বাঁধানো ছবি বিক্রি করে। ঈদের সময় হাতে বানানো ঈদকার্ড তৈরি করে বিক্রি করে। সেই ঈদকার্ডে প্রেমের কবিতার লাইন লিখে দিই আমি। রাগিব চা সিগ্রেট খাওয়ায়। আমার সময়কার লেখক কবি অনেকেই বিকেল থেকে অনেকটা রাত পর্যন্ত রেখায়নে আড্ডা দেয়। রেখায়নের শুরু থেকেই এখানটায় আমার আসা যাওয়া। ও রাধা ও কৃষ্ণ উপন্যাসে রেখায়নের কথা আছে।

রেখায়নের আড্ডায়ই পরিচয় হয়েছিল মাকসুমুল আরেফীনের সঙ্গে। রোববারের শুরু থেকে সেই পত্রিকায় আমার সহকর্মী ছিল সানাউল আরেফিন। আরেফিন কাজ করতো বিজ্ঞাপন বিভাগে। মাকসুমুল  আরেফিন যে সানাউল আরেফীনের বড় ভাই এই তথ্য আমি কিছুটা পরে জেনেছি। সানাউল আরেফিন সবার কাছে ‘সানা’ নামে পরিচিত। মাকসুমুল আরেফিন হচ্ছে ‘মাকসু’।

এই মাকসু আমাকে বিজ্ঞাপন এজেন্সি করার ধারণাটা দিয়েছিল। ‘এডভারটাইজিং ফার্ম’। রেখায়নের আড্ডা শেষ করে এক রাতে রিকশায় করে ফিরছি। রোববারের চাকরি হারিয়ে আমি খুবই ফ্রাসট্রেইটেড। ঢাকা ক্লাব ছাড়িয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের দিকে যাচ্ছে রিকশা। ওদিকটায় এসে মাকসু বলল, ‘চল আমরা একটা অ্যাডভ্যাটাইজিং ফার্ম করি।’ বিরাশি সালের মাঝামাঝি সময়ের কথা। মাকসুর দুলাভাই শরফুদ্দিন সাহেব বিজ্ঞাপন জগতের এক মহীরুহ। কবি ফজল শাহাবুদ্দিনের সঙ্গে একত্রিত হয়ে বিশাল বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠান করেছিলেন ‘নান্দনিক’। মাকসু, সানা আর তাঁদের মেজোভাই সজল আরেফিন সবাই বিজ্ঞাপনঘনিষ্ঠ মানুষ। ইতোমধ্যে রেখায়নে সজলদার সঙ্গেও আমার পরিচয় হয়েছে। তিনি জানতেন আমি তার ছোট ভাই মাকসু ও সানার বন্ধু। ‘যৌবনকাল’ নামে ছোট একটা প্রেমের উপন্যাস লিখেছিলাম কোনও একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায়। সেই লেখা সজলদার খুব ভালো লেগেছিল। রেখায়নে বসে কথাটা বললেন। সজলদা অত্যন্ত হাস্যোজ্জ্বল, সুন্দর করে কথা বলা মানুষ। বিনয়ী। সজলদাকে খুব ভালো লেগে গেল আমার।

তারপর শুরু হয়েছিল আমার বিজ্ঞাপন ব্যবসা। কোম্পানির নাম দিলাম ‘দোয়েল’। কাজী হাসান হাবীব চমৎকার একটা লোগো করে দিলেন। সজলদা একটা অফিস রুম নিয়ে দিলেন বিজয়নগরে। দোতলার ওপর ছোট্ট রুম। নিচতলায় পুরোটা জুড়ে এক সময় শরফুদ্দিন ভাইয়ের ‘নান্দনিক’ ছিল। ‘নান্দনিক’ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সেই জায়গায় ‘ইয়াংস’ নামে চায়নিজ রেস্টুরেন্ট করেছিলেন শরফুদ্দিন ভাই। আমি তাঁকে ‘দুলাভাই’ ডাকতাম। মানুষটি খুব পছন্দ করতেন আমাকে। ‘ইয়াংস’ তৈরির কাজ চলছিল সেই সময়। উপরতলায় ‘দোয়েল’ এর এক রুমের অফিস। শুরু করেছিলাম মাকসু আর আমি। তারপর যুক্ত হলো অন্য বন্ধুরা। আবদুর রহমান, পাভেল রহমান, আফজাল হোসেন ও সানাউল আরেফিন। শোয়েব সিদ্দিকী নামে আমাদের এক বন্ধু ছিল। শুরুর দিকে সেও কয়েক মাস পার্টনার ছিল। সজলদা বড় একটা সেক্রেটারিয়েট টেবিল কিনে দিয়েছিলেন, সঙ্গে একটা রিভলবিং চেয়ার। দুটোই পুরনো, ব্যবহৃত। তবে জৌলুস ছিল টেবিল চেয়ারের। মান্নান নামে কৈশোর উত্তীর্ণ একটি ছেলে কিছুদিন পিয়নের কাজ করেছিল নান্দনিকে। সেই ছেলেটিকে পিয়ন হিসেবে এনে দিলেন সজলদা। অফিস রুমের পাশে চা তৈরির একচিলতে লম্বা মতো একটা জায়গা ছিল। লম্বায় ফুট দশেক হবে। চওড়ায় ফুট তিনেক। মান্নান ওখানটায় থাকতো আর আমাদের চা বানাতো। সজলদা আছেন মাথার ওপরে। সজলদার কল্যাণে, মাকসুর কল্যাণে টুকটাক কাজ আসে। সানাউল আরেফিন তখনও রোববার পত্রিকায় কাজ করছে। পত্রিকার কাজ সেরে দোয়েলে এসে বসে। সেও কিছু কাজ আনে। কাজের চেয়ে আড্ডা হয় বেশি। প্রত্যেকেরই নিজস্ব সার্কেলের বন্ধুবান্ধবরা এসে আড্ডা দেয়। চা বানাতে বানাতে অস্থির মান্নান। সিগ্রেটের ধোঁয়ায় রুমটা আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। কখনও কখনও চাঁদা করে বিয়ারও খাওয়া হয়।

একদিন রহমান পাঁচ টাকার একটা বান্ডিল নিয়ে এল তাঁর বাবার কাছ থেকে। নতুন চকচকে টাকার বাণ্ডিলটা তাসে সাফল দেওয়ার ভঙ্গিতে আমাদের চোখের সামনে নাচাতে লাগল। কে যেন ওই টাকা দেখে বিয়ার খাওয়াবার প্রস্তাব দিল। তখন এক ক্যান বিয়ারের দাম বারো পনেরো টাকা হবে। রহমানের স্বভাব হচ্ছে যে কোনও প্রস্তাবের শুরুতেই বলবে ‘প্রশ্নই আসে না’। বিয়ার খাওয়াবার প্রস্তাবে প্রথমে বলল ‘প্রশ্নই আসে না’। কিন্তু আমরাও তো রহমানের বন্ধু! জানি কিভাবে তাকে পটাতে হয়। পটানো শুরু করলাম। এক সময় সে পটে গেল। বলল ‘ঠিক আছে, তোরা যখন বলছিস তখন দুটো বিয়ার আনাচ্ছি। এই দুটোই চারজনে ভাগ করে খাবো। আব্বার কাছ থেকে পাঁচশো টাকা এনেছি। এই টাকায় আমার অন্য কাজ আছে।’

আমরা তাতেই রাজি। দুটো বিয়ার এলো। ভাগ করে চারজনে খেলাম। তারপর আবার রহমানকে পটাতে লাগলাম। প্রশ্নই আসে না, প্রশ্নই আসে না করতে করতে রহমান আবার দুটো বিয়ার আনালো। বিয়ারের ক্যান খোলার একটি বিশেষ কেতা ছিল রহমানের। শীতল ক্যান হাতে ধরে ‘আহ্’ বলে পরিতৃপ্তির একটি শব্দ করবে। মুখে ভুবনজয়ী হাসি। তারপর অতি মায়ায় ক্যানটি টেবিলে রেখে, ওপেন করার জায়গায় আলতো করে কয়েকটি টোকা মারবে। সেদিনও এভাবেই চলছিল বিয়ার পান। রুমের মেঝেতে কার্পেট বিছানো। সেখানে গোল হয়ে বসেছি আমরা। বিয়ার আর সিগ্রেট চলছে। সন্ধ্যার দিকে দেখা গেল অনেকগুলো খালি ক্যান জমেছে মেঝেতে আর আমরা কাতচিৎ হয়ে শুয়ে আছি। রহমানের পাঁচশো টাকার একটিও নেই, পুরোটা চলে গেছে বিয়ারে।

আহা, কী সব উম্মাতাল আনন্দময় দিন ছিল আমাদের জীবনে!

বেশ কয়েক মাস লেগেছিল শরফুদ্দিন ভাইয়ের ‘ইয়াংস’ চালু হতে। ডেকোরেশনের কাজ শেষই হচ্ছিল না। চালু হলো আমার ‘বৌ-ভাতের’ অনুষ্ঠান দিয়ে। এগারোই ডিসেম্বর উনিশশ বিরাশি। শরফুদ্দিন ভাই আর সজলদার তত্ত্বাবধানে হলো পুরো অনুষ্ঠান। প্রচলিত বিয়ের খাবারই খাওয়ানো হলো অতিথিদের। বিরিয়ানি, রোস্ট, গরুর রেজালা, বোরহানি, জরদা এইসব। এরশাদের আমল। তার মন্ত্রিসভার কৃষিমন্ত্রী হয়েছেন জাঁদরেল সিএসপি অফিসার আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। আমাদের প্রিয় সেন্টুভাই। মন্ত্রীর চেয়েও আবু জাফর ওবায়দুলল্লাহ কবি হিসেবে আমাদের কাছে অত্যন্ত সম্মানীয়। তাঁর বাসভবনে কত সন্ধ্যায় আড্ডা দিতে গেছি। আমাকে নিয়ে যেতেন রফিক আজাদ। সেন্টুভাই খুব স্নেহ করতেন। অত ব্যস্ত থাকা মানুষটি ঠিকই সময় করে আমার বৌ-ভাতের অনুষ্ঠানে এলেন। শামসুর রাহমান, ফজল শাহাবুদ্দিন, রাহাত খান, আবুল খায়ের মুসলেউদ্দিন আর রফিক আজাদ তো আছেনই। আফজাল হোসেন আর সুবর্ণা মুস্তাফা জুটি তখন চূড়ান্ত জনপ্রিয়তার দিকে যাচ্ছে। দুজনেই আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দুজনেই আছে অনুষ্ঠানে। ক্যামেরাশিল্পী পাভেল রহমান তখনই খুব বিখ্যাত। কিশোর বয়সে বঙ্গবন্ধুর ছবি তুলে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল সবাইকে। আটাত্তর-উনআশি সাল থেকেই ‘সচিত্র সন্ধানী’ পত্রিকাতে কাজও করছিল পাভেল। তখন ফটোগ্রাফি খুব ব্যয় বহুল। রিল ভরে ছবি তুলতে হয়। পাভেল টাকা পয়সার তোয়াক্কা না করে শত শত ছবি তুলেছিল আমার বৌ-ভাতের অনুষ্ঠানে।

এক রুমের অফিসে আমাদের কুলাচ্ছিল না। রহমান গিয়ে ধরল তার বাবাকে। তিনি বড় ব্যবসায়ী। মতিঝিলে দৈনিক বাংলার ওদিকটায় তাঁর বিখ্যাত ‘ঢাকা সিড স্টোর’। সঙ্গে নার্সারি। আমাদের দলটিকে পছন্দ করেন। তিনি বেশ বড় একটা অফিস নিয়ে দিলেন ‘খাবার দাবার’ এর তিনতলায়। আফজাল খুব সুন্দর টেবিল চেয়ারের ডিজাইন করলো। প্রত্যেকের জন্য টেবিল। আফজালের আঁকাআঁকির জন্য আলাদা কাঁচঘেরা রুম। আমার জন্যও ওরকম একটা। টুকটাক ব্যবসা হয়। এ সময় ‘পিয়ারসন্স’ নামে একটা কোম্পানি আধুনিক পোশাক তৈরি করে তাক লাগিয়ে দিচ্ছিল। সেই কাজটা আমরা পেলাম। আফজাল দুতিনটি অসামান্য বিজ্ঞাপন চিত্র তৈরি করল। পত্রিকায় ছাপার জন্য আকর্ষণীয় ডিজাইন করল। বিখ্যাত ব্যক্তিদের পিয়ারসন্সের পোশাক পরানো হলো, পাভেল ছবি তুলল। সম্পূর্ণ নতুন ধরনের আইডিয়া। বেশ সাড়া পড়ল পিয়ারসন্সের বিজ্ঞাপন নিয়ে। ওই অফিসটাতে বোধহয় বছর খানেক বা বছর দেড়েক চলেছিল ‘দোয়েল’। তারপর একদিন ভেঙে গেল। বন্ধুদের মধ্যে মনোমালিন্য। চেয়ার টেবিল ভাগাভাগি হয়ে গেল। আফজাল আর আরেফিন গিয়ে ‘মাত্রা’ নামে নতুন কোম্পানি খুলল। দোয়েলের অফিসের রহমান শুরু করল ‘প্রিয়জন’ নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা। আমি সব ছেড়েছুঁড়ে গেণ্ডারিয়ার বাসায় ফিরে গেলাম।

মাসখানেক পর সেই বাসা থেকেও আমাকে বেরিয়ে আসতে হলো।

আফজাল আর আরেফিন তাঁদের নিষ্ঠা আর যত্ন দিয়ে ধীরে ধীরে মাত্রাকে নিয়ে গেল দেশের শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠানগুলোর সারিতে। খাবার দাবারের ওখানকার অফিস ছেড়ে রহমান তার ‘প্রিয়জন’ নিয়ে গেল মতিঝিলে নিজেদের ভবনে।

নতুন নতুন আইডিয়ার ওস্তাদ ছিল রহমান। আটাত্তর সালের দিকে নিজেদের ‘ঢাকা সিড স্টোর’ এর পাশে একটা ফুলের দোকান করেছিল। তাজা ফুল দিয়ে বিয়ের গাড়ি সাজানো, ফুলের তোড়া আর বুকে বিক্রি করা। অভিনব আইডিয়া। বহু পরে একটা সময়ে আমরা লক্ষ্য করলাম একটা দুটো করে তাজা ফুলের দোকান হচ্ছে ঢাকায়। হু হু করে বাড়ছে ফুলের কদর। শাহবাগে ফুলের একটা মার্কেটই হয়ে গেল। শুধুমাত্র ফুলের চাষ করে সচ্ছল হয়ে গেছে বাংলাদেশের কোনও কোনও গ্রাম। বছরে পাঁচ সাতশো কোটি টাকার ফুলের ব্যবসা হয়। পেছন ফিরে তাকালে এখন দেখতে পাই এই ব্যবসায়ের ধারণাটি এসেছিল আমার বন্ধু আবদুর রহমানের মাথা থেকে। পথটা রহমানই দেখিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ব্যবসাটায় সে আর লেগে থাকেনি।

বিয়ের পর দাদা বলেছিল বাসা ভাড়ার দুহাজার টাকা মাসে মাসে আমার দিতে হবে। বছরখানেক এদিক ওদিক করে দিতে পেরেছি। ‘দোয়েল’ থেকে কিছু পেতাম। সেই পথ বন্ধ হয়েছে, বাসা ভাড়া দেব কোত্থেকে। এই নিয়ে মনোমালিন্য। স্ত্রীকে তার মায়ের কাছে রেখে ওদের বাড়ির কাছেই একটা টিনশেড ভাড়া নিলাম। চিপাগলির ভিতর, ধোলাইখালের পরে লম্বা নতুন একটা টিনশেড। মাঝখানে দেওয়াল। দেওয়ালের পেট কেটে দরজা। শ্বশুরবাড়ি থেকে পাওয়া খাটটা নিয়ে এসেছি। অন্য রুমে সিঙ্গেল একটা চৌকি। লেখার টেবিল নেই। গরমেও টিকতে পারি না। রহমানকে গিয়ে বললাম। আফজালের ডিজাইন করা সেই একটা টেবিল আর চেয়ার আমাকে দিল রহমান। একটা ফ্যানও দিল। স্ত্রী ওই বাসায় আসতেন না। টিফিন কেরিয়ারে আমার খাবার পাঠাতেন। ব্যর্থদের এক ধরনের অহংকার থাকে। ওই সময় সেই অহংকারে আমি নিমজ্জিত। শ্বশুরবাড়িতে সহজে ঢুকি না। আমার বড়কন্যাটি পৃথিবীর আলো দেখার অপেক্ষায়। একদিন তীব্র গরমে লেখার টেবিলটায় বসে ঘামতে ঘামতে সিদ্ধান্ত নিলাম, লিখেই অন্নের সংস্থান করব। দিনরাত উন্মাদের মতো লিখতে শুরু করেছিলাম।

আমার সেই টিনসেডের বাসায় একদিন সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত পান করলেন রফিক আজাদ। জীবন সম্পর্কে নানা প্রকার জ্ঞান দিয়ে টলতে টলতে চলে গেলেন। আমার বন্ধু দিদারুল আলম এসে একটা রাত কাটাল। সঙ্গে ‘দ্রব্য’ এনেছিল। রাতভর জীবনের কথা বললাম দুজনে আর সিগ্রেট টানলাম আর পান করলাম। ব্যর্থতার দিনে মানুষ কিছুটা দর্শন আক্রান্ত হয়। বিরাট বিরাট দার্শনিক চিন্তা আসে, কথাবার্তা আসে। পান করলে সেটা বাড়ে। আমাদেরও তাই হয়েছিল। জীবন নিয়ে প্রচুর জ্ঞানের কথা আমরা দুজন বললাম।

আমার পরের ব্যবসা কম্পোজ সেকশনের।

বড় মেয়েটির জন্ম হলো ডক্টর ফিরোজা বেগমের হাতে। গাইনির বিখ্যাত ডাক্তার তিনি। ধানমন্ডিতে নিজের বাড়িতেই ক্লিনিক। গেইট দিয়ে ঢোকার পর বাগান, তারপর দোতলা বিল্ডিং। তিনি ওপরতলায় থাকেন আর নিচতলায় প্রসূতিরা। আমার স্ত্রীর নাম আফরোজা আক্তার। ডাকনাম জ্যোৎস্না।  সকালবেলায় জ্যোৎস্নাকে ভর্তি করিয়ে, শাশুড়িকে তাঁর সঙ্গে রেখে আমি বেরোলাম টাকার সন্ধানে। পকেটে বিশ পঞ্চাশ টাকা হয়তো আছে। তাতে কি আর ক্লিনিকের বিল শোধ হবে ? এক প্রকাশককে আগেই বলে রেখেছিলাম, তিনি কথাও দিয়েছেন। গেলাম তাঁর বাংলাবাজারের দোকানে। পাঁচশো টাকা দেবার কথা। বিকেল পর্যন্ত বসিয়ে রাখলেন, চা শিঙ্গাড়া খাওয়ালেন কিন্তু একটা পয়সাও দিলেন না। দোকানে নাকি বিক্রি নেই, ব্যাংকেও টাকা নেই। কোত্থেকে দেবেন ? ম্লানমুখে হাসপাতালে ফিরলাম। জ্যোৎস্নার বড়ভাইও বসে আছেন ক্লিনিকে। আমাকে কিছুটা শ্লেষ করলেন। অযথা দৌড়াদৌড়ি করে লাভ কি ? এখানেই বসে থাকো। কত কিছুর দরকার হতে পারে।

মাথা নিচু করে তাঁর কথাগুলো শুনলাম। দীর্ঘশ্বাস চেপে ফিরোজা বেগমের লনে এসে সিগ্রেট ধরালাম। রাত একটায় আমার মেয়ে জন্মালো। ধপধপে ফর্সা একটা পুতুল যেন। মাথাভর্তি কালো চুল। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে চোখে পানি এলো। ওকে আমি কেমন করে বাঁচিয়ে রাখব! কী খাওয়াব! কী পরাব! এত অসহায় লাগছিল! সকালবেলা আফজাল আর আরেফিন এলো মেয়ে দেখতে। আমার ভাইবোনরা কেউ আসেনি, মা আসেননি। হাসপাতালের বিল হয়েছিল চারশো টাকা। জ্যোৎস্নার বড়ভাই বিল শোধ করলেন।

দুতিন মাস পর অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল। জ্যোৎস্না বাচ্চা নিয়ে তাদের বাড়িতে থাকে। আমি রোজই দু তিনবার গিয়ে মেয়েকে দেখে আসি। পকেটে পয়সা থাকে না। আমার মুখ দেখে শাশুড়ি সেটা টের পান। প্রায়ই একশো দুশো টাকা হাতে গুঁজে দেন। ওই দিয়ে মেয়ের জন্য টুকটাক জিনিসপত্র কিনি। ঝুমঝুমি, মোজা, এই সব। ব্যর্থতার কী রকম একটা ক্রোধ যেন বুকে চেপে থাকে। ক্রোধটা নিজের ওপর। বুক ফেটে সেই ক্রোধ একদিন বেরিয়ে এলো। শ্বশুরবাড়ির সঙ্গের গলিতে আমার বন্ধু বেলালদের বাড়ির সামনে প্রচুর রিকশা লাইন ধরে থাকে। একদিন দুপুুরের দিকে ওখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। এক রিকশাঅলা ব্যালান্স হারিয়ে সামান্য একটা ধাক্কা দিল গায়ে। সামনের চাকাটা একটুখানি লেগেছে আমার পিছন দিকটায়। বুকের  ভেতর চেপে থাকা ব্যর্থতার ক্রোধটা যেন ফেটে বেরিয়ে এলো। একটা লাকড়ির দোকান আছে গলির মুখে। সেখান থেকে হাত তিনেক লম্বা একটা গজারির লাকড়ি নিয়ে শুধু সেই রিকশাঅলাকে না, ওখানটায় লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল আরও ছয় সাতটি রিকশা, প্রত্যেক রিকশাঅলাকে পিটালাম। শ্বশুরবাড়ির রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে সবাই দেখছে, আমার কোনওদিকে ভ্রƒক্ষেপ নেই। উন্মাদের মতো কাজটা করলাম। আসলে বোধহয় নিজেকেই নিজে পিটালাম। নিজের ওপর এক ধরনের প্রতিশোধ নিলাম। অশ্লীল প্রতিশোধ। ঘটনাটা ভাবলে কী যে লজ্জা হয়।

দুপুরের দিকে একটা চেয়ার নিয়ে উদাস হয়ে বসে আছি জ্যোৎস্নাদের দোতলার বারান্দায়। কী করব, কীভাবে চলব, মেয়েটিকে কীভাবে বড় করে তুলবো সেই ভাবনায় ভিতরে ভিতরে দিশেহারা। বইপত্র টুকটাক বেরোয় কিন্তু প্রকাশকরা এক দুশো টাকাও দিতে চান না। দুয়েক জায়গায় চাকরির চেষ্টাও করেছি। সর্বত্রই ব্যর্থ। জ্যোৎস্নার গয়না বেচে টিনসেডের ভাড়া শোধ করি। বারান্দায় বসে এসব ভাবছি, আমাদের বাসার কাজের ছেলেটি এসে বিদেশি একটা চিঠির খাম দিয়ে গেল। তখনকার পশ্চিম জার্মানির স্টুটগার্ট শহর থেকে এসেছে। খুলে হতভম্ব হয়ে গেলাম! হাজার তিনেক মার্কের পে-অর্ডার। সঙ্গে একটা চিঠি। স্টুটগার্টে ভেঙে ভেঙে যতদিন কাজ করেছি তা থেকে ট্যাক্স বাবদ যে টাকাটা কেটে রাখা হয়েছিল সেটাই পাঠিয়েছে। শুনেছিলাম যে এরকম টাকা পাওয়া যায়। পরে দেশে আসার পর ভুলেও গিয়েছিলাম। পে-অর্ডারটা হাতে নিয়ে মনে হলো জীবনের বন্ধ হয়ে যাওয়া দরজার চাবিটা যেন পেয়ে গেলাম। এখন দরজাটা আমি খুলতে পারব। তারপরই হুমায়ূন আহমেদের একটা কথা মনে হলো। তখন একদিন দুদিন পরপরই হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে দেখা হয়। বাংলাবাজার আর নয়তো ইউনিভার্সিটি ক্লাবে বসে চা সিগ্রেট খেতে খেতে আড্ডা হয়। ইউনিভার্সিটি ক্লাবে আমাদের আড্ডার অন্য দুজন সঙ্গী হচ্ছেন হুমায়ুন আজাদ আর সালেহ চৌধুরী। সালেহ ভাই গল্প বলতে পছন্দ করেন। তাঁর গল্পগুলো হয় একটু লম্বা। হুমায়ূন আহমেদ আর আমি সিগ্রেট টানি আর চুপচাপ তাঁর গল্প শুনি। তিনি নতুন গল্প শুরু করতে গেলেই হুমায়ুন আজাদ বলেন, ‘গল্প বেশি লম্বা করবেন না, সালেহ সাহেব’।

হুমায়ূন আহমেদ আর আমি নিঃশব্দে হাসি। হুমায়ূন আহমেদ তখন একেবারেই মুখচোরা। আড্ডায় কথাবার্তা একদমই বলেন না। যখন আমি তাঁর সঙ্গে থাকি তখন বলেন। আমার মেয়ে হওয়ার কথা শুনে বললেন, ‘এবার তোমার জীবন বদলাবে’।

সত্যি কি জীবন বদলাবে ? অপ্রত্যাশিত পে-অর্ডার হাতে ধরা, মেয়ের বিছানার সামনে গিয়ে অপলক চোখে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মেয়ে ঘুমাচ্ছে আর আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে কাঁদছি।

কিন্তু এই পে-অর্ডার কোথায়, কীভাবে ভাঙাব ? আমার একটা অ্যাকাউন্ট আছে সোনালী ব্যাংকে। গেলাম সেই ব্যাংকে। ব্যাংকের পরিচিত ম্যানেজার বুদ্ধি দিলেন, ‘আপনার এই অ্যাকাউন্টে পে-অর্ডার জমা দিলে জার্মানি থেকে কবে ক্লিয়ারেন্স আসবে সেই অপেক্ষায় থাকতে হবে। কয় মাস সময় লাগবে বলতে পারব না। তারচেয়ে আপনি একটা কাজ করুন, মতিঝিলের ফরেন এক্সচেঞ্জ শাখর সামনে যান। ওখানে দেখবেন রাস্তায় ডলার কেনাবেচা করার অনেক ব্রোকার দাঁড়িয়ে থাকে। তারা এ ধরনের পে-অর্ডার কিনে নেয়। ক্যাশ টাকা পেয়ে যাবেন।’

ওখানে গিয়ে এক ব্রোকারের কাছে আঠারো হাজার টাকায় পে-অর্ডারটা বিক্রি করে দিলাম। টাকাটা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবনের গতি যেন বেড়ে গেল। এই আঠারো হাজার টাকা দিয়েই আমাকে এখন দাঁড়াতে হবে। ছোটখাটো ব্যবসা যাহোক একটা করতে হবে। যেখান থেকে দুচার হাজার রোজগার হবে। অন্যদিকে পত্রপত্রিকায় লিখে কিছু রোজগার হবে, বই লিখে কিছু রোজগার হবে। বাংলাবাজার এলাকায় বিখ্যাত ‘বিউটি বোর্ডিং’ এর গলিটার নাম শ্রীশদাস লেন। গলির মাঝামাঝি একটা ‘গুরুদুয়ারা’ আছে। শিখ ধর্মের গুরু নানক যেখানে যেখানে পা রাখতেন সেই জায়গাগুলোই হয়েছে গুরুদুয়ারা। শ্রীশদাস লেনের ওই চিপাগলিতেও তিনি একবার পা রেখেছিলেন। সেই প্রায় ধসে-পড়া পুরনো বাড়িটির ঠিক উল্টোদিকে আরেকটি দোতলা পুরনো বাড়ি। পশ্চিম দিকে বাড়িতে ঢোকার গেট। পুবদিকটায় তিনচার ধাপ সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয় এমন একটা ইটের রেলিং দেওয়া বারান্দা। তারপর পুরনো কাঠের সবুজ রং করা দরজা। ভিতরে পুবে-পশ্চিমে লম্বা একটা রুম। এই রুমের পেট বরাবর উত্তরে আরেকটা রুম। ভাড়া তিনশ টাকা। এক মাসের ভাড়া এডভান্স দিয়ে এই রুম দুটো নিলাম। সেখানে শুরু হলো আমার কম্পোজ সেকশন। কম্পোজ সেকশন আসলে হাফ প্রেস। মেশিন নেই। শুধু হ্যান্ড কম্পোজ করার ব্যবস্থা। একটা একটা করে সিসার টাইপ খোপ থেকে তুলে শব্দের পর শব্দ, বাক্যের পর বাক্য, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা টাইপ করে যেতে হয়। ওরকম ষোলো পৃষ্ঠায় এক ফর্মা। একটি করে ফর্মা তৈরি হয়ে গেলে, প্রুফ কারেকশান ইত্যাদি হয়ে গেলে কম্পোজিটাররা নিয়ে প্রেসে পৌঁছে দিয়ে আসে। মেশিনে ছাপা হতে থাকে একটার পর একটা ফর্মা। কম্পোজ সেকশন যাদের আছে তারা কাছাকাছি যেকোনও প্রেসের সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করে নেয়। প্রেস মালিক শুধু ছাপার খরচটা নেন। কম্পোজ সেকশনের নাম দিয়েছিলাম মেয়ের নামে ‘নির্বাচিতা’। ‘নির্বাচিতা’র সুন্দর লোগোটিও কাজী হাসান হাবীব করে দিলেন। ‘নির্বাচিতা’র দুটো বাড়ির পরেই পুরনো ধসে যাওয়া এক জমিদার বাড়ি। সামনের রুক্ষ মাটির খোলা চত্বর আর ভেঙে পড়া দেয়াল। গেটের বালাই নেই। অনেকটা খালি জায়গার পর দক্ষিণমুখী ভাঙা দোতলা দালান। এক দেড়শ বছর বয়স হবে বাড়ির। এই বাড়ির পুবদিকটায় টিনের লম্বা শেড করে প্রেস বসিয়েছেন আমার চেয়ে বয়সে ছোট কিন্তু আমার বিশেষ বন্ধু সরকার কবির উদ্দিন। অত্যন্ত বিনয়ী চমৎকার ছেলে। সাহিত্য পড়েন, লেখালেখি করেন। ‘বিদ্যাপ্রকাশ’-এর স্বত্বাধিকারী মুজিবুর রহমান খোকার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কবির কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে মিলে একটি লিটেল ম্যাগাজিনও করতেন। ম্যাগাজিনটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কবিরের আরও দুই বন্ধু। পরবর্তীকালে গল্প উপন্যাস লিখে সেই বন্ধুদের একজন বিখ্যাত হন। তাঁর নাম পারভেজ হোসেন। পারভেজ পরে বড় প্রেস করেন, বিদগ্ধ পাঠকের জন্য অতি সৃজনশীল একটা প্রকাশনা সংস্থাও করেন। কবির চলে যান অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানেই সেটেল করেন।

কবিরের প্রেসে ‘নির্বাচিতা’র ছাপাছাপির কাজটা হত। টাকাকে তিনি বলতেন ‘মুদ্রা’। পাওনা টাকা চাইতে এসে অত্যন্ত বিনয়ী ভঙ্গিতে হাসিমুখে বলতেন, ‘কিছু মুদ্রা যে দিতে হয় মিলন’। কথা একটু জড়ানো ছিল কবিরের।

বারান্দার সঙ্গের রুমটায় আমি বসতাম। ছোট একটা চেয়ার টেবিল ছিল বসার। ‘দোয়েল’ এর সেই মান্নান ছেলেটা এসে ‘নির্বাচিতা’র দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছে। পিছনের রুমটার একটা চৌকিতে সে ঘুমাত। ওখানেই রান্না করে খেত। আমার ওপর রাগ করে সে একটা পুরোদিন আর তার পরের দিন দুপুর পর্যন্ত না খেয়ে ছিল। মান্নানের কাছে যে টাকা নেই, এই কথা আমি ভুলে গিয়েছিলাম। দুপুরের পর গিয়ে দেখি মান্নান কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। দিনের বেলা শুয়ে থাকার কারণটা তিন কম্পোজিটারের কেউ বলতে পারল না। পবন নামে একজন ছিল। মান্নানের পর তাকেই চা সিগ্রেট আনার কাজে ব্যবহার করতাম। পবন গিয়ে ডাকাডাকি করল। মান্নান ওঠে না। আমি গিয়ে টেনে তুললাম। মান্নান মুখগোঁজ করে রেখেছে। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করি, কথাই বলে না। অনেকক্ষণ চেষ্টা করার পর কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘কাইল থিকা না খাইয়া আছি। আপনি তো একটা পয়সাও দিয়া যান নাই।’

অপরাধবোধ আর লজ্জায় আমি মরে গেলাম।

‘নির্বাচিতা’ চলার সময়েই ‘চারদিক’ করেছিলাম। প্রকাশনা সংস্থা। কাজী হাসান হাবীব, সিরাজুল ইসলাম, ফিরোজ সারোয়ার আর আমি। চারজনের প্রতিষ্ঠান বলে নাম দিলাম ‘চারদিক’। কলাবাগনে হাবীবের বাসা। সেই বাসায় বসে প্রতিষ্ঠানের নীতি নির্ধারণ করা হলো। হুমায়ূন আহমেদ তখন ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছেন। তাঁর বই দিয়ে শুরু হলো যাত্রা। বইয়ের নাম ‘তোমাকেই’। আমরা তিনজন হচ্ছি ছায়াসঙ্গী। মূল কাজ করবেন ফিরোজ সারোয়ার। যেসব লেখক বন্ধু নিজের টাকায় বই বের করতে চান তাঁরা আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে বই করতে পারবেন। মুহাম্মদ জুবায়েরের অসম্পূর্ণ উপন্যাসটি ওভাবে বেরিয়ে ছিল। রোববার পত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যায় উপন্যাসটি প্রথমে ছাপা হয়েছিল। পরে ‘চারদিক’ থেকে বই হয়ে বেরোয়।

আমার লেখালেখির শুরুর পাঁচ সাত বছর আগে থেকেই গল্প লিখতেন সিরাজুল ইসলাম। তরুণ লেখকদের মধ্যে তাঁর খুব নামডাক ছিল। বুয়েট থেকে পড়াশোনা করে বেরিয়েছে। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। দৈনিক বাংলার সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন কবি আহসান হাবীব। তিনি সিরাজের লেখা খুব পছন্দ করতেন। দৈনিক বাংলার সাহিত্য পাতায় প্রচুর গল্প সিরাজের একসময় ছাপা হয়েছে। তাঁর উপন্যাসও বেরোল ‘চারদিক’ থেকে। আমার বেরোল সারাবেলা। ‘চারদিক’ শুরু হওয়ার পর সেই বছরের বইমেলায় স্টল পেয়েছিলাম আমরা। টুকটাক বিক্রি হচ্ছিল বই। আমি স্টলে থাকলে আমার বইটা একটু বেশি বিক্রি হয়। এই নিয়ে সিরাজ এক রাতে আমার সঙ্গে খুব দুর্ব্যবহার করল। জুবায়ের তখন থাকে সিদ্ধেশ্বরীতে। ভিকারুননিসা নূন স্কুলের উল্টোদিককার বড় বিল্ডিংয়ের নিচতলার ফ্ল্যাটে। সেদিন ওই ফ্ল্যাটে আমাদের পানাহারের ব্যবস্থা। একটা পর্যায়ে বই বিক্রিটিক্রির ব্যাপার নিয়ে সিরাজ আমার ওপর চড়াও হলো। ‘তুই তো তোর বইয়ের বিক্রি ছাড়া আর কিছুই ভাবিস না’ ইত্যাদি ইত্যাদি। বেশ কিছু কটু কথা সে বলল। আমার মনটা এত খারাপ হলো। হাবীব, সারোয়ার আর জুবায়ের স্তব্ধ হয়ে গেছে সিরাজের আচরণে। কারণ সিরাজ ওরকম না আসলে। বন্ধুদের সঙ্গে কখনও তাকে দুর্ব্যবহার করতে দেখিনি। কেন যে সেদিন করল ? সেই রাতে আমাকে আর বাড়ি ফিরতে দিল না সারোয়ার। সে হাবীবের বাসাতেই থাকে একটা রুম নিয়ে। ছোট্ট সেই টিনসেডের রুমটায় সারোয়ারের পাশে শুয়ে আমি একটা মিনিটও ঘুমাতে পারলাম না। সিরাজের কাছ থেকে পাওয়া আঘাতে সারাটা রাত জর্জরিত হলাম। পরে ভেবেছি বন্ধুদের সঙ্গে এই ধরনের মনোমালিন্য তো হতেই পারে। ওসব মনে রেখে কী হবে ?

‘নির্বাচিতা’ বোধহয় বছর তিনেক চলেছিল। আর ‘চারদিক’ বিক্রি হয়ে গিয়েছিল বছর চার পাঁচেক চলার পর।

এতসব ব্যর্থতার পরও ব্যবসার ভূত আমার মাথা থেকে গেল না। ততদিনে ভিসিআর এসেছে দেশে। ভিডিও ক্যাসেট ভাড়া দেওয়ার দোকান হচ্ছে পাড়ায় পাড়ায়। আমি একটা ভিডিও ক্যাসেটের দোকান দিলাম গেণ্ডারিয়ার দীননাথ সেন রোডে। ‘সীমান্ত গ্রন্থাগার’ এর উল্টোদিকটায়। আমার চাচাতো ভাই ফজল কাকার বড় ছেলে বাশারকে ঢাকায় নিয়ে এসেছিলেন মা। একটা সময়ে আমার কম্পোজ সেকশন চালাতো বাশার। নাইট স্কুলে পড়তো। কম্পোজ সেকশন উঠে যাওয়ার পর তাকে এনে বসালাম ভিডিও ক্যাসেটের দোকানে। কলুটোলার সেই টিনসেড ছেড়ে গেণ্ডারিয়ার রজনী চৌধুরী রোডের চারতলার ওপর ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছি। বাড়ির মালিক মোসলেম সরকার পুস্তক ব্যবসায়ী। বাংলাবাজারে তাঁর নোট গাইডের ব্যবসা। মোসলেম সাহেবের পরের ভাই আবু মুসা সরকার পরে সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থা করেন ‘হাতেখড়ি’ নামে। আমার বেশ কিছু বই বেরিয়েছিল তাঁদের প্রতিষ্ঠান থেকে। শিশু কিশোরদের জন্য সম্পাদিত বই ছিল অনেকগুলো। বাশার বোধহয় সাতআট মাস ভিডিও ক্যাসেটের দোকানটা চালিয়েছিল। সে চলে যাওয়ার পর আমার ভাই বাদল দোকানটা দেখতো। বাশার থাকা অবস্থাতেও বাদল মাঝেমাঝে বসতো। আমিও গিয়ে বসতাম কখনও কখনও। ভিডিও ক্যাসেটের দোকানের নামও দিয়েছিলাম ‘নির্বাচিতা’। এই ব্যবসা চলেছিল বছর দেড়েক। তারপর লালবাতি জ্বলে গেল।

ভিডিও ক্যাসেটের দোকানে বসে কোনও কোনও বিকেলে আমি অপলক চোখে তাকিয়ে থাকতাম রাস্তার ওপারকার ‘সীমান্ত গ্রন্থাগার’ এর দিকে। সেই বিকেলটির কথা মনে পড়ত। যে বিকেলে প্রথম মনে হয়েছিল লেখালেখির কথা। আমিও কি লিখতে পারি না?

১৯৭৩ সাল। বিকেলবেলা ‘সীমান্ত গ্রন্থাগার’এ বসে বই পড়ছি। আমার বয়সী একটি ছেলে খুবই অহঙ্কারী ভঙ্গিতে সেখানে এসে ঢুকল। অনেকেই দেখি তাকে খুব সমীহ করছে। তার বাবা বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক। বাংলাবাজারে নামকরা প্রকাশনা সংস্থা আছে তাদের। বইয়ের দোকান আছে। ছেলেটি নিজেও ছোটদের জন্য লেখে। বোধহয় সেদিন তার কোনও লেখা ছাপা হয়েছে কাগজে। লেখার কাটিং নিয়ে পরিচিতজনদের দেখাচ্ছে। সবাই খুবই খাতির তোয়াজ করছে তাকে। এককোণায় বসে লক্ষ্য করলাম অহঙ্কারী ছেলেটির পা আর মাটিতে নেই। মাটির ছ সাত ইঞ্চির উপরে যেন সে দাঁড়িয়ে আছে। ওই দেখে মনে হলো সে যদি গল্প লিখতে পারে আমি পারব না কেন? সে প্রায়ই এসে ‘সীমান্ত গ্রন্থাগার’ থেকে বই নিয়ে যায়, পড়ে ফেরত দিয়ে যায়। আমিও তো বই পড়ি। কমও তো পড়ি না। আমারও তো পারা উচিত ?

এই ভাবনার পর জীবনের প্রথম গল্পটা আমি লিখেছিলাম। গল্পের নাম ‘বন্ধু’।

একটি কিশোর ছেলে ও একটি বানরের বন্ধুত্ব নিয়ে গল্প। ছেলেটি আমার ছোটভাই খোকন। আমরা তখন রজনী চৌধুরী রোডে থাকি। ১৪/১এ রজনী চৌধুরী রোড। এক দারোগা সাহেবের বাড়ি। তিনি দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে সংসার করেন খিলগাঁওয়ে। এই বাড়িটা প্রথম স্ত্রীর। এই সংসারে তিন ছেলে দুই মেয়ে। রতন, কাঞ্চন আর নবনূর। দুই মেয়ে মঞ্জু আর জলি। মঞ্জু আপা নার্সের চাকরি করেন ঢাকার বাইরে। বড় আর মেজো ছেলে রতন কাঞ্চন চাকরি করেন। ছোট নবনূর ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়েন। সবার ছোট জলি। সে আমার বোন মণির বয়সী। মণিজা রহমান গার্লস স্কুলে পড়ে। নবনূর ভাইয়ের আরেকটি নাম মিন্টু। ভালোনাম মোজাম্মেল হক মিন্টু। আমরা তাঁকে নবনূর ভাই বলে ডাকতাম। নবনূর ভাইয়ের সঙ্গে পরে মণির বিয়ে হয়। তাঁর কারণেই আমি জার্মানিতে গিয়েছিলাম। পরে তিনি আমেরিকায় সেটেল করেন। লেখালেখি করতেন। বেশ কিছু গল্প উপন্যাসের বই আছে। বাংলা একাডেমি পুরস্কারও পেয়েছেন।

নবনূর ভাইদের বাড়িটায় আমরা ভেঙে ভেঙে দুবার থেকেছি। ’৬৮ সালের শেষদিক থেকে ’৬৯ সালের অনেকটা। তারপর ’৭২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে বেশ কয়েক বছর। মুরগিটোলা থেকে এই বাড়িটাতেই প্রথমবার এসেছিলাম। তখন পশ্চিম দক্ষিণ দিককার টিনের ঘরটায় থাকতাম। এই ঘরের লাগোয়া উত্তর দিককার বড় ঘরটায় ছিল নবনূর ভাইদের সংসার। জলি ফুটফুটে সুন্দর ছিল। খালাম্মার গায়ের রংও ফর্সা, চেহারা সুন্দর। সামান্য রাগী ক্ষেপাটে ধরনের মানুষ। কিন্তু আমাদের সবাইকে খুব ভালোবাসতেন। আব্বাকে খুব পছন্দ করতেন।

স্বাধীনতার পর এই বাড়ির গেইটের উত্তর পাশটায় একতলা বিল্ডিং উঠেছে। বিল্ডিংয়ের পশ্চিম পাশে চওড়া বারান্দা। বড় বড় দুটো রুম। এই বিল্ডিংয়ের ভাড়াটে ছিলাম আমরা। যে টিনের ঘরটায় প্রথম থেকেছি, ওই ঘরটায় একসময় ভাড়া থাকতেন কবি আবুল হাসানরা। তাঁর বাবাও পুলিশ      বাহিনীতে চাকরি করতেন। বাড়ির পশ্চিম দিককার সীমানা দেওয়ালের সঙ্গেই স্থানীয় বাসিন্দাদের কবরস্থান। সারাক্ষণ থমথমে নীরবতা কবরস্থানে। গাছপালা ঝোপজঙ্গলে ঝিঁঝিঁ ডাকে। মধ্যরাতে ওদিকটায় তাকালে গা ছমছম করে। বড় বড় বেজি চলাচল করতে দেখা যায় দিনদুপুরে। কবরস্থানের ধাড়ি ইঁদুরগুলো ইয়া বড় বড়। খাদ্যের সন্ধানে বেজি আর ইঁদুর বাড়িটায় এসে ঘুরঘুর করতো। গেণ্ডারিয়ায় বানরের কোনও অভাব নেই। সাধনা ঔষধালয়ের কারখানা দীননাথ সেন রোডে। বানরের আখড়া হচ্ছে সাধনায়। অধ্যক্ষ যোগেশচন্দ্র ঘোষ সাধনা ঔষধালয়ের হর্তাকর্তাবিধাতা। তিনি নিয়ম করে বানরগুলোকে খাওয়াতেন। একটা নির্দিষ্ট সময়ে চাঙারি ভরে ভরে বানরদের জন্য খাবার বিছিয়ে দেওয়া হত কারখানার খোলা চত্বরে। শত শত বানর তাদের স্বভাবমতো হুটোপুটি করত, খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করত। তাদের দৌড়ঝাঁপ আর চিৎকার চেঁচামেচিতে মুখর হয়ে উঠত সাধনার আঙিনা।

এপ্রিল মাসের ৪ তারিখ ১৯৭১। নব্বই বছরের কাছাকাছি বয়সের বৃদ্ধ অধ্যক্ষ যোগেশচন্দ্র ঘোষকে পাকিস্তানি মিলিটারিরা হত্যা করে সাধনার সামনের রাস্তায় ফেলে গিয়েছিল। বৃদ্ধ দেশপ্রেমিক মানুষটিকে এলাকার লোকজন সাবধান করেছিল, ‘দাদা আপনি সরে যান। পাকিস্তানিদের বিশ্বাস নেই।’ যোগেশবাবু বলেছিলেন, ‘আমি বুড়ো মানুষ। আমাকে মেরে ওদের কী লাভ ?’

আন্ডারগ্রাউন্ডে যোগেশবাবুর রিসার্চ করার রুম ছিল। সেখানেই থাকতেন। পাতালঘর থেকে তুলে এনে তাঁকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি পিশাচের দল। চারদিকে সুনসান নীরবতা। এলাকায় মিলিটারি আসার পরেই জনশূন্য হয়ে গিয়েছিল। হায়েনারা চলে যাওয়ার পর একজন দুজন করে বেরিয়ে এসেছিল মানুষজন। এসে দেখে তার পোষা দেড় দুশ বানর চুপচাপ ভিড় করে আছে কারখানার সেডে আর আঙিনায়। কোনও হুটোপুটি নেই তাদের, চিৎকার হৈহল্লা ছোটাছুটি নেই। মনিবের শোকে মুহ্যমান হয়ে আছে।

যোগেশবাবুর মৃত্যুর পর সাধনার বানরগুলো খাদ্য সংকটে পড়েছিল। মনিব নেই, নিয়মিত  খাবারটা কে দেবে ? আগেও বানরগুলো তাদের স্বভাবমতো এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে আসা যাওয়া করত। রান্নাঘরে ঢুকে খাবার নিয়ে যেত। শিশুদের ভয় দেখাত। অর্থাৎ বানরের যা স্বভাব সেই কাজগুলো করত। খাদ্য সংকটে পড়ে তারা আরও ডেসপারেট হয়ে উঠেছিল। মণিজা রহমান গার্লস স্কুলের রাস্তায় সাগরকলা ফেরি করছে এক লোক। মাথায় চাঙারি ভরা সাগরকলা। দেওয়ালের ওপর থেকে ধাড়ি একটা বানর লাফ দিয়ে পড়ল ঠিক সেই চাঙারির ওপর। লোকটা হুড়মুড় করে পড়ল রাস্তায়। কলা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল। তখন চারপাশ থেকে ছুটে এল আরও সাত আটটা বানর। মুহূর্তে এক চাঙারি কলা লুট হয়ে গেল। রাস্তায় হুমড়ি খেয়েপড়া ফেরিঅলা হতভম্ব হয়ে সেই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে রইল।

এই ধরনের কাণ্ড করতে গিয়ে একটি বানর তার সামনের ডানদিকের পা ভেঙে ফেলেছিল। ভেঙে ওই পা একেবারে ঝুলে গিয়েছিল। ভাঙা পা নিয়ে সে ঠিকমতো বাদড়ামোটা করতে পারত না, খাবার জোগাড় করা তার পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সকালের দিকে নবনূর ভাইদের বাড়ির দক্ষিণের দেওয়ালে এসে অসহায় ভঙ্গিতে বসে থাকত। বাড়ির লোকজন নাশতা করছে। অনাহারি বানরটি লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো। এক সকালে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা খোকন দেখল। টিনের থালায় দুখানা আটারুটি আর একটুখানি গুড় নিয়ে সকালের নাশতা করছিল সে। সাড়ে ছয় এর মতো বয়স।  হঠাৎ বানরটির দিকে তাকিয়ে তার মায়া লাগল। একটুখানি রুটি ছিঁড়ে উঠোনের দিকে ছুঁড়ে দিল। ভাঙা পা উঁচিয়ে তিনপায়ে হেঁটে এলো বানরটি। রুটির টুকরো নিয়ে ভয়ার্ত ভঙ্গিতে ফিরে গেল দেওয়ালে। ওখানে বসে খুবই পরিতৃপ্ত ভঙ্গিতে খেতে লাগল। জানালা দিয়ে দৃশ্যটা আমি দেখলাম। তিনদিন পর দেখি সেই বানর আমাদের বারান্দায় চলে এসেছে। খোকনের পায়ের কাছে বসে আছে সুবোধ বালকের মতো। খোকন নিজে রুটি খায়, বানরটিকে দেয়, বানরও খায়। যেন দুই বন্ধু একসঙ্গে নাশতা করছে। এই নিয়ে ছিল আমার গল্প ‘বন্ধু’।

গল্প তো লিখলাম, এখন ছাপাবার ব্যবস্থা কী ? কোন পত্রিকায় কীভাবে গল্প পাঠাবো ? কীভাবে তা ছাপা হবে? ‘সীমান্ত গ্রন্থাগার’এ দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকাটি আসত। সেই পত্রিকার ছোটদের পাতার নাম ‘চাঁদের হাট’। সেই লেখক ‘চাঁদের হাট’ পাতাটি নিয়েই সেদিন ‘সীমান্ত গ্রন্থাগার’এ এসেছিল। অহঙ্কারী ভঙ্গিতে সবাইকে দেখিয়ে ছিল। গল্প তাহলে এখানে পাঠানোই ভালো। অতিযত্নে কপি করলাম লেখা। গোটা গোটা পরিষ্কার অক্ষরের লেখাটি লম্বা খামে ভরে, পূর্বদেশ পত্রিকার ‘চাঁদের হাট’ এ পোস্ট করতে চললাম। ধূপখোলা মাঠের উত্তর পাশে কমিউনিটি সেন্টারের সঙ্গে বড় পোস্ট অফিস হয়েছে। দুপুর হয়ে আসা রোদ ভেঙে মাঠ পাড়ি দিচ্ছি, দেখি ওই গরমেও গলা বন্ধ আচকান পায়জামা পরা, পায়ে জুতো মোজা ভদ্রলোকটি ছাতা মাথায় দিয়ে উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিকে আসছেন। বিশাল ধূপখোলা মাঠটিতে তিনি প্রতিদিনই এই পোশাকে এইভাবে হাঁটেন। দক্ষিণ থেকে উত্তরে যান, উত্তর থেকে আসেন দক্ষিণে। মুখে শ্বেতির দাগ, মাথায় টুপি। কারও সঙ্গে কথা বলেন না। সাবেক শরাফতগঞ্জ লেনে এই ভদ্রলোকের বাড়ি। শুনেছি তিনি একজন পির। কিছু না ভেবেই ভদ্রলোকের পথ রোধ করে দাঁড়ালাম। তিনি থতমতো খেয়ে তাকালেন। বললাম, আমি একটা গল্প লিখেছি। আপনি আমাকে দোয়া করে দিন। ভদ্রলোক কোনও কথাই বললেন না। মুহূর্তকাল আমার মুখের দিকে তাকিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাঠের পশ্চিম দিককার ন্যাড়া শিমুল গাছ তিনটার দিকে তাকালাম। এত ফুল ফুটেছে গাছগুলোয়, শিমুল ফুলের আলোয় রোদ আরও উজ্জ্বল হয়ে গেছে।

পরের সপ্তাহেই চাঁদের হাট-এর পাতায় গল্প ছাপা হয়ে গেল। সুন্দর ইলাসট্রেশান। আমার নাম শিল্পী অতিযত্নে প্যাঁচিয়ে লিখেছেন। তবে বানানটা ভুল হয়েছে। ‘ই’ এর পরে ‘ম’ এর জায়গায় ‘ক’ হয়েছে। পরে জেনেছি পূর্বদেশ এর সাহিত্য পাতা আর ছোটদের পাতার আঁকাআঁকির কাজ করেন কাজী হাসান হাবীব। তখনও তিনি সম্ভবত চারুকলার ছাত্র। ফাঁকে ফাঁকে পত্রিকায় কাজ করেন। পরে কাজী হাসান হাবীব আমার অভিন্নহৃদয় বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। আমাদের দুজনের স্ত্রীর একই নাম।

ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখে মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আমার গল্প ছাপা হয়েছে পত্রিকায়! দুতিনটা পত্রিকা কিনে হাতে রেখেছি। ওই নিয়ে ঘুরে বেড়াই। বন্ধুবান্ধব পরিচিতজনদের দেখাই। এই যে দেখো আমার গল্প ছাপা হয়েছে। কেউ বিশ্বাস করে, কেউ করে না। তাতে কী ? ব্যাপারটা তো মিথ্যা না! গল্প তো ছাপা হয়েছে! বিকেলবেলা পত্রিকা নিয়ে গেলাম ‘সীমান্ত গ্রন্থাগার’এ। সেই ছেলে যেমন করে নিজের লেখা দেখায়, আমিও সেইভাবে দেখালাম। লোকজনের অবাক হওয়া দৃষ্টি আর মুগ্ধতায় আমার অহঙ্কার হয়ে গেল সেই ছেলের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। ও তো মাটির ছয় সাত ইঞ্চি উপরে দাঁড়িয়েছিল, আমি দাঁড়িয়ে গেলাম দেড় দু ফুট উপরে। বেশ একটা সাহিত্যিক সাহিত্যিক ভাব এসে গেল।

তারপর বেশ কয়েক বছর ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখার আকক্সক্ষায় আমি লিখেছি। গল্পই লেখার চেষ্টা করেছি। সেগুলো গল্প হয়েছে কিনা জানি না। রোজই মাথা গুঁজে লিখি। জগন্নাথ কলেজে পড়ার ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন পত্রিকার অফিসে গিয়ে লেখা দিয়ে আসি। কোথাও কোথাও ছাপা হয়, কোথাও কোথাও হয় না। বাংলাবাজার স্কুলের গেইটে, রয়েল স্টেশনারী সাপ্লাই হাউজের পাশে দোতলা পুরনো দালান বাড়িতে দৈনিক জনপদ-এর অফিস। সম্পাদক বিখ্যাত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। তাঁকে তখনও পর্যন্ত চোখে দেখিনি। জনপদ-এর সাহিত্য পাতা আর ছোটদের পাতা দেখতেন শিশুসাহিত্যিক এখ্লাসউদ্দিন আহমেদ। তাঁকেও তখন পর্যন্ত দেখিনি। প্রতি সপ্তাহে লেখা দিয়ে আসতাম সেই পত্রিকার পিয়নের হাতে। বলতে গেলে প্রতি সপ্তাহেই লেখা ছাপা হত। কোনও সপ্তাহে ছোটদের পাতায়, কোনও সপ্তাহে বড়দের পাতায়। গল্পগুলোর ভারি সুন্দর ইলাসট্রেশান করতেন আবুল মনসুর। পরে জেনেছি তিনি মনীষী আবুল ফজল সাহেবের ছেলে। জনপদ পত্রিকায় পঁচিশ তিরিশটা গল্প বোধহয় লিখেছিলাম। কাটিং রেখেছিলাম একটা ফাইলে। কলকাতার ‘উল্টোরথ’ ‘প্রসাদ’ এইসব পত্রিকার আঙ্গিকে ঢাকা থেকে দুটো পত্রিকা বেরোত তখন। ‘ঝিনুক’ আর ‘জোনাকি’। ‘ঝিনুক’ এ কম ছাপা হয়েছে আমার গল্প। ‘জোনাকি’তে ছাপা হয়েছে বেশ কয়েকটি। ‘কামনা’ নামে একটা যৌন পত্রিকা ছিল। ওখানেও গল্প ছাপা হয়েছে। অলক বারী নামে এক ভদ্রলোক রোমাঞ্চ পত্রিকা বের করতেন। তিনি ছিলেন শেখ আবদুল হাকিম ও বুলবুল চৌধুরীর বন্ধু। এই পত্রিকাটির প্রায় প্রতিসংখ্যায় গল্প লিখতাম। আফজাল হোসেন প্রচ্ছদ করতেন, ইলাসট্রেশান করতেন। শুভেচ্ছা নামে একটা পত্রিকার দুটো না তিনটা সংখ্যা বেরিয়েছিল বাংলাবাজার থেকে। সেখানেও গল্প লিখেছি। চিত্রকল্প বেরিয়েছিল। সেই পত্রিকায়ও লিখেছি। এক সময় চিত্রকল্প পত্রিকাটি বুলবুল চৌধুরী আর সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে আমিও মালিকানা নিয়েছিলাম। পত্রিকার মূল মালিক সম্পাদক শাহজাহান সাহেব চিত্রকল্প আমাদের তিনজনকে দিয়ে দিয়েছিলেন। দুটো সংখ্যা বের করেই আমরা ফেল মেরেছিলাম। টাকা পয়সা যা ছিল আমাদের সব উধাও হয়ে গেল। বুলবুল চৌধুরী ওয়াপদায় কেরানির চাকরি করতেন। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পত্রিকা জমে গেলে চাকরি ছেড়ে দেবেন। ভাগ্যিস ছাড়েননি। দ্বিতীয় সংখ্যার পর আর চালাতে না পেরে আমাদের বন্ধুত্ব ঠিকই থাকল তবে তিনজন তিনদিকে ছিটকে গেলাম। আমি জগন্নাথ কলেজে পড়ার ফাঁকে ফাঁকে মিউনিসিপ্যালিটিতে কন্ট্রাক্টরি করি। সিরাজ ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে চাকরির চেষ্টা করছিল। ‘চিত্রকল্প’ এর পিছনে পকেটের শেষ পয়সাটি পর্যন্ত খরচ করে ফেলেছেন বুলবুল চৌধুরী। ওয়াপদায় যাওয়ার রিকশা ভাড়া নেই। ছোট ভাইয়ের সাইকেলটা নিয়ে সূত্রাপুরের পূর্ণদাশ লেন থেকে চালিয়ে গেলেন মতিঝিলের ওয়াপদায়।

জনপদ পত্রিকায় যেসব লেখা ছাপা হয়েছিল, সেসবের ফাইল আর অন্য পত্রিকায় যেসব লেখা ছাপা হয়েছিল সেগুলোর কপি যত্ন করে রেখে চলে গেলাম জার্মানিতে। জার্মানি তখন দুটো দেশ। পূর্ব জার্মানি আর পশ্চিম জার্মানি। আমি গেলাম পশ্চিম জার্মানিতে। দুবছর পর ফিরে এসে দেখি আমার ছাপা হওয়া লেখার ফাইল আর পত্রপত্রিকার কপি জঞ্জাল ভেবে আমার মা সের দরে বিক্রি করে দিয়েছেন। তারও অনেক পরে অল্পবয়সী একটা ছেলে বই ছাপার আশা নিয়ে আমার কাছে এল। সে প্রকাশক হবে। কিছু টাকাও নিয়ে এসেছে। আমার হাতে কোনও লেখা নেই। আগামী দুচার মাসে দিতেও পারব না। টাকাটা রাখলম না। তাকে জনপদ পত্রিকার লেখাগুলোর কথা বললাম। ‘পারলে ওগুলো উদ্ধার করে আনো। তোমার বই হয়ে যাবে।’ আসলে ছেলেটিকে অ্যাভয়েড করার জন্য বলেছিলাম। মাসখানেক পর সে একটা ফাইল হাতে নিয়ে এলো। জনপদ পত্রিকার প্রায় সবকটি লেখার ফটোকপি সেই ফাইলে। আমি বিস্মিত এবং আনন্দিত। কিন্তু গল্পগুলো পড়ে মহা হতাশ! অতি কাঁচাহাতের হাবিজাবি লেখা। এই জিনিস বই হতে পারে না। নানারকম বুঝ দিয়ে সেই ছেলেকে বিদায় করেছিলাম।

আমার ব্যবসা মানে শেষ পর্যন্ত ‘লালবাতি’। ভিডিও ক্যাসেটের ব্যবসায়ও বছর খানেক পর ওইবাতি জ্বলে গেল। আবুল হাসানের কবিতার মতো ‘আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি’। কান ধরে প্রতিজ্ঞা করলাম, এই জীবনে আর যাই করি ব্যবসাটা কোনওদিন করব না। বহু প্রতিজ্ঞার মতো এটিও ২০০০ সালে ভেঙে গেল। হাতে কিছু টাকা জমেছিল। ওই টাকা দিয়ে পুরানা পল্টনে পাঁচতলার ওপর একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিলাম। নাটক তৈরির অফিস বানালাম। ওই ফ্ল্যাটের ঠিক ওপরতলায় শুটিং ফ্লোর তৈরি করলাম। আমার বন্ধু স্বপন দত্ত এসে ম্যানেজারের দায়িত্ব নিল। অগ্রণী ব্যাংকের অফিসার সে। ব্যাংক শেষ করে অফিসে এসে বসে। কয়েকটা কম্পিউটার কিনে সেই পুরনো কম্পিউটার সেকশনের আদলে কম্পোজ সেকশন করলাম। চার পাঁচজন কম্পোজিটার নেওয়া হলো। রঞ্জনকুমার নন্দী নামে শাঁখারি বাজারের একটি ছেলে কম্পোজিটার প্রধান হিসেবে এলো। তার হাত চলে যন্ত্রের মতো। অসামান্য দক্ষ ছেলে। একটাই খারাপ স্বভাব রঞ্জনের। প্রতিদিন বিরিয়ানি খায়। ‘হাতেখড়ি’র প্রচুর কাজ পেলাম। ‘অনন্যা’র মনির, ‘সময় প্রকাশন’ এর ফরিদ ওরাও কাজ করাতে লাগল। লেখক মঈনুল আহসান সাবেরের প্রকাশন সংস্থার নাম ‘দিব্যপ্রকাশ’। সেও কাজ নিয়ে এল। বেশ জমজমাট অবস্থা। নিজে নাটক লিখে প্রযোজনা করতে লাগলাম। ততদিনে গেণ্ডারিয়া ছেড়ে মগবাজারে নিজের ফ্ল্যাটে এসে উঠেছি। সিলভার কালারের সুন্দর একটা টয়োটা গাড়ি কিনেছি। ‘বিটিভি’র প্রডিউসার রিয়াজউদ্দিন বাদশা আমার বন্ধু। আমার নাটকগুলো সে-ই তৈরি করে। অভিনেত্রী জয়া আহসান তখনও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেননি। তাকে নিয়ে ‘আমাদের ছোট নদী’ নামে ১৩ পর্বের একটা সিরিজ করলাম। ‘চ্যানেল আই’ এই সব নাটক কিনে নিয়ে চালাতে লাগল। ‘বিটিভি’তেও প্রচারিত হলো কোনও কোনওটা। শুটিং ফ্লোর করার সময় অনেকেই কথা দিয়েছিলেন ফ্লোরটি ভাড়া নিয়ে শুটিং করবেন। তাদের একজনও এলেন না। তবে হুমায়ূন আহমেদ দুটো নাটকের শুটিং করলেন। এক পর্বের ‘ওপেনটি বায়েস্কোপ’ আর ‘নীল তোয়ালে’। পরিকল্পনামতো ‘নীল তোয়ালে’ ধারাবাহিকটি হুমায়ূন ভাই শেষ করতে পারেননি। ‘একুশে টেলিভিশন’ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে ধারাবাহিকটি তিনি কোনও একটা পর্যায়ে এনে শেষ করেন। অভিনয় করেছিলেন, আসাদুজ্জামান নূর, সারা যাকের, শাওন প্রমুখ। নাটকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটির নামও ছিল ‘নির্বাচিতা’। বার বার তিনবার। ২০০৪ সালে ‘নির্বাচিতা’র তৃতীয় এবং শেষ ব্যবসাটিও বন্ধ হয়ে গেল।

নাটকের ব্যবসা করতে গিয়েই নূরজাহান দ্বিতীয় পর্ব লিখতে অনেক দেরি হয়েছিল। আমার চরিত্রের কোথায় যেন ভয়াবহ এক অস্থিরতা আছে। জীবনের বহুক্ষেত্রে হুটহাট করে বড় বড় এমন সব সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যেসব না নিলে এ জীবন অন্যরকম হত। বড় আফসোস হয় নিজের দিকে তাকালে। কেন এত কিছু করার চেষ্টা করেছি? কেন শুধু লেখালেখিটা নিয়ে থাকিনি ? গভীর রাতে হঠাৎ হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। তারপর আর ঘুম আসে না। নিজের জীবনের কথা ভাবি। অতীত জীবনের ভুলগুলো মাথার ভিতরে কড়া নাড়ে। তারপর ভাবি, যে জীবনে ভুলভ্রান্তি থাকে না, সেই জীবন, জীবন হয় কী করে ? শত শত ভুলভ্রান্তি নিয়ে এই তো আমি! শামসুর রাহমানের কবিতার মতো ‘এখনো দাঁড়িয়ে আছি এ আমার এক ধরনের অহঙ্কার’।

[চলবে]

———–

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button