আর্কাইভগল্প

একটি হলুদ পাখির কান্না

আব্দুল বারী

জমির উদ্দিন মণ্ডল, সন ১৩৬২। দেওয়ালের গায়ে লেখাটা এখনও বেশ পড়া যায়। দেওয়ালের নিচের দিকে সবুজ স্পঞ্জের মতো চাপ চাপ শ্যাওলা আর জলের ভেজা দাগ। সাদা চকচকে বালি সিমেন্টের প্লাস্টার করা দেওয়ালের ওপরের অংশে জায়গায় জায়গায় নোনা ধরেছে। নোনা খাওয়া জায়গায় কালের চিহ্ন বুকে বিচিত্র সব মানচিত্র। মাটি থেকে তিন ফুট মাথা উঁচু করে বৃত্ত হয়ে থাকা ইঁদারার দেওয়ালটি আর কতদিন টিকে থাকবে তা আর শুধু মহাকালের হাতেই নাই এখন অনেকটা জমির উদ্দিনের দুই নাতির হাতেও বটে।

তখন এ পাড়ায় ভালো জলের কোনও বড় পুকুর ছিল না। কোন ইঁদারাও না। জমির উদ্দিনের বাপ কিফারত মণ্ডল একটা পুকুর কাটিয়ে ভিন পাড়া থেকে উঠে আসেন এ পাড়ায়। সে অনেক দিন আগের কথা। পুকুরের জলেই তখন সব কাজ চলত। বাড়িতে দুজোড়া হাল বলদের চাষ, খান চারেক গাই বাছুর, ছেলেমেয়ে, নাতি নাতনি, রাখাল কিষাণ নিয়ে বিরাট সংসার। চান করা, পান করা, গরু বাছুরকে খাওয়ানো, গৃহস্থালির কাজে প্রচুর জল লাগে। সব জল আসত ওই পুকুর থেকে। পাড়ারও অনেকে এই পুকুরের জল খেত। কিফারত মণ্ডল পুকুর টাকে বেশ নজর দিয়ে আগলে রাখতেন। কোনও নোংরা আবর্জনা পড়তে দিতেন না। ক্ষারের কাপড় কাচা বারণ। গরু বাছুরের গা ধোয়ানো বা অন্য নানা কাজে কিছু দূরের ডুমুরতলার নালা আছে। সেখানে যেতে হয়।

এ পাড়া থেকে একটু দূরে সাহেব মোড়লের বাড়িতে একটা ইঁদারা ছিল। সেখানেও যেত অনেকেই। মাঝেমাঝেই আয়তন বিবি হাঁক পারত―বাসি কাপড়ে ইঁদারায় দড়ি নামাবানা কেউ, সকাল বেলায় খালি কলসি লিয়ি চলি এসিছো, এটা তো গিরস্থ বাড়ি, বাড়ির ভালাই আছে না নাই। মানুষকে সামনে দাঁড় করিয়ে মুখের ওপর বলে দিত এ সব। অনেক মানুষ শরম পেত। যেতে পারত না আর। কিফারতের পুকুরে এতটা ছুৎমার্গ, নিয়ম নিষ্ঠা ছিল না। শুধু পরিষ্কার জল পাত্র নিয়ে গিয়ে জল তুলে আনলেই হতো। তবে পুকুরে নেমে চান করায় বাধা ছিল। পুকুরের পাড়ে চান করা যেত। তাছাড়া চান করার পরিষ্কার নালার অভাব ছিল না।

সুরমা বিবির বড় ইচ্ছা বাড়িতে একটা ইঁদারা হোক। ইঁদারার ওপর কনুই রেখে সর সর করে দড়ি ছেড়ে পিতলের ঘড়া জলে নামিয়ে দেবে। জল যখন ভর্তি হবে ঘড়ায় তখন বগবগ করে শব্দ হবে। তারপর ভর্তির আগে ফুরুৎ ফু, ফুরুৎ ফু কিংবা বগ করে একটা আওয়াজ, তারপর সব চুপচাপ। একটু থেমে বগাৎ করে শব্দ উঠবে। ইঁদারার মধ্যে সামান্য শব্দ হলেও বেশ জোরে শোনায়। কেমন গমগম করে বেজে ওঠে। ইঁদারার উপর একটু ঝুঁকে জলে নিজের ছায়া দেখা আর এসব শোনার বড় সাধ সুরমার। কিন্তু শ্বশুর কিফারতকে বলা যায় না। বুকের ভেতর এই সাধ আর স্বপ্নটা নড়েচড়ে বেড়ায়। উতলা করে সুরমাকে।

চৈত্র মাসের দুপুরে পুকুরের জল গরম হয়ে ওঠে। খাওয়া যায় না। সকাল-সকাল ঘড়ায় তুলে রাখলেও গরম হয়। কেবল একটু ঠাণ্ডা থাকে কালো কলসিতে জল রাখলে। দুপুরে ইঁদারা থেকে ঠাণ্ডা জল তুলে কাঁসার জামবাটিতে করে তা খেলে জান ঠাণ্ডা হয়। বাপের বাড়িতে অনেকদিন খেয়েছে সুরমা। কত দিনের ইচ্ছা দুপুরে জামবাটিতে করে ইঁদারার সদ্যতোলা ঠাণ্ডা জল খাওয়ার। এ ইচ্ছার কথা স্বামী জমির উদ্দিনকে বলে। জমির উদ্দিন বউকে সান্ত্বনা দেয়, বলে হবে হবে, সব হবে। একটু সবুর করো। সুরমা বোঝে এ সান্ত্বনা বড় পলকা। কিফারত মণ্ডল বাগান, পুকুর, জমি জিরেত নিয়ে বড় গৃহস্থ হলেও এখনই ইঁদারা করা তার ইচ্ছা নাই।

কিফারত গত হয়েছে বেশ ক’বছর হলো। এখনও জমির উদ্দিনরা ভায়ে ভায়ে পৃথক হয়নি। সুরমার বুকের ভেতর ইঁদারার জল ঢেউ তোলে। খলখল করে খেলে বেড়ায়। রাতে স্বপ্ন দেখে। সন্ধায় গরু বাছুর গোয়ালে ভরে দিয়ে ঝটপট চানে বসেছে সে। ইঁদারা থেকে ঘড়া ঘড়া জল তুলছে আর মাথা থেকে পা পর্যন্ত ভিজিয়ে নিচ্ছে। জলের ধারা শির শির করে নেমে যাচ্ছে। তলপেটের ভেতর সুড়সুড় করে জল ঢুকে পড়ছে। তারপর পা বেয়ে নামছে ঠাণ্ডা জল। আহ্! কি শান্তি। সারাদিনের ক্লান্তি যেন ধুয়ে যাচ্ছে। খিল খিল করে হেসে ওঠে সুরমা। পাশ থেকে ঠেলা দেয় জমির উদ্দিন। ঘুম ভেঙে যায় সুরমার। জমির উদ্দিন বলে কি অত হাসছ যে বড়। কি স্বপ্ন দেখলা, আমাদের খোকা হয়েছে। তাকে আদর করছ ?

 কিছু বলতে পারে না সুরমা। স্বপ্নের আবেশ, আরাম ছিঁড়ে ফেঁড়ে যায়। দেখতে দেখতে বেশ কয়েক বছর হলো বিয়ে হয়েছে, এখনও কোল খালি।

 বিয়ে হওয়ার পর প্রথম বছরগুলোতে তার মনে হতো একটা সন্তান হোক। ছোট ছোট হাত দিয়ে তার গালে মুখে আঁচড় দেক। নরম নরম পা দিয়ে গায়ে ঠেলা মারুক। আহা কি সুখ। কচি মুখের হাসি আর আধ আধ বোল এসব ভাবনা বড় উতলা করত তাকে। সুরমার মতো প্রথমদিকে জমির উদ্দিনও বড় উতলা হতো। সে চাইত ছোট ছোট দুটো পা উঠোনময় ঘুরে বেড়াক। আকাশের চাঁদ নেমে আসুক মাটির উঠোনে। কিন্তু মাসের শেষে স্বাভাবিক ঋতুচক্রে ভেসে যেত সে স্বপ্ন। বড় ভাইয়ের ছেলে মেয়ে উঠোনময় খেলে বেড়ায়। এসব দেখে তাড়া দিয়ে মা ইকাতন বলে বেশ ক’বছর হলো বাপ, এবার আর একটা বিয়ে করো। জমির উদ্দিন জোর দিয়ে না বলতে পারত না। মায়ের সামনে থেকে সরে যেত। অসহায়ের মতো বসে থাকত সুরমা। কোনও কোনও অলস দুপুর কিংবা বিকেলের দিকে বাড়ির সবাই এক জায়গায় বসেছে। বিভিন্ন বিষয়ে কথা হচ্ছে। হঠাৎ কথার ফাঁকে সন্তানের কথা উঠলে সকলেই সুরমার দিকে তাকায়। নানান কথা বলে। চার দিক থেকে ছুটে আসা কথায় বিদ্ধ হয় সুরমা। তার মনের ইচ্ছা কেউ বুঝতে চাই না। তারও যে বড় ইচ্ছে হয় পাথাল কোলে ফেলে ছেলেকে তেল হলুদ মাখানোর, কচি গালে চুমু খাওয়ার। ঝাপসা চোখে এক বুক কান্না নিয়ে উঠে যেতে হয় সুরমাকে।

 রাতে সুরমাকে পাশে নিয়ে তার ব্যথায় হাত রাখে জমির উদ্দিন। সমস্ত দুঃখ ভাগ করে নিতে চায় দুজনে। স্বামীর ভালোবাসার স্পর্শে দুগালে গরম জলের ধারা নামে সুরমার। বড় যত্নে মুছে দেয় জমির উদ্দিন।

 সেবার গ্রামে কলেরা দেখা দেয়। পাড়ায় পাড়ায় অনেকেই আক্রান্ত। বড় ভাইয়ের ছেলের আজ তিন দিন পায়খানা বমি। বাড়ির আরও দুটো ছেলেও পায়খানা করছে। সুরমার বিরাম নাই। ছেলেগুলোর কাপড় বদলে দেওয়া, বমি ধুয়ে দেওয়া, চোখেমুখে জল দেওয়ার। পেটের যন্ত্রণায় কাতর ছেলের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কখনও নোংরা কাপড় বাড়ির বাইরে গিয়ে পরিষ্কার করে আনে। সুরমা শুধু একা নয় ছেলেদের মায়েরাও হাত লাগাই, তবে তারা দুই হাতে করতে পারে না। অন্য ছেলেদের দেখতে হয় তাদের।

 যুগ যুগ ধরে যে ঘটনা ঘটে চলেছে সাহিত্যের পাতায়, বারবার যার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে, সেই একই নিয়তি অপেক্ষা করছিল সুরমারও।

 গরুর গাড়ি করে ইঁট আসে ভিন গাঁ থেকে। বাংলা ভাটার ইঁট। মিস্ত্রি আসে মির্জাপুর থেকে। মুনিস দিয়ে মাটি কাটা শুরু হয়। একটু একটু করে গর্ত গভীর হতে থাকে। অনেকটা গভীর। নিচের দিকে চোখের দৃষ্টি যায় না। সব অন্ধকার। কিন্তু জলের দেখা নাই। মিস্ত্রিরা আতান্তরে পড়ে। যা খোঁড়া হয়েছে তার থেকে অনেক কম খুঁড়ে জলের সন্ধান পায় তারা। প্রথমে ভেজা মাটি, তারপর বিজ বিজ করে জল উঠে। ক্রমে ক্রমে জলের ধারা দেখা দেয়। তারপর একটু একটু করে তা জমতে থাকে। মিস্ত্রিরা বালতি বা টিনে সেই জল সেঁচে নেয়। আর দ্রুত হাতে ইঁট গেঁথে কাজ সারে। তারপর উঠে আসে ওপরে। ক্রমে চুঁইয়ে আসা জলে ভরে ওঠে ইঁদারা। কিন্তু এখানে এত গভীর করে খোঁড়া হলেও জলের দেখা নাই। মাটি হালকা ভেজা বটে কিন্তু জলের ধারা নেই।

 মিস্ত্রিরা ওপরে উঠে আসে। হতাশ মুখে বিড়ি ধরায়। সবার চোখেমুখে হতাশা। জমির উদ্দিন নিশ্চুপ বসে আছে চারা আমগাছটার নীচে। তাহলে কি সুরমার স্বপ্ন, তার ইচ্ছা পূর্ণ হবে না। এ মাটিতে কি জল নাই। বসে বসে নিজের বুকটায় খুঁড়ে চলে জমির উদ্দিন।

 বিকেলের দিকে বুড়ো মিস্ত্রি আবার নামে ইঁদারায়। মাটির এত গভীরে সে আগে কোনও দিন নামেনি। নীচটা একেবার আঁধার। হ্যারিকেন জ্বালানো হয়েছে। বুড়ো মিস্ত্রি মুঠো করে মাটি তোলে। মাটির গন্ধ নেই। সবই ঠিক আছে। মাটিতে জলের গন্ধ আছে। তবে জল নামছে না কেন ? জলের ধারা মাটির কোন গহনে ঘুমিয়ে আছে ? বুড়ো তীক্ষ্ম চোখে মাটি দেখে, বারবার গন্ধ নেই, পরীক্ষা করে। চারা আমগাছতলা থেকে উঠে আসে জমির উদ্দিন। ইঁদারায় নামে। নামতে নামতে ঘাড়ে কার যেন চেনা একটা স্পর্শ পায়। সে তো হবার নয়। তবুও মনে হয় সত্যিই কে যেন স্পর্শ করল। বহু পরিচিত এই ছোঁয়া। একবার ভাবে মনের ভুল।

 চাচা একবার আমি কি মাটিতে কোপ দিয়ে দেখব ? যদি মাটির ঘুম ভাঙে, যদি দয়ার ধারা বইয়ে দেয়। বুড়ো মিস্ত্রি কোদাল তুলে দেয় জমির উদ্দিনের হাতে। জমির উদ্দিন কয়েকটা কোপ দেয়। ঝুড়িতে মাটি ভর্তি করে। দড়ি ধরে টেনে তুলে নেয় উপরের লোক। আবার কাঁধে সেই স্পর্শ। চোখের সামনে সুরমার মুখ। সমস্ত শক্তি এক করে কোপের পর কোপ মারে। কয়েক কোপ মারার পর দেখে মাটি আগের চেয়ে বেশি ভেজা। হ্যারিকেনের আলোয় জল চিকচিক করছে। কোদালের কোপ দিয়ে এক তাল মাটি তুলে নেয়। সেখানে জল বিজবিজ করে। বুড়ো মিস্ত্রিকে দেখায়, সে বলে আরও কোপ দাও।

 আবার স্পর্শ―ঘাড়ে, গলায়, বুকে। চোখ বন্ধ করে কোপ দেয়। ফুরফুর করে জল বের হতে থাকে তোলা মাটি থেকে। বুড়ো মিস্ত্রি বলে এ যে জলের ফোয়ারা। ফোয়ারার মুখ খুলে গেছে। ওখানে কিছু মাটি ফেলে দাও। সামান্য কিছু মাটি ফেলে ফোয়ারার মুখ চেপে দেওয়া হয়। কিন্তু জল আটকায় না। বিজ বিজ করে অনেকটা জল জমে যায়। বালতিতে জল ভরে দড়ি করে ওপরে তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু জল যেন কমতে চায় না। বরং বাড়তে থাকে। পাতাল ফুঁড়ে উঠে আসছে জলের ধারা। ভরে উঠছে ইঁদারা। বুড়ো মিস্ত্রি জোরে চিৎকার করে ওপর থেকে আরও দড়ি বালতি পাঠাতে বলে। দড়ি বালতি নামানো হয়। ততক্ষণে জমির উদ্দিনের হাঁটু কাছ পর্যন্ত জল উঠে গেছে। দুহাতের আঁজলায় জল নিয়ে মুখে ঝাপটা দেয়। কাঁধে আবার সেই স্পর্শ। আঁজলা করে জল খায়। কি ঠাণ্ডা। যেন বুকটা জুড়িয়ে যাচ্ছে। বুড়ো মিস্ত্রি চিৎকার করতে থাকে এ তো ফোয়ারা ইঁদারা। চল ওপরে ওঠ।

 আচ্ছন্নের মতো দাঁড়িয়ে থাকে জমির উদ্দিন। গায়ে-মাথায় আঁজলা আঁজলা জল দিতে থাকে। মাথা থেকে শীতল জলের ধারা শির শির করে ঘাড় বেয়ে নামতে থাকে। যেন সুরমা স্নান করছে তার দেহে। বুড়ো মিস্ত্রি এবার ধাক্কা দেয়। উপরে উঠতে বলে। দড়ি ধরে খাঁজে খাঁজে পা দিয়ে ওপরে উঠে আসে দুজনে।

 ইঁদারা প্রতিষ্ঠিত হয়। চারিদিক গেঁথে তোলা হয়। সাদা চকচকে বালি দিয়ে প্লাস্টার করে তার ওপর লেখা হয় নাম। জমির উদ্দিন মণ্ডল, সন ১৩৬২। বড় ইচ্ছা ছিল নামটা সুরমা বিবির ইঁদারা রাখার। কিন্তু তা দিতে পারেনি।

 গ্রামে কলেরা ঢোকায় শুধু সুরমা চলে যায় তাই নয়, কিফারতের বাড়ির বাঁধনও আলগা হয়ে যায়। পৃথক হয় ভায়ে ভায়ে। তার আগে জমির উদ্দিনের আবার বিয়ে দেওয়া হয়। এখন দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী ওজিফার দুটি সন্তান। সংসার একটু থিতু হলে বুকের ভেতর সুরমার ইঁদারার স্বপ্ন আবার দুলে উঠে। সেই স্বপ্নকে প্রতিষ্ঠা দেয় জমির উদ্দিন। বাড়ির সীমানায় রাস্তার ধারে তৈরি হয় ইঁদারা।

 কলসি, ঘড়ায় করে জল গড়িয়ে যায় পাড়ার ভেতর। সকাল-সন্ধ্যা জল তোলার কোনও মানা নাই। জল তো জীবন। জীবন গড়িয়ে যায় পাড়ায় পাড়ায়। সজীব হয় পাড়া। সুরমার স্বপ্ন মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে চারা আম গাছতলার পাশে। জমির উদ্দিন লক্ষ্য করে প্রায় প্রতিদিন একটা হলুদ পাখি এসে বসে চারা আমগাছের ডালে। আর তাকিয়ে থাকে ইঁদারার দিকে। কখনও সুযোগ পেলে কার্নিশে বসে।

 যতদিন জমির উদ্দিন বেঁচে ছিলো ইঁদারার উপর দড়ি বাঁধা একটা বালতি থাকত। পাড়ার লোক হাঁড়ি কলসি ভর্তি করে জল নিয়ে যেত। পাড়া ছাড়িয়ে দূরের পাড়ার লোকও আসত এখানে জল নিতে। এ জল যেমন ঠাণ্ডা তেমনি মিষ্টি। বড় স্বাদ এ জলের। মাঠ থেকে চষে এসে এক ঘটি জল গলায় ঢাললে জান ঠাণ্ডা হয়ে যায়। মিছরির শরবত, ডাবের জল এর কাছে যেন কিছুই নয়। তাই পাড়া, ভিন পাড়া থেকে লোক আসে জল নিতে।

 জমির উদ্দিন ইন্তেকাল করেছে অনেক বছর হলো। ছেলেরা সংসারী হয়েছে। গ্রাম বেড়েছে অনেকটা। গ্রামের মাঝ দিয়ে পাকা রাস্তা বয়ে গেছে। সারা দিন শব্দ করে বাস লরি চলে। গ্রামের অনেকেই চাষবাসের পাশাপাশি ব্যবসা শুরু করে। গাঁয়ে একটা দুটো করে পাকা বাড়ি হতে তৈরি থাকে। অনেকের বাড়িতে বসে টিউবওয়েল। সরকার থেকেও তে-মাথার রাস্তার পাশে বসিয়ে দেয় টিউবওয়েল। মানুষ লাইন দিয়ে সেখানকার জল নেয়। কদর কমে ইঁদারার।

 ইঁদারায় বালতি নামিয়ে এখন আর জল তোলে না কেউ। ইঁদারা তো সব প্রায় বুজিয়ে দিয়েছে। গ্রামে প্রায় দশ বারটি ইঁদারা ছিল। এখন মাত্র দুটি জীবন্ত। বাকি সব ইঁদারা নোংরা আবর্জনা ফেলতে ফেলতে বুজিয়ে দেওয়ার উপক্রম। আবর্জনা ভর্তি ইঁদারায় পাটকাঠি, কঞ্চি পড়ে থাকে। চারপাশের ইঁটের বেড় ক্রমে ভেঙে পড়ে। ভেঙে পড়া অংশ দিয়ে কোলা ব্যাঙ গিয়ে পড়ে জলে। জলে ভেসে থাকা ঝুনো নারকেলের ওপর বসে থাকে ব্যাঙ। ছেলেরা ঢিল নিয়ে দুবেলা হাতের টিপ করে সেই ব্যাঙের ওপর। কখনও থুথু ফেলার প্রতিযোগিতা করে।

 একদিন এই ইঁদারাগুলোই ছিল গ্রামীণ মানুষের আভিজাত্য, অহংবোধের প্রতীক। মানুষের জীবনের সঙ্গী, প্রাণের দোসর। জমির উদ্দিনের প্রতিষ্ঠিত স্বপ্ন এখনও বেঁচে আছে। তবে জলে আর সেই স্বাদ নাই। জলে বালতি নামানো বন্ধ হয়েছে প্রায় ২০ বছর আগে। প্লাস্টিকের পাইপ নামিয়ে টিউবওয়েল জোড়া হয়েছে ইঁদারার পাশে। টিউবওয়েলের হাতলে চাপ দিয়ে জল তোলা হয়। বালতি নামিয়ে জল তোলার সময় জল ছিল কাচের মতো চকচকে। এখন জল কেমন লালচে। মুখে দিলে একটু নোনতা লাগে। এখন আর কেউ এ জল খায় না। তবে স্নান করে, বাসন ধোয়।

 বাড়িতে বাড়িতে এখন নলকূপ। সে জলও খাওয়া চলে না, আয়রন আর আর্সেনিকে ভর্তি। তাই দশ কিমি দূর থেকে লছিমনে সাত শো লিটারের ট্যাঙ্ক বেঁধে পি.এইচ.ই এর পরিশুদ্ধ জল আনা হয় গ্রামে গ্রামে। সেই জল কিনে খায় অনেকে।

তবে এখনও চৈত্র বৈশাখ মাসে যখন প্রচণ্ড খরা শুরু হয় তখন ডোবা, দীঘি, পুকুর নদীর জল শুকিয়ে যায়। ভূগর্ভস্থ জল স্তর অনেক নেমে যায়। টিউবওয়েলে জল উঠে না। জমির উদ্দিনের প্রতিষ্ঠিত এই ইঁদারা তখনও জলে ভর্তি হয়ে থাকে। এক আশ্চর্য জলের উৎস এই ইঁদারা। গ্রীষ্মের মাসগুলি আবার আগের মতো গ্রামের মানুষ ইঁদারার চারপাশজুড়ে জল নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। চারদিক কেমন জীবন্ত হয়ে ওঠে। সকাল থেকে সারাদিন জল তুলতে থাকে। সেই দারুণ গ্রীষ্মেও এর জল খুব বেশি কমে না। তপ্ত দুপুরে পাড়ায় পাড়ায় গড়িয়ে চলে জীবনের ধারা, শীতলতা।

 জমির উদ্দিনের দুই নাতির মধ্যে বাড়ির জায়গা ভাগ হয়। ইঁদারাটা পড়ে দুই সীমানায়। অর্ধেক বড়জনের আর অর্ধেক ছোটোর। বড়জন ইঁদারাটা রাখতে চাইলেও ছোট একেবারেই নারাজ। বুঝিয়ে দিতে চায়। সে ব্যবসায়ী মানুষ। চুলের ব্যবসা করে হাতে প্রচুর টাকা এখন। বাড়িঘর করেছে ঝা চকচকে, বাড়ির সামনেটাও সুন্দর করতে চায়। তাই ইঁদারা রাখতে চায় না। সে ভাব আর রেখেই বা তার লাভ কি। বাড়িতে সাবমার্শল বসিয়েছে, পিউরিফাই জলের ব্যবস্থা করেছে।

 বিষয়টি নিয়ে গ্রাম্য সালিশ বসে। গ্রামের কিছু প্রবীণ মানুষ বড়জনের মতকে সমর্থন করে। তারা ইঁদারা রাখতে চায়। তারা জানে এই ইঁদারার জলের গুণ। ছেলেবেলায় এই জল খেয়ে তারা মানুষ। এখনও দুর্দিনে এই ইঁদারা কাজে লাগে। এ ইঁদারা তাদের বড় আপন।

 কিন্তু ছোটজন তা শুনতে নারাজ। তাকে সমর্থনের লোকেরও অভাব নাই। যারা বয়সে নবীন তারা বলে ওই নোনা জলের ইঁদারার কোন দরকার নাই। বুঝিয়ে দিয়ে জায়গাটা আধাআধি ভাগ করে দেওয়াই ভালো। সুরমার স্বপ্ন, জমির উদ্দিনের প্রতিষ্ঠিত ইঁদারা বিতর্কের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। একদিন যে ইঁদারা ঘরে ঘরে প্রাণের সঞ্চার করেছিল, জীবন দিয়েছিল, আজ তার প্রাণ নিয়ে টানাটানি।

 ইঁদারার কার্নিশের ওপর একটা হলুদ পাখি এসে বসে। ভাঙা গলায় শিস দেয়। যেন কান্নার উদ্গত ধ্বনি। মাথা কুটে কুটে ইঁদারার ওপর পাক খায়। ইঁদারার কান্না যেন তার গলায় ঝরে পড়ে।

 সেদিকে কারও দৃষ্টি নাই। নবীনদের গলার আওয়াজ, তাদের দাবি জোরালো হতে থাকে।

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button