আর্কাইভসাক্ষাৎকার

‘আমার লেখা আফ্রিকান-আমেরিকান হয়ে উঠুক’―টনি মরিসন

বিশ্বসাহিত্য : বরেণ্য কথাশিল্পীর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার

সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন : এলিসা শ্যাপেল এবং  ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর

অনুবাদ : উৎপল দাশগুপ্ত

[Toni Morrison টনি মরিসন (১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩১―৫ আগস্ট ২০১৯) মার্কিন ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক ও শিক্ষক।  প্রথম উপন্যাস দ্য ব্লুয়েস্ট আই ছাপা হয় ১৯৭০ সালে। ১৯৭৭ সালে ছাপা সং অব সলোমন ন্যাশনাল বুক ক্রিটিকস সার্কল অ্যাওয়ার্ড লাভ করে। পুলিৎজার পুরস্কার পান ১৯৮৮ সালে। ১৯৯৩ সালে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন―এ বছরই এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন।―সম্পাদক]

‘কবিসুলভ লেখিকা’ নামে অভিহিত হতে টনি মরিসনের আপত্তি আছে। তিনি মনে করেন তাঁর রচনার ছন্দময়তাকে তুলে ধরার প্রচেষ্টা করে তাঁর প্রতিভাকে অকিঞ্চিৎকর করে তোলা হয়েছে এবং তাঁর কাহিনিগুলোকে তাদের সপ্রতিভতা আর প্রতিধ্বনি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। বিরল ঘরানার এমন একজন ঔপন্যাসিক, যাঁর রচনা যতটা জনপ্রিয় ঠিক ততটাই বিদ্বজ্জন দ্বারা সমাদৃত, কোন স্তরের প্রশংসা তিনি গ্রহণ করবেন সেটি ঠিক করে নেওয়ার অধিকার অবশ্যই তাঁর আছে। অবশ্য সব ধরনের শ্রেণিবিন্যাসকেই তিন নাকচ করে দিচ্ছেন সেরকম নয়, বিশেষ করে ‘একজন কৃষ্ণাঙ্গ লেখিকা’ এই তকমাটা তিনি সাদরে গ্রহণ করেছেন। ব্যক্তিবিশেষকে শক্তির স্বরূপ হিসেবে এবং খামখেয়ালকে অনিবার্যতা হিসেবে তুলে ধরার এই ক্ষমতার জন্য কিছু কিছু সমালোচক তাঁকে  কৃষ্ণাঙ্গ মননের ডি এচ লরেন্স হিসেবে অভিহিত করেছেন। জনমুখী উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রেও তাঁর প্রশ্নাতীত পারদর্শিতা, জনগোষ্ঠী এবং লিঙ্গ, আর সভ্যতা এবং প্রকৃতির পারস্পরিক সম্পর্কের অনুসন্ধানের সঙ্গে সঙ্গে কিংবদন্তি এবং অতিকথনের মধ্যদিয়ে গভীর রাজনৈতিক সংবেদনশীলতাকে তুলে ধরতেও সচেষ্ট হয়েছেন।

প্রিনস্টন বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের শ্যামল পরিবেশে রবিবারের এক অপরাহ্ণে আমরা মরিসনের সঙ্গে কথা বলি।  সাক্ষাৎকার গ্রহণপর্বটি তাঁর অফিসঘরে বসেই হয়। অফিসঘরের দেয়ালে, হেলেন ফ্র্যাঙ্কেনথেলারের পেন্টিং এর বড় একটি প্রতিলিপি ছাড়াও রয়েছে কালি-কলম দিয়ে একজন স্থপতির করা তাঁর রচনায় উল্লিখিত সমস্ত ঘরবাড়ির ড্রয়িং, কিছু ফোটোগ্রাফ, তাঁর লেখা কয়েকটি বইয়ের প্রচ্ছদের জ্যাকেট বাঁধিয়ে রাখা, আর তাঁর কাছে হেমিংওয়ের পাঠান একটি ত্রুটিস্বীকার―এটি একটি নকল, নিছকই মজা করার উদ্দেশ্যে রাখা। টেবিলের ওপর নীলরঙের কাচ দিয়ে তৈরি একটি চায়ের পেয়ালা, তার ওপরে শার্লি টেম্পলের প্রতিকৃতি আঁকা। দুনম্বরের যে ধরনের পেনসিল দিয়ে উনি প্রাথমিক খসড়া তৈরি করেন, পেয়ালাটিতে সেই রকম কিছু পেনসিল রাখা। জানালায় জেড প্ল্যান্টের টব বসান, আরও কিছু গাছ টবে বসিয়ে ওপর থেকে ঝোলানো। ঘরের ছাদ বেশ উঁচুতে, ঘরজুড়ে বিশাল একটি টেবিল আর পিঠ-উঁচু কয়েকটা চেয়ার রয়েছে, তবে তার সঙ্গে একটি রান্নাঘরের অস্তিত্ব থাকায় পরিবেশ বেশ উষ্ণ, বোধহয় মরিসনের সঙ্গে তাঁর লেখা নিয়ে কথা বলার মধ্যে এমন এক অন্তরঙ্গতার স্পর্শ রয়েছে যা অনেক সময়েই রান্নাঘরের পরিসরেই হওয়া সম্ভব, কিংবা এমনও হতে পারে আলাপ আলোচনা করতে করতে যখন কিছুটা আলসেমি আমাদের পেয়ে বসে, তখন জাদুবলে উনি এক মগ ক্র্যানবেরি জুস এনে হাজির করে ফেলেন। মনে হতো উনি যেন আমাদের নিভৃত এক আবাসে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছেন, এবং অত্যন্ত সুকৌশলে পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবে নিজের হাতেই ধরে রেখেছেন।

বাইরে থেকে ওক পাতার চাঁদোয়ার ফাঁক দিয়ে সূর্যের কিরণ শ্বেতশুভ্র অফিসঘরে ঢুকে হলদে আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে দিচ্ছে। মরিসন তাঁর বিশাল টেবিলের পেছনে বসে। টেবিলের সব কেমন ‘এলোমেলো’ হয়ে আছে বলে উনি বিনয় প্রকাশ করলেও  আমাদের চোখে কোনও অগোছালো ভাব ধরা পড়ল না। বইয়ের থাক আর কাগজের তাড়া দেওয়ালের কাছে একটি রঙ করা বেঞ্চের ওপর রাখা। এমন ছোটখাটো একজন মানুষ, না দেখলে বোঝার উপায় নেই। ধূসর এবং রুপোলি কেশ, পাতলা বিনুনি করা, ঠিক কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে। সাক্ষাৎকার চলার ফাঁকে ফাঁকে মরিসনের গমগমে গভীর কণ্ঠস্বর অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ে, কোনও কোনও কথা বলতে বলতে হাত দিয়ে টেবিলে চাপড় দেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হিংসা নিয়ে উত্তেজিতভাবে কথা বলতে বলতে পলকের মধ্যে টিভির ছাইপাঁশ প্রদর্শনীর সঞ্চালকদের নিয়ে রসালো বিদ্রুপও ছুড়ে দেন। বুঝিয়ে দেন অপরাহ্ণে অবসর পেলে উনি কখনও কখনও টিভির চ্যানেলগুলো ঘোরাতে থাকেন।

                                                                  ―এলিসা শ্যাপেল এবং  ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : আপনি বলেছেন যে আপনি ভোর হবার আগে থেকেই লেখালেখি আরম্ভ করে দেন। এর পেছনে ব্যবহারিক কোনও কারণ আছে, না প্রত্যুষের সেই সময়ে নিজেকে অধিকতর সৃষ্টিশীল বলে মনে হয় আপনার ?

টনি মরিসন : ভোরের আগে থেকে লিখতে শুরু করার অভ্যেসটা প্রয়োজন থেকেই করতে হয়েছিল―প্রথম যখন লিখতে শুরু করি, আমাকে আমার শিশু সন্তানদের দেখাশোনা করতে হত। তাই ওরা জেগে উঠে মা বলে ডাকার আগের সময়টা কাজে লাগাতে হতো। সেটি মোটামুটি ভোর পাঁচটা নাগাদ হতো। অনেক বছর পরে, র‌্যানডম হাউজের কাজটি ছেড়ে দেওয়ার পরে, দু’বছরের মতো বাড়িতেই কাটিয়েছি সেই সময়, নিজের সম্বন্ধে বেশ কিছু অজানা ব্যাপারও (তখন) খেয়াল করলাম, যা নিয়ে আগে কখনও ভেবে দেখিনি।  প্রথম প্রথম জানতামই না আমার কখন খেতে ইচ্ছে করে, কারণ সর্বদাই আমি লাঞ্চের সময়ে বা ডিনারের সময়ে বা ব্রেকফাস্টের সময়ে খেয়ে এসেছি। কাজের চাপ আর সন্তান প্রতিপালনের দায়িত্ব আমার সমস্ত অভ্যেসকে চালিত করত … সপ্তাহের কাজের দিনে আমার নিজের বাড়িতে ওঠা আওয়াজের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না; সব মিলিয়ে কেমন যেন অস্থির লাগত আমার।

সেই সময় ‘বিলাভেড’ (Beloved) উপন্যাসটা লিখতে ব্যস্ত ছিলাম―১৯৮৩ সাল হবে―আর ক্রমশ উপলব্ধি করলাম যে সকালের দিকেই আমার চিন্তাভাবনা বেশি স্বচ্ছ থাকে, আত্মবিশ্বাস বেশি থাকে আর সাধারণভাবে মাথাটাও ভালভাবে খাটাতে পারি। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়ার অভ্যেসটা, আমার সন্তানদের শৈশবে যে অভ্যেসটা আমি ধরে নিয়েছিলাম, এখন (সেটিই) আমার পছন্দের সময় হয়ে উঠেছে। সূর্য ডুবে যাওয়ার পরে আমি ঠিক ততটা দীপ্তিমান, ততটা রসজ্ঞ, ততটা সৃষ্টিশীল হয়ে উঠতে পারি না।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : লেখালেখির ব্যাপারে আপনার রোজনামচাটা কী রকম ?

টনি মরিসন : মনে মনে লেখালেখির ব্যাপারে একটি রোজনামচা আমার আছে, তবে সেটি পরখ করে দেখার সুযোগ কখনওই হয়নি, মানে যেমন ধরুন, নটি অবিচ্ছিন্ন দিন আমাকে বাড়ি ছেড়ে বেরোতে হবে না বা ফোন ধরতে হবে না। আর প্রশস্ত একটি ঘর―যেখানে কয়েকটা বড় বড় টেবিল থাকবে। আর শেষমেষ আমার কি না, সম্বল এইটুকু মাত্র জায়গা [টেবিলের পর চৌকো ছোট একটি জায়গা হাত দিয়ে দেখিয়ে বলেন] যেখানেই থাকি না কেন, সেখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কসরৎ করতে হয়। যে ছোট টেবিলে বসে এমিলি ডিকিনসনকে লিখতে হত, সেটার কথা মনে পড়ে যায়, আর আমি মুখ টিপে হেসে ভাবি, বেচারা, তবু তো হাল ছাড়েননি। তা এই স্বল্প পরিসরেই আমাদের সবাইকে মানিয়ে নিতে হয়, সে আমাদের ফাইল করার পদ্ধতি যা-ই হোক না কেন, বা জঞ্জাল সাফ করতে যত সময়ই লাগুক না কেন―জীবনের, কাগজপত্রের, চিঠির, অনুরোধ উপরোধের, আমন্ত্রণের, চালানের―সব এসে জড়ো হতে থাকে। নিয়ম করে আমার লেখালেখি করা হয়ে ওঠে না। কখনও করে উঠতে পারিনি―বিশেষত, আমাকে তো নটা-পাঁচটা অফিস করতে হতো। হয় আমাকে ওই সময়ের ফাঁকে ফাঁকে তাড়াহুড়ো করে লিখতে হতো, আর নয়ত অনেকগুলো ছুটির দিন বা ভোরবেলায় সময়টা দিতে হতো।  

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : কাজের পরে লিখতে পারতেন ?

টনি মরিসন : সেটি বেশ কঠিন ছিল।  গুছিয়ে লেখার মত যথেষ্ট জায়গা না থাকার বিকল্প হিসেবে আমি নিজেকে শৃঙ্খলাপরায়ণ হয়ে উঠতে বাধ্য করেছিলাম, তাই যখনই জরুরি ভিত্তিতে কিছু করার বা দেখার বা বোঝার প্রয়োজন হত বা জোরালো কোনও রূপকের ভাবনা মনে এসে যেত, তখনই অন্য সব কিছু সরিয়ে রেখে অনেকটা সময় নিয়ে লিখে যেতাম।  মানে আমার প্রথম খসড়াটা কীভাবে তৈরি হত, সেই কথাটাই আপনাদের বললাম। 

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : আপনাকে তখন তখনই কাজটি করে ফেলতে হতো ?

টনি মরিসন : করি। তবে ধরাবাঁধা কিছু নয়।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : ট্রেনে সফর করতে করতে জুতোর তলায় লিখে ফেলতে পারেন, রবার্ট ফ্রস্ট যেমন করতেন ? বিমানে বসে লিখতে পারেন ?

টনি মরিসন : কখনও কখনও কোনও একটি বিষয়, যেটি আমায় ভাবাচ্ছিল, মনে এসে যায়, যেমন ধরুন, একটি বাক্যাংশ, আমি সেটি একটি কাগজের টুকরোর ওপরে লিখে ফেলি, হোটেলের লেখার কাগজে সেখানে বসেই, কিংবা গাড়িতে যেতে যেতেই। যদি এসে যায়, বুঝতে পারছেন তো, ভাবনাটি মনের মধ্যে সত্যিই যদি নড়েচড়ে ওঠে, তখন আপনাকে লিখে ফেলতেই হবে।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : আপনার লেখালেখির শারীরিক প্রক্রিয়াটি কী ধরনের ?

টনি মরিসন : আমি পেনসিল দিয়ে লিখে নিই।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : কোনও ওয়ার্ড প্রোসেসরে লিখেছেন কখনও ?

টনি মরিসন : ও হ্যাঁ, তাও করি, তবে অনেক পরে, ব্যাপারটি যখন গুছিয়ে নিতে পেরেছি। সেটি তখন আমি কমপিউটারে টাইপ করে ফেলি আর তারপর সংশোধন করতে শুরু করে দিই। তবে প্রথমে যা কিছুই লিখি না কেন, পেনসিল দিয়ে লিখি বা পেনসিল হাতের কাছে না থাকলে বল-পয়েন্ট কলম দিয়ে। আমি খুব খুঁতখুঁতে নই, তবে হলুদ রঙের ‘লিগ্যাল সাইজের’ প্যাডে ভালো দু’নম্বরের একটি পেন্সিলে লিখতেই আমি পছন্দ করি।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : ডিক্সন টাইকোনডেরোগা কোম্পানির দু’নম্বর সফট ?

টনি মরিসন : একদম ঠিক। একবার, মনে পড়ে, টেপ রেকর্ডার ব্যবহার করবার চেষ্টা করেছিলাম।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : আপনি সত্যি সত্যি একটি গল্প মেশিনে বলেছিলেন ?

টনি মরিসন : না, পুরোটা নয়, অল্প কিছুটা। যেমন ধরুন, একটি কী দুটি বাক্য যেরকম চাইছিলাম সেরকম মাথায় এসে গেল, মনে হল গাড়িতে একটি টেপ রেকর্ডার নিয়ে চলাফেরা করা খুব দরকার, বিশেষ করে র‌্যানডম হাউজে চাকরি করার সময়, দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার আমাকে যাতায়াত করতে হত। মনে হল রেকর্ড করে রেখে দিলে বেশ ভাল হবে। ব্যাপারটি আমার পোষালো না। যতক্ষণ না লিখে ফেলছি ততক্ষণ নিজের লেখার ওপর আমার বিশ্বাস নেই, যদিও তারপর সেই লেখার মধ্যে লেখকসুলভ অহংবোধ ফুটে উঠেছে সেগুলো সরানোর জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হয়, যাতে লেখাটি ছন্দময়  হয়ে ওঠে এবং সহজবোধ্য চলিত ভাষায় প্রকাশ পায়।  সব মিলিয়ে লেখাটি যাতে জীবনমুখী এবং বাস্তবসম্মত হয়। আমার মনের মধ্যে আনাগোনা  করা ভাবনাগুলোকে তৎক্ষণাৎ কাগজে কলমে লিপিবদ্ধ করে ফেলায় আমি বিশ্বাস রাখি না। 

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : কোনও লেখা নিয়ে যখন কাজ করছেন, তখন কি কখনও সেটি জোরে জোরে পড়ে থাকেন ?

টনি মরিসন : প্রকাশিত হবার আগে পর্যন্ত নয়। আমি প্রতিপাদনে বিশ্বাস করি না। হয়ত আমার মনে হবে লেখাটি সার্থক হয়ে উঠেছে, কার্যক্ষেত্রে তা নাও হতে পারে। লেখার ব্যাপারে আমি যে সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকি―অনেক সমস্যার মধ্যে একটি―তা হল  এমন একটি ভাষার প্রয়োগ, যাতে কিছুই শুনতে পান না এমন একজন পাঠকও নীরবে রসগ্রহণ করতে পারবেন। আর সেই জন্যই শব্দের অন্তরালে সাম্ভাব্য অর্থটি কী দাঁড়াতে পারে  সেই ব্যাপারে অত্যন্ত যত্নশীল থাকতে হয়। কী অনুল্লেখিত থাকল। সঠিক মানদণ্ড কোন্টি,  তালটি কেমন হবে, এই সব।   অর্থাৎ যা আপনি  লিখলেন না সেটিই অনেক সময় যা আপনি লিখেছেন তাকে জোরালো করে।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : একটি অনুচ্ছেদকে এই মানদণ্ডে পৌঁছনোর জন্য মোটামুটি কতবার লিখতে হয় বলে মনে হয় আপনার ?

টনি মরিসন : দেখুন, যেখানে যেখানে পুনর্লিখনের প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয়, যতক্ষণ সম্ভব আমি সেই কাজটি চালিয়ে যাই। যেটি বলতে চাইছি, এমনও হয়েছে যে আমি ছ’বার, সাতবার, এমনকি তেরোবার পর্যন্ত সংশোধন করেছি। তবে সংশোধন করা আর ধৈর্যচ্যুতি ঘটিয়ে হাল ছেড়ে দেওয়া, দুটোর মধ্যে একটি পার্থক্য আছে। ধৈর্যচ্যুতি কখন ঘটছে সেটি আপনাকে বুঝতে হবে; ধৈর্যচ্যুতি তখনই ঘটে যখন ব্যাপারটি কিছুতেই মনের মত হয়ে উঠতে চায় না, তখন সেটিকে বাতিল করে দেওয়াই ভাল।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : একবার যে লেখা প্রকাশিত হয়ে গেছে, আপনি কি সেই লেখার পুনর্বিবেচনা করেন আর এরকম কি আপনার মনে হয় কোনও কোনও ব্যাপারে আপনার আরও একটু খুঁতখুঁতে হওয়ার দরকার ছিল ?

টনি মরিসন : খুব হয়। সবটা নিয়েই হয়।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : যেটি প্রকাশিত হয়ে গেছে, আপনি কি সেই অনুচ্ছেদগুলো কখনও নতুন করে লিখেছেন, শ্রোতাদের কাছে পড়ে শোনানোর আগে ?

টনি মরিসন : শ্রোতাদের জন্য পরিবর্তন আমি করি না, তবে কী হওয়া উচিত ছিল কিন্তু হয়নি, সেটি আমি বুঝতে পারি। বছর কুড়ি বাদে আপনি ঠিকই ধরতে পারবেন; তখন আমি যতটুকু জানতাম, এখন অবশ্যই তার থেকে বেশি জানি। এটি নয় যে ব্যাপারটি অন্য রকম কিছু হত বা বেশি ভাল হত; তবে এটি বলতে পারি, পাঠকদের কাছে তখন আমি যেটি তুলে ধরতে চেয়েছিলাম বা যে প্রতিক্রিয়া পাঠকদের মনে হবে বলে ভেবেছিলাম, এত বছর পরে সেই ছবিটা আমার কাছে অনেক বেশি স্বচ্ছ।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : আপনি কি মনে করেন কুড়ি বছর ধরে সম্পাদিকার কাজ আপনার লেখিকা-সত্তাকে প্রভাবিত করেছে ?

টনি মরিসন : ঠিক বলতে পারব না। তবে এটি ঠিক যে প্রকাশনা-শিল্পকে নিয়ে আমার আতঙ্ক অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। মাঝে মধ্যে লেখক আর প্রকাশকের মধ্যে একটি সংঘাতের পরিবেশ তৈরি হয় সেটি বুঝতাম, কিন্তু সম্পাদকের ভূমিকা কতটা মহত্ত্বপূর্ণ, কতটা অপরিহার্য সেটি জানতে পেরেছিলাম; আমার মনে হয় না আগে এই ব্যাপারে আমার কোনও ধারণা ছিল।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : এমন কোনও সম্পাদক আছেন যাঁরা গঠনমূলক সমালোচনা করে আপনাকে সাহায্য করেছেন ?

টনি মরিসন : অবশ্যই। ভাল সম্পাদক যাঁরা, তাঁদের কথাই আলাদা। ওঁরা হলেন পুরোহিত বা মনস্তত্ত্ববিদদের মত; মনের মত মানুষটিকে না পাওয়া গেলে একলা চলাই ভালো; অবশ্য এমনও কিছু সম্পাদক আছেন, তাঁদের সংখ্যা অনেক নয়, তাঁদের সান্নিধ্য পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার, তাঁদের সন্ধানে থাকতে হয়, আর তেমন কারওর সন্ধান পাওয়া গেলে আপনি নিজে থেকেই বুঝতে পারবেন।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : সব চাইতে বর্ণময় কোন সম্পাদকের সঙ্গে আপনার কাজ করার সুযোগ হয়েছে ?

টনি মরিসন : একজন সম্পাদক আছেন, আমার চোখে তিনি মহীয়ান একজন মানুষ―বব গটিলেব। কেন উনি আমার চোখে মহান হয়ে উঠেছিলেন, তার অনেকগুলো কারণ আছে―কোন কোন বিষয়ে হাত না দেওয়াই ভালো, উনি জানতেন; সময় পেলে আপনি নিজেকে যে সব প্রশ্ন করতে চাইতেন, উনিও সে সব প্রশ্নই করতেন। একজন ভালো সম্পাদক হলেন তৃতীয় নয়নের মতো। প্রশান্ত, স্থিতপ্রজ্ঞ। আপনার প্রতি বা আপনার লেখার প্রতি তাঁর কোনও পক্ষপাত থাকবে না; আমার কাছে এটি অনেক বেশি মূল্যবান―প্রশংসা পাওয়ার চাইতেও। কখনও কখনও বেশ রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হয়েছে; এমন সব জায়গার দিকে আঙ্গুল তুলবেন যে সব জায়গাতে নিজের দুর্বলতা সম্বন্ধে আপনি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল, কিন্তু সেই সময় এর চেয়ে ভালো কিছু মাথায় আসেনি। একজন ভাল সম্পাদক সেই সব জায়গা চিহ্নিত করে ফেলেন, আর কখনও কখনও পরামর্শও দেন। কিছু কিছু পরামর্শ অবশ্য তেমন কাজে লাগে না, কারণ, আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন, সমস্ত কথা তো আর সম্পাদকের কাছে ব্যাখ্যা করে বলা সম্ভব হয় না। সব কিছু হয়ত সম্পাদকের কাছে ব্যাখ্যা করে বলা যায়নি, কারণ আমাকে তো ভিন্ন ভিন্ন স্তরে কাজটি করতে হয়। তবু যদি পারস্পরিক বিশ্বাসের জায়গাটা থাকে, শুনবার আগ্রহ থাকে, অসামান্য ফল পাওয়া যায়। আমি সর্বদাই বই পড়তে থাকি, আমার বিশ্বাস লাইন ধরে সম্পাদনা করার চেয়ে কেউ যদি আলোচনা করে, তাহলেই আমি বেশি লাভবান হতে পারব। কখনও কখনও ভাল একজন সম্পাদকের প্রয়োজনীয়তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ প্রথম থেকেই তেমন একজন কেউ যদি না থাকেন, তাহলে পরের দিকে তাঁকে পাওয়া বেশ শক্ত হয়ে পড়ে। সম্পাদকের সাহায্য ছাড়াই যদি আপনি লেখালেখি ভালভাবেই করতে পারেন, পাঁচ-ছয় বছর ধরে আপনার বইয়ের কাটতি বেশ ভালোই হলো, তারপরে এমন একটি বই লিখলেন―যার কাটতি হলো, কিন্তু আগের বইগুলোর মতো নয়―তাহলে সম্পাদকের পরামর্শ মেনে চলার কী দরকার আছে আপনার ?

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : আপনি ছাত্র-ছাত্রীদের সংশোধন প্রক্রিয়া নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতে বলেছেন, কারণ লেখালেখি থেকে আনন্দ লাভ করবার সেটি অন্যতম উপায়। আপনি কি প্রথম খসড়া তৈরি করে বেশি আনন্দ পেয়ে থাকেন, না সংশোধনের সময় ?

টনি মরিসন : দুটি একেবারে আলাদা ব্যাপার। আমি বরং কোনও ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করার বা নতুন কোনও ভাবনা পেলে অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পড়ি  লেখালেখি শুরু করার আগেই।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : সেটি কি বিদ্যুৎচমকের মত মাথায় খেলে যায় ?

টনি মরিসন : তা নয়, অধ্যবসায় সহকারে আমাকে লেগে থাকতে হয়। সর্বদাই একটি ধারণা থেকে আমি শুরু করি, এমনকি ধারণাটা অনেক সময়েই বেশ একঘেয়ে ধরনের হয়, বেশ কিছু প্রশ্ন নিয়ে আমার মনে এসে উদয় হয়, যার উত্তর আমার জানা থাকে না। বিশেষ করে ‘বিলাভেড’ ট্রিলজি লিখতে শুরু করার পর থেকে, যে উপন্যাসের শেষ পর্বটা এখন আমি লিখছি, মনে মনে ভেবেছি, যে সব মেয়েরা আমার থেকে কুড়ি বা তিরিশ বছরেরও ছোট, তারাও কেন আমার বয়সের কিংবা তার থেকেও বেশি বয়সের মহিলাদের চেয়ে একটুও বেশি সুখী নয়। যখন ওরা অনেক কিছুই করতে পারে বা ওদের সামনে অনেক কিছু করবার পথ খোলা আছে ? মেনে নিচ্ছি এটি হল প্রাচুর্যের পরিহাস, কিন্তু তাতে কী এসে যায় ? এত দীনতা কেন সবার মধ্যে ?

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : কোনও একটি বিষয় নিয়ে আপনার অনুভূতিটা ঠিক কী রকম, সেটি জানার জন্যই কি আপনি লেখেন ?

টনি মরিসন : না, নিজে কী অনুভব করছি, সেটি আমার জানা আছে। আর পাঁচজনের মত আমার অনুভূতিও সংস্কার আর প্রতীতিরই ফলশ্রুতি। একটি ধারণা কতটা জটিল হতে পারে, তার দুর্বলতার জায়গাগুলো কী, সেটি নিয়েই আমার আগ্রহ। ‘এটাই আমার বিশ্বাস’-এমনতর কোনও ব্যাপার নয়, তাহলে সেটি আর বই হয়ে উঠবে না, হবে খানিক বাগাড়ম্বর। বই মানে হল ‘এ রকম হতে পারে বলেই আমার বিশ্বাস, কিন্তু আমি যদি ভুল করে থাকি  তাহলে কী হবে ?’ অথবা, ‘এটি কী হবে আমি জানি না, তবে আমার কাছে, এবং অন্যদের কাছেও  এর কী অর্থ হতে পারে সেটি জানতে আমি আগ্রহী’। 

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : ছোটবেলায় আপনি কি জানতেন যে আপনি একজন লেখিকা হতে চান ?

টনি মরিসন : না। আমি একজন পাঠিকা হতে চেয়েছিলাম। তখন ভাবতাম যা কিছু লেখার দরকার, সবই লেখা হয়ে গেছে, বা হয়ে যাবে। প্রথম বইটা আমি লিখেছিলাম কারণ আমার মনে হয়েছিল সেটি লেখা হয়নি, আর লিখে ফেলতে পারলেই সেটি আমি পড়তে পারব। আমি কিন্তু একজন খুব ভাল পাঠিকা। পড়তে আমি ভালোবাসি। সত্যি কথা বলতে কী, এটাই আমি করে থাকি। অতএব সেটি যদি আমি পড়তে পারি, সেটিই হবে আমার সর্বোচ্চ উপলব্ধি। লোকে বলে আমি নাকি নিজের জন্য লিখি। কথাটা খুবই উদ্ভট শোনায়, খুবই আত্মরতিমূলক লাগে। কিন্তু অন্যভাবে দেখতে গেলে, আপনার যদি জানা থাকে নিজের লেখা কী ভাবে পাঠ করতে হয়, মানে যথেষ্ট পক্ষপাতহীন দূরত্ব বজায় রেখে, তাহলেই আপনি একজন ভালো লেখক এবং সম্পাদক হতে পারবেন। যখন সৃজনশীল সাহিত্য নিয়ে ক্লাস নিই, কী ভাবে নিজের লেখা পড়তে হয় সেই ব্যাপারে ছাত্র-ছাত্রীদের আমি বলে থাকি; তোমার নিজের লেখা বলেই তোমার ভাল লাগতে হবে সেরকম কিছু বলি না।  বরং বলি যে নিজের লেখাটি থেকে দূরে সরিয়ে নাও নিজেকে, তারপরে পড়, যেন প্রথমবার লেখাটি তুমি পড়ছ। এইভাবে লেখাটির সমালোচনা কর। নিজের লেখা কিছু রোমাঞ্চকর বাক্য বা অন্য কিছুর ফাঁদে কিছুতেই পড়ে যেও না…

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : পাঠক―পাঠিকাদের কথা মাথায় রেখেই কি আপনি লিখতে বসেন ?

টনি মরিসন : কেবল নিজের কথা। কোনও জায়গায় এসে ঠেকে গেলে, আমার কাহিনির পাত্র-পাত্রীরা রয়েছে, ওদের  কাছে ফিরে যাই ভরসা পাওয়ার জন্য। আমি ততদিনে ওদের সঙ্গে এতটাই বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলেছি যে ওরাই আমাকে বলে দেয় আমার লেখনীতে ওদের জীবন নির্মাণ বাস্তবসম্মত হয়েছে কি না। অবশ্য বেশ কিছু ব্যাপার আছে যেটি আমিই বলতে পারি। হাজার হলেও লেখাটি তো আমারই। ঠিক করি কি ভুল করি, তার পুরো দায় তো আমাকেই নিতে হবে। ভুল করলেই যে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে তা কিন্তু নয়, সমস্যা তখনই আসে যখন ভুল করে ফেলার পরেও মনে হতে থাকে ওটাই ঠিক। একবার মনে আছে, পুরো গ্রীষ্মকাল ধরে একটি লেখা লিখে ফেললাম, আমি নিজেই চমৎকৃত লেখাটি নিয়ে, তারপরে শীতের আগে পর্যন্ত লেখাটি আর ফিরে দেখার সময় পাইনি। লেখাটি অতি উত্তম হয়েছে এই রকম একটি আত্মবিশ্বাস নিয়ে ওই পঞ্চাশটি পাতা পড়তে শুরু করলাম। তখন মনে হল ওই পঞ্চাশটিপাতার প্রতিটিই যেন ভয়াবহ। চিন্তাভাবনা না করেই লেখা। ব্যাপারটি ঠিক করে নিতে পারব ঠিকই, কিন্তু লেখার সময় এটিকে ভাল বলে মনে হয়েছিল, ভাবনাটি আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ভাবনাটি বেশ আতঙ্কের কারণ আপনি বুঝতে পারছেন আসলে আপনার আত্মবিশ্বাসটা ঠিক ছিল না।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : কী এমন ছিল যা আপনার ভাল লাগল না ?

টনি মরিসন : অসম্ভব বাগাড়ম্বরপূর্ণ। বাগাড়ম্বরপূর্ণ এবং অপাঠ্য।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : শুনেছি, আপনি বিবাহবিচ্ছেদের পরই লিখতে শুরু করেন, নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তিলাভের উপায় হিসেবে। কথাটা কি সত্যি ? আজকাল কি অন্য কারণে লেখালেখি করেন ?

টনি মরিসন : হতে পারে।  কথাটা যত সহজ শোনায়, বাস্তবে তা নয় অবশ্য। আমি ঠিক জানি না, সেই জন্যই লিখতাম, না অন্য কিছু কারণ ছিল―বা এমন কোনও কারণ যা আমার মনে আসেইনি। এটি অবশ্যই জানতাম যদি লিখবার মত কিছু না থাকে, তাহলে এখানে আমার ভাল লাগবে না।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : এখানে, মানে কোথায় ?

টনি মরিসন : মানে এই বিশ্বসংসারে। অবিশ্বাস্য রকমের হিংসা, ইচ্ছাকৃত অজ্ঞতা, ক্ষুধার্ত মানুষের বেদনা, এই সব কিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব। এগুলো সম্বন্ধে আমি সর্বতোভাবে সচেতন, তবে কোনও কোনও পরিস্থিতি আমাকে ভুলে থাকতে সাহায্য করে―ভালো বন্ধুদের সঙ্গে ডিনার করতে করতে, বা ভাল বই পড়ার সময়। শিক্ষকতা অবশ্য অনেকটাই সাহায্য করে, তবে যথেষ্ট নয়। শিক্ষকতা কখনও কখনও আমাকে সমাধানের অংশ না হয়েও আত্মতৃপ্ত এবং অজ্ঞ ব্যক্তিতে পরিণত করে ফেলতে পারে। শিক্ষক হিসেবে নয়, বা মাতৃরূপে নয় বা প্রেমিকারূপে নয়, কেবল লেখার সময়ে আমার মনের গহীনে যা চলতে থাকে, তার সঙ্গে একাত্ম হতে পারলেই আমি নিজেকে বিশ্বসংসারের একজন বলে অনুভব করতে পারি। তখনই নিজেকে এখানকার একজন বলে মনে হয়, আর তখনই সব অসদৃশ এবং পরস্পরবিরোধী শক্তিগুলির প্রয়োজনীয়তা বোঝা যায়। অন্যান্য লেখকেরা বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলায় নিয়ে আসার যে ঐতিহ্যবাহী কাজগুলি করেন বলে দাবি করেন, আমি সেগুলি করতে সক্ষম হই। এমনকি যখন আপনি বিশৃঙ্খলাটির পুননির্মণ করেন, সেই পুননির্মাণের কৃতিত্ব সর্বতোভাবেই আপনার। কোনও লেখা নিয়ে মনের ভেতর চলতে থাকা অবিরাম লড়াইটি অত্যন্ত জরুরি―লেখাটি প্রকাশের আলোয় আসার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : এটি যদি আপনি না করতে পারেন ? তাহলে বিশৃঙ্খলা―

টনি মরিসন : তাহলে আমিও সেই বিশৃঙ্খলারই একটি অঙ্গ হয়ে পড়ব।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : তার সমাধানসূত্র খুঁজতে হয় আপনাকে বিশৃঙ্খলা নিয়ে লেকচার দিতে হবে আর নয়ত রাজনীতিতে অংশ নিতে হবে, তাই নয় কি ?

টনি মরিসন : যদি সেই ক্ষমতা আমার থাকত। আমি কেবল এটুকুই করতে পারি―বই পড়া, বই লেখা, বইয়ের সম্পাদনা করা এবং বইয়ের সমালোচনা করা। একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে নিজেকে নিয়মিতভাবে তুলে ধরা আমার ক্ষমতার বাইরে বলেই মনে হয়। আমি আগ্রহ হারিয়ে ফেলব। সেই সম্ভাবনা আমার মধ্যে নেই, আমার সেই সংগতি নেই। মানুষকে সঙ্ঘবদ্ধ করতে পারেন, এমন মানুষ অনেক আছেন, আমি পারি না। আমি বিরক্তবোধ করতে থাকব।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : লেখিকা হয়ে ওঠাই যে আপনার নিয়তি, এটি আপনি কবে বুঝতে পারলেন ?

টনি মরিসন : বেশ দেরিতে বুঝেছি। আমি পারলেও পারতে পারি, এরকম একটি কথা যে মনে হয়নি তা নয়, কারণ লোকে বলত, কিন্তু সেটি তো ওদের ধারণা, আমার নিজস্ব  ধারণা তো আর নয়। তাই ওদের কথা নিয়ে আমি বিশেষ মাথা ঘামাইনি। আমার কাছে তার গুরুত্বই ছিল না। তারপর আমি যখন সং অফ সলোমন লিখছি―আমার তৃতীয় বই―তখন আমি উপলব্ধি করতে আরম্ভ করলাম যে লেখালেখির সঙ্গেই আমার জীবন অচ্ছেদ্যবন্ধনে জড়িয়ে পড়েছে। একথা বলছি না যে অন্যান্য মহিলারা কথাটা বরাবর বলে আসেননি, তবে একজন মহিলার পক্ষে, আমি একজন লেখিকা এরকম একটি ঘোষণা করে দেওয়া একটু মুশকিল। 

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : কেন ?

টনি মরিসন : ঠিকই, এখন আর ততটা মুশকিল নয়, তবে আমার জন্য এবং আমার প্রজন্মের মহিলাদের জন্য বা আমার জাতের মহিলাদের জন্য, সেই  সময় অবশ্যই মুশকিল ছিল। কত বিধিনিষেদের বেড়াজাল পেরোতে হয়, আমার ধারণাই ছিল না। আসলে ব্যাপারটি হল এই যে আপনি আপনার লিঙ্গের নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করতে চাইছেন। এদিকে আপনি বলতে চাইছেন যে আমি একজন মা, কিংবা একজনের স্ত্রী, বা শ্রমনিবিড় কোনও পেশার সঙ্গে যুক্ত থেকে বলছেন যে আমি একজন শিক্ষিকা বা সম্পাদিকা। কিন্তু নিজেকে লেখিকা হিসেবে জাহির করে আপনি কী বার্তা দিতে চাইছেন ? এটি কি এক ধরনের চাকরি ? এটিই কি আপনার জীবিকা অর্জনের উপায় ?  অর্থাৎ আপনি এমন একটি এলাকায় হস্তক্ষেপ করতে চাইছেন যেখানে আপনি সুপরিচিত নন―যার সঙ্গে আপনার কোনও সংযোগ নেই। সেই সময়ে, আর কোনও সফল লেখিকার সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় আমার ছিল না। মনে হত এই এলাকাটি কেবল পুরুষ মানুষদের জন্যই সংরক্ষিত। সেই এলাকার একটি প্রান্তে বড় জোর অতিসাধারণ অখ্যাত এক মানুষ হিসেবে জায়গা পেতে পারি। লিখতে হলে আপনাকে সম্মতি পেতে হবে, ব্যাপারটি যেন অনেকটা এই রকম। মহিলাদের জীবনী এবং আত্মজীবনী আমি পড়ে দেখেছি, এমনকি তাঁরা কী ভাবে লেখালেখি শুরু করেন, তার বিবরণীও পড়েছি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই কিছু না কিছু ঘটনা আছে যেখানে লেখালেখির ব্যাপারে সম্মতিলাভের ব্যাপারটি তুলে ধরা হয়েছে। কেউ হয়ত অবাক হয়ে বললেন―ও তুমি বলছ তুমি একজনের মা―একজনের স্ত্রী―বা তুমি একজন শিক্ষিকা―লিখতে চাও ? তা বেশ―লেখো না!  একজন পুরুষের ক্ষেত্রে সম্মতির একেবারে প্রয়োজন নেই, তা বলছি না কিন্তু। ধরুন তরুণ একজন লেখক, ওঁর অভিজ্ঞ পথপ্রদর্শক হয়ত উৎসাহ দিয়ে বলবেন―তোমার মধ্যে আছে বুঝলে, লিখে যাও। আর তিনি লেখক হিসেবে অবতীর্ণ হয়ে যান। যেন সর্বজনস্বীকৃত এই অধিকার। অথচ আমি যখন বুঝে গেছি লেখাই আমার জীবন দেবতা, লেখালেখিতেই মনপ্রাণ সমর্পণ করে ফেলেছি, এর মধ্যেই জীবনের সর্বোচ্চ আনন্দের সন্ধান পেয়েছি, জীবনের সব চাইতে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছি, আমি কিন্তু মুখ ফুটে বলার সাহস পাইনি। কেউ হয়ত জিগ্যেস করেই বসলেন, কী কর তুমি ? আমি লিখি বলাটা ধৃষ্টতা হয়ে যাবে। আমাকে বলতে হবে, আমি সম্পাদনা করি, বা আমি একজন শিক্ষিকা। সবার সঙ্গে আপনি ধরুন লাঞ্চে গেলেন, ওঁরা ধরুন জানতে চাইলেন, তুমি কী কর ? আর আপনি বলে বসলেন যে আপনি একজন লেখিকা, ওঁরা চিন্তায় পড়ে যাবেন, তারপর প্রশ্ন করবেন, কী লিখেছ তুমি ? তখন ওঁদের মতামত জানাতে হবে, ভাল লেগেছে না লাগেনি। ভাল লাগানো বা না লাগানোকে মানুষ একটি দায় বলেই মনে করে, এবং ভাল লাগা বা মন্দ লাগা জানানোটাও। আমার লেখাকে অপছন্দ করার অধিকার নিশ্চয়ই আছে। হতেই পারে। আমার নিজেরই অনেক নিকট বন্ধু আছেন, যাঁদের লেখা আমারও পছন্দ হয় না।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : লেখালেখিটা নিজস্ব স্তরেই চালিয়ে যেতে হবে এরকম কথা কখনও মনে হয়েছে ?

টনি মরিসন : অবশ্যই মনে হয়েছে, ভেবেছিলাম এটাকে নিজস্ব ব্যাপার হিসেবেই রেখে দেব। চেয়েছিলাম এটি একান্তই আমার নিজেরই থাকুক। কারণ একবার বলে ফেললেই, অন্যদেরও জড়িয়ে ফেলা হয়। সত্যি কথা বলতে কী, র‌্যানডম হাউজে থাকাকালীন আমি কখনও বলিনি যে আমি একজন লেখিকা।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : কেন বলেননি ?

টনি মরিসন : সে ভারি অস্বস্তির ব্যাপার হত। প্রথমত, এই কাজটি করার জন্য ওরা আমাকে নিযুক্ত করেনি। ওদেরই একজন হয়ে ওঠার জন্য ওরা আমাকে চাকরি দেয়নি। দ্বিতীয়ত, সেটি করলে ওরা আমাকে ছাড়িয়ে দিত।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : সত্যি বলছেন ?

টনি মরিসন : নিশ্চয়ই। আভ্যন্তরিক সম্পাদকমণ্ডলীতে এমন কেউ ছিলেন না যিনি গল্প লিখতেন। সম্পাদক ডক্টরো১কে ছেড়ে চলে যেতে হয়। এছাড়া আর কেউই ছিলেন না―সম্পাদক হিসেবে যিনি―(লেখকদের সঙ্গে) (স্বত্ব) ক্রয় বা কারবারের স্বার্থে আলাপ আলোচনা (দর কষাকষি) চালিয়ে যাচ্ছেন আবার লেখিকা হিসেবে নিজের লেখা উপন্যাসও প্রকাশ করছেন।

১ এডগার লরেন্স ডক্টরো (আমেরিকান ঔপন্যাসিক, সম্পাদক এবং অধ্যাপক, ঐতিহাসিক কল্পকাহিনির লেখক হিসেবে জনপ্রিয়)

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : আপনি একজন মহিলা, এই ব্যাপারটিই একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল কি ?

টনি মরিসন : এই ব্যাপারে আমি খুব একটি মাথা ঘামাইনি। এত ব্যস্ত থাকতে হতো। কেবল বুঝেছিলাম আমার জীবন আর ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনও পুরুষমানুষের খামখেয়ালিপনার ওপর ভরসা করতে পারব না―সে তিনি সংস্থারই কেউ হন, বা বাইরের। নিজের ক্ষমতা সম্বন্ধে আমার ধারণা আর কখনও ওঁদের মতামতের ওপর দাঁড়িয়ে থাকবে না। বিবাহবিচ্ছিন্ন হওয়া এবং সঙ্গে সঙ্গে সন্তানের দায়িত্ব পাওয়া―সে এক পরম মুক্তির অনুভব। ব্যর্থতা মেনে নিতে আমার অসুবিধে হয় না, কিন্তু একজন পুরুষই (আমার চেয়ে) বেশি জানেন, একথাটা মেনে নেওয়া আমার পক্ষে খুব মুশকিল। আগে যে সব পুরুষমানুষদের বেশি জানেন মনে করতাম, তাঁরা অবশ্যই বেশি জানতেন।  আমার বাবা, আমার শিক্ষকেরা জ্ঞানী মানুষ ছিলেন, তাই বেশি জানতেন। তারপর আমি একজন সবজান্তা পুরুষমানুষের সান্নিধ্যে এলাম, আমার জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তাঁর, কিন্তু তিনি আমার থেকেও ভাল জানতেন বলে মনে হয়নি। 

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : উনি কি আপনার স্বামী ছিলেন ?

টনি মরিসন : হ্যাঁ। নিজের জীবন সম্বন্ধে উনি অনেক ভাল জানতেন, কিন্তু আমার জীবন সম্বন্ধে নয়। আমাকে স্মরণ করিয়ে দিতে হত, আমাকে নিজের মত শুরু করতে দাও, দেখি না স্বাবলম্বী হতে কেমন লাগে। গৃহত্যাগ করবার সিদ্ধান্ত নিলাম, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে যাব, প্রকাশনার কাজে আত্মনিবেশ করব, দেখা যাক না, কত দূর যাওয়া যায়। মতলবটা কাজ নাও করতে পারে, তার জন্যও তৈরি ছিলাম, তবু স্বাবলম্বী হতে কেমন লাগে সেটি পরখ করে নিতে চেয়েছিলাম।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : র‌্যানডম হাউজের সেই মুহূর্তটি সম্পর্কে কিছু বলতে পারেন যখন ওরা আবিষ্কার করল, ওদের মধ্যে একজন লেখক রয়েছেন ?

টনি মরিসন : দ্য ব্লুয়েস্ট আই নামে একটি বই প্রকাশ করেছিলাম। ওদের সেই কথা জানাইনি। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে বইটির পর্যালোচনা পড়ার আগে পর্যন্ত ওরা জানতে পারেনি। হোল্ট প্রকাশ করেছিল বইটি। কেউ একজন এই যুবকটিকে বলেছিল যে একটি কিছু লিখছি, যুবকটিও খুব একটা ভাবনা চিন্তা না করেই আমাকে বলেছিল, কোনও লেখা যদি শেষ করতে পারি তবে ওর কাছে যেন পাঠিয়ে দিই। তাই পাঠিয়ে দিলাম। ১৯৬৮, ১৯৬৯ নাগাদ অনেক কৃষ্ণাঙ্গ মানুষই লেখালেখি করছিলেন, ফলে ও লেখাটি কিনে নিল এই ভেবে যে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষেরা কী লিখছে সেটি নিয়ে মানুষের কৌতুহল বেড়ে চলেছে, তাই আমার বইটিরও নিশ্চয়ই কাটতি হবে। কিন্তু ওর হিসেবে ভুল হলো। কাটতির পেছনে আসল রহস্যটা হল―দেখ আমি কত শক্তিশালী আর তুমি কত নিকৃষ্ট বা এরই ধারে কাছে কিছু একটি বলা। কারণ যাই হোক না কেন, ও অল্প একটু  ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছিল। খুব বেশি পারিশ্রমিক আমাকে দেয়নি ও, তাই বইটা বিক্রি হল কি না হল, তাতে ওর খুব একটি কিছু এসে যায়নি। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের রবিবাসরীয় পুস্তক সমালোচনা বিভাগে বইটিকে তুলোধোনা করা হয়েছিল, অবশ্য পরে দৈনিক সংস্করণের পর্যালোচনাটা ভালই হয়েছিল।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : লেখালেখির অনুমতি পাওয়ার কথা বলছিলেন। অনুমতি কে দিয়েছিলেন ?

টনি মরিসন : কেউই দেননি। অনুমতির নেওয়ার প্রয়োজন হয় সফল হবার জন্য। লেখা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি কখনও কোনও চুক্তিপত্রেই সই করিনি, কারণ আমি কোনও লেখার জন্য কারও কাছে দায়বদ্ধ হয়ে থাকতে চাইনি। চুক্তি মানে হল, কেউ একজন লেখাটির জন্য অপেক্ষা করে বসে আছেন, কাজটি আমাকে করে ফেলতেই হবে, আর এই ব্যাপারে ওঁরা আমার কৈফিয়ত চাইতে পারেন। ওঁরা আমার ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলতে থাকবেন, সেটি আমার পছন্দ নয়। কাজটি আমি চুক্তিপত্রে সই না করেই করব, আর যদি আপনি দেখতে চান, আপনাকে দেখতে নিশ্চয়ই দেব। ব্যাপারটি হল মর্যাদার সঙ্গে করতে পারার। অনেকদিন ধরেই নিশ্চয়ই আপনারা লেখকদের মধ্যে স্বাধীনতা নিয়ে এই রকম একটি বিভ্রম সৃষ্টি করার প্রবণতা দেখতে পেয়েছেন, যে এটি আমার নিজস্ব ব্যাপার, আর একমাত্র আমিই এটি করতে সক্ষম। ইউডোরা ওয়েল্টিকে উপস্থাপন করার কথা মনে পড়ে, মনে আছে বলেছিলাম উনি ছাড়া আর কেউই সেই গল্পগুলি লিখতে পারতেন না, মানে অধিকাংশ বই সম্বন্ধে আমার উপলব্ধিটা বোঝাতে চেয়েছিলাম, যে বিশেষ কোনও সন্ধিক্ষণে কোনও একজনকে বইটি লিখে ফেলতেই হতো। কিন্তু অনেক এমন লেখকও আছেন, যাঁরা ছাড়া বিশেষ কিছু কাহিনি লেখা হতই না।  বিষয়বস্তু বা কাহিনির কথা বলছি না, কাহিনিটি যে দৃষ্টিকোণ থেকে লিখেছেন সেটির কথা বলছি―তির্যকতার প্রয়োগ বাস্তবিকই অনন্যতার দাবি রাখে।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : তাঁদের কয়েকজনের নাম বলবেন ?

টনি মরিসন : হেমিংওয়ে পড়েন তাঁদের মধ্যে, ফ্ল্যানার ও’কনর। ফকনার, ফিটজেরাল্ড…

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : এঁরা কৃষ্ণাঙ্গদের যেভাবে দেখিয়েছিলেন, আপনি তার সমালোচনা করেছিলেন কি ?

টনি মরিসন : না তো! আমি, সমালোচনা করেছিলাম ? শ্বেতাঙ্গরা কৃষ্ণাঙ্গদের সম্পর্কে কী ধরনের অনুমান করে থাকেন সেটিই উদঘাটিত করেছি। অনেকেই সেই কাজটি অসামান্য দক্ষতার সঙ্গে করেছেন। ফকনার অসামান্য দক্ষতায় করেছেন। হেমিংওয়ে কোথাও কোথাও দুর্বলভাবে করেছেন, কিন্তু অন্যত্র দক্ষতার সঙ্গে করেছেন।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : কী রকম ?

টনি মরিসন : কৃষ্ণাঙ্গ চরিত্র ব্যবহার করেননি, অথচ কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের নান্দনিকতা বোধকে নৈরাজ্য হিসেবে,  যৌন স্বেচ্ছাচারিতা হিসেবে, বা বিচ্যুতি হিসেবে ব্যবহার করেছেন। দ্য গার্ডেন অফ ইডেন―হেমিংওয়ের সর্বশেষ বইটিতে―ওঁর নায়িকা ক্রমাগত কৃষ্ণ থেকে কৃষ্ণতর হয়ে পড়ছেন। মহিলাটি, যিনি এই রূপান্তরে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন, তাঁর স্বামীকে বললেন, আমি তোমার কাছে ছোট্ট আফ্রিকান রানিটি হয়েই থাকতে চাই।  উপন্যাসটি শক্তি সঞ্চয় করছে এইভাবে―তার শুভ্র থেকে শুভ্রতর কেশ আর তার কৃষ্ণ থেকে কৃষ্ণতর ত্বক  যেন হুবহু ম্যান রে’র তোলা একটি ফোটো। সম্প্রদায়গত মতাদর্শ নিয়ে মার্ক টোয়েনের মতো শক্তিশালী, বাগ্মী এবং শিক্ষামূলক বক্তব্য আমি আর কারও লেখায় পড়িনি। এডগার অ্যালেন পো বলেননি। উনি শ্বেতাঙ্গদের এবং প্ল্যান্টার শ্রেণির শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাস করতে ভালবাসতেন, এবং উনি নিজেকে একজন ভদ্রলোক প্রতিপন্ন করতে চাইতেন আর এই সব কিছুই অনুমোদন করতেন। এই নিয়ে না পক্ষে কিছু বলেছেন, না বিপক্ষে। মার্কিন সাহিত্যের ক্ষেত্রে যা খুবই আশ্চর্যের তা হল কীভাবে লেখকেরা নিজেদের ভাবনা তাঁদের কাহিনির মধ্যে, কাহিনির আড়ালে এবং কাহিনির চারপাশে উপস্থাপন করবেন। যেমন পু’ড’নহেড উইলসন’-এর কথা ধরুন, বর্ণ কী তাই নিয়ে উল্টোপাল্টা ব্যাখ্যা, নাকি এমন কিছু যার ব্যাখ্যা কারও পক্ষেই সঠিকভাবে দেওয়াই সম্ভব নয়, নাকি কিছু আবিষ্কার করে ফেলার রোমাঞ্চকর অনুভূতি ? ফকনারের ‘আবসালোম, আবসালোম!’ সাম্প্রদায়িক ইতিহাস অনুসন্ধানের জন্য পুরো একটি বই লিখে ফেলতে হয়েছে তাঁকে, অথচ কিছুই খুঁজে পাবেন না। কেউই কিছু খুঁজে পাবেন না, এমনকি যে চরিত্রটি কৃষ্ণাঙ্গ, সেও পাবে না। আমার ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আমি এই বক্তৃতাটি তৈরি করেছিলাম, বেশ সময় লেগেছিল, আমি সেই সমস্ত জায়গাগুলিকে চিহ্নিত করতে চেয়েছিলাম যেখানে বর্ণবৈষম্যগত তথ্য বা সূত্র  প্রতিসংহৃত, পক্ষপাতদুষ্ট এবং জনশ্রুতির ওপর নির্ভর করে ইঙ্গিত করা হয়েছে, কিন্তু তার সঠিক প্রতিফলন ঘটতে পারেনি। আমি কেবল বিষয়টি নথিভুক্ত করতে চেয়েছি। পৃষ্ঠা ধরে ধরে আমি এদের উল্লেখ, ছদ্মবেশ এবং অন্তর্ধানগুলিকে তালিকাভুক্ত করেছি―মানে প্রতিটি বাক্যাংশের! সবটুকুই, এবং আমার ক্লাসে ব্যাপারটি নিয়ে বক্তব্য রেখেছি। ওরা সকলেই ঘুমিয়ে পড়ল! তবে কৌশলগত দিক থেকে আমি কিন্তু খুব মুগ্ধ হলাম। এই ধরনের তথ্য আড়াল করে রেখে, শুধু মাত্র ইশারা করে, আঙ্গুল তুলে দেখানো, কাজটি মোটেই সহজ নয়, তা জানেন কি ?  আর তারপর সব কিছু সামনে নিয়ে আসা, যেন জানানো, বলার উদ্দেশ্য সেটি মোটেই নয় ? কী অদ্ভুত ধরনের চালাকি! পাঠক হিসেবে তন্নতন্ন করে কালো মানুষদের রক্তক্ষরণের হদিস খোঁজার জন্য আপনাকে বাধ্য করা হচ্ছে, যেন সেটিই সব কিছু, আবার কিছুই নয়। বর্ণবিদ্বেষী ভাবনার উসকানি। খুব বিতর্কিত একটি কাঠামো। কে কী বলল, কী বলল না, সেটি কোনও ব্যাপারই নয়… ব্যাপার হল বইটির কাঠামো, আর আপনি যে কালো জিনিসটির হদিস খুঁজছেন, সেটি কোথাও খুঁজে পাবেন না, অথচ সেখানেই যত গণ্ডগোলের সূত্রপাত। আর কেউই ঠিক এই ধরনের কিছু করেননি, কখনওই। তাই যখন সমালোচনা করি, আমি এটাই বলতে চাই যে ফকনার বর্ণবিদ্বেষী হলেন কি না হলেন তাতে আমার কিছু যায় আসে না; ব্যক্তিগতভাবে আমি তার পরোয়া করি না, তবে এই রকম করে লেখার উদ্দেশ্য কী, সেটি আমাকে নিঃসন্দেহে ভাবিয়ে তোলে। 

২ ম্যান রে (ইম্যান্যুয়েল র‌্যাডনিটজকি)―একজন মার্কিন ভিজুয়াল আর্টিস্ট এবং ফোটোগ্রাফার। পেশাদারি বৃত্তির অনেকটা সময় তিনি প্যারিসেই থাকেন ।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : কৃষ্ণাঙ্গ লেখকদের ব্যাপারে কী বলবেন… শ্বেতাঙ্গ সংস্কৃতির আধিপত্যের মধ্যে এবং সেই সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, তাঁরা কী ভাবে লেখালেখি করে থাকেন ?

টনি মরিসন : ভাষার উত্তরণ ঘটিয়ে, অর্থাৎ ভাষাকে উন্মুক্ত করে, অবরুদ্ধ বা সীমাবদ্ধ না রেখে, তার পূর্ণতর প্রকাশ ঘটিয়ে। বিচলিত করে। বর্ণবিদ্বেষী পরিকাঠামোটিকে ভাঙচুর করে। ‘রেসিটাটিফ’ নামে একটি গল্প লিখেছিলাম, অনাথ আশ্রমের দুজন বালিকার কথা, একজন শ্বেতাঙ্গ, আর অন্যজন কৃষ্ণাঙ্গ। তবে পাঠক জানতে পারেন না, সাদা কোন জন আর কালো কোন জন। আমি সঙ্কেত ব্যবহার করেছি, কিন্তু কোনও ধরনের বর্ণনির্ভর সঙ্কেত নয়।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : এটি কি পাঠকদের বিভ্রান্ত করার জন্য ?

টনি মরিসন : তা বলতে পারেন। উস্কানি দেওয়ার জন্য এবং উদ্বুদ্ধ করার জন্য। একটু রগড় করবার জন্যই করা। আলসেমি থেকে, কতগুলো বস্তাপচা ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে আপনি লিখতে বাধ্য হচ্ছেন, এর থেকে চমৎকার ব্যাপার আর কী হতে পারে ? যেই বলব, একজন কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা… অমনি আমাকে মনগড়া কিছু জবাব শোনবার জন্য তৈরি থাকতে হবে, আর যদি সেটি না বলতে চাই, তা হলে অনেক ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে একজন ব্যক্তি হিসেবে ওকে তুলে ধরতে হবে।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : কৃষ্ণাঙ্গ একজন মহিলা দোকান থেকে বেরিয়ে এলেন―এই কথাটা আপনি কেন বলতে চাইবেন না ?

টনি মরিসন : হ্যাঁ, বলা যেতেই পারে, তাহলে মহিলাটি যে কৃষ্ণাঙ্গ সেটিই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়বে।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : ‘দ্য কনফেশন অফ ন্যাট টার্নার’৩ নিয়ে কী বলবেন ?

টনি মরিসন : ভাল কথা, এখানে অত্যন্ত আত্মসচেতন একটি চরিত্রকে আমরা পেয়েছি যিনি এই ধরনের কথা বলে থাকেন―আমার কালো হাতটির দিকে তাকালাম, আমি জেগে উঠলাম এবং নিজেকে কালো বলে অনুভব করলাম। এই অনুভূতি বিল স্টাইরনের মনে ভালো করে গেঁথে আছে। ন্যাট টার্নারের ত্বকের আবরণে তা সজীব হয়ে ওঠে… নিজেকে স্বতন্ত্র বলে মনে করেন। ফলে এক স্বতন্ত্র ভাবনা নিয়ে বইটি আমরা পড়ে থাকি, ব্যস, এটুকুই।

৩ কনফেশন অফ ন্যাট টার্নার―উইলিয়াম টার্নারের লেখা একটি উপন্যাস, যেটি ১৯৬৭তে পুলিৎজার পুরস্কার পায়। ন্যাট টার্নার একটি ঐতিহাসিক চরিত্র। দাস বিদ্রোহের পটভূমিতে লেখা। অবশ্য অনেক জায়গাতেই ঐতিহাসিক ঘটনাগুলি সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়নি বলে অভিযোগ করা হয়।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : সেই সময় রীতিমত শোরগোল পড়ে গেছিল, অনেকে মনে করেছিল স্টাইরনের ন্যাট টার্নারকে নিয়ে লেখার কোনও অধিকারই ছিল না।

টনি মরিসন : যা লেখার ইচ্ছে হবে সেটি লেখা ওঁর অধিকারের মধ্যেই পড়ে। বরং তাঁকে অন্য কিছু লেখার পরামর্শ দেওয়াটাই গর্হিত কাজ। যে ব্যাপারটার সমালোচনা ওঁরা করতেই পারতেন, কেউ কেউ করেছনও, সেটি হল, স্টাইরন দেখাতে চেয়েছেন যে ন্যাট টার্নার কালো মানুষদের ঘৃণা করতেন। টার্নারের এই বিতৃষ্ণার প্রকাশ বারবার ঘটেছে  কৃষ্ণাঙ্গদের থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন, দেখাতে চেয়েছেন, উনিই শ্রেষ্ঠতর। অতএব মৌলিক প্রশ্নটা হল ওঁকে কেন সবাই অনুসরণ করবে ? বর্ণবিদ্বেষ যাঁর মজ্জায় মজ্জায়, তিনি আবার কেমন ধরনের নেতা, কালো মানুষরা সেই লেখা পড়বে, সেটি একটু অবাস্তব নয় কি ? যে কোনও শ্বেতাঙ্গ নেতা, যিনি ওদের মরণপণ লড়াইয়ের আহ্বান জানাচ্ছেন, কম করে হলেও ওদের সম্বন্ধে তাঁর আগ্রহ থাকতে হবে এবং কোনওভাবে ওদের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করতে হবে। যে সব সমালোচক বলেছেন যে টার্নার শ্বেতাঙ্গদের মত কথা বলেছেন, ওঁরা এই কথাটাই বলতে চেয়েছেন। বর্ণবৈষম্যের এই দূরত্বটাকেই উপন্যাসে গভীর এবং সুস্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : ‘বিলাভেড’―এর জন্য ক্রীতদাস সম্পর্কিত অনেক কাহিনি নিশ্চয়ই আপনাকে পড়তে হয়েছে ?

টনি মরিসন : তথ্য সংগ্রহের জন্য যে সেগুলি আমি পড়েছি, তা নয়, কারণ আমি জানতাম শ্বেতাঙ্গ মুরুব্বিদের দ্বারা তার সত্যাসত্য যাচাইয়ের ব্যাপার একটি ছিলই, তাছাড়া ওঁরা যতটুকু বলতে চেয়েছেন, তার সবটাই বলে উঠতে পারেননি, কারণ পাঠকশ্রেণিকে চটিয়ে দেওয়ার মতো দুঃসাহস ওঁরা দেখাতে পারেননি; কিছু কিছু ব্যাপারে ওঁদের নীরবই থাকতে হয়েছে। পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে থেকে যতটা ভাল হওয়া যায়, সেটি তাঁরা হয়েছেন এবং যতটা খোলাসা করে বলা যায়, সেটিও বলেছেন, তবে কখনওই বলতে পারেননি, কতটা ভয়ঙ্কর ছিল অবস্থাটা। ওঁরা শুধু বলেছেন, জানেনই তো আপনারা, কতটা ভয়াবহ ছিল ক্রীতদাস প্রথা, আসুন আমরা সকলে এই প্রথার উচ্ছেদ করি, যাতে  জীবনধারণ মসৃণ হয়ে ওঠে। রাখঢাক করেই ওঁদের আখ্যানগুলি বলতে হয়েছে। যদিও আমি এই সব দলিলে চোখ বুলিয়েছি এবং ক্রীতদাস প্রথা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হয়েছি, বিহ্বল হয়েছি, তবু আমি চেয়েছি উপলব্ধিটা বাস্তবসম্মত হোক। ঐতিহাসিকতা থেকে ব্যক্তিকতায় উত্তরণ ঘটাতে চেয়েছি। কী আছে ক্রীতদাস প্রথায় যা একে এতটা অরুচিকর, এতটা ব্যক্তিগত, এতটা উদাসীন, এতটা নিবিড় অথচ এতটাই সর্বজনীন করে তুলেছে, বহুদিন ধরে আমি এই প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি।

এই সব নথি পড়তে পড়তে লক্ষ্য করলাম একটি জিনিসের বারে বারে উল্লেখ আছে, অথচ কখনওই সঠিকভাবে সেটির বর্ণনা দেওয়া হয়নি―বিট ৪। শাস্তি দেওয়ার জন্য জিনিসটা ক্রীতদাসদের মুখে পুরে কথা বলা বন্ধ করে দেওয়া হতো, কিন্তু কাজ চালিয়ে যেতে বাধা সৃষ্টি করত না। জিনিসটা দেখতে কেমন ছিল সেটি জানার জন্য আমি অনেকটা সময় ব্যয় করেছি। এই ধরনের উক্তি প্রায়ই আমাকে পড়তে হয়েছে―জেনিকে বিটটা লাগিয়ে দিলাম, অথবা, ইকুয়ানো বলছে, ‘আমি রান্নাঘরে গেলাম’ আর সেখানে চুল্লির সামনে একজন মহিলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম, আর আমি জিগ্যেস করলাম, কী ওটা ? আর একজন আমাকে বলে দিল ওটা কী, আর তখন আমি বললাম, জীবনে আমি এরকম ভয়ঙ্কর ব্যাপার আর দেখিনি। তবে সত্যি বলতে কী, জিনিসটা কেমন দেখতে তা আন্দাজ করতে পারিনি―ওটা কি ঘোড়ার বিটের মত কিছু, নাকি অন্য কিছু ?

অবশেষে জিনিসটির কয়েকটি নকশা এই দেশের একটি বইতে পেলাম, বইটিতে স্ত্রীর ওপরে স্বামীর নির্যাতনের একটি নথি। দক্ষিণ আমেরিকায়, ব্রাজিলে, বা এই রকম কোনও দেশে, এই ধরনের কিছু স্মারকচিহ্ন রাখা থাকত। কিন্তু এই অনুসন্ধান চালানোর পর্যায়ে, অন্য একটি কথা আমার মনে হল―এই বিটটি, এই জিনিসটি, নির্যাতনের এই মূর্ত রূপটি, ইনকুইজিশন৫ আমল থেকে চলে আসা কোনও নির্যাতন যন্ত্রের বর্তমান উত্তরসূরি নয়তো ? এটাও বুঝেছিলাম, জিনিসটা কিনতে পাওয়া যেত না। দাসদের ওপর ব্যবহারের জন্য বিট ডাকযোগে পাওয়ার বন্দোবস্তও ছিল না। সিয়ার্স৬-এ পাওয়া যায় না। অতএব আপনাকে বানিয়ে নিতে হবে। বাড়ির পেছনের উঠোনে গিয়ে কয়েকটা জিনিস জোড়া দিয়ে তৈরি করে নিতে হবে, তারপরেই সেটি কারও ওপরে প্রয়োগ করা যাবে। তাহলে যিনি নির্মাণ করলেন এবং যাঁকে পরানো হলো, তাঁদের কাছে এই পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে একটি একান্ত নিজস্ব অনুভূতি জড়িয়ে আছে। আমি বুঝতে পারলাম, জিনিসটার বর্ণনা দিলে খুব একটা সুবিধা হবে না; জিনিসটা কেমন ছিল সেটি দেখতে পাওয়ার চেয়ে অনুভব করতে পারাটাই পাঠক-পাঠিকাদের জন্য বেশি জরুরি। এটাও মনে হল বিটকে চালু একটি যন্ত্র হিসেবে কল্পনা করানোটা বেশি প্রয়োজনীয়, দুর্লভ কোনও বস্তু বা একটি ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে উপস্থাপন করার চাইতে। ঠিক একই ভাবে, ক্রীতদাসত্ব কেমন ছিল সেটার ওপর জোর না দিয়ে ক্রীতদাস হওয়ার অনুভূতি কেমন ছিল সেটিই পাঠকের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছি। 

একটি জায়গা আছে যেখানে পল ডি সেঠেকে বলছেন, ‘এই ব্যাপারে আমি কখনও কাউকে কিছু বলিনি’, তবে কখনও কখনও নিজের মনে গুনগুন করেছি। বিট পরালে কেমন লাগে সেটি মেয়েটিকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু দেখা গেল উনি একটি মোরগের কথা বলতে লাগলেন, দিব্বি গেলে বললেন ওটা পরার পর মোরগটা নাকি ওঁর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলেছিল―নিজেকে ওঁর খুব হীন লেগেছিল আর মনে হয়েছিল গামলার ওপর বসে রোদ পোয়াতে থাকা একটি মোরগের মূল্যও ওঁর থেকে বেশি। আরও কয়েক ধরনের অনুভূতির উল্লেখও আমি করেছি, যেমন বারবার থুতু ফেলার ইচ্ছে করা, লোহা চুষতে থাকা, এবং আরও অনেক কিছু; তবে মনে হয়েছিল ওটা দেখতে কেমন সেটি বর্ণনা করার অর্থ হল যে অভিজ্ঞতার দিকে আমি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছি, তার থেকে সরিয়ে আনা, মানে অনুভূতিটা কী ধরনের। এই ধরনের তথ্য ইতিহাসের ফাঁকফোকরে আপনি খুঁজে পেতে পারেন। ইতিহাসের পাতা থেকে এরা হারিয়ে যায়, বা এক ঝলক দেখা দিয়েই মিলিয়ে যায়, বা কেবল মাত্র একটি উল্লেখ হিসেবেই রয়ে যায়। কোনও প্রতিষ্ঠানের মানবিক রূপটি যখন সামনে চলে আসে, ঐতিহাসিক চরিত্রগুলিকে নাম দিয়ে চিহ্নিত করা যায়, একমাত্র তখনই এর খোঁজ মেলে।

৪ বিট (bit)―ঘোড়ার মুখের ভেতরে লাগিয়ে দেওয়া লাগামের লোহার তৈরি একটি অংশ।

৫ ইনকুইজিশন―দ্বাদশ শতকে ইউরোপ এবং দুই আমেরিকা থেকে অবিশ্বাসীদের নিকেশ করা এবং শাস্তি দেওয়ার জন্য ক্যাথলিক চার্চের ভেতরে নির্যাতন কক্ষ। বিবিধ উপকরণের সাহায্যে এই সব অবিশ্বাসীদের নির্যাতন করা হত।

৬ সিয়াস-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি মেল অর্ডার স্টোর (উনবিংশ শতকের শেষদিকে শুরু হয়েছিল)

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : কোনও চরিত্র যখন আপনি সৃষ্টি করেন, সেটি কি সম্পূর্ণভাবে আপনার কল্পনার আশ্রয় নিয়ে করেন ?

টনি মরিসন : যাঁদের আমি চিনি, তাঁদের কাউকেই আমি ব্যবহার করি না। দ্য ব্ল্যুয়েস্ট আই উপন্যাসের কোনও কোনও জায়গায় আমার মায়ের ইশারা ইঙ্গিত আর কথাবার্তা ব্যবহার করেছিলাম, আর সামান্য একটু ভূগোল। এর পরে আর কখনও করিনি। সত্যি বলতে কী, সে ব্যাপারে আমি অত্যন্ত সচেতন। বিশেষ কাউকে মনে রেখে চরিত্র সৃষ্টি করি না। অনেক লেখকই যা করে থাকেন, আমি করি না।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : এরকম করেন কেন ?

টনি মরিসন : শিল্পীরা একটি ব্যাপার খুব অনুভব করেন―বিশেষ করে আলোকচিত্রশিল্পী যাঁরা, এবং যাঁরা লেখালেখি করেন―যে তাঁরা সাকিউবাসের৭ ভূমিকা পালন করে থাকেন কোনও সজীব বস্তু থেকে কিছু আহরণ করা এবং নিজের প্রয়োজনে সেটিকে প্রয়োগ করা। সজীব বস্তুটি বৃক্ষরাজি হতে পারে, বা প্রজাপতির সমাহার, কিংবা মানব সম্প্রদায়ও হতে পারে। অন্যদের জীবনে উঁকি মেরে নিজের প্রয়োজনে জীবনের একটি ক্ষুদ্র প্রতিলিপি তৈরি করে নেওয়া, বেশ বড় বিতর্কের বিষয় এটি, যার ধার্মিক বা  নৈতিক দ্যোতনা থাকতেই পারে।

উপন্যাসে আমার চরিত্রগুলি যখন সম্পূর্ণভাবে উদ্ভাবিত হয়, তখনই নিজেকে পরিপূর্ণ মেধাবী, স্বাধীন এবং উদ্দীপিত বলে মনে হয়। উত্তেজনার অংশ এটি। অথচ চরিত্রগুলো যদি কোনওভাবে বাস্তবচরিত্রের অনুকরণে সৃষ্ট হয়, তাহলে সেটি স্বত্ব লঙ্ঘনের পর্যায়ে পড়েছে বলাই যায়। সেই জীবনটিতে তো সেই ব্যক্তিটির স্বত্ব, তাঁর নিজস্ব অধিকার। উপন্যাসে ব্যবহারের জন্য সেটি কখনওই উপলব্ধ নয়।

৭ সাকিউবাস―লোককাহিনির মহিলা দানব চরিত্র যা প্রাচীন কাল থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত কিংবদন্তি হয়ে থেকেছে যে এরা নারী রূপ ধারণ করে স্বপ্নে দেখা দিয়ে পুরুষদের যৌন সঙ্ঘমে প্রলুব্ধ করে।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : এরকম কি কখনও আপনার মনে হয়েছে যে আপনার চরিত্ররা আপনার থেকে দূরে সরে যাচ্ছ্,ে আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে ?

টনি মরিসন : এদের নিয়ন্ত্রণ আমি নিজের হাতেই রাখি। অত্যন্ত যত্নসহকারে এদের কল্পনা করা হয়।  আমি অনুভব করি আমি যেন এদের সম্পর্কে যতটুকু জানার আছে, সবটাই আমি জানি, এমনকি যেসব কথা আমি লেখায় আনি না―যেমন ওরা কেমনভাবে মাথায় সিঁথে কাটে। ওরা যেন অশরীরী সত্তা। নিজেরা ছাড়া ওদের মনে আর কোনও ভাবনাই নেই, এবং নিজেদের ছাড়া অন্য কোনও ব্যাপারে আগ্রহও নেই। ফলে আপনার পরিবর্তে ওদের দিয়ে উপন্যাসটি লেখাতে আপনি পারবেন না। এমন অনেক বই আমি পড়েছি, যেখানে ঠিক এই ব্যাপারটিই ঘটেছে―যেখানে কোনও একটি চরিত্র ঔপন্যাসিকের নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণরূপে দখল নিয়ে নিয়েছে। আমি বলতে চাইছি, এটি আপনি হতে দিতে পারেন না। যদি ওদের গ্রন্থ রচনার ক্ষমতা থাকতই, তাহলে ওরা নিজেরাই লিখে ফেলত, কিন্তু সেই ক্ষমতা ওদের নেই। আপনার আছে। তাই আপনাকেই বলতে হবে। অতএব দয়া করে মুখ বন্ধ কর, আর দূর হয়ে যাও। কাজটি আমিই করে নেব। 

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : কখনও কি আপনার চরিত্রদের মুখ বন্ধ রাখার জন্য বলতে হয়েছে ?

টনি মরিসন : পাইলেট৮―আমাকে বলতে হয়েছিল। ফলে ও খুব বেশি কথা বলেনি। দুই ছেলের সঙ্গে ওর দীর্ঘ একটি বার্তালাপ রয়েছে, আর মাঝে মাঝেই ওকে কিছু না কিছু বলতে হবে, কিন্তু অন্যদের জন্য যে সংলাপ রয়েছে, সেটি ওর নেই। সেই কাজটি আমাকেই করতে হল, না হলে ও সবাইকে বিহ্বল করে ফেলত। ক্রমে বেশ আকর্ষণীয় চরিত্র হয়ে উঠছিল ও; এরকম কাজ চরিত্ররা একটু-আধটু করতেই পারে। আমাকে রাশ ধরতে হয়।  উপন্যাসটি আমিই  লিখছি; আর সেই উপন্যাসটির নাম ‘পাইলেট’ নয়।  

৮ পাইলেট―টনি মরিসনের সং অফ সলমন উপন্যাসের একটি স্ত্রী চরিত্র।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : কত দৃঢ় চরিত্র এই পাইলেট। আমার মনে হয়, আপনার উপন্যাসে স্ত্রী চরিত্ররা প্রায় সময়েই পুরুষদের চেয়ে বেশি দৃঢ়, বেশি সাহসী হয়। এরকম কেন ?

টনি মরিসন : কথাটি মোটেই ঠিক নয়, তবে এরকম কথা প্রায়ই আমাকে শুনতে হয়। মনে হয় যেন নারীদের কাছ থেকে আমাদের প্রত্যাশা অত্যন্ত কম। তিরিশদিন মেয়েরা শিরদাঁড়া উঁচু করে দাঁড়ালেই, সবাই হাততালি দিয়ে বলবে, বাহবা! কী সাহসী! সত্যি বলতে কী, কেউ একজন সেঠে৯কে নিয়ে লিখেছিলেন, বলেছিলেন এমন দৃঢ়চেতা, এমন মহিমাময় একজন নারী মানবী হতেই পারে না। কিন্তু বইটির শেষের দিকে ও ঘাড় ঘোরানোর ক্ষমতাটিও হারিয়ে ফেলে। জড়িয়ে ধরে ওকে; খাবারটুকুও মুখে তুলতে পারে না। এই অবস্থাকে কি শক্ত বলা যায় ?

৯ সেঠে―বিলাভেড উপন্যাসের একটি গর্বিত এবং মহৎ নারী চরিত্র।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : অনেকেই উপন্যাসটি সেভাবেই পড়েছেন, কারণ বিলাভেড-এর গলা চিরে দেওয়াকে ওঁরা একটি কঠিন বিকল্প বাছাই করা হিসেবেই দেখেছেন। ওঁরা হয়ত মনে করেছেন সেটিই ওর দৃঢ়তার পরিচয়। কেউ কেউ হয়ত বলবেন সেটি নেহায়েৎই অশিষ্ট আচরণ।

টনি মরিসন : বেশ কথা, কিন্তু বিলাভেড নিশ্চয়ই এটিকে কঠিন ব্যাপার মনে করেনি। ও এটিকে পাগলামি বলেই ভেবেছে। কিংবা আরও একটু স্পষ্টাস্পষ্টি, তুমি কী ভাবে জানলে যে মৃত্যুই বেশি ভালো আমার জন্য ? তোমার তো মৃত্যু হয়নি। তাহলে তুমি কী করে জানলে ? কিন্তু আমার মনে হয়, পল ডি, সান, স্ট্যাম্প পেড, এমনকি গিটার পর্যন্ত সমান কঠিন বিকল্প বেছে নিয়েছিল; ওদের একটি নীতিগত অবস্থান ছিল। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে নারী কথার বদলে কথা বলে না বা দুর্বলের অস্ত্রই কেবল প্রয়োগ করে থাকে, কেবল সেরকম নারীকেই আমরা দেখতে অভ্যস্ত। 

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : দুর্বলের অস্ত্র কী কী ?

টনি মরিসন : প্যানপ্যান করা। বিষ খাওয়ানো। পরচর্চা। রুখে দাঁড়ানোর বদলে আড়ি পেতে শোনা।

এলিসা শ্যাপেল এবং  ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : মহিলাদের একে অপরের মধ্যে নিবিড় বন্ধুত্বের কথা খুব কম উপন্যাসেই পাওয়া যায়। এর কারণ কী আপনার মতে ?

টনি মরিসন : এক প্রকারের অসম্মানজনক ঘনিষ্ঠতা হিসেবেই একে ধরে নেওয়া হয়েছে। যখন ‘সুলা’ রচনা করছিলাম, আমার ধারণা হয়েছিল মহিলা জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশের কাছে একজন মহিলার সঙ্গে বন্ধুত্ব একটি গৌণ সম্পর্ক হিসেবেই থেকে যায়। পুরুষ আর নারীর মধ্যকার সম্পর্কটিই প্রাথমিকতা পায়। একজন পুরুষের অনুপস্থিতিতে, মহিলারা, আপনার নিজস্ব বন্ধুবৃত্তেও, কেবল একটি গৌণ সম্পর্ক হিসেবেই থেকে যায়। আর ঠিক এই কারণেই এমন একটি মহিলাবৃত্তের সৃষ্টি হয়েছে যারা মহিলাদের বন্ধু হিসেবে পছন্দ করে না, বরং পুরুষমানুষদের সঙ্গে বন্ধুত্ব এদের কাছে বেশি পছন্দের। একে অপরকে পছন্দ করার ব্যাপারটি আমাদের শিখতে হবে। গং. পত্রিকাটির প্রবর্তনের পেছনে যুক্তি ছিল যে আমাদের একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা, ঘৃণা করা, একে অপরের সঙ্গে লড়াই করা, এবং পুরুষমানুষদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিজেদেরই নিন্দা করতে থাকা―অধীনস্থ মানুষ যা যা করে অভ্যস্ত―এই সব  বন্ধ করা খুব দরকার। খুব জরুরি শিক্ষা এটি। অধিকাংশ সাহিত্যই যখন এরকমই ছিল―মহিলাদের সহাবস্থানের কাহিনি যখন আপনি পড়েন (মহিলা সমকামীদের কথা বা যে সব সহাবস্থানের গূঢ় উদ্দেশ্য মহিলা সমকাম, যেমন ভার্জিনিয়া উলফের লেখায় পাওয়া যায়, তাদের বাদ দিয়ে), সেটি আসলে স্পষ্টতই মহিলাদের সহাবস্থান নিয়ে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। এগুলি সাধারণত পৌরুষ ভাবনায় প্রভাবিত―হেনরি জেমসের কিছু চরিত্রের মত―বা নারীরা পুরুষদের নিয়ে যে ধরনের কথা বলাবলি করে, জেন অস্টেনের বান্ধবীদের মত… কোন্ ছেলেটার বিয়ে হল, কী করে বিয়ে হল, তাহলে কি ছেলেটা তোর জীবন থেকে হারিয়েই গেল, মনে হয় মেয়েটা ওকেই বিয়ে করতে চায়, এই সব গালগল্প। সেই ১৯৭১ সালে সুলা প্রকাশিত হওয়ার সময় স্বাভাবিক যৌনপ্রবৃত্তির (heterosexual/ বিষমকামী) মেয়েরা, যারা একে অপরের বন্ধু, নিজেদের মধ্যে কেবল নিজেদের নিয়েই কথা বলছে, আমার কাছে বিষয়টি খুবই ব্যতিক্রমী বলে মনে হয়েছিল, আজকাল অবশ্য তেমন ব্যতিক্রমী বলে মনে হবে না। 

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : ধীরে ধীরে স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে।

টনি মরিসন : হ্যাঁ, কিছুটা একঘেঁয়ে হয়েই উঠছে। বিষয়টা নিয়ে ঠিক বাড়াবাড়ি করা হবে আর খুব স্বাভাবিকভাবেই মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : আপনারা, লেখকেরা, যৌনতা নিয়ে লিখতে এত সংশয় বোধ করেন কেন ?

টনি মরিসন : যৌনতা নিয়ে লেখা কঠিন কারণ তাতে যৌন আকর্ষণ বলতে গেলে থাকেই না। যৌনতা নিয়ে কিছু লেখার একটি মাত্র রাস্তা হল যতটা কম লিখে পারা যায়। লেখনীর মধ্যে পাঠককে নিজের যৌন আবেদন নিজেকেই খুঁজে নিতে দেওয়া হোক। যে লেখক যৌনতা শুধু মাত্র ইশারায় নিজের লেখায় নিয়ে আসেন, সাধারণত আমি সেই লেখকের সম্বন্ধেই উচ্চধারণা পোষণ করি। বর্ণনাটা বড় বেশি বিশদ হয়ে পড়ে। ধরুন আপনি বলতে শুরু করলেন ‘-এর বাঁক’ একটু পরে মনে হবে আপনি বুঝি একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। একমাত্র জয়েসই পার পেয়ে গেছেন। সব রকম নিষিদ্ধ শব্দ ব্যবহার করে গেছেন। উনি cunt কথাটা বললেন, বেশ বড় একটি ধাক্কা। নিষিদ্ধ শব্দগুলো বেশ উত্তেজক হতে পারে। তবে কিছুক্ষণ পরে একঘেয়ে হয়ে যায়, উত্তেজক থাকে না। স্বল্পভাষিতা সর্বদাই অধিকতর বাঞ্ছনীয়। কিছু কিছু লেখক মনে করেন নোংরা শব্দ ব্যবহার করেই কেল্লা ফতে করে ফেলবেন। অল্প কিছুদিনের জন্য এতে কাজ হতে পারে, কিংবা কিংবা কৈশোরের কল্পনাপ্রবণ মনে দাগ কাটতে পারে, কিন্তু তারপরে ব্যাপারটি আর সাড়া জাগায় না। সেঠে আর পল ডি’র প্রথম যখন দেখা হল, মোটামুটি আধ পৃষ্ঠার মধ্যে ওদের শারীরিক মিলন হয়ে গেল নিতান্ত আচমকাই, আর সেটিকে খুব তৃপ্তিদায়কও বলা যায় না―খুব দ্রুত হল ব্যাপারটি, আর নিজেরাও এর জন্য অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল―তারপর ওরা পাশাপাশি শুয়েও ভান করার চেষ্টা করল যে ওরা বিছানায় শুয়ে নেই, যেন ওদের দেখাই হয়নি, তারপর ওরা ভিন্ন ভিন্ন কথা ভাবতে লাগল, পরে ওদের ভাবনাগুলো মিলেমিশে যেতে লাগল, কোনটা কার ভাবনা সেটি আপনি আলাদা করে বলতে পারবেন না। আমার মনে হয় এই মিলেমিশে যাওয়াটা, আমি যদি শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বর্ণনা দিতে শুরু করতাম তার চেয়ে কৌশলগতভাবে অনেক বেশি কামোদ্দীপক।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : প্লট সম্বন্ধে কী বলবেন ? আপনার গন্তব্য কি আগে থাকতেই জানা থাকে ? কাহিনির শেষে পৌঁছনোর আগেই কি শেষ দৃশ্য লিখে ফেলেন ?

টনি মরিসন : কী হতে পারে সেটি যদি বাস্তবিকই জানা থাকে, তাহলে শেষ দৃশ্য আমি লিখে ফেলতে পারি। বিলাভেড-এর শেষটা আমি লিখে ফেলেছিলাম যখন সবে উপন্যাসটার এক-চতুর্থাংশ লেখা হয়েছে। জাজ-এর শেষটা বেশ আগেভাগেই লিখেছিলাম আর সং অফ সলমন-এর শেষটাও একেবারে গোড়ার দিকে লেখা। প্লটের জন্য আমার প্রয়োজনটা আসলে কীভাবে হল সেটি জানা। এক দিক ঠিক একটি গোয়েন্দা গল্পের মতোই বলা যেতে পারে। কে মারা গেছে আপনার জানা, কে মারল সেটি আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে। মৌলিক ঘটনাটি আপনি সামনে তুলে ধরলেন, পাঠক কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইবেন কীভাবে ঘটনাটি ঘটল। কে করল এবং কেন ? বিশেষ ধরনের ভাষার প্রয়োগে আপনি বাধ্য হবেন যাতে পাঠকের মনে সেই সব প্রশ্ন উঠে আসে। জাজ উপন্যাসে, আগের দ্য ব্ল্যুয়েস্ট আই উপন্যাসে যেমন করেছিলাম, সম্পূর্ণ প্লটটা প্রথম পাতাতেই দিয়ে দিয়েছিলাম। সত্যি কথা বলতে কী, প্রথম সংস্করণে প্লটটা মলাটেই দেওয়া হয়েছিল, যাতে বইয়ের দোকানেই ক্রেতা মলাটে সেটি পড়ে বইটির বিষয়বস্তু বুঝে নিতে পারেন, আর সেরকম মনে হলে, ওই বইটি বাতিল করে অন্য কোনও বই কিনতে পারেন। জাজ-এর জন্য এটি একটি যথার্থ কৌশল বলে মনে হয়েছিল, কারণ উপন্যাসটির প্লটের কথা আমার মাথায় ছিল, ত্রয়ী এই উপন্যাসে স্বরমাধুর্য সৃষ্টি করে, একটি স্বরমাধুর্যকে অনুসরণ করাটাই সংগত―যখনই কথক সেই মাধুর্যে ফিরে আসেন, সেটি অনুভব করার তৃপ্তি পাওয়া যায়। এটিই আমার ভাবনার কাক্সিক্ষত নান্দনিক রূপ―বারে বারে স্বরমাধুর্যে আঘাত হানা, অন্যের চোখ দিয়ে একে যাচাই করে নেওয়া, প্রত্যেকবার নতুন করে একে পাওয়া, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ছন্দটি নিয়ে খেলা করা।

কেথ জ্যারেট যখন ‘ওল’ ম্যান রিভার’ পরিবেশন করেন, গানটির সুর থেকে আমরা ততটা তৃপ্তি এবং আনন্দ লাভ করি না, যতটা না সুরটির ভেসে ওঠা এবং অন্তরালে চলে যাওয়াটি অনুভব করতে পেরে লাভ করি, আর যখন সেটি সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায়, সেই শূন্য আসনে যার স্থান হল, তাকে উপলব্ধি করে। গানের মূল কথাগুলো আমাদের ততটা আকর্ষণ করে না, যত না ব্যারেট পরিবেশিত সঙ্গীতের চড়াই উতরাই আর বিভিন্ন মাত্রার প্রতিধ্বনি করে। জাজ-এর প্লটে আমি এরকমই কিছু একটি আনতে চাইছিলাম। আমি চেয়েছিলাম কাহিনিটি প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত টেনে রাখবে, কিন্তু পরিপূর্ণ আনন্দ লাভ করতে হলে কাহিনি থেকে বেরিয়ে এসে চারপাশে চোখ বোলাতে হবে, আবার কাহিনিতে ফিরে গিয়ে তার মধ্য দিয়েও লক্ষ্য করতে হবে, ঠিক যেমন তিন পলা কাঁচের ভেতর দিয়ে দৃশ্যপট অবিরাম বদলে যেতে থাকে।

যে সমস্ত পাঠক কাহিনিটির মাধুর্যটুকুই কেবল উপভোগ করতে চেয়েছিলেন, যাঁরা শুধু জানতে চেয়েছিলেন কী ঘটেছিল, কার দ্বারা ঘটেছিল এবং কেন, জাজ-এর এই সতত সঞ্চরণশীলতা তাঁদের ভাল লাগেনি। কিন্তু আমার কাছে এই জাজ-সদৃশ কাঠামোটিতে গৌণ কোনও ব্যাপার ছিল না, বরং এর সঙ্গে জড়িয়েছিল বইটির অস্তিত্বের প্রশ্নটিও। কথকের প্লটটি পরিবেশন করার এই পরীক্ষামূলক প্রক্রিয়াটি আমার কাছে ঠিক ততখানিই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যতখানি গল্পটি বলতে গিয়ে আমি রোমাঞ্চিত বোধ করেছিলাম। 

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : বিলাভেড-এও প্লটটা আপনি বেশ আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন।

টনি মরিসন : আমার মনে হয়েছিল বিলাভেড-এর গর্হিত কর্মটি―শিশু হত্যার ঘটনাটি―অবিলম্বে জানা উচিত, তবে এই ব্যাপারে বিস্তৃত আলোকপাতকে বিলম্বিত করা হয়েছিল, অগোচরে রাখা হয়েছিল। এই ঘটনার সম্পূর্ণ তথ্য এবং এর পরিণাম কী হতে পারে সেটি আমি পাঠকদের সামনে মেলে ধরতে চেয়েছি, কেবল ঘটনার হিংসাত্মক দিকটি থেকে নিজেকে এবং পাঠকদের সরিয়ে রেখেছি। মনে আছে সেঠের শিশুটির গলা কেটে দেওয়া নিয়ে বাক্যটি আমি উপন্যাসটি লেখার সময়, অনেক, অনেক পরে লিখেছি। মনে আছে আমি টেবিল ছেড়ে উঠে বাইরে গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে পায়চারি করেছি―উঠানে গিয়ে এক পাক লাগিয়ে ফিরে এসে সামান্য কিছু পরিমার্জন করে আবার বাইরে চলে এসেছি, বাক্যটি বার বার নতুন করে লিখেছি প্রতিবার মনে হচ্ছে বাক্যটি এবার ঠিকঠাক লাগছে, অন্তত তখন সেরকমই মনে হয়েছে আমার, কিন্তু তারপরেই আমার পক্ষে বসে থাকাটা অসম্ভব হয়ে পড়ত আর আমাকে আবার উঠে গিয়ে আবার ফিরে আসতে হত। আমার মনে হয়েছে হিংসাটি কেবল ধামাচাপা দেওয়াই যথেষ্ট নয়, যা বলার, অস্পষ্ট করে বলতে হবে। কারণ ভাষা যদি হিংসার প্রতিস্পর্ধী হয়ে ওঠে তবে সেটি হবে অশ্রাব্য, অশ্লীল।  

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : বোঝা যাচ্ছে লেখন-শৈলী আপনার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাজ-এর ব্যাপারে এটি নিয়ে কিছু আলোকপাত করতে পারেন ? 

টনি মরিসন : শ্রোতাদের সঙ্গে একজন গায়ক যে অনুভূতি ভাগাভাগি করে নেন, জাজ উপন্যাসে আমি ঠিক সেটিই করতে চেয়েছি―অনুভব করানোর মত আরও কিছু আছে, তবে সবটুকু ভাগাভাগি করা থেকে নিজেকে বিরত রাখলাম। একটি সংযত প্রয়াস বলা যেতে পারে, খানিকটা ধরে রাখা হলো―নেই বলে নয়, বা ফুরিয়ে গেছে বলে নয়, বরং সেটি সুষমামণ্ডিত বলে, সেটির পুনরাবৃত্তি করা যেতে পারে বলে। কখন থেমে যেতে হবে এটি উপলব্ধি করতে পারাটি শিখে নিতে হয়, আমি সর্বদাই যে উপলব্ধি করে উঠতে পারি, তা বলতে পারি না। খুব সম্ভবত, সং অফ সলমন লেখার আগে পর্যন্ত কল্পনা এবং ভাষার ব্যবহারে মিতব্যয়ী হতে পেরেছি এরকম আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়নি। জাজ উপন্যাসটি লেখবার সময় যা কিছু কল্পিত এবং কৃত্রিম তার সঙ্গে উদ্ভাবনকে মিশ খাওয়ানোর ব্যাপারে আমি বেশ সতর্ক ছিলাম। নিজেকে একজন জাজ গায়ক হিসেবে কল্পনা করে নিতাম―যে কিনা অনুশীলন করতেই থাকত, করতেই থাকত যাতে তার আপন শৈলী আবিষ্কার করতে সক্ষম হয় এবং সেটি অনায়াসসাধ্য আর সুষমামণ্ডিত বলে মনে হয়। লেখন প্রক্রিয়ার নির্মাণের দিক সম্বন্ধে আমি সর্বদাই সচেতন ছিলাম আর লেখাটি যাতে আনুষ্ঠানিক গড়ন ভেদ করে সহজ এবং মার্জিত হয়ে ওঠে, তার জন্য নিয়মিত অনুশীলন করতে থাকতাম। বাকসংযম নিয়মিত  অভ্যাসের দ্বারাই গড়ে তোলা যায়, আর তখনই আপনি অপব্যয়ের বিলাস সম্বন্ধে সচেতন হতে পারেন―আপনার মনে হবে অপব্যয় করবার মত অতুল সম্পদ আপনার আছে, যা আপনি নিজের কাছেই ধরে রাখলেন―কোনও রকম অপব্যয় না করেই। আত্মশ্লাঘায় মজে যাবেন না, অতি অল্পেই তুষ্ট হয়ে যাবেন না। কোনও সৃজনকার্য সমাধা হবার পরে প্রতিবারই আমি তৃষ্ণার্ত বোধ করেছি―আরও বেশি কিছু পাওয়ার এক আকুলতা―যেটি আরও অনেক অনেক বেশি প্রগাঢ়। অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে এক ধরনের তৃপ্তিও পেয়েছি, বুঝেছি ভবিষ্যতে আরও বেশি করে পাওয়ার আশা করা যায়, কারণ যে কোনও শিল্পীসত্তার মধ্যে উদ্ভাবনের অসীম সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকে।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : অন্য কোনও ধরনের… উপাদান, পরিকাঠামোগত অস্তিত্ব আছে কি ?

টনি মরিসন : দেখুন, আমার মনে হয়, অভিবাসন আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। আমি আবার এসব ব্যাপারে খুবই অনুভূতিপ্রবণ―আমার ধারণা সেই জন্যই আমি উপন্যাস লিখি―আমার মনে হয় গৃহযুদ্ধপরবর্তী সময়ে বৈপ্লবিক এবং নবীন কিছু পরিবর্তন ঘটে গেছিল। বেশ অনেক কিছুরই আমূল পরিবর্তন ঘটেছিল, কিন্তু সেই যুগটিতে প্রাক্তন ক্রীতদাসদের ওপর দাবি ত্যাগের এবং বেদখলের একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছিল। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এই সব প্রাক্তন ক্রীতদাসদের স্থানীয় শ্রমবাজারে গ্রহণ করা হয়েছিল, কিন্তু নিজেদের নানা ধরনের সমস্যার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য অনেকেই এরা শহরে চলে গেছিল। আমি অবাক হয়ে ভাবতাম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় প্রজন্মের এই সমস্ত প্রাক্তন ক্রীতদাসেরা, যারা গ্রামাঞ্চলে নিজেদের লোকদের সঙ্গে থেকেই অভ্যস্ত, তাদের কাছে শহুরে জীবন কী মাহাত্ম্য নিয়ে ধরা দিত। নিশ্চয়ই মনে করেছিল যে শহর হবে অত্যন্ত প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর অসাধারণ একটি বাসযোগ্য স্থান।

শহরের কাজ কারবার কীভাবে চলে আমার সেটি জানার আগ্রহ ছিল। নিজের নিজের বৃত্তের মধ্যে কীভাবে একটি শ্রেণি, একটি গোষ্ঠী, বা একটি সম্প্রদায় সংখ্যাগতভাবে নিজেদের সুরক্ষাবলয় তৈরি করে নেয়, তাছাড়া এটি জেনেও রোমাঞ্চ বোধ করলাম যে এরকম একাধিক বৃত্ত বা অঞ্চলের অস্তিত্ব আছে, এবং জনতার এই ভিড়ে নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়ার জাদু আর শিহরণও বাস্তবে উপলব্ধি করতে পারলাম।  কীভাবে দেশে সঙ্গীতের বিবর্তন ঘটেছে সেটাও খুব জানার ইচ্ছে হল। আধ্যাত্মিক, ধার্মিক এবং ব্ল্যু ধারার সংগীতের মাধ্যমে ক্রীতদাসত্ব প্রথা নিয়ে প্রতিস্পন্দন মূর্ত হয়ে উঠেছে―পরিত্রাণ পাবার আকুতির সাংকেতিক ভাষা খুঁজে পেয়েছে।

ব্যক্তিগত জীবনচর্যা নিয়েও আমার জিজ্ঞাসা কম নয়। একজন মানুষ অপর একজন মানুষকে কীভাবে ভালোবাসে ? মুক্তি বলতে ওরা কী বোঝে ? সেই সময়টিতে, প্রাক্তন ক্রীতদাসেরা যখন শহরে গিয়ে ভিড় জমাচ্ছে, এমন একটি ব্যাপার থেকে পালিয়ে যেতে চাইছে যা এতদিন ওদের রুদ্ধ করে রেখেছিল, মৃত্যুর কারণ হচ্ছিল, বারে বারে অধিকার ছিনিয়ে নিচ্ছিল, তার থেকে―সেই সময় ওদের পরিমণ্ডল ছিল অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ। যখন ওদের সংগীত আপনি শুনবেন―জাজ সংগীতের শুরুতে―আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন ওরা ভিন্ন কিছু বলার চেষ্টা করছে। ভালবাসার কথা বলছে, পরাজয়ের কথা বলছে। অথচ গানের কথাগুলির মধ্যে এমন চমৎকারিত্ব লুকিয়ে আছে, এমনভাবে মন ভরিয়ে দেয়, ওরা সুখী নয়―কেউ না কেউ চিরবিদায় নিচ্ছে―অথচ ওরা বিলাপে ভরিয়ে তুলছে না। কাউকে আপন করে নেওয়া, লোকসানের সম্ভাবনা সত্ত্বেও ভালবাসতে পারা, আবেগে আপ্লুত হওয়া, কামনাবাসনার আকাক্সক্ষা, আর তারপরে সব কিছু হারিয়ে ফেলা, কিছুই যেন এসে যায় না, কারণ পছন্দটা তো ওদেরই একান্ত। ভালবাসার মানুষটিকে পছন্দ করে নেওয়াটা কিন্তু বেশ বড় একটি ব্যাপার। আর সংগীতের মাধ্যমে প্রেম তার পরিসর তৈরি করে নেয়, যেখানে মানুষ মুক্তিলাভের জন্য সংগ্রাম করতে পারে।

খুব স্বাভাবিকভাবেই, সমস্ত নতুন ধারার সংগীতের মতই, জাজকে আসুরিক সংগীত বলেই মনে করা হতো; বড় বেশি ইন্দ্রিয়পরায়ণ, বড় বেশি উস্কানিমূলক, এবং আরও অনেক কিছু। কিন্তু কিছু কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের কাজে জাজ মানে হল নিজের গতরের স্বত্ব দাবি করা। একবার কল্পনা করুন তাদের মনের অবস্থাটা, যাদের নিজেদের গতরের মালিক তারা নিজেরা নয়, যারা আশৈশব দাসত্বের বন্ধনে বাঁধা, বা যাদের স্মৃতিতে তাদের বাবা-মায়ের পরিচয় ক্রীতদাস হিসেবেই। ব্ল্যু আর জাজ সংগীত আবেগের ওপর ওদের নিজস্ব সত্তা প্রতিষ্ঠার প্রতীক। প্রকাশভঙ্গি অবশ্যই একটু বাড়াবাড়ি রকমের প্রখর―বিয়োগান্ত সমাপ্তিতেই তৃপ্তি, যেন মিলনান্তক হলে এর আকর্ষণ, এর নৈপুণ্য, অনেকটাই মলিন হয়ে যাবে। বিজ্ঞাপনদাতারা টেলিভিশনে আজকাল জাজের ব্যবহার করেন আধুনিকতা এবং প্রামাণিকতা প্রতিষ্ঠা করেন, যেন বলতে চান, ‘ভরসা করতে পার আমায়’, বলতে চান, ‘ফ্যাশনদুরস্ত’। এখনও শহরে জাজের যুগে উত্তেজনার যে মাত্রা ছিল, তাতে ভাটা পড়েনি―কেবল এই উত্তেজনাকে আমরা সম্পূর্ণ নতুন এক ধরনের বিপত্তির সঙ্গে জুড়ে দিয়েছি। গৃহহীনদের নিয়ে আমরা গান গাই, গলা খুলে চেঁচাই, অধীর হয়ে পড়ি; বলি আমাদের পথটা ছেড়ে দাও; গৃহহীনতার অসহায় চেতনা থেকে বলি, গৃহহীনতাকে মোকাবেলা করার কৌশল হিসেবে বলি, যাতে অন্তত নাগরিক জীবনের আস্বাদটা আমরাও নিতে পারি। শহরে বাস করার অনিবার্য শর্ত হল অনির্দেশ্য, বহিরাগত, আজব, এবং হিংস্র শক্তির মোকাবেলা করার এবং টিকে যাওয়ার জন্য আমাদের কাছে ঢাল, তরোয়াল, শক্তি, বলিষ্ঠতা এবং বুদ্ধিমত্তা আছে  এটি ধরে নেওয়া। মানুষ যখন গৃহহীনতা নিয়ে ‘অভিযোগ’ করে, ওরা আসলে সেটি বড়াই করে বলে―নিউ ইয়র্কে স্যান ফ্র্যানসিস্কো থেকে গৃহহীনদের সংখ্যা বেশি। আরে কী যে বল, স্যান ফ্র্যানসিস্কোতে অনেক বেশি গৃহহীন।  তুমি তো আবার কখনও ডেট্রয়েট যাওনি। আসলে আমরা প্রায় রেশারেশির পর্যায়ে পৌঁছে গেছি এটি বোঝাতে যে দেখ আমাদের সহ্য ক্ষমতা কত বেশি, আমার মতে গৃহহীনতাকে এমন সহজে স্বীকার করে নেওয়ার পেছনে এটি বড় একটি কারণ।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : অর্থাৎ শহর প্রাক্তন ক্রীতদাসদের  ইতিহাসের পিছুটান থেকে মুক্তি দিয়েছে ?

টনি মরিসন : আংশিকভাবে কথাটা ঠিক। অতীত ভুলিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় শহর, তাই এত আকর্ষণীয়।  শহর মুক্তির সম্ভাবনা নিয়ে হাতছানি দেয়―মানে ইতিহাসের পিছুটান থেকে মুক্তি। যে ইতিহাস আচ্ছন্ন করে রাখে, গতিরুদ্ধ করে, সেই ইতিহাস আবদ্ধ হয়ে থাকাটা যদিও কাম্য নয়, তবে তাকে সম্পূর্ণ বিস্মৃত হওয়াটাও ঠিক নয়। এর সমালোচনা কর, যাচাই কর, মুখোমুখি হও এবং বোঝার চেষ্টা কর যাতে কেবল অনুমতি পাওয়া নয়, সত্যিকারের স্বাধীনতা পাওয়া যায়, প্রকৃত প্রাপ্তব্যবহারের কর্তৃত্ব অর্জন করা যায়। শহুরে প্রলোভনকে অগ্রাহ্য করে যদি তুমি এর ভেতরে ঢুকতে পার, তাহলেই তোমার নিজের ইতিহাসের মুখোমুখি হতে পারবে―অপ্রয়োজনীয় অংশগুলো ভুলে যেতে পারবে আর প্রয়োজনীয় অংশকে কাজে লাগাতে―প্রকৃত কর্তৃত্ব অর্জন তখনই সম্ভব।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : চাক্ষুষ দৃশ্য আপনাকে কতখানি প্রভাবিত করে ?

টনি মরিসন : সং অফ সলমন-এর একটি দৃশ্য বর্ণনা করতে আমার অসুবিধে হচ্ছিল একটি মানুষ তার দায়িত্ব এবং নিজের থেকে পালানোর চেষ্টা করছে। এডভার্ড মুঙ্খ১০-এর একটি পেন্টিংকে হুবহু কাজে লাগিয়েছিলাম।  মানুষটি রাস্তার এক পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, ওর পাশে কেউ নেই। বাকিরা রাস্তার অন্য ধারে।

১০ এডভার্ড মুঙ্খ―একজন নরওয়েজিয়ান পেন্টার।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : আপনার অন্যান্য উপন্যাসের―যেমন বিলাভেড, যেটি সিপিয়া-টোনড―তুলনায় সং অফ সলমন অসাধারণভাবে অলঙ্কৃত।

টনি মরিসন : অংশত এর কারণ হল, ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে, মেয়েরা, বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েরা, সাধারণভাবে উজ্জ্বল রঙের পোশাকের প্রতি আকর্ষিত হয়―এই ব্যাপারে আমি সচেতন থাকায় আমার মনে কিছু কল্পদৃশ্য ভেসে উঠত।  অধিকাংশ মানুষই অবশ্য রঙ সম্বন্ধে ভীতিকর ধারণাই পোষণ করেন।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : কিন্তু কেন ?

টনি মরিসন : এমনিই। ওদের রুচিতে অনুগ্র রঙকেই মার্জিত বলে মনে করা হয়। পশ্চিমের সংস্কৃতিবান মানুষ কখনওই টকটকে লাল রঙের কাপড় বা বাসন কিনবে না। আমি যা বলতে চাইছি, সেটি ছাড়া আরও কোনও কথা থাকতে পারে। কিন্তু ক্রীতদাস গোষ্ঠীর কাছে রঙের পছন্দ বা অপছন্দের সুযোগই ছিল না, কারণ ওরা পরত ক্রীতদাসদের পোশাক, বা মালিকদের বাতিল করে দেওয়া পোশাক বা বস্তা বা পাটের কাপড় থেকে তৈরি কাজ করবার পোশাক। ফলে ওদের কাছে রঙিন পোশাক মানে সেটিকে দৃষ্টি আকর্ষক হতে হবে; কাপড়ের গুণমান নিয়ে ওদের কোনও মাথাব্যথাই ছিল না, লাল বা হলুদ রঙের পোশাক হলেই চলত। বিলাভেড থেকে রঙের ব্যাপারটি আমি হঠিয়ে দিয়েছি, ফলে শেঠের পাগলের মত ছুটে গিয়ে ফিতে আর ধনুক কিনে, সেই সব রঙ দেখে বাচ্চাদের মত উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ার মতো মুহূর্তগুলো খুব বেশি একটি নেই।  ক্রীতদাস ব্যবস্থা এতদিন ধরে চলতে পারার পেছনে রঙের বিশেষ একটি ভূমিকা আছে। ব্যাপারটি ঠিক এরকম নয় যে একদল কয়েদি সেজেগুজে আপনার চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে গেল। না, তা নয়, এদের গায়ের রঙই এদের চিহ্নিত করে দেবে, চেহারার অন্যান্য বৈশিষ্টও। অতএব চিহ্নিতকরণের ব্যাপারে রঙের একটি বিশেষ গুরুত্ব আছে। বেবি সাগস স্বপ্নে রঙ দেখে আর চেঁচিয়ে উঠে বলে, ‘আমাকে একটু ল্যাভেন্ডার এনে দাও।’ এক ধরনের বিলাস বলতে পারেন একে। রঙ আর দৃশ্যমানতা আমাদের এমন করেই প্লাবিত করে রেখেছে।  আমি শুধু সেটাকেই টেনে সরিয়ে দিয়েছি, যাতে অতৃপ্তি আর আনন্দের স্বাদ অনুভব করাতে পারি। সং অফ সলমন-এর মত চিত্রায়িত বই হলে সেটি আমি করতে পারতাম না।  

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : এটিকেই কি আপনি একটি নিয়ামক ভাবমূর্তির প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছেন ? 

টনি মরিসন : কখনও কখনও তাই। সং অফ সলমনে  তিন চার রকমের আছে, উপন্যাসটি চিত্রায়িত হয়ে উঠুক এটাই আমার ইচ্ছে ছিল, আর তাই এর শুরুটা লাল, সাদা আর নীল হোক সেটিই চেয়েছিলাম। এটাও জানতাম কোনও না কোনও অনুষঙ্গে  ওকে ‘উড়তে’ হতে পারে। সং অফ সলমনে প্রথমবার একটি চরিত্রকে নিয়ে লিখেছি যে এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চালিকা শক্তি হবে; কোনও চরিত্রের মনের গভীরে ডুব দিয়ে তার নির্মাণে আমি কতটুকু দক্ষ সেই ব্যাপারে আমার মনে যথেষ্ট সংশয় ছিল; বাইরে থেকে দেখে  কোনও চরিত্র সম্বন্ধে লেখা কোনও বড় ব্যাপার নয়, কিন্তু সেটি অনেকটাই হবে উপলব্ধিভিত্তিক। আমাকে শুধু ওপর থেকে দেখে কিছু লিখে দিলেই চলবে না, ওর বাস্তব অনুভূতিটা ঠিক কেমন হয়েছিল সেটাও আমাকে বুঝতে হবে। এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমার মনে যে ছবিটি ভেসে উঠল সেটি একটি রেলগাড়ির। আমার আগের উপন্যাসগুলো সবই নারীকেন্দ্রিক, ওরা সবাই আশপাশের বাসিন্দা বা উঠোনে বসে জটলা করে, এবারে মনে হল বাইরে বেরোতে হবে। তাই রেলগাড়ির কথাটা আমার মনে এল একটু নাড়িয়ে দেওয়া, আর সেই প্রভাব কাটার আগেই ওকে বের করে আনা এবং সব শেষে পেছনে ফেরার রাস্তাটা একরকম বন্ধ করে দেওয়া; গতি বাড়িয়ে দেবে কিন্তু রুদ্ধ হতে দেবে না, একটি পিছুটান থেকে গেলেও সামনে এগোনো ছাড়া কোনও রাস্তা থাকবে না। অর্থাৎ এই কাল্পনিক দৃশ্যটিই এই উপন্যাসের কাঠামোটা নিয়ন্ত্রণ করেছে; অবশ্য খোলাখুলি এসব কথা কোথাও বলিনি, বা উল্লেখ করিনি; এই কল্পনা আমার কাজের সুবিধে করে দিয়েছে, এটাই আসল কথা। বাকি উপন্যাসে খানিকটা সর্পিল রূপই দেখা যায়, যেমন সুলাতে।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : জাজ উপন্যাসের ক্ষেত্রে এই নিয়ামক ভাবমূর্তির কী রকম ব্যাখ্যা করবেন ?

টনি মরিসন : জাজ-এর ব্যাপারটি বেশ জটিল, কারণ এই উপন্যাসে আমি দুটি পরস্পরবিরোধী বিষয়কে পুনঃ উপস্থাপনের চেষ্টা করেছি―নির্মাণকৌশল এবং উদ্ভাবন― একটি শিল্পকৃতিকে যেখানে গভীর ভাবনার ফসল বলে মনে হবে আবার একই সঙ্গে মনে হবে তাৎক্ষণিক উদ্ভাবন, ঠিক জাজ-এর মত। দৃশ্যকল্পটি আমি একটি বই হিসেবে ভাবার চেষ্টা করেছি। আদতে একটি বই, তবে একই সঙ্গে লেখাটিও। সেটি কল্পনা করা। বলা। কী করতে চলেছে সেটি নিয়ে সজাগ থাকা।  নিজেই নিজেকে লক্ষ্য করে এবং চিন্তা করে। এই ব্যাপারটিকেই আমার মনে হয়েছে নির্মাণকৌশল এবং উদ্ভাবনের সমবায়―নব উদ্ভাবনের জন্য যা আপনি অনুশীলন করতে থাকেন এবং নকশা প্রস্তুত করেন। অসফল হবার জন্য, ভুল করবার জন্য আপনাকে তৈরি থাকতে হবে, কারণ জাজ এক ধরনের সাধনা। সাধনায় ভুল হতে পারে, পরে সংশোধন করে নেওয়ার বিলাস দেখানো যায় না, যা একজন লেখক দেখাতে পারেন; সেই ভুলের ভেতর থেকেই আপনাকে কিছু বের করে আনতে হবে,  আর সেটি যদি বেশ ভালভাবে উৎরে যেতে পারেন তাহলে এমন একটি জায়গায় পৌঁছে যেতে পারেন, ভ্রান্তিটি না হলে সেখানে পৌঁছনো সম্ভবই হত না। অর্থাৎ সাধনায় আপনাকে ভুল করবার ঝুঁকি নিতে হবে। নৃত্যশিল্পীরা প্রায়ই করে থাকেন, জাজ সংগীতশিল্পীরাও। জাজ নিজের কাহিনি নিজেই আগে থেকে অনুমান করে নেয়। দেখার দোষেই অনেক সময় ভুল হয়ে যায়। চরিত্রগুলির কল্পনা সঠিক হয়নি, ভুলটা স্বীকার করে নেয়, তারপর ঠিক জাজ-গায়কের মতই ওরাও কথা বলতে শুরু করে। নিজের উদ্ভাবিত চরিত্রের কথাবার্তা মন দিয়ে শুনতে হয় এবং তার থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে হয়। এই জটিল কার্যটিই আমি করেছি, যদিও আমার উদ্দেশ্যে ছিল যারা এখনও জানে না যে তারা জাজ যুগে বাস করছে এবং শব্দটি কখনওই ব্যবহার করেনি, তাদের নিয়ে অতি সরল একটি কাহিনি বলা।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : এই পরিকাঠামোটি অর্জন করার একটি উপায় হল প্রতিটি উপন্যাসে একাধিক কণ্ঠস্বরকে কথা বলতে দেওয়া। তাহলে আপনি এই ভাবে কেন করতে চাইলেন ?

টনি মরিসন : একটি সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ চলে আসাটা বাঞ্ছিত ছিল না। মার্কিন সাহিত্যে এই সামগ্রিকতার বড় বেশি রমরমা―সব কিছুরই যেন কেবল একটিই সংস্করণ। কিন্তু একই ধরনের আচরণ করা, সম্পূর্ণ সদৃশ জনগোষ্ঠী তো আমরা নই।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : সামগ্রিকতা বলতে আপনি এটিই বলতে চেয়েছেন ?

টনি মরিসন : হ্যাঁ। অন্য কারও কাছ থেকে বা যিনি আমাদের হয়ে কথা বলছেন তাঁর কাছে থেকে পাওয়া চূড়ান্ত কিংবা প্রভুত্বব্যঞ্জক দৃষ্টিকোণ। অসাধারণত্বের জায়গা নেই, বৈচিত্র্যের জায়গা নেই। নানা ধরনের কণ্ঠস্বরকে আমি বিশ্বাসযোগ্যতা দিতে চেয়েছি, প্রতিটি কণ্ঠস্বরই প্রগাঢ়ভাবে ভিন্ন। আফ্রিকান-আমেরিকান সংস্কৃতির যে বিষয়টি আমাকে নাড়া দেয় তা হল এর বৈচিত্র্য। এমন কত সমসাময়িক সংগীত রয়েছে, যেখানে সব কিছুই এক ধরনের শুনতে লাগে। কিন্তু আপনি যখন কোনও কৃষ্ণাঙ্গ সংগীত শোনেন, আপনি ডিউক এলিংটন এবং সিডনি বেচেটের কিংবা  স্যাচমো বা মিলস ডেভিসের গানের ভিন্নতা নিয়ে ভাবেন। এঁদের একজনের থেকে অপরজনকে আলাদা মনে হবে, অথচ আপনি জানেন এঁরা সকলেই কৃষ্ণাঙ্গ গায়ক, দক্ষতা যাই হোক না কেন, আপনি উপলব্ধি করবেন, ঠিকই তো, আফ্রিকান-আমেরিকান ঐতিহ্য হিসেবে যেটিকে চিহ্নিত করা হয়, এসব তো তারই অংশ।  একজনও জনপ্রিয় কৃষ্ণাঙ্গ গায়িকা,  জাজ গায়িকা, ব্ল্যু গায়িকা নেই যাঁর গানের সঙ্গে অন্য কারও গানের মিল খুঁজে পাওয়া যাবে।  বিলি হলিডেকে অ্যারেথার মতন লাগে না, নিনার মতন লাগে না, সারাহ-র মতন লাগে না, এদের কারও মতই লাগে না। বাস্তবেই স্বমহিমায় এঁরা একে থেকে অপরে আলাদা। এবং এঁরা বলবেন যে অন্য কারওর সঙ্গে মিল থাকলে এঁরা কোনওদিনই সংগীতশিল্পী হতে পারতেন না। এলা ফিটজগেরাল্ডের মত কণ্ঠ নিয়ে কেউ যদি আসরে নামেন, সবাই বলবে, আরে এরকম গলা তো আগেই শুনেছি… কেমন করে এই সব মহিলারা নিজেদের এই রকম স্বতন্ত্র, সন্দেহাতীত ছবি তৈরি করতে পেরেছেন, আমার জানবার খুব কৌতূহল। লেখার ব্যাপারে আমিও এইরকমই কিছু করতে চাই, যা সন্দেহাতীতভাবে আমার বলেই চেনা যাবে, কিন্তু প্রথমত, আফ্রিকান-আমেরিকান পরম্পরার সঙ্গে খাপ খাবে, আর দ্বিতীয়ত, ধারাটি সাহিত্যের সমগ্রতার মধ্যে স্থান পাবে। 

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : প্রথমে আফ্রিকান-আমেরিকান ?

টনি মরিসন : হ্যাঁ।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : সাহিত্যের সমগ্রতার চেয়েও ?

টনি মরিসন : অবশ্যই।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : কেন ?

টনি মরিসন : এটি সমৃদ্ধতর। এর উৎস অনেক জটিলতার গভীরে। কিনারা ধরে টান মেরে তুলে আনে, যা অনেক বেশি নবীন। যার একটি মানবীয় ভবিষ্যৎ রয়েছে।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : কেবল একজন আফ্রিকান-আমেরিকান লেখিকা হিসেবে পরিচিত না হয়ে আপনি কি সাহিত্যের মহান একজন উদ্গাতা হিসেবে পরিচিত হতে চাইবেন না ?

টনি মরিসন : আমার লেখা আফ্রিকান-আমেরিকান হয়ে উঠুক, সেটিই আমার কাছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ; যদি এটি অন্য একটি বা বৃহত্তর কোনও ধারার অঙ্গীভূত হয়ে যায়, সে ভাল কথা। কিন্তু আমাকে সেটিই করতে বলা হবে, সেটি চলবে না, জয়েসকে সেরকম কিছু করতে বলা হয়নি। টলস্টয়কে বলা হয়নি। বলতে চাইছি, সেগুলিকে রাশিয়ান, ফরাসি, আইরিশ বা ক্যাথলিক বলাই যেতে পারে, এঁরা নিজেদের পরিসর মেনেই লিখেছেন, আমিও সেটিই করতে চাইছি। তবে আমার ক্ষেত্রে পরিসরটি হল আফ্রিকান-আমেরিকান; সেটি ক্যাথলিক হতে পারে, মধ্য-পশ্চিমী হতে পারে। এসবই আমার সত্তার অঙ্গ, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : সবাই জানতে চায়, আপনি এমন কিছু লেখেন না কেন, যা আমরা বুঝতে পারি ? আপনার কী মনে হয় ? আপনি কি সাধারণ পাশ্চাত্য, রৈখিক, কালানুক্রমিক উপায়ে না লিখে তাদের ভয় দেখাতে চাইছেন ?

টনি মরিসন : আমার মনে হয় না ওঁরা সেরকম কিছু বলতে চান। মনে হয় ওঁরা বলতে চান, আপনি কি কখনও সাদা মানুষদের নিয়ে একটাও উপন্যাস লিখবেন না ? ওঁরা হয়ত এটিকে এক ধরনের প্রশংসা বলেই মনে করেন। ওঁরা বলতে চাইছেন, আপনি ভালই তো লেখেন, আমি চাই আপনি আমাকে নিয়েও কিছু লিখুন। কথাটা আর কাউকেই ওঁরা বলতে পারবেন না। বলতে চাইছি, আমি কি আন্দ্রে জিদের কাছে চলে যেতাম আর বলতে পারতাম, ঠিক আছে, কিন্তু আপনি কবে একটু আন্তরিক হয়ে কালো মানুষদের নিয়ে লিখবেন ? আমার মনে হয় না এই প্রশ্নের উত্তর কীভাবে দেওয়া যেতে পারে সেটি ওঁর জানা আছে। একই ভাবে আমারও জানা নেই। উনি বলবেন, কী বললেন ? ইচ্ছে হলে লিখব, বা, আপনি বলার কে ? এই ধরনের প্রশ্নের পেছনের কারণটা এই রকম, একটি কেন্দ্রবিন্দু রয়েছে, সেটি সাদা মানুষদের দখলে, তারপর রয়েছে স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গ এবং এশীয় মানুষেরা, কিংবা অন্য যে কোনও প্রান্তিক মানুষেরা। এই ধরনের প্রশ্ন কেবল কেন্দ্রবিন্দু থেকেই করা চলে। বিল ময়ারস কবে-আপনি-এটি-নিয়ে- লিখবেন প্রশ্নটি টেলিভিশনে আমাকে করে নিয়েছেন। আমি শুধু বলেছি, দেখা যাক, একদিন হয়ত লিখব… কিন্তু ওঁকে আমি বলতে পারিনি, এই প্রশ্নটি আপনি কেবল ওই কেন্দ্রবিন্দু থেকেই যে করতে পারেন, সে তো আপনি জানেনই। বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু! আমি বলতে চেয়েছি উনি একজন শ্বেতাঙ্গ পুরুষ। একজন প্রান্তিক মানুষের কাছে জানতে চাইছেন, আপনি কখন কেন্দ্রে পৌঁছবেন, কবে আপনি শ্বেতাঙ্গ মানুষদের নিয়ে লিখবেন। আমি বলতে পারি না, বিল, এই প্রশ্নটা আমায় কেন করছেন ? কিংবা এই প্রশ্নটি যতদিন প্রাসঙ্গিক থাকবে, আমি লিখব না, লিখতে পারব না। মোদ্দা কথা হল উনি আমার পিঠ চাপড়ে দিচ্ছেন; বলছেন, ভালই তো লেখেন; যদি চান,  আপনি কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত হতেই পারেন। প্রান্তসীমায় আপনার পড়ে থাকার দরকারই নেই। আর আমি বলছি, ভাল কথা,  আমি এই প্রান্তসীমাতেই বেশ আছি, কেন্দ্রকে আমাকে লক্ষ্য করা চালিয়ে যেতে দাও।

আমার এই দাবিটি মিথ্যেও হতে পারে, তবে পুরোপুরি নয়। যাঁদের আমরা বিদ্বজ্জন মনে করি, তাঁদের জন্য কথাটি যে সত্যি, তা আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি। জয়েসই এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। উনি এখানে ওখানে অনেক জায়গায় ঘুরেছেন, কিন্তু যেখানেই থাকুন না কেন, লিখেছেন সেই আয়ার্ল্যান্ডকে নিয়েই, কোথায় আছেন তার পরোয়াই করেননি। আমি নিশ্চিত যে মানুষ জিজ্ঞেস করেছে ওঁকে, কেন ? ফরাসিরা হয়ত জানতে চেয়েছে, প্যারিসকে নিয়ে কবে আপনি লিখছেন ?

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : জয়েসের কোন গুণটি আপনাকে আকর্ষণ করে ?

টনি মরিসন : কিছু বিশেষ ধরনের বিদ্রুপ এবং রসবোধ কী ভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেটি ভেবে আমি অবাক হয়ে পড়ি। মাঝে মাঝে জয়েস বেশ কৌতুকপ্রিয় হয়ে ওঠেন। স্নাতক স্কুল থেকে বেরনোর পর ফিনেগানস ওয়েক১১ বইটি পড়ি, আর আমার খুব সৌভাগ্য যে বইটি কারও সাহায্য না নিয়েই পড়েছিলাম। ঠিকঠাক বুঝেছিলাম কিনা জানি না, তবে বইটি খুবই মজাদার ছিল! হাসতে হাসতে মরে গেছিলাম! অনেক কিছুই বোধগম্য হয়নি, তবে কিছু এসে যায়নি, আমি তো আর পরীক্ষার পড়া করছিলাম না। শেক্সপিয়ার পড়ে এখনও যে সবাই এত মজা পায়, তার কারণ, আমার মনে হয়, ওঁর সময়ে কোনও সাহিত্য সমালোচক ছিলেন না।  উনি কেবল লিখে যেতেন; পর্যালোচনার কোনও ব্যাপারই ছিল না, শুধু দর্শকদের মঞ্চে ছুঁড়ে দেওয়া মন্তব্যগুলি ছাড়া। ওঁর পক্ষে লিখে যাওয়াটা অসম্ভব ছিল না। 

১১ ফিনেগানস ওয়েক―জেমস জয়েসের একটি পরীক্ষামূলক উপন্যাস। 

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : ধরুন, যদি ওঁর লেখার পর্যালোচনা হত, উনি কি তবে কম লিখতেন ?

টনি মরিসন : ব্যাপারটাকে উনি যদি পাত্তা দিতেন, তাহলে উনি নিশ্চয়ই খুবই আত্মসচেতন হয়ে পড়তেন।  ভান করা যে ওঁর কিছুই এসে যায় না, ভান করা যে উনি সেগুলো (সমালোচনাগুলো) পড়েও দেখেন না―কাজটি খুব সহজ নয়।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : আপনার লেখার পর্যালোচনাগুলো পড়েন ?

টনি মরিসন : আমি সবই পড়ি।

এলিসা শ্যাপেল এবং  ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : সত্যি বলছেন ? আপনাকে তো মারাত্মক সিরিয়াস মনে হচ্ছে।

টনি মরিসন : আমাকে নিয়ে যে কোনও লেখা, যা আমার নজরে পড়ে, সবই আমি পড়ি।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : এরকম কেন ?

টনি মরিসন : যা যা ঘটছে, আমাকে জেনে নিতে হয়!

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : আপনাকে কী ভাবে নেওয়া হচ্ছে সেটি আপনি বুঝতে চান ?

টনি মরিসন : তা নয়। আমাকে বা আমার লেখাকে নিয়ে নয়, বরং কী ঘটছে, সেটা। মহিলাদের লেখা, বিশেষ করে আফ্রিকান-আমেরিকানদের লেখা, সমসাময়িক লেখালেখি কোন পথে এগোচ্ছে, সেটি নিয়ে একটি ধারণা থাকা আমার জন্য খুব জরুরি।  সাহিত্যের একটি পাঠ্যসূচি পড়াই। সেই পড়ানোর ব্যাপারে কাজে লাগবে, এরকম সব তথ্যই আমি পাঠ করে থাকি।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : যখন ওঁরা আপনাকে জাদুবাস্তবতার প্রবক্তাদের সঙ্গে তুলনা করেছেন, যেমন গেব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের সঙ্গে, আপনি কি কখনও সত্যি সত্যি অবাক হয়েছেন ?

টনি মরিসন : হ্যাঁ, এক সময় হতাম। তবে আমার কাছে এর কোনও অর্থ হয় না। যখন অধ্যাপনা করি, তখন স্কুলই আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এক তাড়া ফাঁকা হলদে কাগজ নিয়ে আমি যখন এখানে এসে বসি, আমার কিছুই মনে হয় না, কী ভাবে বলা যায় ? আমি একজন জাদুবাস্তববাদী ? প্রত্যেকটি বিষয়েরই একটি নিজস্ব রূপ থাকতে হবে, নিশ্চয়ই বোঝেন সে কথা।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : আপনি প্রাক-স্নাতকদের অধ্যাপনা কেন করেন ?

টনি মরিসন : এখানে, এই প্রিন্সটনে, এঁরা প্রাক-স্নাতক পাঠ্যক্রমের সত্যিই খুব কদর করেন, ব্যাপারটি বেশ ভাল, কারণ, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই কেবল স্নাতক পাঠ্যক্রম বা পেশাদারী গবেষণায় রত স্কুলেরই দাম দেন।  প্রিন্সটনের এই প্রবণতা আমার ভাল লাগে। নিজের সন্তানদের ক্ষেত্রেও সেটিই আমি ভাল মনে করতাম। নবীন এবং দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের আমি মঞ্চায়নের ক্ষেত্র বা খেলার মাঠ বা ক্যানভাস হিসেবে বিবেচনা করা আমার পছন্দ নয়, যাদের ব্যবহার করে স্নাতক স্তরের শিক্ষার্থীরা অধ্যাপনার প্রশিক্ষণ লাভ করবে। সর্বোত্তম শিক্ষা ওদের প্রাপ্য। আমার সর্বদাই মনে হয়েছে পাবলিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য পাঠের সুযোগ পাওয়া উচিত। ওই যেসব ক্লাসকে প্রতিকারমূলক বা বিকাশমূলক ক্লাস বলা হত, সেখানে হামেশাই আমি ঈডিপাস রেক্স১২ পড়িয়েছি। ওই সব ক্লাসে সেই সব শিক্ষার্থীদের পাঠানো হত যারা একঘেয়েমিতে ভুগত। সুতরাং ওদের মনযোগ ধরে রাখার জন্য  আপনার সেরাটা দিতে হবে।

১২ ঈডিপাস রেক্স―গ্রিক নাট্যকার সোফক্লিসের লেখা একটি বিয়োগান্ত নাটক। খ্রিস্টপূর্ব ৪২৯ সালে নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয়েছিল।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : আপনার একজন পুত্র সংগীতকার। সংগীত কি আপনার মধ্যে কখনও অনুভব করেছেন, আপনি কখনও পিয়ানো বাজিয়েছেন ?

টনি মরিসন : না, তবে আমি অত্যন্ত কুশলী সংগীত পরিবার থেকে এসেছি। অত্যন্ত কুশলী বলতে আমি বলতে চাইছি, ওঁদের অনেকেই হয়ত সরগম পড়তে পারতেন না, কিন্তু একবার কিছু শুনলেই সেটি তুলে নিতে পারতেন অবিলম্বে। ওঁরা আমাদের―আমার বোন আর আমাকে―সংগীতের পাঠ নেওয়ার জন্য ভর্তি করে দিল।  যা ওঁরা অনায়াসে করতে পারতেন, সেটিই শেখবার জন্য ওঁরা আমাকে ভর্তি করে দিলেন। আমার মনে হল আমি কমজোরী, পিছিয়ে আছি। ওঁরা আমাকে বোঝাননি যে সরগম পড়তে জানাটা খুব জরুরি সম্মানের ব্যাপার, অসম্মানের নয়। আমার মনে হল আমরা খোঁড়া, তাই আমাদের হাঁটতে শেখার জন্য পাঠানো হয়েছে, যেটি অন্যেরা উঠে দাঁড়িয়ে অনায়াসে করে ফেলতে পারে।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : আপনি কি মনে করেন লেখক হয়ে ওঠার জন্য আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন ? নিয়ম করে বই পড়া―সম্ভবত ?

টনি মরিসন : খুবই সীমিত প্রয়োজন।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : বিশ্বভ্রমণ করা ? সমাজবিদ্যা, ইতিহাস নিয়ে কোনও পাঠ্যক্রম ?

টনি মরিসন : অথবা বাড়িতে বসে থাকা, আমার মনে হয় না কোথাও যাবার প্রয়োজন আছে বলে।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : অনেকে বলে থাকেন, ওহো জীবনটা পুরোপুরি উপভোগ না করে, যতক্ষণ না অভিজ্ঞতা হচ্ছে, ততক্ষণ উপন্যাস লেখা সম্ভব নয়।

টনি মরিসন : হতে পারে হতেও পারে ওঁদের পক্ষে লেখা সম্ভব নয়। কিন্তু এমন মানুষও তো আছেন, যাঁরা কখনও কোথাও যাননি, শুধু কল্পনা করে নিয়েছেন। টমাস মান। মনে তো হয় না উনি খুব কিছু ঘোরাঘুরি করেছেন… হয় আপনার এই রকম কল্পনাশক্তি থাকবে, আর নয়ত অর্জন করতে হবে। মাঝে মাঝে সত্যিই উদ্দীপনা লাভের প্রয়োজন হয়। তবে উদ্দীপনা লাভের জন্য আমার কোথাও যাওয়ার দরকার হয় না। একটি জায়গায় চুপ করে বসে থাকার সুযোগ পেলেই আমি খুশি। অনেকে যেমন বলে থাকেন লেখা শুরু করার আগে কিছু একটি করার দরকার, আমি এই ধারণায় বিশ্বাসী নই। আমি কিন্তু আত্মজীবনীমূলক কিছু লিখছি না। প্রথমত, আমার উপন্যাসের চরিত্র হিসেবে বাস্তবে দেখতে পাওয়া কোনও মানুষের প্রতি আমার আগ্রহ নেই―এমনকি নিজের প্রতিও নয়। কোনও একটি ঐতিহাসিক চরিত্র, ধরা যাক মার্গারেট গার্নার, তাঁকে নিয়ে যদি কিছু লিখি, ওঁর সম্বন্ধে বলতে গেলে আমি কিছুই জানি না। যেটুকু জেনেছি ওঁর সম্বন্ধে, সেটুকু কেবল ওঁর দুটি সাক্ষাৎকার পড়েই জেনেছি। ওঁরা বলবেন, এটি কি অভাবিত নয়। এমন একজন মহিলা যিনি ক্রীতদাসত্বের ভয়াবহতা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য সিনসিনাটি পালিয়ে যান, অথচ পাগলাটে নন। নিজের শিশু সন্তানকে হত্যা করা সত্ত্বেও, তাঁর মুখ থেকে ফেনা ঝরে না। উনি অত্যন্ত শান্ত; বলেন, (দরকার পড়লে) আবার আমি করতে পারি। আমার কল্পনাশক্তিকে উদ্দীপিত করার জন্য এটুকুই যথেষ্ট।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : ওঁকে একজন চাঞ্চল্যকর ব্যক্তিত্ব হিসেবে মনে করা যেতে পারে ?

টনি মরিসন : উনি তা-ই ছিলেন। উপন্যাসে যতটুকু বলা হয়েছে, ওঁর জীবন তার চেয়েও বেশি বীভৎস ছিল, তবে ওঁর সম্বন্ধে যা যা জানা যায়, সবই যদি জেনে ফেলতাম, আমি কখনও সেই সব লিখতাম না। লেখাটির দফা রফা হয়ে যেত; আমার নিজের কথা বলার কোনও অবকাশ থাকত না। আগে থেকেই রান্না হয়ে থাকা একটি রন্ধনপ্রণালীর মত। আপনি ওখানেই রয়েছেন। আপনি তো সেই একই ব্যক্তিত্ব। আপনার কাছে থেকে চুরি করে আমার কী লাভ ? এ আমার পছন্দ নয়। উদ্ভাবন প্রক্রিয়াটিই আমার কাছে অধিকতর পছন্দের বিষয়। একটি চরিত্র যখন ধোঁয়ার কুণ্ডলী থেকে পূর্ণাবয়ব ব্যক্তির রূপ পরিগ্রহ করে, তখনই সেটি কৌতূহল জাগ্রত করে। 

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : ক্রোধ কিংবা অন্য কোনও আবেগ দ্বারা তাড়িত হয়ে কোনও রচনা করেছেন কি ?

টনি মরিসন : না, ক্রোধ তীব্র হতে পারে কিন্তু আবেগ হিসেবে অতি ক্ষণস্থায়ী। দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না। সৃজনশীল নয়, অন্তত আমার জন্য নয়। বলতে চাই, এই সব উপন্যাস লিখতে কম করে তিন বছর লেগে যায়!

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : রেগে থাকার জন্য সময়টা বেশ দীর্ঘ ?

টনি মরিসন : ঠিক কথা। ওই জিনিসটির ওপর আমার এতটুকুও ভরসা নেই।  ক্ষণস্থায়ী কোনও আবেগই আমার পছন্দ নয়, যেমন, আমি কত একা, হে ভগবান, ওহোহোহো এই সব আবেগকে আমার চালিকাশক্তি হিসেবে পছন্দ করি না। অর্থাৎ আমি বলছি যে ওই সব আবেগ আমারও আছে।

এলিসা শ্যাপেল এবং ক্লডিয়া ব্রডস্কি ল্যাক্যুর : আক্ষেপ করার  অজুহাত হিসেবে ভালো নয় ?

টনি মরিসন : ঠিক। ঠাণ্ডা মাথায় যদি চিন্তা না করা যায়, সুস্থির হয়ে ভাবনাগুলোকে যদি যথোপযুক্ত মেজাজসহ পরিবেশন না করা যায়, তাহলে সেটির কোনও মূল্যই নেই। ভাবনাগুলো করতে হবে খুবই ঠাণ্ডা মাথায়, অন্তত শান্ত। আপনার মস্তিস্ক। সেটিই সবকিছু।

লেখক : অনুবাদক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button