আর্কাইভপ্রচ্ছদ রচনা

এতিম কিশোর অথবা মদ্যপ মায়ের স্মৃতির আখ্যান

বুকার পুরস্কারজয়ী আট কথাসাহিত্যিক : নিবন্ধ

২০২০ সালে ম্যান বুকার পুরস্কারপ্রাপ্ত কথাসাহিত্যিক

ডগলাস স্টুয়ার্টের উপন্যাস শ্যাগি বেন :

এতিম কিশোর অথবা মদ্যপ মায়ের স্মৃতির আখ্যান

কুলদা রায়

স্কটিশ লেখক ডগলাস স্টুয়ার্ট ২০২০ সালে বুকার পুরস্কার পান তার শ্যাগি বেন উপন্যাসের জন্য। এই সফলতা পাওয়ার আগে লেখক বইটি প্রকাশের জন্য প্রকাশকে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন। ৩০ জনের বেশি প্রকাশক তাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। প্রকাশ করতে রাজি হননি।

আশির দশকের ঘটনা। গ্লাসগো শহরে একজন মদ্যপ মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে লেখা এই উপন্যাসটি। এরকম লেখা সহজ নয়। এটা লেখকের নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই নেওয়া। বলা যায় এক ধরনের আত্মজীবনীই।  গ্লাসগো শহরেই তিনি বেড়ে উঠেছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একজন সমকামী। এসব নিয়েই লেখা শ্যাগি বেন উপন্যাসটি।

১৯৭৬ সালে স্টুয়ার্ট জন্মেছিলেন স্কটল্যান্ডের গ্লাশগো শহরের সাইটহিল এলাকায়। ভাইবোনের মধ্যে তিনি হলেন কনিষ্ঠ। খুব ছেলেবেলায়ই তার বাবা তাদেরকে ছেড়ে চলে যায়। তার বাবা ছিলেন প্রোটেস্টান্ট। মা ক্যাথলিক। বিয়ের ব্যাপারে পরিবারের ব্যাপক আপত্তি ছিল। বিয়েতে স্টুয়ার্টের মামাবাড়ির কেউই আসেনি। তারা বয়কট করেছিলেন। শ্যাগি বেন বইয়ে শ্যাগির মা-ও ক্যাথলিক। প্রোটেস্টান্ট স্বামীর সঙ্গে সংসার করেছিলেন কিছুকাল।

তার মা একা একাই তিন সন্তানকে লালন করেন। তার মা ছিলেন মদে আসক্ত। এই নেশা আর দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে করতে তার মা মারা যান। তখন স্টুয়ার্টের বয়স মাত্র ১৬। তার বড় ভাইয়ের সঙ্গে কিছুদিন ছিলেন। তার পরের বছর বোর্ডিং হাউসে চলে যান।

 স্টুয়ার্ট লিখেছেন, তাদের বাড়িতে বইপত্র ছিল না। তাদেরকে ঘিরে ছিল কঠিন দারিদ্র্য। পড়াশুনা করাটা ছিল তার জীবনের জন্য এক রকম লড়াই। তার ভাইবোনেরা কেউই স্কুলের গণ্ডি পার হয়নি। তারা নানা কাজে ঢুকে গেছে বাঁচার জন্য। কিন্তু স্টুয়ার্ট সে সময়েই স্বপ্ন দেখতেন তাকে পড়াশুনা করতেই হবে। তিনি দেখেছিলেন তার ভাই বোন পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে কঠোর পরিশ্রম করছে বটে কিন্তু আয় করছে খুবই কম। তা দিয়ে দারিদ্র্য দূর হয় না। তিনি বুঝলেন, পড়াশুনার মাধ্যমেই তিনি একটি ভালো ক্যারিয়ার গড়তে পারবেন। তখন অনেক বেতনের চাকরি পাবেন। সেজন্য পড়াশুনাও করেছেন একাগ্র চিত্তে। যত কষ্টই হোক না কেন তিনি পড়াশুনায় ভালো করার চেষ্টা করেছেন। তার শিক্ষকেরাও তার কঠোর সংগ্রাম দেখে তাকে উৎসাহ দিয়েছেন। সে সময় পড়ার বইয়ের বাইরে কোনও বই পড়ার সুযোগই পাননি। কিন্তু স্বপ্ন দেখতেন, তার জন্য ভালো সময় আসবে। তিনি সাহিত্য পাঠ করবেন। লিখবেন। সেই কঠিন সময়ে তিনি সাহিত্যের বইগুলো পড়ার সময় পেতেন না বলে বইয়ের কভার দেখতেন। কভারের পেছনের লেখাগুলো পড়তেন।

তিনি স্কটিশ কলেজ অফ টেক্সটাইল থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রি পাশ করেন। লন্ডনের রয়েল কলেজ অফ আর্ট থেকে মাস্টারস ডিগ্রি করেন। সাহিত্য বিষয়ে কোনও প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যা তিনি গ্রহণ করেননি। তার একজন শিক্ষক তাকে সাহিত্যটাহিত্য নিয়ে পড়তে নিরুৎসাহিত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন―স্টুয়ার্টের মতো হতদরিদ্র পরিবার থেকে আসা লোকজনকে সাহিত্য পড়া ঠিক নয়। ফলে স্টুয়ার্টকে টেক্সটাইল নিয়ে পড়তে হয়েছে। এতে পাশ করে ভালো চাকরি পাওয়া যায়।

মাত্র ছয় বছর বয়সে স্টুয়ার্ট কাপড় সেলাই করা শিখেছিলেন মায়ের কাছে। প্রচলিত কাপড়শিল্প স্কটিস অর্থনীতির মূলশক্তি ছিল। থেচার-সরকারের সময়ে তা ধ্বসে পড়ল, তখন স্টুয়ার্ট হাইস্কুলে যাচ্ছেন, সেই সময় থেকেই বুঝেছিলেন এই কাপড়ের কাজটিই তার জন্য উপযুক্ত। স্টুয়ার্ট এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আমার হাইস্কুলের শিক্ষকেরা একদিন দেখলেন এই ছেলেটি হুট করে এতিম হয়ে গেল। একটিমাত্র বিছানার চাদর তার সম্বল।  সেটাও একজন বয়স্ক লোকের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে হয়। সপ্তায় চার রাত সে কাজ করে। আর শনি রবি―এই দুইদিন পূর্ণদিনই কাজ করে। এর মধ্যেই সে চেষ্টা করছে ভালো কিছু করার। তারাই আমাকে কাপড়ের কাজের ব্যাপারে প্রেরণা যুগিয়েছেন।

গত ২২বছর স্টুয়ার্ট নিউ ইয়র্ক শহরে আছেন। ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে একটি বড় কোম্পানিতে কাজ করছেন। বুকার পুরস্কার পাওয়ার পরে এই কাজ ছেড়ে ফুলটাইম লেখালেখতেই থিতু হয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি বৃটিশ ও আমেরিকান নাগরিক। নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনে ইস্ট ভিলেজে তার স্বামী মাইকেল ক্যারির সঙ্গে থাকছেন স্টুয়ার্ট। ক্যারি একজন আর্ট কিউরেটর।

এই সাফল্য তার জন্য মোটেই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। বেশ কিছু গল্প লিখেছেন তিনি। সেগুলো দি নিউ ইয়র্কার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তারপর তিনি লিখে শেষ করেছেন তার দ্বিতীয় উপন্যাস খড়পয অবি।

তৃতীয় উপন্যাস লিখতে শুরু করেছেন ক্ষয়িষ্ণু টেক্সটাইল শিল্প নিয়ে। এ তিনটিকে ট্রিলজি বলা যেতে পারে।

স্টুয়ার্ট বলেন―‘একজন লেখক হওয়ার স্বপ্ন তার সব সময়েই ছিল। এখন থেকে ১৪ বছর আগে তিনি লিখতে বসেন। শুরুতে কোন বই লিখবেন বা বই হবে এ ধরনের আশা তার ছিল না। ছেলেবেলায় তাঁর ইচ্ছে ছিল ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়বেন। একজন লেখক হবেন। তিনি বলেন, কিন্তু আমার ছেলেবেলায় আমার মতো খেটে খাওয়া দরিদ্র পরিবারের মানুষদের এরকম নিজের ইচ্ছে থাকতে নেই। দক্ষিণ গ্লাসগোতে এটা বিপজ্জনকও ছিল। কথা বলতাম গ্লাসগোইয়ান উচ্চারণের ইংরেজিতে। তার পুরোটা  প্রমিত ইংরেজি নয়।

তখন, সেই বাল্যকালে, পরিবারের উপর নির্ভরশীলতার সময়ে চোরের মতো গোপনে লেখালেখি করতাম। কাউকেই সে কথা জানাইনি। এমনকি পরে যখন শ্যাগি বেন লিখি, আমার নিজের জীবনের ঘটনাকে অবলম্বন করেই লিখতে থাকি দশ বছর ধরে, তখন কাউকেই সে লেখা দেখাইনি। কেবল আমার স্বামী দেখেছে।’

তিনি বলেন―‘আমি লিখতে বসেছিলাম। মাথায় নানা দৃশ্য ফুটে উঠেছিল। সচরাচর এরকম দৃশ্য আমার মাথায় আসে। এগুলোই আমি লিখলাম। পর্যায়ক্রমে দৃশ্যগুলো লিখলাম। লিখতে বসার আগে আগে আমি জানতামই না এই লেখাগুলো বাড়তে থাকবে। এটা একটা শক্তি। জানতামই না এই লেখাগুলো নিয়ে আমার একটা বই হবে।’

স্টুয়ার্ট যখন বইটি লিখতে শুরু করেন তখন তিনি নিউ ইয়র্কে। এই নিউ ইয়র্কের জীবন আর গ্লাসগোর সেই হতদরিদ্র জীবন এক রকম নয়।

‘কিছু বেদনা বের করার জন্য আমি লিখেছিলাম। কিন্তু এর সঙ্গে আমার জীবনের দুটো ভিন্নতর বিষয়ের সঙ্গে নিজেকে আবার যুক্ত করার জন্যই মনে হয় লিখতে বসেছি।’

তার নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভেতর আলো ফেলে বইটি লিখেছেন। লিখতে লিখতে বুঝতে পেরেছেন এটা লিখতে ভালো লাগছে তার। ভোরবেলা ঘুম থেকে জেগেই প্রথম কাজ ছিল বইটি লেখা। আবার কাজ থেকে ফিরে লিখেছেন।

তিনি বলেন―‘আমি ভাবি আমার যেন বছরে চার পাঁচবার চীনদেশে ভ্রমণের মতো ঘটনা হয়। এই ভ্রমণকালে প্লেনে কেউ আমাকে বিরক্ত করবে না। একজন লেখক হিসেবে আমার সব ব্যক্তিগত কাজগুলো একপাশে সরিয়ে রাখব। কেউ আমার কাছে আসতে পারবে না। এই সময়কালে কেবল আমি আমার গল্পের চরিত্র নিয়ে ভাবব। ভাবতে থাকব আমার লেখা নিয়ে। এই জীবনটাই হবে আমার স্বর্গ।’

‘আমার বইটির প্রথম পাঠক আমার স্বামী। সে পড়েছে বলে গত দশ বছরের শেষ দিকে স্বামীই কেবল বইটি প্রকাশ করা নিয়ে ভেবেছে।’

ডগলাস স্টুয়ার্টের স্বামীর নাম মাইকেল ক্যারি। ২০১৭ সালে তারা বিয়ে করেন। ক্যারির সঙ্গে স্টুয়ার্টের দেখা হয় শিকাগোতে। শিকাগোতে স্টুয়ার্ট যখন প্রথম যান তখন সেখানে পরিচিত কেউ ছিল না। তার এক বন্ধু একথা  শুনে, যাওয়ার আগে, মাইকেল ক্যারির সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে দেন।

আশির দশকে মার্গারেট থেচারের প্রধানমন্ত্রিত্বকালে গ্লাসগো একটি কঠিন সময় পার করেছে। গ্লাসগো শহরের কর্মশূন্যতা বেড়ে গিয়েছিল শতকরা ২৬ ভাগ।

স্টুয়ার্ট বলেন―‘এসব সত্ত্বেও তার স্বামী প্রায়ই তার সঙ্গে দেখা করতে আসত। এসে তার বইটি পড়ত। পড়ে  তার চোখ খুলে গিয়েছিল।’

‘এইরকম একটা জায়গায় বসে কিভাবে এই বইটি লেখা হলো সেটা সত্যিই সে বুঝতে পারছিল না। আমার মায়ের সঙ্গে পরিচিতজনদের সম্পর্ক ভালো ছিল না। বলা যায় সম্পর্কের সুতো টুকর টুকর হয়ে গিয়েছিল। ফলে এই সব বিষয় নিয়ে লেখা বইটি যখন সে পড়ত তখন আমার প্রতি তার এক গভীর অনুভূতির জন্ম হতো।’

স্টুয়ার্ট জানান শ্যাগি বেন উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন। বলেছেন―‘আমি বেড়ে উঠেছিলাম গরীব অবস্থায়। বখেও গিয়েছিলাম খানিকটা। ছিলাম একজন সিঙ্গল মায়ের ছোট ছেলে। আমার সমগ্র ছোটকালজুড়েই মা ছিলেন মদ্যপানে আসক্ত। এক সময় তিনি মদ্যপানের সঙ্গে জুঝে উঠতে পারেনি। মা মদের নেশা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করত। মাঝে মাঝে সফল হলেও আবার মদের নেশায় চুর হয়ে যেত। এটা ছিল তার জন্য এক ধরনের যুদ্ধ।’ স্টুয়ার্ট তাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করতেন। একজন শিশু হিসেবে মাকে সহযোগিতা করা সহজ নয়। কিন্তু সেটা তাকে শিখতে হয়েছিল। এভাবেই তিনি বদলে গিয়েছিলেন। শিশু বয়সেই তিনি প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠেছিলেন। সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য মাকে তিনি প্রতিদিনই বলতেন―‘মা, আমি তোমার স্মৃতিকথা লিখতে যাচ্ছি।’ তখন তার মা তার সঙ্গে স্বাভাবিক হতেন। তাকে তার জীবনের ঘটনা বলতেন। এগুলোই ছিল শ্যাগি বেন উপন্যাসটির বীজ। তিনি তখন পায়ের কাছে বসতেন। একটা পুরনো একটা স্কুলের খাতা খুলে দিতেন। তার বলা গল্পগুলো টুকে রাখতেন।

তার মা ৩২ বছর আগে মারা যান। তিনি যখন বইটি লিখতে বসেন তখন তার মা আর তার বেড়ে ওঠা শহরটির জন্য তার এক ধরনের গভীর আবেগ অনুভব করেছিলেন। উভয়কেই তিনি হারিয়েছেন।

শ্যাগি বেন বইটিতে এগেনস নামে যে চরিত্রটি নির্মাণ করেছেন স্টুয়ার্ট, সেই এগেনস মাদকাসক্ত। কি পরিস্থিতিতে সে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছিল সেই বিষয়ে চিন্তা করলে দেখা যাবে এগেনস বহুমুখী আর জটিল স্বভাবের একজন নারী।

সে একজন উদার, রূপসি, মিশুক ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ মানুষ। কিন্তু সে খুবই ঝামেলাপূর্ণ আর হতাশও বটে।

কিন্তু তার মধ্যে একটা গভীর বেদনা ছিল। সেটাই তাকে আসক্তির দিকে ঠেলে দিয়েছে।

স্টুয়ার্ট বলেন―‘আমার ছেলেবেলাটা বেশ ঝামেলাপূর্ণ ছিল। এর মধ্যে অনেক হাসি আর ভালোবাসা থাকলেও কিন্তু বেশি ছিল দুঃখ, সন্ত্রাস আর খুব বিষাদপূর্ণ ঠাট্টা।’

এই বইটি পড়লে খুব বেশি বেদনার সুর শোনা যায়। কারণ আসক্তি আর ক্ষতি নিয়েই লেখা। কিন্তু এর মধ্যেই পাওয়া যাবে আশার কথাও। পাওয়া যাবে অনেক মজার বিষয়ও। এই জীবনের যুদ্ধ, একাকিত্ব আর বিচ্ছিন্নতার সুর রয়েছে বইটির ছত্রে ছত্রে। স্টুয়ার্ট মনে করেন এই বোধ আসলে তাঁর কৈশোর থেকে পাওয়া। তরুণ বয়সেও এই একাকিত্ব আর বিচ্ছিন্নতা বোধে তিনি আক্রান্ত ছিলেন। এই বিষাদে ভোগার কারণ হিসেবে মনে করেন―তার মাকে হারানো আর একটি খেটে খাওয়ার মানুষের বসতির একজন শিশু হিসেবে তার অভিজ্ঞতা।

বইয়ের শ্যাগির বাবা বিগ শ্যাগি একজন প্রোটাস্টান্ট খ্রিস্টান। পেশায় ট্যাক্সি ক্যাব চালক। অচিরেই তার প্রতারক চরিত্রটি বের হয়ে পড়ে। আরেকজন নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। একপর্যায়ে তার স্ত্রী এগেনস ও তার ছেলে-মেয়েদের ছেড়ে চলে যায়।

স্টুয়ার্ট বলেন―‘যদিও তার বাবাকে সে জানত না। কিন্তু পুরুষ নিয়ন্ত্রিত জগতে সে নিজে একজন সমকামী হিসেবে বেড়ে ওঠে।

‘অনেক সন্ত্রাস দেখেছি। নারীদের নিয়ে পুরুষরা কতভাবে দেখে আমি দেখেছি। আর দেখেছি নষ্টভ্রষ্ট মানুষদের নিয়ে কি সব তারা ভাবে। প্রত্যেকের জন্যই এ এটা খুবই সীমাবদ্ধ কাল।’

সে সময়ে বিগ শ্যাগির সব জারিজুরি গোপন থাকেনি। তার মা একে ভেঙে পড়েন। আরও মদ্যপ হয়ে ওঠেন।

‘ইংল্যান্ডে থেচার ক্ষমতায় এল। আর চাকরি কমে গেল। যার কুফল পড়ল পড়ল সর্বত্র। এর মধ্যে অন্যতম হলো মানুষের জীবনকাল ছোট হয়ে গেল’―স্টুয়ার্ট বলেন।

সমকামীদের কোনও রোল মডেল ছিল না।  বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত স্টুয়ার্টের সঙ্গে কোনও সমকামীর দেখা হয়নি। তার মেয়েলি ও ইঁচড়েপাকা স্বভাবের কারণে তাকে অনেক হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে।

গ্লাসগো টাইমস পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, ‘ছেলেবেলায় সমকামী হওয়ার কারণে অনেক হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে তাকে।’ তিনি বলেন―‘আমি তখন ক্লাশ টুতে পড়ি। সেদিন দুপুরের পরে বৃষ্টি হচ্ছে। ক্লাশরুমে সবাই আমরা খেলছিলাম। খুব ভালো সময় কাটছিল তখন। ঠিক কি খেলা করছিলাম সেটা ঠিক ঠিক মনে নেই, তবে মনে আছে ছেলেরা ছেলেদের সঙ্গে খেলছি। মেয়েরা মেয়েদের সঙ্গে খেলছিল। আমি খেলছিলাম মেয়েদের দলে। মেয়েদের সঙ্গে খেলতে ভালো লাগছিল।

ছয়জন ছেলে আমাকে ঘিরে ধরে অভিযোগ করল, কেন আমি ছেলেদের বাদ দিয়ে মেয়েদের সঙ্গে খেলছি ? তোমার সমস্যা কী ? তুমি ঠিক কাজটি করছ না।

এরপরই খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে সেই অল্প বয়সে আমাকে দেখলেই তারা কুৎসিৎ নোংরা শব্দ ছুড়ে মারত। এসব শুনতে আমার ভালো লাগত না।’

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই হেনস্থার মাত্রা বেড়ে গেল। তাকে ছেলেরা সঙ্গী হিসেবে বাদ দিল। তাকে দেখলেই কুৎসিত শব্দই শুধু বলত না কখনও কখনও তাকে শারীরিকভাবে আক্রমণও করত।

‘তারা আমাকে গালিপালির একটি পাত্র হিসেবে ধরে নিয়েছিল। তাদের মনের মধ্যে যা কিছু খারাপ ছিল সেগুলোই আমার প্রতি উগরে দিত।’

কিশোবেলার আরেকটি ঘটনা মনে করতে পারেন স্টুয়ার্ট। দিনটি শনিবার। দুপুরবেলা। ১২ জন কিশোরের একটি গ্যাং তাকে আক্রমণ করে।

তিনি বলেন―‘সেদিন আমি রাস্তার বিপরীত দিক থেকে হেঁটে আসছিলাম। তখন তারা আমাকে ঘিরে ধরে পেটাতে লাগল। রাস্তা দিয়ে একজন বয়স্কা মহিলা গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন ছেলেগুলো একটা কুকুরকে মারছে। তিনি গাড়ি থামালেন। বের হয়ে ছেলেগুলোকে তাড়া করলেন। আমি রাস্তায় পড়েছিলাম।

বিষাদের অংশ হিসেবে এই স্কুলজীবন শেষ হলো। যেন বহু বহু বছর পরে সামাজিক মাধ্যমের কারণে স্কুলের পরের প্রজন্মের অনেক ছেলেমেয়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। তারা বলেছে―আমি একজন সমকামী ছিলাম।  সে সময়ে তারা আমার প্রতি সংহতি পর্যন্ত জানাতে পারেনি।’ 

মিডিয়াগুলো সমকামীদের মেয়েলিস্বভাবের কারণ হাস্যকৌতুককর চরিত্রে দেখানও হয়। সেখানে সমকামীদের কোনও রোল মডেল দেখা যায় না বলে স্টুয়ার্ট মনে করেন।

গ্লাসগো শহরতলীর আঞ্চলিক ভাষায় স্টুয়ার্ট বইটি লেখা শুরু করেন। তখন কাজ করতেন। তিনি বলেন―‘সে সময় কিভাবে লিখতে হয় তা জানতাম না। আমি তখন চরিত্রগুলো নিয়ে ভাবতাম। কোনও পাঠকের ভাবনা আমার মাথায় ছিল না। আমি কি লিখতে চাই সেটাই লিখতে চেষ্টা করতাম।’

নিউ ইয়র্কে থাকতে শুরু করলে সকালে ফ্যাশন ডিজাইন অফিসে প্রতিদিনই যেতেন। নিউ ইয়র্কের সহকর্মীরা গ্লাসগোইয়ান উচ্চারণের ইংরেজিটা বুঝতে অসুবিধা বোধ করত। এজন্যই তিনি কাজের স্বার্থেই গ্লাইগোইয়ান ইংরেজিটা ভুলে যেতে থাকলেন। নিউ ইয়র্কের ইংরেজিটা আয়ত্ত করে ফেললেন। তবু তিনি ইচ্ছে করেই শ্যাগি বেন বইটিতে অনেক গ্লাসগোইয়ান উচ্চারণের ইংরেজি শব্দ-বাক্য ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু বইটি প্রকাশিত হওয়ার আগে প্রকাশক কর্তৃক নিয়োজিত তার সম্পাদক এটা করতে নিষেধ করেন। বইটি তখন পুরোপুরিই আমেরিকান ইংরেজিতেই প্রকাশিত হয়েছে।

শ্যাগি বেন বইটিকে স্টুয়ার্ট দুঃখের যন্ত্রণার আখ্যান বলতে চান না। যারা এটা মনে করেন তারা আসলে নিজেদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলে যাওয়ার জন্যই বলেন। তিনি মনে করেন বইটির মুখ্য চরিত্র শ্যাগি বেন একজন কিশোর। তখন সে যে জীবনের মধ্যে দিয়েই যাক না কেনো বয়স্কদের মতো দুঃখকষ্টকে গভীরভাবে বুঝতে পারা তার কথা নয়। কারণ সে এই ধরনের জীবনেই জন্ম নিয়েছে। বেড়ে উঠেছে। এই দুঃখকষ্টটাই তার কাছে স্বাভাবিক। বয়স্ক হলে হয়ত তারা বুঝতে পারে, হ্যাঁ, এটা হয়ত দুঃখের―যন্ত্রণার জীবনই ছিল।

স্টুয়ার্ট মনে করেন―বইটির মূল বিষয় ভালোবাসা। যে জীবন যাপন তিনি সে সময়ে করেছিলেন সে সময়ে যে ভালোবাসা অনুভব করেছিলেন তার মায়ের প্রতি, তার শহরের প্রতি―সেটাই এই বইয়ের মূল প্রতিপাদ্য। তার মা সারাজীবন ভালোবাসার কাঙাল ছিলেন। সেই ভালোবাসার প্রতি তার কাঙাল মায়ের ভালোবাসা আর তার নেশায় আসক্ত মায়ের প্রতি সন্তান হিসেবে তার ভালোলোবাসা―এ দু ধরনের ভালোবাসা তো কম কথা নয়। হতে পারে সে ভালোবাসা মিষ্টিমধুর ভালোবাসা নয়।

স্টুয়ার্ট বলেন―‘নিঃশর্ত ভালোবাসার জন্য একজন মানুষ কতদূর যেতে পারে সেটাও এই বইটির অন্যতম থিম।

বইটি বেশ কিছু প্রশ্ন জাগায়। তার অন্যতম হলো নিজেকে বাঁচানোর আগে ভালোবাসার মানুষটিকে  বাঁচাতে কত কিছুই না করতে পারে।’

গ্লাসগো শহরটির সঙ্গে তিনি সব সময়ই একটা আত্মিক টান অনুভব করেন। সেখানেই তার নাড়ী পোঁতা। পৃথিবীর যেখানে যান না কেন নিজেকে সব সময় গ্লাসগোর খেটে খাওয়া পরিবারের একজন ছেলেই মনে হয়। শ্যাগি বেন উপন্যাসটি তাই-ই।

লেখক : কথাশিল্পী,

এ নিবন্ধটি পাঠিয়েছেন নিউইয়র্ক থেকে

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button