জাকিয়া রহমান
সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫-২০১৬) অনবদ্য এক কথার জাদুকর। অন্তঃস্পর্শী চমকপ্রদ গদ্যে মানবমনের চেতন-অবচেতন অনুভূতির অস্তিত্বের বহুমাত্রিক বৈচিত্র্যকে উন্মোচন করেছেন। কুড়িগ্রামের বাসিন্দা হওয়ায় রংপুর অঞ্চলের আঞ্চলিক ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা, সংস্কার অসাধারণ শিল্পিত ঢঙে সাহিত্যের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় লেখকের স্বচ্ছন্দ বিচরণÑকবিতা, গল্প, উপন্যাস, কাব্যনাট্য ও প্রঅবন্ধসহ প্রায় দুই শতাধিক গ্রন্থ রচনা করে বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের সবচেয়ে ভুল বোঝাবুঝির উপন্যাস খেলারাম খেলে যাÑউপন্যাসের প্রারম্ভে ‘সবিনয় নিবেদন’ অংশে ঔপন্যাসিক উপন্যাসের বাস্তবধর্মিতার কথা বলেছেন। সে অর্থে লেখকসত্তায় ধারণ করা বোধশক্তি, উপলব্ধ সত্য তাঁর লেখনীতে বাস্তবধর্মী রূপে রূপায়িত হয়ে ওঠে।
উপলব্ধির ভিন্নতা সাহিত্য-সৃজনে বৈচিত্র্যের নতুন কুঁড়িকে পাঠক মনে প্রস্ফুটিত করে তোলে। এ বৈচিত্র্য একজন লেখকের চিন্তা-চেতনার মর্মমূলে সক্রিয়রূপে সহ-অবস্থান করে। ফলত একই লেখকের কলমে চোর-ডাকাত, সাধু-সন্ন্যাসী চরিত্র জীবন্ত হয়ে ওঠে। শুদ্ধ ও অশুদ্ধ চেতনার বহিঃপ্রকাশে অকুতোভয় লেখক সাহিত্যের চরিত্র নির্মাণে দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন। কাহিনি-পরিকল্পনা ও মনস্তত্ত্ব উপস্থাপনে অভাবনীয় রূপে অস্তিত্বের অন্তঃস্থলের অন্তঃক্রন্দন, অন্তঃক্ষরণ, হতাশা, গ্লানি, আনন্দ ও আবেগকে চরিত্রায়নের মাধ্যমে সত্যচিত্রে রূপদান করতে সক্ষম হয়ে ওঠেন। এ প্রসঙ্গে সৈয়দ শামসুল হক বলেন :
‘চেতনার গভীর নিঃশব্দ স্তরে এভাবেই নিশ্চয়ই সৃজনের কাজ চলে; কতকিছু এসে মিশে যায়, কত কিছু এসে নতুন মাত্রা যোগ করে; নিঃশব্দে ও প্রায় যেন আপনা থেকেই; তারপর যখন একটি লেখার আকারে তাকে আমরা ধরে উঠি তখন প্রথম প্রসঙ্গটি আর পূর্বযথা রূপে থাকে না; যেন একটি ছিন্ন বাহু নিয়ে যথাযোগ্য একটি শরীরের সন্ধানÑতারপর একদিন যখন তাকে পাওয়া যায়; তখন ওই বাহুটি আসলেই যার শরীর থেকে ছিন্ন; সেও বুঝি নিজের বাহু বলে তাকে আর শনাক্ত করতে পারবে না। এভাবেই আমার সকল গল্প-উপন্যাস হয়ে ওঠে, উঠেছে।’
(খেলারাম খেলে যা, সবিনয় নিবেদন)
পতন উপন্যাসটি ২০০০ সালে অন্যদিন পত্রিকার ‘ঈদ সংখ্যায়’ প্রকাশিত হলেও উপন্যাসটি দীর্ঘদিন অগ্রন্থিত রূপে ছিল। উপন্যাসের প্রকাশ ও পরিচিতি পর্বে আনোয়ারা সৈয়দ হক ‘সামান্য কথা’ জানাচ্ছেন : ২১ বছর পরে তিনি হঠাৎ এ উপন্যাসটি খুঁজে পান এবং ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথমা প্রকাশন থেকে উপন্যাসটি প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। ৭০ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসের বয়ানশৈলী প্রশংসনীয়। নারী-পুরুষের মনস্তত্ত্ব ও বিশ্বাসকে সৈয়দ শামসুল হক যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন। কখনও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ আবার কখনও হাহাকার ও আত্মবিলাপের ক্ষরিত স্বর থেকে সত্য উন্মোচন করেছেন। এ কথা সত্য শরীরকেন্দ্রিক আত্মার বিচরণ, শরীর ভিন্ন আত্মা অকল্পনীয়। সৃষ্টির মর্মমূলে রয়েছে শরীরের সমন্বয়। আপাতদৃষ্টিতে শরীরকেন্দ্রিক বিপরীত লিঙ্গের পারস্পরিক আকর্ষণ ও আলোচনা অশ্লীল ও কুরুচির স্মারক বলে মনে হলেও নিবিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গিতে তা মহাসত্যের অনুরণন, স্বাভাবিক সত্যের সরল স্বীকারোক্তি। শরীর ও এই শরীরকেন্দ্রিক যাবতীয় রসায়নকে অস্বীকার করলে পৃথিবীও অস্বীকৃত হয়, প্রাণশূন্য হয়। সৈয়দ শামসুল হক এই উপন্যাসে নারী ও পুরুষের দৈহিক ও মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে বাণীরূপ দিয়েছেন। পুরুষের চতুরতা ও কামুকতাকে অকপটে স্বীকার করেছেন। সাবলীল স্বীকারোক্তি তাঁর খেলারাম খেলে যা উপন্যাসটিকে যেমন বিতর্কিত করে তুলেছিল তেমনই সত্যযুক্তি বিবর্জিত নামমাত্র সভ্য পাঠকের খরদৃষ্টি থেকে পতন উপন্যাসের বিষয় ভাবনার সমৃদ্ধি ও শুদ্ধ চেতনায় লেখকের আত্মোপলব্ধির আলো ছড়িয়ে দেওয়া কষ্টসাধ্য বিষয় বটে। সময়ের বিবর্তনে মিথ্যা অভিযোগের কঠিন আবরণ ভেদ করে খেলারাম খেলে যা উপন্যাসটি স্বতন্ত্র মহিমায় পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছে। পতন উপন্যাসটিও এর ব্যতিক্রম হবে না বলেই বিশ্বাস।
পতন উপন্যাসের মূল সুর নিছক মানবশরীরের কামপ্রবৃত্তি নয়, শরীরকেন্দ্রিক পাপবোধের আত্মগ্লানির মধ্য দিয়ে প্রকৃত জীবনসত্যের উন্মোচন। নারী-পুরুষের নিখাদ প্রেমের স্বরূপটিও যেন এ উপন্যাসে প্রাণ পেয়েছে, নবজন্ম লাভ করেছে। জাগতিক মোহসর্বস্ব পাপের আত্মদহনে পোড়া পাঠক-হৃদয়কে পরিশুদ্ধির নির্বাণ মার্গে উন্নীত করার দিকনির্দেশনাকে লেখক উপন্যাসের পটভূমিতে প্রাধান্য দিয়েছেন। আদি মানবের আদি পাপের শাস্তি পতন হলেও সে পতনে ধ্বংস নয়, নতুনের সূচনা গ্রথিত ছিল। জীবনবাদী লেখকের দৃষ্টিভঙ্গির তীক্ষ্নতা বা ভিন্নতা পতন উপন্যাসকে অনন্য করে তুলেছে। উপন্যাসের কাহিনি উত্তম পুরুষে বর্ণিত হয়েছে। আমি নামক যে চরিত্র কাহিনি বর্ণনায় নিয়োজিত তার নামটি ৭০পৃষ্ঠার উপন্যাসের অখণ্ড কাহিনির ৫৫ নম্বর পৃষ্ঠায় একবারই মাত্র উচ্চারিত হয়েছে। ‘আমি’ চরিত্রটির নাম ‘বাদশা মিয়া’। ঔপনিবেশিক চেতনায় ব্যক্তির অস্তিত্বে বিচ্ছিন্নতাবাদ ও খণ্ডিত চেতনায় ‘আমি সত্তা’র উন্মেষ ঘটে। রবীন্দ্রসাহিত্যে আমিত্বের প্রবল প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। সৈয়দ শামসুল হকের ‘আমি’ শুধু আমিত্বের সরল পরিচয়ের স্মারক নয়, ‘আমি’র বিস্তৃতি ও বিকাশে নারী-পুরুষের মনোদৈহিক সমীক্ষণ পূর্ণমাত্রায় বিকশিত হয়ে উঠেছে।
উপন্যাসের কাহিনি-পরিক্রমায় সংযোজিত হয়েছে কথক ‘আমি’ (বাদশা মিয়া), সামাদ, বেলাল ও ফজলু নামক চার বন্ধুর দৈহিক ও মনস্তাত্ত্বিক সংকট। ফজলুর বিয়ে, মোহাবিষ্ট অবস্থায় সামাদের পতিতালয়ে গমন, ‘আমি’র (বাদশা মিয়ার) আদিম আকর্ষণে গণধর্ষণের মতো লোমহর্ষক কাজে অংশগ্রহণই তাদের মনস্তাত্ত্বিক সংকটের কারণ। রংপুরে সিনেমা দেখতে যেয়ে ব্যর্থ হওয়া চার তরুণ বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে রেলস্টেশনে যায়। রেলস্টেশনের একপাশে গাঢ় অন্ধকারে গজিয়ে ওঠা পতিতাপল্লিতে সামাদের প্রবেশ-প্রস্তাবকে সবাই উপেক্ষা করে দৌড়ে পালিয়ে যায়। মোহাবিষ্ট সামাদ পতিতার কাঁচের চুড়ি পরা হাতের আহ্বানে ভেতরে যায় এবং যৌনপল্লির রাতের সিনেমার চরিত্রে মিশে যায়। পতিতাপল্লি ত্যাগ করার পরেই তার মোহমুক্তি ঘটে। ঘৃণা ও গ্লানির প্রবল ঝড়ে সামাদের আত্মপ্রবঞ্চনা ও পাপ-পুণ্যের অনুভূতির তীব্রতার সঙ্গে সিফিলিস নামক যৌন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে সে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। মনের ভয় ও আতঙ্ক তার শরীরে সিফিলিস রোগের লক্ষণকে প্রকট করে তোলে। যদিও ডাক্তারি পরীক্ষায় সিফিলিস ধরা পড়ে না। সিফিলিস রোগের সংক্রমণ অর্থাৎ পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও তা অনায়াসে ছড়িয়ে পড়ার ভয়াবহতা ড. হনরিক ইবসেন তাঁর ঘোস্ট নাটকে ফুটিয়ে তুলেছেন।
সামাদের চেয়েও অন্ধ-নিকৃষ্ট-কামুক ভোগবাদী চরিত্র কথক ‘আমি’ অর্থাৎ বাদশা মিয়া চরিত্রটি। সামাদের পতিতালয়ে গমনের পূর্বেই সে নারীদেহের সংস্পর্শ পেয়েছে। ঘটনাক্রমে কোনও এক মাঝরাতে ধর্ষক দলের প্রস্তাবে সে নির্দ্বিধায় গণধর্ষণে অংশ নেয়। ধর্ষণের ঘটনার আত্মতৃপ্তিতে তার মনে হয়Ñ‘ আমি তৃপ্ত বোধ করে উঠি যে সমূহ একটি কিচ্ছার কথা, বাস্তবিক এক সংকটের কথা সবার আগে ধারণায় আনতে পেরেছি।’ (পৃ: ৩৮) চরিত্রটি পাপের বোধ বিবর্জিত এক সত্তা, যে কি না মুহূর্তে সব ভুলেও যায়। বন্ধুদের মধ্যে সীমাহীন ঘনিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও এ কঠিন সত্যকে সে বন্ধুদের কাছে লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। লেখকের ভাষায়Ñ‘যত বন্ধুই হও, তোমার কিছু না কিছু থাকে যা একান্ত তোমারই। হৃদয় তো এমন যে যতই খুলে দাও তবু কিছু অন্ধকারে থেকে যায় এবং এখন আমার মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে অনেক অনেকখানিই থেকে যায় অন্ধকারে।’ (পৃ: ৪২) সামাদের আত্মগ্লানি ও পাপবোধ এবং ফজলুর হতাশায় সে নিজের পাপ উপলব্ধি করে। আত্মদহনের নিমজ্জিত সত্তায় পরিশুদ্ধির পথ অনুসন্ধান করে। ফজলু বাসর রাতে স্ত্রীর যৌনাঙ্গে অসংখ্য পোড়া ক্ষত দেখে উক্তি করে ‘নারীমূর্তি মুক্তি পাপ’। প্রকৃতপক্ষে ‘নারী মূর্তিমতী পাপ’ মন্তব্যের নিগূঢ় ভেদ করতে পাঠকের নিবিষ্ট চিত্তে ৭০ পৃষ্ঠা উপন্যাসের সম্পূর্ণ কাহিনি পাঠ আবশ্যক। উপন্যাস পাঠে উপলব্ধ হয়Ñএই মন্তব্য সাপেক্ষে শিল্পিত প্রয়াসে লেখক সীমাহীন রাগ-ক্ষোভ ও যুক্তি প্রদর্শন করেছেন।
অবচেতন মনের পিচ্ছিল চটচটে আদিম আবেদন যা ফ্রয়েডীয় যৌন চেতনা নামে বিপরীত লিঙ্গের পারস্পরিক আকর্ষণকে অবলম্বন করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; সেই শরীরী আবেদনকে কেন্দ্র করে চরিত্রের আমি সত্তার মর্মপীড়নই পতন উপন্যাসের মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। কথক ‘আমি’ অর্থাৎ বাদশা মিয়া, বেলাল, ফজলু, সামাদ চার বন্ধুই পিতৃহারা এবং বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান। পরিচয় প্রসঙ্গে লেখকের উপস্থাপনা অধিকতর অনুধাবনযোগ্য। ‘বেলাল আর ফজলু, আমি আর সামাদ, প্রথমে আমরা ছিলাম জোড়া জোড়া বন্ধু, তারপর চারজনে মিলে যাই।’ (পৃ: ২৯)। জোড়া জোড়া বন্ধুর দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় বেলাল আর ফজলুর মধ্যে প্রথমে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। অপর জোড়ায় আছে ‘আমি’ (বাদশা মিয়া) আর সামাদ। প্রকৃতপক্ষে সমমনস্তত্ত্ব, বিশ্বাস এবং একই আচরণের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। সে অর্থে লেখক সম্পর্ক স্থাপনেও যেন সফল হয়েছেন। এই উপন্যাসে বেলাল, ফজলু দুজনই শুদ্ধ সত্তার অধিকারী। বিবাহ বহির্ভূত কোনও যৌন সম্পর্ক এদের চরিত্রকে কলুষিত করে না। আবেগ-অনুভূতি সংবলিত চারিত্রিক শুদ্ধতার প্রশ্নে এ দুটি চরিত্র একই শ্রেণির। অপরপক্ষে আমি ও সামাদ নামক দুটি চরিত্রের সীমাহীন লিপ্সা, অনিয়ন্ত্রিত আবেগ এবং সবশেষে চরিত্র দুটিকে মোহাবিষ্ট হয়ে অনৈতিক সম্পর্কে লিপ্ত হতে দেখা যায়।
আমি ও সামাদের আবেগ বিহ্বল নিষিদ্ধ আদিম সম্পর্কে লিপ্ত হওয়া ও বর্বরতার পরিশেষে আত্মগ্লানির যে আগুন তাদের দুজনের মধ্যে ঝলসে উঠতে দেখা যায়, তা মূলত শুদ্ধসত্তা ও সৎ চরিত্রের অধিকারী দুই বন্ধুর অপর দুই বন্ধুর সাহচর্যে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কেননা পরবর্তীকালে তারা চারজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে দীর্ঘদিন পারস্পরিক সাহচর্যে রয়েছে। চার বন্ধুর যাপিত জীবনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন, পাপবোধে অন্তর্দহন, আত্মগ্লানির পরিশেষে পাপ মুক্তির প্রচেষ্টা পতন উপন্যাসের কাহিনিকে অখণ্ড চেতনায় এগিয়ে নিয়েছে। পাপবোধ, পাপের স্বরূপ উন্মোচন, পাপ থেকে মুক্তির পথ দেখিয়ে যেন গ্লানি সর্বস্ব জীবনকে নিয়ত ক্ষয়ে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া, নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে লেখক নবজন্মের ইঙ্গিত দিলেন। উপন্যাসে দুখু ভাইয়ের মুখে বলতে শুনিÑ‘নিস্তার থাকবে না কেনে ? পাপ বুঝিলেই পাপের অর্ধেক নাই হয়ে যায়। … আর যদি বাকি অর্ধেক চোখের পানিতে মুছি দিতে পারেন তো পাপ আর পাপ থাকে না বাহে।’ (পৃ: ৫০)
শারীরবৃত্তীয় রসায়নের আদিমতাকে সহচরী করে পথভ্রষ্টরা শতগুণ অন্ধকারাচ্ছন্ন মনের সমর্থনে তাদের শরীরকে সামনে এগিয়ে নিয়ে চলে। ঘটে অনিয়ম, অনাচার, সীমাহীন পাপ। পাপীর পাপাত্মা সত্যের পথে পরিচালিত হয় শুদ্ধ কোনও বহিঃশক্তির ঐশ্বরিক জাদুস্পর্শে। এ উপন্যাসে বেলাল এবং ফজলু তেমনি এক শুভশক্তি। অন্যদিকে আমি চরিত্রের মুখে শুনতে পাইÑ‘পাপের কথা যদি এর আগে বলে থাকি, তবে সে নিজেকে পেছন ফিরে দেখেই এখন বলছি, তখন আমার পাপ বোধ ছিল না।’ (পৃ: ৬১) পাপের আত্মগ্লানির অনল মানবাত্মাকে কতখানি পোড়ায় তার সমূহ প্রমাণ সৈয়দ শামসুল হকের পতন উপন্যাসে অসাধারণ গদ্য ভঙ্গিমায় উপস্থাপিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে পাপীর পাপবোধ তাকে শুদ্ধ শুভ্র সত্যের পথে নিয়ে যায়। অন্যথায় পাপী নির্দ্বিধায় অকুণ্ঠচিত্তে পাপ কাজে লিপ্ত থাকে। পতন উপন্যাসে লেখকের শুভ প্রত্যয় সেই সকল চরিত্রের পাশে জীবনীশক্তির আলোকবর্তিকা হয়ে দাঁড়ায় যারা পাপকে অনুভব করে দগ্ধীভূত হয়, হচ্ছে, হবে অনাগতকালেও। উপন্যাসে পতিতালয়ে গমনের পাপ সামাদকে যেভাবে পোড়ায় তা অপেক্ষা শতগুণ বেশি আত্মগ্লানির আগুনে পোড়ে ধর্ষক ও উপন্যাসের ‘আমি’ চরিত্রটি। একই সূত্রে এ কথা বলা যায় না যে, ধর্ষককে শুদ্ধাচারের বিধান দিয়ে লেখক ধর্ষণের মতো অন্যায়কে উস্কে দিলেন। ধর্ষককে তিনি শুধু উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করেছেন মাত্র, অবশ্যই উস্কে দেননি। আবার এ কথাও সত্যি যে আমি চরিত্রটি সীমাহীন কামুক এবং কামনার বশবর্তী হয়েই সে ধর্ষকদলের প্রস্তাবে রাজি হয়েছে । সে প্রকৃতপক্ষে ধর্ষণের পরিকল্পনাকারী না, অর্থাৎ ‘আমি’ চরিত্রটি স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যে ধর্ষক নয়। আবার একই সঙ্গে তার ভোগলিপ্সায় ধর্ষণ কাজে অংশ নেওয়ায় সে ধর্ষক। তার স্বীকারোক্তি প্রমাণ দেয় সেই রাতে সে এতটাই মোহাবিষ্ট ছিল যে ধর্ষণকে ধর্ষণ বলে শনাক্ত করতে পারেনি। ‘আমি যে এক নববধূকে ধর্ষিত হতে দেখেছি, ধর্ষণ বলেও একে শনাক্ত সে রাতে করতে পারিনি। এ যেন পথে একটা টাকা পড়ে পাওয়া এবং নির্বিকার চিত্তে পকেটে পুরে ফেলা।’ (পৃ: ৬১) সমালোচক-মনে প্রশ্ন জাগে ধর্ষণের বিষয়টি শনাক্ত করতে পারলে কি সে এ কাজে অংশ নিত ? প্রকৃতপক্ষে এক আদিম আকর্ষণ তাকে সামনে এগিয়ে নিয়েছে। এ আকর্ষণকে উপেক্ষা করার মনোশক্তি ‘আমি’ চরিত্রে অনুপস্থিত। ধর্ষককে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করার কারণ ধর্ষক অন্য সকল অপরাধীর চাইতে নিকৃষ্ট জঘন্য অপরাধী। এছাড়া বলা যায় প্রকৃতিগতভাবে আদিমতম প্রবৃত্তিতে অসংযত মানসচেতনায় শরীরকেন্দ্রিক অনাচার এবং পাপাচারের সম্ভাবনাও বেশি। হয়ত এ কারণেই কামুকের মনস্তত্ত্বকে লেখক সাহিত্যে সংস্থাপন করেছেন।
নারীর প্রতি সৃষ্টিগতভাবে বিপরীত লিঙ্গের মানুষের অন্তঃসত্ত্বায় কুপ্রবৃত্তি জাগ্রত হয়। কুপ্রবৃত্তি জাগ্রত হওয়ার মুহূর্তে বিবেকের আলোর পথটি তাদের কাছে অচেনা থেকে যায়। সংঘটিত পাপ কাজে সে কোনও পাপ বা অন্যায় দেখতে পায় না। মোহাচ্ছন্ন চেতনায় ঘোরের মধ্যে ক্রমশ অন্যায়ের দিকে ধাবিত হয়। পতন উপন্যাসে পাপীর মুখে এ কথা অসংখ্যবার ধ্বনিত হয়েছে। অনুতপ্ত সত্তায় পাপীর দাবি ওই সময়ে যে ছিল সে ‘আমি’ ছিলাম না। অর্থাৎ পরিচিত সত্তার অন্তরালে বাস করে এক অজানা সত্তা যে নির্দ্বিধায় প্রবৃত্তির চোরাবালিতে নিমজ্জিত হয়। মোহমুক্তির মাধ্যমে স্বীয় সত্তার পর্যবেক্ষণে পতন উপন্যাসের চরিত্র ‘আমি’র মুখে বলতে শুনিÑ‘তারপর আমার পালা আসতেই যুবতীর কাছে এগিয়ে যাই। যেন আমি নেই। অন্য কেউ।’ (পৃ: ৫৭) দ্বিতীয়বারের ধর্ষণের সময়েও ‘আমি’ চরিত্রের মুখে ধ্বনিত হয়Ñ‘আমি কি উঠে দাঁড়াই ? না অন্য কেউ ? আমার বোধ চৈতন্য নেই।’ (পৃ: ৬০) পরমুহূর্তে আবারও বলতে শুনিÑ‘তবে বুঝি মানুষের ভেতরে অনেক মানুষ। এক মানুষ পাপ করে, ভেতরের আরেক মানুষ সেই পাপ ভুলে যায়। না, ভুলে যাওয়া কেন ? ভেতরের সেই আরেক মানুষ মনে করে, পাপ যে করেছিল, হাহাকার করে উঠেছিল সে আমি নই।’ (পৃ: ৪৭) পতিতালয়ে গমন করা সামাদের মুখে শুনতে পাইÑ‘আমি সেই রমণীর টানে গলির ভেতরে চলে যাই। আমি কি যাই, আমার ভেতরে যে অন্য এক আছে সেই যায় ?’ (পৃ: ২২)
সৈয়দ শামসুল হকের গদ্যভাষার গাঁথুনির ঢঙে কিছু বৈচিত্র্য দৃষ্টিগোচর হয়। যা ভাষার স্বাভাবিক গতিশীলতাকে থামিয়ে পাঠককে ভাবনার ভাবালুতায় নিমজ্জিত করে। অমনোযোগী পাঠকও নিবিষ্টমনে পূর্বপাঠের বিষয় বা পাঠ-অভিজ্ঞতা অথবা ব্যক্তি অভিজ্ঞতার স্মৃতির আকর খুঁজতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে। এ কাজে কখনও কখনও লেখক বাক্যের শেষে প্রশ্নবোধক চিহ্ন বসিয়ে যেন পাঠককে ভাবতে বাধ্য করেছেন। পতন উপন্যাসে এরূপ অনেক বাক্যের ব্যবহার রয়েছে :
‘নারী মূর্তিমতী পাপÑআমরা তিনজন একসঙ্গে উচ্চারণ করে উঠি। এ কথার অর্থ কি ?’ (পৃ: ৯)
‘ঘরে যুবতী মেয়ে দেখতে শুনতেও বড় ছিমছাম, তবে একটু হাবাগোবা কিন্তু তাতেই বা কী ?’ (পৃ: ১৪)
‘এ তুই কোথায় গেলি ? এ তুই কী করলি ? সামাদ ? নারী তবে সত্যিই মোহিনী ? নারী তবে পাপের শিকড় ?’ (পৃ: ২৪)
‘বেশ্যাও কি নারী নয় ?’ (পৃ: ২৫)
‘বন্ধু সুখ-দুঃখ নিজের কিসের বন্ধুত্ব ? কেমন বন্ধুত্ব ?’ (পৃ: ২৬)
‘কিন্তু পাপ ? পাপ কি মানুষকে পুণ্যবান করবে বলেই তার বিষদাঁতে এমন আমাদের কামড় দেয় ? পাপ যদি মানুষকে পুণ্যবান করবার জন্যেই জগতে এসেছে, তবে দোজখ কেন তৈরি করেছে খোদা ?’ (পৃ: ৪৬)
‘পাপ বুঝিলেই যে পাপের অর্ধেক চলি যায় কইলেন, যে না বুঝি ওঠে, তার কী হয় ?’ (পৃ: ৫০)
‘মনে আছে ভাই ? সেই একবার!’ (পৃ: ০৯)
সৈয়দ শামসুল হকের গদ্যের ভাষায় কাব্যময়তা রয়েছে। কাহিনির অন্তঃস্থলে চিত্রকল্পের ব্যবহার গদ্যভাষা ও কাহিনিকে সমৃদ্ধ করেছে। সৈয়দ শামসুল হকের মতে, ‘গল্প পড়তে পড়তে যিনি ছবি না দেখে উঠেন, মুখ না অনুভব করেন বুঝতে হবে গলদ একটা আছে কোথাও। আমি এর জন্য পাঠককে দায়ী করবার বদলে লেখককেই করবো। বলবো, লেখকই পাঠাতে পারেননি সংকেত।’ কাব্যধর্মী ভাষার প্রয়োগে পতন উপন্যাসের গদ্যভাষায় উপমা, উৎপ্রেক্ষা, প্রতীক ও অনুপ্রাসের বহুল ব্যবহার লক্ষ করা যায়।
ভাষার সাবলীল ব্যবহারে আঞ্চলিকতার স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। কতিপয় শব্দের ব্যবহারে স্পষ্ট হয়ে ওঠে এ উপন্যাসে রংপুর অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ করেছেন :
‘তোমরা সেই হন তো ?’ ( পৃ: ২৭)
‘তোমরা চারজন তো ছিলেন।’ (পৃ: ২৭)
‘তোমরা যদি বন্ধু হন তার, তাকে দেখি রাইখবেন।’ (পৃ: ২৭)
‘কাঁই, কাঁই বাহে এ ঠায় বসিয়া।’ (পৃ: ৪৯)
‘তোমরাও মজা লোটেন, বাহে। আসেন। লাইন করি বসেন।’ (পৃ: ৫৬)
লেখকের নূরলদীনের সারাজীবন নাটকে একই ভাষার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। শেকড়ের টান লেখককে তাঁর লেখাতে রংপুর-কুড়িগ্রাম অঞ্চলমুখী করেছে। খেলারাম খেলে যা উপন্যাসেও দেখা যায় উপন্যাসের চরিত্র বাবর কুড়িগ্রাম ভ্রমণে যায়। তাঁর অধিকাংশ রচনাতেই রংপুর অঞ্চলের আঞ্চলিকতার প্রভাব রয়েছে। কাহিনি ও চরিত্রের উপযোগী ভাষা প্রয়োগে তিনি দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। বেশ কিছু চমকপ্রদ আঞ্চলিক শব্দ যেমন দিশেবিশে, বেপথু পথিক, আজন্মার পুত, না ছোঁন না ছোঁন, গা করে নাই, ঘুরঘুণ্ডি অন্ধকার, নিকষ ঘন অন্ধকার, নিশুতি রাত, গোল চাঁদÑএর ব্যবহার রয়েছে।
উপমা :
‘পাথরের মতো ভারী করে রাখে।’ (পৃ: ০৭)
‘জোনাকির মতো ক্ষীণ সেই স্বর জ্বলে নিভে সেই স্বর। আমার বুকের জমাট অন্ধকার সে আলোকিত করতে পারে না।’ (পৃ: ২৮)
‘এ তাপ জ্বালা ধরায় না, এ তাপ কোমল আঙুলের মতো সারা মুখে বিলি কাটে।’ (পৃ: ৩০)
‘শব্দের সন্ধানে যেন কান্না এক কানা বিড়ালের মতো তার দেহের ভেতরে ছোটাছুটি করছে।’ (পৃ: ২১)
গদ্য ভাষায় উৎপ্রেক্ষা ও প্রতীকের সুচারু প্রয়োগ লক্ষণীয় :
‘মরাচাঁদ-যেন এক অসুস্থ শিশু মায়ের কোল থেকে মুখ বাড়িয়েছে।’ (পৃ: ১৮ এবং ২০)
‘যেন রুপার পাত্র কেউ দুধ ভরে মুখে দেয় আমার, আমি ঢোঁকে ঢোঁকে পান করতে থাকি। যেন এক দুর্ভিক্ষের পর এই পেটে পড়ে অঢেল খাবার।’ (পৃ: ২৩)
‘সরল পিছল ছিল নাড়ি সেই নাড়ি কংকরে কংকরে পূর্ণ হয়ে ওঠে বড় অকস্মাৎ।’ (পৃ: ২৩)
‘হঠাৎ মুখ পেছনে নিয়ে যেন হাঁড়ির ভেতর উঁকি দিয়ে অকস্মাৎ সাপ দেখে পিছিয়ে উঠে।’ (পৃ: ৩০)
অনুপ্রাস এর ব্যবহারও দৃষ্টিগোচর হয়।
‘মনে হয় দংশায় না কেন ? সে বড় মধুর দংশন। সে বড় সুখের দংশন। দংশনের আগেই দেহ দংশনের চোটে ঝিম ধরে থাকে, চোখ থেকে দৃশ্য ছবি মুছে যায়, দেহের ভেতরে কেউ চিৎকার করে চায়Ñদংশাও হে দংশাও আমাকে। সেই দংশনের এত জ¦ালা আগে বুঝি নাই।’ (পৃ: ২৩)
‘জগতের আধিব্যাধি জাপটে ধরে সর্বাঙ্গ আমার।’ (পৃ: ২৪)
পতন উপন্যাসের গদ্য ভাষায় ধন্যাত্মক শব্দ ও দ্বিত্বশব্দের বহুল ব্যবহার রয়েছে :
হল্ হল্, হিল হিল, খর খর, টসটস, ঝনঝন, খল খল, থমথম, হন হন, ধপ ধপ, ফটফট, কুটকুট, ঠন ঠন, ফ্যাল ফ্যাল, মিট মিট, ঝর ঝর, ধুয়ে ধুয়ে, টকাস টকাস, হিসহিস, চকচক, টপটপ, ঝাপাৎ ঝাপাৎ, জ্বলজ্বল, টকটক,। যুগ্ম দ্বিরুক্ত শব্দের মধ্যে রয়েছেÑকাছাকাছি, হাপুর হুপুর, টানাটানি, ধরাধরি, ফটফটে, ছোটাছুটি, ঘিনঘিনা, ঝুমঝুমি, চটচটে, ফিসফাস, ছমছমে। উ অঁ, মিউ মিউ, হুক্কাহুয়া, ঝন ঝন, ধপ, গমকে গমকে, হো হো অনুকার দ্বিরুক্ত শব্দগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।
‘নারী মূর্তিমতী পাপ’-মন্তব্যে উপন্যাসের সূচনা করে নারীকে পাপের গোত্রভুক্ত করে আবার পর মুহূর্তেই বলেন-‘উড়োজাহাজের গর্জনটি ফজলুর ওই কথার প্রতি সমর্থন কিম্বা প্রতিবাদ।’ (পৃ: ০৭) উড়োজাহাজের গর্জন দিয়ে সমর্থন কিম্বা প্রতিবাদ উল্লেখ করে লেখক যেন সংশয় প্রকাশ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে আপন পাপকে আড়াল করতে পুরুষ নারীর প্রতি সকল অনাচারের দায় চাপিয়ে দিতে চায়। প্রশ্ন জাগে, পুরুষের মনোদৈহিক সংযম সংকটের দায় কি নারীর ? ধর্ষিতার ধর্ষণের শিকার হওয়ার দায় কি তার ? পতিতার মোহ আলিঙ্গনে ধরা দেয় যে পুরুষ তার দায়ও কি পতিতার ? তবু পৃথিবীর সকল অনাচারের দায় স্বরূপ পুরুষসমাজ নারীর দিকেই অভিযোগের আঙুল তুলে তাকিয়েছে। পতন উপন্যাসে লেখকের সংশয়ই তাঁর অভিব্যক্তির প্রকাশ অর্থাৎ সমর্থন বা প্রতিবাদের এক দোলাচল প্রমাণ করে লেখক এ চিরাচরিত বিষয়টিকে পুরুষের একজন হয়েও সম্পূর্ণ সমর্থন করেন না।
পতন উপন্যাসে নারীর মাতৃরূপের বর্ণনায় নারীর মাতৃত্ব অণ্ড রূপে ধরা দেয়। ‘আমাদের চার মা, যেন এক মা, আমরা কেউ কারও মাকে আলাদা করে দেখি না সেই ছোটবেলা থেকে।’ (পৃ: ২৯) একই উপন্যাসে ভুক্তভোগী নারী চরিত্রের মধ্যে ধর্ষিতা নারী এবং ফজলুর স্ত্রী চরিত্র দুটির দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় আশ্চর্যজনকভাবে তারা জীবনের এক কেন্দ্রবিন্দুতে এসে মিলে গেছে। ধর্ষিতা নারী নববধূ হয়েও পথিমধ্যে স্বামীর উপস্থিতিতে দুর্বৃত্তের দ্বারা গণধর্ষণের শিকার হয়। অন্যদিকে ফজলুর নববধূ বিয়ের পূর্বে গণধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। লেখক কাহিনিতে এরূপ ঘটনার সন্নিবেশে যেন ভয়াবহ এক সামাজিক বিশৃঙ্খলার ইঙ্গিত দিলেন। পুরুষের কামসর্বস্ব অসংযমী মনোভাবে বিবাহিতা অবিবাহিতা নির্বিশেষে নারীরা ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হলে পরবর্তীকালে সকল পুরুষের জীবনসঙ্গিনী ও শয্যাসঙ্গিনী হবে কোনও না কোনও ধর্ষিতা নারী। আশ্চর্যজনক হাস্যকর সত্য, মানসচেতনায় ধর্ষকামী পুরুষও স্ত্রী নির্বাচনে অক্ষতযোনির নারীকেই প্রত্যাশা করে। অথচ ভুলে যায় সে নিজেই ধর্ষক। পতন উপন্যাসের এ অংশটি যেন পুরুষের ধর্ষকামী নগ্ন চেতনার বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ। ‘নারী মূর্তি মূর্তিমতী পাপ’ কথাটি ফজলুর মুখ দিয়ে উচ্চারণ করিয়ে লেখক পুরুষের নগ্নতাকে, চেতনার অন্তঃস্বরকে টেনে পাঠক-সম্মুখে উপস্থাপন করেছেন। প্রকৃতপক্ষে পুরুষের বিকৃত লালসার শিকার হয়ে নারীকে বরণ করতে হয় ধর্ষিতা নামক উপাধি। শরীরকেন্দ্রিক শুদ্ধ-অশুদ্ধের প্রশ্নে পুরুষকে সতীত্বের কাঠগড়ায় বিচার করা হয় না বলেই বাসর রাতে চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে ফজলুর নববধূকে বলতে শুনি ‘আমি নষ্ট’ (পৃ: ৬৬)। স্ত্রীর যৌনাঙ্গে পোড়া ক্ষত সত্ত্বেও ফজলু নির্দ্বিধায় বলতে পারে ‘নারী মূর্তিমতী পাপ’। অর্থাৎ সকল দায় সে নারীর কাঁধেই চাপিয়ে দেয়, অথচ মূল অপরাধী বা ধর্ষকের উদ্দেশ্যে তাঁর কোনও ক্ষোভ বা অভিযোগের প্রকাশ নেই। অপর ধর্ষিতা নারী মৃতের মতো নীরব, নিথর, নিস্পন্দ হয়ে মাটিতে পড়ে ছিল। গণধর্ষণের শিকার হবে জেনেও যে নারী দৌড়ে না পালিয়ে নীরবে আকাশের দিকে চোখ করে মৃতের মতো স্থির মাটিতে পড়ে থাকে, তার বিশ্লেষণ প্রয়োজন। তবে কি সে স্বেচ্ছায় ধর্ষিত হতে চায় ? প্রশ্ন থাকে, কেন ? নিরুপায়, নিঃসহায়, শক্তিহীনতাই কি সব ? নিরুপায় নিঃসহায় শক্তিহীন হলেও সে আহত বা মৃত ছিল না। তাই শেষাবধি তার নিজেকে রক্ষা করার প্রচেষ্টা থাকাই স্বাভাবিক ছিল। হয়ত হাত-পা বাঁধা স্বামীর টানে অর্থাৎ স্বামীর প্রাণ রক্ষার্থে সে তার এ বলিদান স্বীকার করে নিয়েছে। তবু নারীকেই বহন করতে হবে নষ্টা নামক চারিত্রিক সনদ। ধর্ষিতার স্বামীর ক্ষণে ক্ষণে ডুকরে কেঁদে ওঠার আর্তনাদে পৃথিবী কেঁপে উঠলেও ধর্ষকের হৃদয় কাঁপে না। দ্বিতীয়বার ধর্ষণের জন্য ‘আমি’ চরিত্রটি ঠাণ্ডা মাথায় এগিয়ে চলে। ‘পাপ শুধু নয়, মোহিনী সে পাপ, সে আমাদের সকল বিস্মৃত করিয়া কামনায় আকর্ষণ করে অবিরাম ? বাবা আদমের কথা মনে হয়, হাওয়া বিবির হাত থেকে নিষিদ্ধ ফল তিনি খেয়েছিলেন। একবারও কি তখন তার স্মরণ হয় নাই আল্লাহর নিষেধ ?’ (পৃ: ৬৩) নারীর মোহিনী রূপের মোহাচ্ছন্ন-তায় নিজের পাপকে লঘু করতে আদি পিতা মাতার প্রসঙ্গ উপন্যাসে চলে এসেছে। পাপী বা অপরাধী নিজের পাপ বা অপরাধকে অপরের পাপ বা অপরাধের সঙ্গে তুলনা করে নিজের অন্যায়ের বোঝাটা হালকা করতে চায়। নিজেকে একটা গোত্রভুক্ত করে অপরাধবোধকে হালকা করে স্বস্তি পায়। ‘এখন তার হাজতবাসের কথা শুনে আমরা দুঃখিত হবার বদলে বেশ হালকা অনুভব করি। কারণ, তরুণ সমাজের অধঃপাতে যাবার উদাহরণ তবে আমরা নই। সে উদাহরণ মকবুলের, কালা উকিলের ভাতিজার।’ (পৃ: ১৩) আদি পিতা-মাতা ও আল্লাহর নিষেধ প্রসঙ্গটি ছাড়াও এ উপন্যাসে পাপ বোধে ধর্ষকের অনুভূতির বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। ‘যারা তাকে ধর্ষণ করেছিল, তারাই গরম লোহার শিক পুড়িয়ে ছ্যাঁকা দিয়েছিল তার যৌনাঙ্গে। সেই পূর্ণিমা রাতে আমরা তো নববধূটিকে দেইনি। দিইনি বলেই কি পাপ লঘু ?’ (পৃ: ৬৭) পাপের বোধ সকলের সমান নয় সঙ্গত কারণেই সামাদের আত্মগ্লানি দেখেও ‘আমি’ চরিত্রটি অকস¥াৎ পাপকে অনুভব করতে পারে না। সামাদের আত্মগ্লানি এবং ফজলুর হতাশা ক্রমশ ‘আমি’ চরিত্রের বিবেককে জাগ্রত করেছে।
পতন উপন্যাসে নারীকেন্দ্রিক লেখকের সংশয় বা দোলাচল বৃত্তির অস্থির ভাবনা যেন এক একটা চরিত্ররূপে উপন্যাসে প্রাণ পেয়েছে। ফজলুর মন্তব্যে ‘নারী মূর্তিমতী পাপ’ (পৃ: ০১), বেলালের মতেÑ ‘নারী যে পাপের শিকড়, এই কথাটি তোর ঠিক না।’ (পৃ: ২৪) আমি এবং সামাদ আদিম তাড়নার বশবর্তী পাপে লিপ্ত চরিত্র। চার চরিত্রের মাধ্যমে লেখক যেন আত্মভাবনা অর্থাৎ হৃদয়ের সংশয়কে দূরীভূত করে যথার্থভাবে পাপের স্বরূপ, পাপবোধ থেকে মুক্তির উপায় এবং অনুশোচনায় জর্জরিত জীবনে নবচেতনার আলোক ছড়িয়েছেন। আলোক ছড়ানোর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন প্রগতিশীল চেতনার শামসুদ্দিন নামক এক চরিত্রকে। শামসুদ্দিনের জন্মপরিচয় মতে সাধারণের দৃষ্টিভঙ্গিতে শামসুদ্দিন নিজেই এক পাপের ফসল, মূর্তিমান পাপ। সৈয়দ শামসুল হক শামসুদ্দিনের জন্মপাপের জন্য শামসুদ্দিনকে দায়ী করেননি। উপন্যাসে স্পষ্ট ভাবে বলেছেন, ‘সে পাপ তার পিতার তার জননীর, তাদের বিবাহ হয় নাই , কিন্তু পুত্রের জন্মদাতা হয় তারা।’ (পৃ: ৬৮) শামসুদ্দিনের মানসচেতনার শুদ্ধতা, বাস্তববাদী জ্ঞান ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এবং মুক্তিযোদ্ধা জন্মদাতার পরিচয় যেন তার জন্মপাপকে অনেকটা লঘু করেছে। উপন্যাসের শেষাংশে এসে যেন পাপকেন্দ্রিক বিতর্কের অবসানে পতন উপন্যাসের নামকরণের যথার্থতাও উন্মোচিত হয়। লেখকের মতে শামসুদ্দিন এর জন্ম হয়েছে নারী ও পুরুষের পারস্পরিক বিশ্বাস ও ভালোবাসা মাধ্যমে। সঙ্গত কারণেই পাপ সম্পর্কিত চিন্তার সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত হয়ে লেখক বিতর্কিত শামসুদ্দিনের মুখেই যুক্তির বাণী প্রচার করেছেন এবং ফজলুর অন্ধকারে আচ্ছন্ন মনও সে আলোতে আলোকিত করে তুলেছেন।
উপন্যাসের কালা উকিল বেলালের হাত থেকে ব্রিফকেস নিয়ে এগিয়ে চললে হঠাৎ রাতের আঁধারে শিয়াল ডেকে ওঠে। উপন্যাসের কাহিনিতে পরবর্তীকালে বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে অসংখ্যবার শিয়াল ডেকে উঠেছে। এই শিয়ালের ডাককে লেখক অত্যন্ত কৌশলে কখনও কখনও পুরুষের চতুরতা, কামুকতা, কখনও বুদ্ধিমত্তা, কখনও তীব্র ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, কখনও আক্ষেপের সমর্থকরূপে ব্যবহার করেছেন। বক্তব্য বিষয়কে অধিকতর সুস্পষ্ট করার জন্য বা লেখকের বক্তব্যকে অকপটে বিশ্বাস করানোর জন্য শিয়ালের ডাককে তিনি সংকেত হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ক্ষণে ক্ষণে শিয়ালের ডাক বোদ্ধা পাঠকের হৃদয়কে নাড়িয়ে দিতে সক্ষম। লেখক যেন শিয়ালের ডাক এর মাধ্যমে নিজেই নিজের মন্তব্যকে জোরালোভাবে সমর্থন করে চলেছেন। পাঠকের ঘুমন্ত সত্তাকে জাগিয়ে তোলার প্রচেষ্টা করেছেন। সাহিত্যের উপকরণ হিসেবে বিশেষত শিশুতোষ রচনায় শিয়াল তার বুদ্ধিমত্তার জন্য বিশেষ স্থান দখল করেছে। পতন উপন্যাসের শিয়ালের ডাক প্রথমাবস্থায় আকস্মিক, চমকপ্রদ ও সমর্থক বলে মনে হলেও পরবর্তী পর্যায়ে চরিত্রের চতুরতায় শিয়ালের ডাক পাঠকমনে তীব্র ক্ষোভ, ব্যঙ্গ বিদ্রুপের সঙ্গে লঘু কৌতুক রসও পরিবেশন করেছে। গ্রিক সাহিত্যের কোরাসের মতো শিয়ালের হুক্কাহুয়া ডাক যেন এই উপন্যাসে বক্তব্যের গভীরতা প্রকাশে ও সমর্থনে বিবেকের ভূমিকায় উত্তীর্ণ হয়েছে। রাতের তৃতীয় প্রহরের আগে শিয়াল ডাকে না। এই উপন্যাসে বিচ্ছিন্ন সময়ে শিয়ালের ডাক চরিত্রগুলোর মনে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের ছায়াপাত ঘটায়।
নারীকে সকল পাপের কেন্দ্রবিন্দু করে শরীরসর্বস্ব পাপের আত্মগ্লানিতে জর্জরিত ‘আমি’ চরিত্রে আত্মধিক্কার ও তীব্র যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। সে চরিত্রের আত্ম বিশ্লেষণÑ‘পাপ ? কাকে বলে পাপ ? পাপ কি আমাদের দেহধারী ? এবং সেই দেহটি কি নারীরই কেবল ? এবং সেই নারী কি কেবল এক যোনি ভিন্ন আর কোনও অঙ্গ তার দেহে ধরে না ?’ (পৃ: ৪৩) অসংযমী এ চরিত্রটি পাপের বোধে জর্জরিত হয়েও নারীর শরীরের মোহাচ্ছন্নতা থেকে মুক্ত হতে পারে না। সে কলঙ্কিত স্মৃতির অনুরণনে চরিত্রটির সেই নারীর বুকে মাথা নত করার পুনঃপুনঃ প্রবল আকাক্সক্ষাই তার প্রমাণ। আত্মগ্লানি থেকে মুক্তির পথ অনুসন্ধানের পথে কালা উকিলের যুবতী কন্যাকে দেখে আবারও তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। নারীর শরীরের প্রতি তার কামুক মনোবৃত্তিকে সে সংবরণ করতে পারে না। নারীর প্রতি পুরুষের সৃষ্টিগত আকর্ষণ কল্পনায় বিবি হাওয়ার হাত থেকে আদি পিতার নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার বিষয়টি তার মাথায় আসে। আদি পিতাও নারীর রূপে মোহাচ্ছন্ন হয়ে নিষিদ্ধ ফল খেয়েছিলেন। কালা উকিলের আলুথালু বসনা যুবতী কন্যা তাকে কুল বরই খাওয়ার আহ্বান জানালে মুহূর্তে তার মনে হয়-‘আমি যেন চোখে শুধু তার স্তন ছাড়া আর কিছু দেখতে পাই না। … যেন আমিও এক পুরুষ এবং সম্মোহিত। তাকিয়ে আছি ফলের দিকে। … আমি একপা একপা করে অগ্রসর হই।’ (পৃ: ৬৩) নারীর শরীরের প্রতি পুরুষের লোলুপতা বা কামুকতার ভয়াবহ নগ্ন প্রকাশ নারীকে কেবল যোনি বা স্তন সর্বস্ব রূপে কল্পনা করা। সমগ্র নারীসত্তাকে, তার অস্তিত্বকে, ব্যক্তিত্বকে অস্বীকার করে ভোগের বিবেচনাকে লেখক ব্যঙ্গ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে যৌনতা বা কামপ্রবৃত্তি সৃষ্টিগতভাবে প্রতিটি প্রাণীর মধ্যে বিদ্যমান। নির্বিচার যৌনতা মানুষ ভিন্ন অন্য প্রাণীতে শোভা পায়। নারী গর্ভধারিণী মাতা, সহধর্মিণী কন্যা ও বোন। কামপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করতে সম্পর্কের ভিন্নতা যে পুরুষ অনুধাবন করে না বা নারীকে শুধুমাত্র ভোগ্য বলেই মনে করে, সে মানুষের আকৃতি পশু ভিন্ন অন্য নয়। প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি পুরুষের অবচেতন মনে নারীর প্রতি প্রবল আকর্ষণ রয়েছে। বিবেকবোধের বিচার ক্ষমতা এবং কঠোর সংযমেই নারীর প্রতি তার অবচেতন মনে রক্ষিত মোহময়তা বা মোহাচ্ছন্নতাকে অবদমিত করে রাখা সম্ভব। উপন্যাসে অবচেতন মনের প্রবল চাওয়ার বশবর্তী হয়ে কালা উকিলের যুবতী কন্যাকে দেখেই ‘আমি’ চরিত্রটি আবারও দিকভ্রান্ত হয়ে ওঠে।
পতন উপন্যাসের কাহিনির টানাপোড়েন শেষে নামকরণের রহস্য উন্মোচনে লেখকের জীবনবাদী চেতনার আলো কোষমুক্ত হয়ে পাঠকের চেতনাকে আলোকিত করে। পতন সম্পর্কে উপন্যাসের ‘আমি’ চরিত্রের চেতনায় ধর্ষণরত অবস্থায় ধ্বনিত হয়Ñ‘হঠাৎ দেখি, একটা তারা তিরের বেগে খসে পড়ছে। আকাশের অনেকটা বুক চিরে সে দ্রুত বড় দ্রুত অতিদ্রুত ছুটতে ছুটতে দিগন্তের কাছে এসে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। চমকে উঠি আমি। যেন আমারই পতন আমি দেখে উঠি। যেন আমারই ভেতরটা জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে জগতের ওপর ঝরে পড়ে।’ (পৃ: ৬০) ‘আমি’ চরিত্রটি ধর্ষণরত অবস্থায় একটি তারার পতনে নিজের পতন অনুভব করেছে। সে অনুভব চারিত্রিক অধঃপতনের অনুভব। চারিত্রিক পতন অপেক্ষা বড় পতন নেই। উপন্যাসের শেষাংশে পতনের স্বরূপটি ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয়েছে। বিবি হাওয়ার প্রতি মোহাচ্ছন্ন হৃদয়ের প্রবল বিশ্বাস এবং ভালোবাসায় আদি পিতার পতন ঘটেছিল। লেখকের মতে সে পতনে শেষ নয়, জীবনের সূচনা হয়েছে। পৃথিবীতে মানব সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। লেখক পারস্পরিক বিশ্বাস এবং ভালোবাসার পতনে ধ্বংস নয় সৃষ্টির লীলা দেখেছেন। সঙ্গত কারণেই উপন্যাসে ব্যভিচারে লিপ্ত পতিতালয়ে গমন করা সামাদ এবং ধর্ষক ‘আমি’ চরিত্রের মাঝে পাপবোধের তীব্র যাতনা সংস্থাপন করেছেন। পাপের ভারে লজ্জায় ঘৃণায় আত্মগ্লানি ও হতাশাগ্রস্ত এ দুটি চরিত্রকে অনেকটা উন্মাদ করে ছেড়েছেন। পাপের ভার মুক্ত হওয়ার জন্য এ দুটি চরিত্র সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছে। অন্যদিকে আদমের পতন বা শামসুদ্দিনের জন্মে লেখক পাপ অনুভব করেননি। কারণ এই পতনের মর্মমূলে কামসর্বস্বতা নয়, আছে নারী পুরুষের পারস্পরিক বিশ্বাস ও ভালোবাসা। ভালোবাসা ও বিশ্বাসের এ পতনই পৃথিবীতে মানব সভ্যতার সৃষ্টি করেছে যা মূলত সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা। অসীম বিশ্বাস আর ভালোবাসার স্বীকৃতিতে লেখক শুভচেতনা ও বাস্তবতার জ্ঞানসম্পন্ন শামসুদ্দিন নামক পূর্ণাঙ্গ চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। শামসুদ্দিনের মানবিক উদার প্রগতিশীল চেতনার আলোকে লেখক যেন মানবতার জয়গান গেয়েছেন। গ্রাম্যবালকের দেয়া পেয়ারা পাঁচজনে ভাগ করে খাওয়ার মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক মানবিকতা ও পারস্পরিক সৌহার্দ চেতনা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। উপন্যাসের শেষাংশে কোরাস চরিত্র শিয়াল বালকের রূপ ধরে জীবন্ত চরিত্র হয়ে ওঠে এবং পাঠকের কাছে ধরা দেয়। শামসুদ্দিনের দেখানো আলোর পথে ফজলু এগিয়ে যায়। ‘নারীমূর্তি পাপ’Ñশীর্ষক ভ্রান্ত চিন্তা ও বিশ্বাসকে পেছনে ফেলে নতুন চেতনায় বাড়িতে স্ত্রীর কাছে ফিরে যায়। শামসুদ্দিনের সংস্পর্শে ফজলু ও তার বন্ধুদের চেতনার অন্ধকার ঘুচে যায়। আত্মবিশ্বাস অর্জন করে এবং অস্তিত্ব সংকট থেকে বেঁচে যায় কতগুলো তরুণপ্রাণ। ফরাসি ঔপন্যাসিক মিলান কুন্ডেরার মতেÑ‘আমি যখন আনবেয়ারেবল লাইটনেস অব বিয়িং লিখছিলাম তখন আমি অনুধাবন করলাম যে এক একটি চরিত্রে অস্তিত্বের সংকেত মূলত নিহিত আছে কিছু কিছু শব্দের ভিতর। যেমন টেরেজার কিছু শব্দ-শরীর, আত্মা, মাথা ঝিমধরা, দুর্বলতা, প্রশান্তি, স্বর্গ। টমাসের ক্ষেত্রে হালকা ভাব, ওজন।’ (কথা পরম্পরা, পৃ: ১১২)। পতন উপন্যাসের অস্তিত্বের সংকেত রূপে বার বার ধ্বনিত হয়েছে নারীর শরীর, পাপ এবং এই শরীরকেন্দ্রিক পাপের বোধ। কাহিনি পরিক্রমায় পাপের স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে। চার বন্ধুর চিন্তা-চেতনা ও বিশ্বাসের বৈচিত্র্য কাহিনিতে মনোসমীক্ষণ যুক্ত করেছে। মিলান কুন্ডেরার নারী-পুরুষের মনস্তাত্ত্বিক রহস্যেঘেরা উপন্যাস The unbearable lightness of being এবং The Identity উপন্যাসের মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন, চেতনার ঘাত-প্রতিঘাত, শরীর বৃত্তীয় ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় অস্তিত্বের যে সংকট উপলব্ধ হয়ে ওঠে; পতন উপন্যাসে চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক বৈচিত্র্য বিশ্লেষণে সে একই সংকট পরিলক্ষিত হয়। The unbearable lightness of being উপন্যাসের অস্তিত্বের সংকট যেন পতন উপন্যাসেও উপলব্ধ হয়ে উঠে।
‘ফজলু আর মিষ্টির দোকানে ফিরে আসে না’ (পৃ: ০৯) -লেখক এখানে মিষ্টির দোকান ব্যবহার করেছেন। ফজলুর বিবাহিত জীবনের শূন্যতার গভীরতা ও হতাশা বোঝাতে মিষ্টির দোকানের তুলনা যেন উৎকৃষ্ট উদাহরণ। বন্ধুদের বাসর রাতের গল্প শোনার প্রবণতা ও প্রবল আগ্রহ প্রমাণ করে মানুষের মস্তিষ্কের লঘুতা। আদিম রসময় গল্পে বিনোদনের অনুসন্ধান। ‘আমাদের মনে যেন পৃথিবীর এক মহাপ্রবঞ্চনার শোক আর শূন্যতা, আমরা মাতালের মত গা টেনে টেনে ইস্টিশানের দিকে যেতে থাকি।’ (পৃ: ১০) মহাপ্রবঞ্চনার শোক এবং মাতালের মতো গা টেনে চলার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে সিনেমা দেখার প্রতি জলেশ্বরীর বেকার তরুণদের আগ্রহের তীব্রতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। উপন্যাসের এক অন্যতম চরিত্র কালা উকিল। জলেশ্বরীর তরুণ সমাজ নিয়ে তিনি বেশ উদ্বিগ্ন। চার তরুণের পতিতালয় সম্পর্কিত আতঙ্ক এবং অভিজ্ঞতালব্ধ এ সত্যকে আড়াল করতে লেখক সৃষ্ট মনোসংকট বা মনস্ত¡াত্ত্বিক নগ্নতার শিল্পিত বর্ণনা দিয়েছেনÑ‘আমাদের জামাকাপড় টেনে ঠিকঠাক হয়ে বসবার চেষ্টা করি, যেন কোথাও উলঙ্গ হয়ে পড়েছি এবং সেটি কাল উকিলের চোখে পড়েছে।’ (পৃ: ১২) উপন্যাসে মানবমনের বিচিত্র বৈচিত্র্য উপস্থাপনের পাশাপাশি সমকালীন রাজনৈতিক নেতাদের দায়িত্বহীনতার চিত্র ফুটে উঠেছে। উপন্যাসে সুচারু কাহিনির বিন্যাস লক্ষ্য করলে দেখা যায় সেই রাতে ফজলু, বেলাল এবং ‘আমি’ চরিত্র কেবল বন্ধুত্বের সম্পর্কে একই গ্লানিতে ঘুমাতে পারে না। অবশেষে মায়ের কোলে মাথা রেখে তারা ঘুমায়। সামাদ পাপী হওয়ায় লেখক তাকে কৌশলে মায়ের কোলে ঘুমানোর প্রশান্তি থেকে বঞ্চিত করেছেন।
শামসুদ্দিনের মুখ দিয়ে লেখক প্রকৃত পাপীকেও চিহ্নিত করেছেন। শামসুদ্দিনের মতে ঘরে ঘরে অনাহারের জন্য দায়ী রাজনৈতিক নেতাদের শোষণ। সাধারণ মানুষ শুধু পাপ-পুণ্যের হিসাবে মত্ত। অনাহার, খড়া, ফসল না-হওয়ার জন্য সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত গজবে অন্ধবিশ্বাসী। রাজনীতির মঞ্চে মৌলিক অধিকার আদায়ের বিষয়টি তাদের চিন্তার বাহিরেই থেকে যায়। লেখকের মতে সেই রাজনৈতিক নেতারা প্রকৃত পাপী যারা জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে না। বেকার তরুণ সমাজের বিপথে চালিত হওয়ার দায়বদ্ধতা তাদেরই। শামসুদ্দিনের মতে-‘আমরা যে কারণে যে আশায় যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলাম, দেশ যারা এখন চালায় তারা সেসব ভুলে গেছে, এই হচ্ছে পাপ।’ (পৃ: ৬৮) মাত্র সত্তর পৃষ্ঠার পতন উপন্যাসটি শিল্পগুণে সমৃদ্ধ এক অনন্য রচনা। পাশ্চাত্য ফ্রয়েডীয় যৌন চেতনা ও মনোবীক্ষণ, চেতনাপ্রবাহ ও অস্তিত্ব সংকটের সমন্বয়ে এ উপন্যাসটি এক শিল্পসম্মত উপন্যাস হয়ে উঠেছে। সৈয়দ শামসুল হক পতন উপন্যাসে চরিত্রের অধঃপতনে চেতনার অন্তঃক্ষরণ এবং অস্তিত্বের সংকটে পশুত্বের পতন ঘটিয়ে মানবিক ভালোবাসা ও পারস্পরিক বিশ্বাসের ভিত রচনা করেছেন।
লেখক : প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, এমফিল গবেষক, প্রাবন্ধিক ও সাহিত্যবিশ্লেষক
————————–