আর্কাইভভাষা গবেষণা

শব্দবিন্দু আনন্দসিন্ধু – প্রথম পর্ব

ভাষা-গবেষণা ধারাবাহিক

মানবর্দ্ধন পাল

[প্রাচীন ভারতীয় আলংকারিকেরা শব্দকে ‘ব্রহ্ম’ জ্ঞান করেছেন―শব্দ যেন ঈশ্বরতুল্য। পাশ্চাত্যের মালার্মেসহ নন্দনতাত্ত্বিক কাব্য-সমালোচকদেরও বিশ্বাস, শব্দই কবিতা। যা-ই হোক, শব্দের মাহাত্ম্য বহুবর্ণিল ও বহুমাত্রিক। বাংলা ভাষার বৃহদায়তন অভিধানগুলোর পাতায় দৃষ্টি দিলেই তা প্রতিভাত হয়। আগুনের যেমন আছে অসংখ্য গুণ তেমনই ভাষার প্রায় প্রতিটি শব্দেরও আছে অজস্র অর্থের সম্ভার। কালস্রোতে ও জীবনের প্রয়োজনে জীবন্ত ভাষায় আসে নতুন শব্দ, তা বিবর্তিতও হয়। পুরোনো শব্দ অচল মুদ্রার মতো ব্যবহার-অযোগ্য হয়ে মনি-কাঞ্চনরূপে ঠাঁই নেয় অভিধানের সিন্দুকে।

বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার সমুদ্রসম―মধুসূদনের ভাষায় : ‘ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন’। বৈঠকি মেজাজে, সরস আড্ডার ভঙ্গিতে লেখা, এই ‘শব্দবিন্দু আনন্দসিন্ধু’। ব্যক্তিক ও নৈর্ব্যক্তিক―সবকিছু মিলিয়ে শব্দের ভেতর ও বাইরের সৌন্দর্য-সৌগন্ধ এবং অন্তর্গত আনন্দধারার ছিটেফোঁটা ভাষিকরূপ এই ‘শব্দবিন্দু আনন্দসিন্ধু’ ধারাবাহিক।]

তালাচাবি

চাবি হারাননি কিংবা ভুলক্রমে চাবি ফেলে আসেননি এমন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সংখ্যা খুবই কম। তা একেবারেই আণুবীক্ষণিক। প্রয়োজনের চাবিটি হাতে না-থাকলে যেমন বিড়ম্বনা তেমনি হাতে থাকলেও বিপদ! হয়ত পথেঘাটে খোয়া গেছে, অফিসে ফেলে এসেছেন। টিপ-তালার সমস্যা আরও বেশি―হয়ত চাবি ঘরে রেখেই অন্যমনস্ক হয়ে তালায় টিপ দিয়ে ফেলেছেন! এমন ঘটনা কদাচিৎ একালে কারও জীবনে না-ঘটার কথা নয়! দরকারি চাবিটা হয়ত ভুলক্রমে আপনার পকেটেই ছিল কিংবা দরজা খোলার অস্ত্রসম চাবিটি ফেলেই আপনি চলে এসেছেন শতেক কিলোমিটার দূরে! এমন অবস্থায় অন্যের যেমন অপার অসুবিধা তেমনই আপনারও সমূহ বিপদ! অনাকাক্সিক্ষত এই বিপর্যয়কে বিপদ না-বলে বরং ‘আপদ’ বলাই সঠিক। এমন আপদ-বালাই হরহামেশা না-হলেও মাঝেমধ্যে ঘটে! তখন ‘কই গেল, কোথায় রাখলাম’ বলতে-বলতে মাথা ফোরটি নাইন! অবশেষে ফুটপাতে বসে-থাকা তালাচাবির ‘ইঞ্জিনিয়ার’কে ডাকো নয়ত ভাঙো তালা, ভাঙো কয়রা বা হেজবুল!

তালা একটি যন্ত্রেরই নাম আর চাবি এটি বন্ধ বা খোলার অস্ত্র―এ কথা সবারই জানা। তালা কে আবিষ্কার করেছেন তা জানি না। তবে দরজা বা দরকারি কিছু আবদ্ধ করে রাখার যন্ত্রের প্রচলিত নাম তালা। শব্দটি সংস্কৃত ‘তলক’ থেকে এসেছে। এর অন্য নাম ‘কুলুপ’। তবে বহুতল-বিশিষ্ট বিল্ডিংয়ের প্রতিটি স্তরকেও আমরা ‘তালা’ বলি―যা আসলে তলা। ‘কানে তালা লাগা’ বললে আবার অন্য অর্থ বোঝায়। মধ্যযুগের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর রচনায় পাই : ‘দারুণ প্রহার তার উদরের জ্বালা। / ঘন শ্বাস বহে তার কানে লাগে তালা।’

দ্বার বন্ধ করার যন্ত্র হিসেবে তালা সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিস। এই তালা নিরাপত্তার প্রতীক। চোর যাতে সহজে মূল্যবান জিনিস অপহরণ করতে না-পারে। নারীর প্রতি অবিশ্বাস ও নারী-নির্যাতনের অস্ত্র হিসেবে তালার অপব্যবহারের কথাও আমরা জানি।

আগে ছিল সিঁদকাটা ও বেড়াকাটা চোর। কালের আবর্তে ওরা এখন কেউ পকেটকাটা, গ্রিলকাটা ও তালাকাটা চোরে রূপান্তরিত হয়েছে। তালা নিরাপত্তার প্রতীক ঠিকই তবে তা ভদ্রলোকের জন্য―নিশিকুটুম্বের জন্য নয়। পাকা চোরের জন্য যত দামি তালাই হোক সবই পানিভাত―তা ডিজিটাল তালাই হোক বা আঙুলের ছাপযুক্ত তালাই হোক।

‘চাবি’ পর্তুগিজ শব্দ। তালা খোলার শলাকা বা কাঠি। কোনও কল বা যন্ত্রপাতি চালু বা বন্ধ করার বিশেষ কাঠির নামই চাবি। চাবিকে অনেকে ‘কুঞ্জি’ বলে। সংস্কৃত ‘কুঞ্জিকা’ থেকে ‘কুঞ্জি’। গ্রামবাংলায় চাবিকে বলে ছোড়ান্ বা ছোড়ানি। চাবির আকৃতি শলাকার মতো বলে এর সঙ্গে ‘কাঠি’ শব্দ জুড়ে দিয়ে বলা হয় ‘চাবিকাঠি’। অজানা জিনিস আবিষ্কারের সহায় ‘চাবিকাঠি’। কোনও কিছুর মূল চালিকাশক্তি বা প্রধান নিয়ন্ত্রককেই বলা হয় চাবিকাঠি। সম্প্রতি প্রকাশিত জীবনানন্দ দাশের কাব্যপ্রতিভা সম্পর্কে ড. আকবর আলি খানের একটি চমৎকার বইয়ের শিরোনাম চাবিকাঠির খোঁজে। ‘প্রধান’ অর্থেও ‘চাবি’ শব্দটির ব্যবহার হতে পারে―চাবিশব্দ, চাবিব্যক্তিত্ব, চাবিকবিতা। তাই বলা যায়, আমাদের স্বাধীনতার চাবিব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু কিংবা ‘দুই বিঘা জমি’ রবীন্দ্রদর্শনের চাবিকবিতা। কাব্য করে রূপক অর্থেও চাবি শব্দটি ব্যবহৃত হয়। তাই কবি দেবেন্দ্রনাথ সেনের অশোকগুচ্ছ কাব্যগ্রন্থে পাই : ‘হলো না রে ঘুরাইতে, প্রেমচাবি না ছুঁইতে, বাজে কেন সোহাগের কল।’

তালা এবং চাবি দুই জিনিস হলেও চাবি শব্দটি তালার বিকল্প হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। অনেক অঞ্চলে তালা অর্থেই চাবি শব্দটির প্রয়োগ হয়। চাবিমারা বা চাবিখোলা মানে তো তালাবদ্ধ বা মুক্ত করার প্রসঙ্গেই বলা হয়। এই তালাচাবি নিতান্ত বৈষয়িক বস্তু হলেও বাংলা কবিতায় কিন্তু এর অবস্থান গৌণ নয়! সলিল চৌধুরী এবং শঙ্খ ঘোষের দুটি বিখ্যাত কবিতা আছে ‘চাবি’ শিরোনামে। নজরুল পরাধীনতা ও বন্দিত্বের প্রতীক হিসেবে তালা ভাঙাকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। বলেছেন : ‘লাথি মার ভাঙরে তালা / যত সব বন্দীশালা / আগুন জ্বালা, আগুন জ্বালা।’ একালের কবি নির্মলেন্দু গুণও লিখেছেন : ‘চাবি দিয়ে তালা খোলা দেখিয়াছি, / এবার তালা দিয়ে খোল দেখি চাবি?’ কলের পুতুল চাবি দিলেই নড়ে এবং ঘোরে। আগের দিনের ঘড়িতে সময় বেঁধে চাবি দেওয়া হতো। এ বিষয়টি বাংলার লোককবি ও বাউলেরা তাদের গানে রূপকার্থে ব্যবহার করেছেন : ‘একবার চাবি মাইরা দিছে ছাইড়া / জনম ভইরা ঘুরতে আছে।’ এই চাবি তো মানবজনমের প্রাণসত্তা ও জীবনযাপনের পরিক্রমা। এর নিহিতার্থ ব্যাপক।

বাঙালির বাস্তব সংসারজীবনে এক গোছা চাবির গুরুত্ব অনেক। চাবির গোছাটি যে-নারীর আঁচলে বাঁধা থাকে তিনিই সংসারের কর্ত্রী। তার আদেশ-নির্দেশই সর্বমান্য। তিনিই গৃহস্থালির পরিচালক। জমিদার-গিন্নি বা সামন্ত-পত্নীর আঁচলের চাবির গোছা আসলে ক্ষমতা ও প্রাচুর্যের প্রতীক। শাশুড়িরা আঁচলে চাবির গোছা বেঁধে পুত্রবধূদের পরিচালনা করেন। বাংলা নাটক-সিনেমা এবং  উপন্যাসে এধরনের চরিত্র অনেক লক্ষ্য করা যায়। এই চাবিগুচ্ছের দখল নিয়েও হয় ব্যাপক দ্বন্দ্ব-সংঘাত। একাধিক পুত্রবধূর মধ্যে সেই চাবিগুচ্ছের দখল নিয়ে শুরু হয় মন কালাকালি, ঝুটঝামেলা এবং অবশেষে যৌথ সংসারের ভাঙন ও বিভক্তি।

চাবি যার হাতে থাকে তিনিই ‘কি-ম্যান’―দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। ভেবে দেখুন জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমাটির কথা! সেখানে এক গোছা চাবি হয়ে উঠেছিল স্বাধিকার ও স্বাধীনতার প্রতীক। স্বৈরাচারের কবল থেকে চাবির গোছাটি জনতার হস্তগত করতে কত কৌশল, কূটনীতি এবং আন্দোলন-সংগ্রাম! তাই চাবির অধিকার আদায় ও সংরক্ষণ মূলত গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার প্রতীক।

রবীন্দ্রনাথ ‘চাবি’ শব্দটি তাঁর গানে নতুন চেতনায় প্রতীকায়িত করেছেন। তাঁর বাউলাঙ্গের একটি বহুশ্রুত গান : ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে―ও বন্ধু আমার!’ গানের এই লাইনটি নিয়ে সাধারণের মনে অনেক প্রশ্ন! তালাভাঙার কথা না-বলে তিনি চাবিভাঙার কথা বললেন কেন ? শব্দপ্রয়োগে কি ভুল করেছেন তিনি ? তা তো হওয়ার কথা নয়! তিনি তো কবীন্দ্র রবীন্দ্রনাথ। যদিও ‘রবীন্দ্রকাব্যে ভুল’ শিরোনামে প্রমথনাথ বিশীর একটি বই আছে। এ বিষয়টি তেমন নয়। একথা সত্যি যে, সাঁওতালসহ পশ্চিমবঙ্গের কোনও-কোনও অঞ্চলে তালা ও চাবি সমার্থক। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এই চাবিভাঙার বিষয়টি বস্তুগত অর্থে ব্যবহার হয়নি। এর ভেতরে আছে রবীন্দ্রদর্শনের নিগূঢ় তত্ত্ব। বিশ্বলোকের যে আহ্বান রবীন্দ্রনাথ অন্তর্লোকে ধারণ করেছেন এবং বাউলতত্ত্বের যে সর্বমানবিক বোধ লালন করেছেন আত্মায় তাতে সকল প্রকার বন্দিত্বই তিনি অস্বীকার করেছেন। তাই বিশ্বলোকের অনন্ত যাত্রায় তিনি এমন চিরন্তন পরিব্রাজক হতে চান যাতে কেউ তাঁকে আর গৃহবন্দি করতে না-পারে! তাই রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ঘরের চাবি ভাঙা মানে, মুক্ত জীবন থেকে কেউ যেন আর বদ্ধ ঘরে প্রবেশ করতে না-পারে। ঘরের চাবি ভেঙে ফেলা তো চিরদিনের মুক্ত জীবন। বন্ধন ও শৃঙ্খলে আবদ্ধ না-হওয়ার চিরন্তন মানবীয় বাসনাই সেখানে ব্যক্ত হয়েছে।

কালো

আমাদের মতো সাধারণের দৃষ্টিতে কালো একটি রঙের নাম। কিন্তু বিজ্ঞান বলে, কালো কোনও রঙ নয়―এমন কি সাদাও নয়। বিজ্ঞানের বিবেচনায় সাতটি মৌলিক রঙ―সংক্ষেপে এর নাম ‘বেনীআসহকলা’। আমরা সবাই শৈশবে এসব জ্ঞানের কথা জেনেছি। বেগুনি, নীল, আকাশী, সবুজ, হলুদ, কমলা, লাল―এই সাতটি রঙের মধ্যে কিন্তু কালো এবং সাদা নেই। তাই বিজ্ঞান বলে, কালো ও সাদা কোনও রঙ নয়। মৌলিক সব রঙ গ্রাস করে বা লুকিয়ে ফেলে বলে কোনও রঙ যখন দেখা যায় না তখনই তা কালো। আর সাদা তখনই হয় যখন কোনও রঙই ধরে রাখতে পারে না। তবে বিজ্ঞানের এসব কথা জেনে এবং মেনেও আমরা সাদা-কালোকে ‘রঙ’ বলেই বিবেচনা করি। রঙের অবশ্য প্রতীকী তাৎপর্যও আছে। লাল রঙকে আমরা বিপ্লব বা ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করি। তেমনই ‘সবুজ’ জীবনের প্রতীক, ‘আকাশী’ উদারতার, ‘হলুদ’ মুমূর্ষুতার, ‘সাদা’ শান্তির প্রতীক। আর ‘কালো’কে আমরা বলি শোকের প্রতীক। এজন্যই  শোক দিবসে আমরা কালোব্যাজ ধারণ করি।

বিজ্ঞান যা-ই বলুক না কেন, কালো রঙের মাহাত্ম্য অনেক―গুণাগুণ প্রচুর! ‘গুণাগুণ’ মানে তো গুণ এবং অগুণ। ভালোমন্দ মিলিয়েই গুণাগুণ। কাক কালো, কোকিল কালো―আমরা নিন্দা করি না! ছাতার কাপড় কালো, বিশেষ পোশাক কালো―খারাপ বলি না। তা চারিত্র্য লক্ষণ। কিন্তু আমাদের সমাজমনস্তত্ত্ব এমনই বিটকেলে যে গায়ের রঙটি কালো হলেই নাক সিঁটকাই―প্রত্যক্ষে না-হলেও পরোক্ষে তো বটেই! কালো মানেই অসুন্দর, কুৎসিত; আর সাদা মানেই সুন্দর। এমন বাজে ধারণা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেই প্রবল। কিন্তু গাত্রবর্ণের ওপর মানবীয় সৌন্দর্য নির্ভর করে না। সৌন্দর্য সামান্যই বহিরঙ্গের―অধিকাংশই অন্তরের। অথচ গায়ের রঙটাই আমাদের চোখে পড়ে, অন্তরের সৌন্দর্য উপলব্ধি হয় না! মনের আলো ওপরের কালোকে ঢেকে দিয়ে উপচে পড়তে পারে, দূর করতে পারে চারপাশের অন্ধকার, তা বুঝতে পারি না আমরা। এই ফর্সা-সুন্দরের ধারণাটি অনেকটাই ঔপনিবেশিক শাসনের কুফল! তাতে শিমুলফুলের মতো রঙের চাকচিক্য আছে কিন্তু সুবাসের মনোহারিত্ব নেই।

কালো আর ফর্সা―এই গাত্রবর্ণের জন্য ব্যক্তি-মানুষ দায়ী নয়। ব্যক্তি নিজে তা নিয়ন্ত্রণ করে না―করতে পারেও না। কিন্তু ভেতরের সৌন্দর্য ব্যক্তি-মানুষের নিয়ন্ত্রিত এবং অর্জিত। অথচ রক্তক্ষয়ী বর্ণবাদ বিশ্বে  কালো মানুষকে কত নির্যাতনই-না করেছে। রক্ত ঝরিয়েছে, প্রাণ কেড়েছে অসংখ্য মানুষের। অথচ মানুষের গায়ের রঙ কালো হয় ‘মেলানিনের’ প্রভাবে। এর মাত্রা কম থাকলে গায়ের রঙ হয় সাদা আর একটু বেশি হলেই কালো। অথচ তা নিয়ে মানুষের মধ্যে কত কত বিভেদ, উন্মত্ততা ও হিংস্রতা! বাঙালিরা ইউরোপীয় এবং আমেরিকানদের মতো বর্ণবাদী নয়। ওরা যেভাবে কালো মানুষ নিগ্রোদের ঘৃণা ও নির্যাতন করে, আমরা তেমন নই। তবে কালো চামড়ার মানুষের প্রতি আমাদের নাক সিঁটকানো ভাব আছে!

এমন অমানবিক মানসিক দৈন্যের বিরুদ্ধেই গেয়েছেন : ‘নানান বরণ গাভীরে ভাই/একই বরণ দুধ।/জগৎ ভ্রমিয়া দেখলাম/একই মায়ের পুত!’ কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তও লিখেছেন : ‘কালো আর ধলো বাহিরে কেবল/ভিতরে সবার সমান রাঙা।’ আর ভূপেন হাজারিকার সেই বর্ণবাদ-বিরোধী জনপ্রিয় মানবিক গানটি তো সবাই শুনেছেন : ‘আমায় একজন সাদা মানুষ দাও যার রক্ত সাদা/ আমায় একজন কালো মানুষ দাও যার রক্ত কালো।’ আলাউদ্দিন আল আজাদের একটি উপন্যাসেরও নাম―কালো জ্যোৎস্নায় চন্দ্রমল্লিকা।

তবে আমাদের বাংলা সাহিত্যে কিন্তু কালো নিন্দনীয় নয়। বরং সেখানে কালোরই জয়জয়কার। বিভূতিভূষণের বিখ্যাত কবি উপন্যাসের উক্তি : ‘কালো যদি এতই মন্দ, চুল পাকিলে কান্দ কেনে ?’ কবি জসীমউদদীন লিখেছেন, ‘কালো চোখের তারা দিয়েই সকল ধরা দেখি/কালো দোয়াতের কালি দিয়েই কেতাব-কোরান লেখি।’ হেমন্তের জনপ্রিয় গানটি কে না শুনেছেন ?―‘মেঘ কালো, আঁধার কালো আর কলঙ্ক যে কালো/যে কালিতে বিনোদিনী হারালো তার কুল/তার চেয়ে অধিক কালো কন্যা তোমার মাথার চুল!’ কালোর প্রতিরূপ অন্ধকার। কথাসরিৎসাগর শরৎচন্দ্রই রাতে জাহাজে রেঙ্গুন যাত্রার কালে আবিষ্কার করেছিলেন, কোনও কিছুই রূপহীন কুৎসিত নয়―‘আঁধারেরও রূপ আছে।’

কালোর কথা বললেই মনে পড়বে রবীন্দ্রনাথের কথা! কাব্যময় করে তিনি করেছেন কালো রূপের জয়গান! ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি―কালো, সে যতই কালো হোক/ দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।’ কালোর গুণগান করতে গিয়ে এর মধ্যে দার্শনিক সত্যও তুলে ধরেছেন কণিকা কাব্যের একটি কবিতায় : ‘আলো বলে, অন্ধকার, তুই বড় কালো।’/ ‘অন্ধকার বলে, ভাই, তাই তুমি আলো।’ তাছাড়া কালোর প্রসঙ্গ এলেই মনে পড়ে যায় কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কথা। তাঁর বিখ্যাত ‘মেজাজ’ কবিতাটি বর্ণবাদের বিরুদ্ধে এবং আফ্রিকার কালো মানুষের পক্ষে কী চমৎকার প্রকাশ! সংসারে নির্যাতিতা একটি কালো বউয়ের স্বামীর সঙ্গে শয়নকক্ষের সংলাপ―একটু পড়ুন : ‘বউ বলছে, একটা সুখবর আছে’।/―বলছে, ‘ঠিক দেখো, আমার মতোই হবে।’/―‘কী নাম দেবো জানো ?/ আফ্রিকা।/ কালো মানুষেরা কী কাণ্ডটাই-না করছে সেখানে।’

কালোর আরেক নাম কৃষ্ণবর্ণ। দেহের বর্ণ কালো শ্যামলা বলেই সনাতন ধর্মে দ্বাপর যুগের অবতারের নাম শ্রীকৃষ্ণ। কৃষ্ণ শব্দের অপভ্রংশ ‘কানু’। কানুর সঙ্গে ‘আই’ প্রত্যয় যোগ করে ‘কানাই’ (কানু+আই)। তাই জ্ঞানদাসের বৈষ্ণব পদাবলিতে পাই : ‘পাসরিতে নারি কালা কানুর পিরিতি।’ আর গিরিশ ঘোষের লেখায় পাই : ‘আমি জপিনু চিকন কালো/ আমার রাইয়ের রূপে ভুবন আলো।’ শ্রীকৃষ্ণকে ভালোবেসে কালাচাঁদ, কৃষ্ণেন্দু, কালিয়া, কালোশশী বলেও ডাকা হয়। তাই গিরিশের লেখায় আরও পাই : ‘বাসি হলো বনমালা দেখ ওলো প্রাণ সই।/ধূসর গগনে শশী, কালশশী এল কই!’ আর মধ্যযুগে কবিগানের শিল্পী হরু ঠাকুরের রচনায় পাই : ‘ওগো চিনেছি চিনেছি, চরণ দেখে/ঐ বটে সেই কালিয়ে।’ শ্রীকৃষ্ণ কালো ছিলেন বলেই গোপিনীদের যমুনার কালো জল এবং কালো তমালগাছ প্রিয়। গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুও কৃষ্ণপ্রেমে মগ্ন হয়ে যমুনার কালো জলে ঝাঁপ দিয়েছিলেন।

নৃবিজ্ঞানীরা বলেন, বাঙালি সংকর জাতি। ‘সংকর’ মানে মিশ্র। তাই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন : ‘শক-হুনদল, মোগল-পাঠান এক দেহে হল লীন।’ এ কারণে আমাদের গায়ের রঙ নিগ্রোদের মতো কালো নয় আবার ইংরেজদের মতো সাদাও নয়। দুধে-আলতায় গায়ের রঙ আমরা পাবো কোথায়! আর্য-অনার্যসহ বহু জাতি-গোষ্ঠীর মিশ্রণের ফলেই আমরা হয়েছি শ্যামলা―ধুপছায়া রঙের। মনে পড়ে বিগত ষাট দশকের কবি ওমর আলীর কথা : ‘এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি।’ কবির সঙ্গে দেখা হলে বলতাম―আরে ভাই, কেবল শুনবো কেন ? শ্যামল রঙ শিল্পিত রমণীদের হামেশাই দেখছি এদেশে! যত অভাবই থাকুক আমাদের―পেছন ফিরে দ্বিতীয় বার দেখার মতো শ্যামল রঙ রমণীর কমতি নেই এদেশে। অনেকে আমাদের গায়ের রঙ ‘তামাটে’ বলেও উল্লেখ করেন। একালের কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার একটি কাব্যগ্রন্থের নাম : আমরা তামাটে জাতি। শ্যামলাই বলি কিংবা তামাটেই বলি―এটা বাঙালির অহংকার। আমাদের পরিশ্রমের চিহ্ন নিখুঁতভাবে লেগে আছে এই গাত্রবর্ণে। এই চিহ্ন অক্ষয়, অমলিন। তাই প্রয়োজন নেই ফর্সা হওয়ার কোনও ক্রিমের। বেঁচে থাকুন কাজলাদিদিরা, কৃষ্ণাবোনেরা ও শ্যামলীআপুরা―কালাদা এবং কানুভাইয়েরাও। তাছাড়া মহাবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের কৃষ্ণ গহ্বরের তত্ত্বকথা না-ইবা বললাম।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ

—————–

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button