আর্কাইভগল্প

রজনীর এক রাত

পিওনা আফরোজ

তখন ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। চোখে আধো ঘুম আধো জাগরণ। সকালের শুরুতেই একটু শীত শীত অনুভব হওয়াতে পায়ের কাছে পড়ে থাকা কাথাটাকে টেনে নিতে যাচ্ছিলাম, তখনই পাশের ঘর থেকে বারকয়েক কাশির শব্দ শুনে হুড়মুড় করে উঠে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি―হাতে সময় খুব কম। মনে পড়ল, আকরাম সাহেবের ওষুধের সময় হয়ে গেছে। তার বয়স সত্তরের কাছাকাছি হবে। শরীরে বিভিন্ন রোগ বাসা বেঁধেছে। যে কটা দিন বেঁচে আছেন যেন সুস্থ থাকেন, সেই আশায় নিয়মমতো ওষুধ-পথ্য খাবার চেষ্টা করেন।
আমি রজনী। আকরাম সাহেবের দেখাশোনা করি। অর্থাৎ এ বাড়িতে কাজ করি। আমি ছাড়া তাকে দেখবার মতো আর কেউ নেই। স্ত্রী ছিল, বছর তিনেক হলো মারা গেছে। একটা মাত্র ছেলে সেও বিদেশে থাকে। আমি চোখে-মুখে এলোপাথাড়ি পানি দিয়ে শরীরের কাপড়টা ঠিক করে আকরাম সাহেবের ঘরে ঢুকলাম।
আকরাম সাহেব বিছানায় হাতের ওপর ভর দিয়ে একটু সামনে ঝুঁকে বসে আছেন। তার পরনে সাদা আর ধূসর রঙের চেকের লুঙ্গি, গায়ে সাদা গেঞ্জি। তাকে দেখে মনে হলো দম নিতে কষ্ট হচ্ছে। এখনি বোধ হয় চোখগুলো কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে। কাছে গিয়ে বললাম, ‘আপনেরে কি পানি দিব ?’
উনি মাথা নেড়ে ভাঙা ভাঙা গলায় বললেন, ‘হুম। দাও।’
আমি আকরাম সাহেবকে পানি দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলাম। ফ্রিজ থেকে আগের দিন বিকেলে বানানো রুটি বের করে তাওয়ায় ছেঁকে প্লেটে সাজিয়ে নাস্তা দিয়ে এলাম। নাস্তা শেষে ওষুধ খাইয়ে দিয়ে জানতে চাইলাম, ‘এখন কেমন লাগছে ?’
বসা থেকে বিছানার উপর বালিশে মাথা রাখতে গিয়ে তিনি বললেন, ‘আগের চেয়ে ভালো।’
আচ্ছা, বলে আমি রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। এখন তিনি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবেন। হয়তো টিভি ছেড়ে হাদিস শুনবেন নয়ত কোরআন তেলওয়াত শুনবেন। আপাতত এ বেলার কাজ শেষ। এখন বেশ কিছুটা সময় আমি নিশ্চিন্তে কাটাতে পারব।
নিজের ঘরে ঢুকে বিছানার মাথার দিকের জানালাটা খুলে দিলাম। সকালের মৃদুমন্দ বাতাসে কফি কালারের পর্দাটা দুলে উঠল। বাইরে বাতাসে গাছের পাতারা দুলছে। আমি বিছানায় রাখা বালিশটা খাটের সাথে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে রইলাম। সকালের কাজের চাপে একটু ক্লান্ত লাগছে। সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। এখন চাইলেই অথবা সুইচ অন করলেই ফ্যানের মাতাল হাওয়া ছোট্ট এই ঘরটা জুড়ে দাপাদাপি করে বেড়ায়। অথচ সেই ছোটবেলায় যখন ঢাকা শহরের ছোট্ট একটা ঘরে আমার বাবা-মা তাদের তিন মেয়ে নিয়ে থাকত তখন বাবার খাট বা চকি কোনওটাই কেনার টাকা ছিলো না। মাটির উপরেই একটা চাটি আর চাটির উপরেই দুই তিনটা কাঁথা বিছিয়ে আমরা থাকতাম। গরমে অসহ্য কষ্ট হত। টিনের চাল। সারাদিন সূর্যের তাপে গরম হয়ে রাতে সেই তাপটা যেন অসহনীয় হয়ে পড়ত। বাসায় টেবিল ফ্যান বা সিলিং ফ্যান কিছুই ছিল না। বাঁশের হাত-পাখার উপরই ছিল একমাত্র ভরসা। সেই হাত-পাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে হাতে ফোসকা পড়ার উপক্রম হত। ছোট বোনটা প্রায়ই বলত, ‘গরমে অনেক কষ্ট হয়, একটা ফ্যান কিনেন না আব্বা…’
কিন্তু তিন বেলা খাবার যোগাতেই যেখানে হিমশিম খেতে হয় বাবার, সেখানে ফ্যান কিনবেন কোথা থেকে। এখন এটা বুঝলেও তখন সেই অল্প বয়সে এই ব্যাপারটা বোঝার ক্ষমতা ছিল না আমাদের কোনও বোনেরই। উত্তরে বাবা শুধু হাসিমুখে বলতেন, ‘কিনব রে মা কিনব।’
‘কবে কিনবেন ?’ ছোট্ট বোন শাহানা পাল্টা জিজ্ঞেস করলে বাবা বলতেন, ‘কয়টা দিন বাদেই কিনমু। হাতে কয়টা পয়সা জমুক।’
বাবার হয়ত আমাদের মিথ্যা আশ্বাস দিতে ভালো লাগত না কিন্তু এছাড়া আর কিইবা করার ছিল!
একদিন সকালে দেখলাম বাবা মাকে বলছেন, ‘আমি একটু বাজারের দিকে যাইতেছি। জসিমের দোকান থেইকা ঘুইরা আসি।’
‘জসিমের দোকানে কি কাম ?’ মা বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন।
‘দ্যাখি গিয়া ফ্যানের দাম দর ক্যামন ? শুনছি জসিমের দোকানে পুরানো ফ্যানও পাওন যায়। ফ্যানের মোটর, কয়েল এগুলান নষ্ট হইয়া গেলে মানুষ অল্প দামে বেইচা দেয়। যাইয়া দেখি, কিছু একটা ব্যবস্থা যদি করতে পারি! গরমে মাইয়াগুলার অনেক কষ্ট হয়।’
মেজ বোন রুনা তখন স্কুলে যায়। ক্লাস থ্রিতে পড়ে। ক্লাসের অন্যদের সুন্দর ইস্কুল ব্যাগ, নানা রকম চুল বাঁধার ব্যান্ড দেখে প্রায় দিননই স্কুল থেকে ফিরে মায়ের কাছে অনেকটা আবদারের স্বরেই বলত, ‘মা আমারে একটা সুন্দর ব্যাগ কিনা দিবা! জান মা, আমাদের ক্লাসের মিনা কি সুন্দর সুন্দর ব্যান্ড দিয়া চুল বাঁইধা আসে!’
মা কিছু বলে না। চুপ করে থাকে।
সারাদিন বাবার পাশাপাশি মাও খেটে মরে, সংসারটা যেন একটু ভালোভাবে চলে, সেই আশায়। কিন্তু তাতেও লাভ হত না। প্রায় দিন তিন বেলা খাবারও ঠিকভাবে জুটত না। ভাত থাকলে তরকারি মিলত না। বেশিরভাগ সময়ই শুকনো মরিচ পোড়া আর পানি দিয়ে কচলে ভাত খেতে হত। কথাগুলো মনে পড়লেই সেইসব দিনগুলো চোখের পাতায় ভেসে ওঠে। যেন আজও জীবন্ত, বিষাদে ভরা আর করুণ।
ভেবে আমার অবাক লাগে-জীবন কত অদ্ভুত! কতভাবেই না জীবনকে যাপন করতে হয়। কত কিছুই না লেখা থাকে জীবনের পরতে পরতে। সে জীবনকে উপলব্ধি না করে পাশ কাটিয়ে আসার কোনও উপায় নেই।
তখন মা সারাদিন সেলাই মেশিনে পেটিকোট, বøাউজ সেলাই করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি করত। সেই টাকা দিয়ে হয়ত বস্তির ভাড়াটা দিত নয়ত বাজারে মুদি দোকানের বাকি পড়ে গেলে তার কিছুটা শোধ করত। বাকিটা বাবার টং দোকানের আয়ের টাকায় কোনওভাবে চলে যেত। টানাটানির সংসার, কোনওকিছুরই ঠিকঠাক প্রয়োজন মিটত না। এত টানাপোড়নের মধ্য দিয়েও একবার মা মেজ বোন মিনাকে কিছু না বলে একটা স্কুলের ব্যাগ কিনে দিয়েছিল। সেদিন কি যে খুশি হয়েছিলো রুনা! কারণ বাবা, মা দু’জনেই চাইত, মেয়েদের পড়াশুনা শেখাতে। তারা একটা সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখত। পড়াশুনা শেষ করে তার মেয়েগুলা প্রাইমারি স্কুলের আপাদের মতো শিক্ষকতা করবে। স্বামি-স্ত্রী দু’জনে মিলে টাকা জমিয়ে গ্রামে এক টুকর জমি কিনে নিজেদের একটা বাড়ি করবে। এ রকম কত স্বপ্ন!
এর কিছুদিন পর থেকেই বাবার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। সারাদিন টঙ দোকানে গরমের মধ্যে পুড়ে মরেন। অবসাদে, ক্লান্তিতে হাত-পা ভেঙে আসতে চায়। বুকেও থেমে থেমে ব্যথা হয়। তাই দুই দিন ধরে দোকান খোলেন না বাবা। শরীর ভালো না থাকলে কাজ করবে কেমন করে! গরিব মানুষের শরীরটাই তো সব।
এদিকে মায়ের হাতেও তেমন কোনও টাকা পয়সা নেই। তবুও মার্কেটের কাজ শেষে সংসারের খরচ বাঁচিয়ে বাড়ি ফেরার সময় বাবার জন্য দুইটা বা একটা ফল কিনে নিয়ে আসে মা। তাতে যদি শরীরের দুর্বলতা খানিকটা কমে!
একদিন হঠাৎ করেই বাবার খুব জ্বর হলো। সারা শরীর জ্বরের তাপে পুড়ে যাচ্ছিল। বাবা কিছু খেতে পারেন না। শোয়া থেকে উঠতে পারেন না। সপ্তাহখানিক অসুস্থ থাকার পর এক সকালে সংসারের কাজ করতে করতে মা বাবাকে বলল, ‘কি ব্যাপার, উঠতাছেন না ক্যান ? কত বেলা হইয়া গেলো!’ বাবা মায়ের কথার কোনও উত্তর দেন না।
হঠাৎ মেঘের গুড়গুড় আওয়াজ শোনা গেলো। বাইরের আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেল। আলোকজ্জ্বল, ¯িœগ্ধ সকালটা নিমিষেই আঁধারের মাঝে হারালো। এতটাই অন্ধকার নেমে এল যে, বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় দিনের বেলায় মোমবাতি জ্বালাতে হলো।
মা আবার বাবাকে বলে, ‘কি অইলো, কথা কন না ক্যান ? আইজ কি আপনার শরীরটা বেশি খারাপ ?’ বাবা এবারও কিছু বলেন না। কাছে গিয়ে মা আরও কয়েকবার বাবাকে ডাকল, রজনীর বাপ ও রজনীর বাপ! কোনও উত্তর না পেয়ে অজানা আশংকায় বাইরের মেঘলা আকাশের মতো মায়ের চোখে মুখেও আঁধার ঘনীভ‚ত হয়ে এল! প্রকৃতিতে তখন প্রচÐ ঝড়ো হাওয়া বইছে। মাঝে মাঝে আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মা তাকিয়ে দেখে―দমকা হাওয়ার তোড়ে এতক্ষণ মোমবাতির সামান্য যে আলোটুকু প্রায় নিভে নিভে যাচ্ছিল, তা একেবারে নিভে গেছে। কিছুক্ষণ মোমাবাতির দিকে তাকিয়ে থেকে মায়ের মনে হলো, এটা কোনও অশুভ সংকেত নয়ত! এরপরই মা বাবার নাকের কাছে হাত নিল, বুকে কান পেতে হার্ট বিটের শব্দ শুনতে চেষ্টা করল। কিন্তু ততক্ষণে সব শব্দরা নিস্তব্ধ হয়ে গেছে।
বাবা মারা যাওয়ার পর আমার আর পড়াশোনা করা হয়নি। আমি তখন ক্লাস নাইনে ছিলাম। সংসারে অভাব তখন ঝাঁক বেঁধে এল। মা তিন মেয়ে নিয়ে কিভাবে সংসার চালাবে, কিভাবে আমাদের মানুষ করবে এই নিয়ে ভীষণ বিপদে পড়ে গেল। মা বাইরে কাজ করতে গেলে আমরা ঘরে একা থাকি। আমাদের নিয়ে সে খুব ভয় পেত! তার ভয়টা অন্য বোনদের তুলনায় আমাকে ঘিরেই বেশি ছিল। ভাবত, মেয়েটা বড় হয়েছে! একলা ঘর! যদি ওর কোনও সর্বনাশ হয়ে যায়! কার মনে কি আছে তা তো বলা যায় না। এইসব দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেতে মা তাড়াতাড়ি আমার বিয়েটা দিয়ে দিল।
আনমনে বসে পুরনো দিনের কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ টের পেলাম, শরীরে ঠাÐা ঠাÐা অনুভ‚তি হচ্ছে। জানালার দিকে চোখ পড়তেই দেখি, মেঘপূর্ব বাতাসে ঘরের পর্দটা জোরে দুলে উঠলো। বাইরের ঘন গাছপালাগুলোও জোরে জোরে দুলছে। হালকা বৃষ্টিও শুরু হয়েছে। ঘরে বৃষ্টির পানি আসবে ভেবে আমি জানালাটা বন্ধ করে দিলাম। কিন্তু পর্দটা ফাঁকা করে বন্ধ কাঁচের জানালা দিয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম বেশ কিছুক্ষণ। মনে হলো, মেঘলা আকাশের সাথে মানুষের মনের একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে। হৃদয়ের গহিনে থাকা ভুলে যাওয়া কত স্মৃতিরা জেগে ওঠে সেই মুহূর্তে! আবার কখনও কখনও অকারণেই মন খারাপ হয়। অযথাই কত কি করতে ইচ্ছে করে! ঠিক এরকমই এক মেঘলা দিনে আমার সাথে রাজুর বিয়ে হয়েছিলো।
রাজু দেখতে শুনতে বেশ। বয়সও বেশি না। আমার চেয়ে মাত্র পাঁচ বছরের বড়। তখন ওকে দেখে ভীষণ ভালো লেগে যায়। ওকে খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়। ওর হাসি, ওর চাহনি, কথা বলা সবকিছইু ভালো লাগত। আমার দু’চোখে তখন আকাশ ভরা স্বপ্ন। আমি তখন কোমরে আঁচল গুঁজে কাজ করি ছোট্ট সংসারে। শুধু স্বামী আর আমি। সংসারে সুখ আর সোহাগের কোনও কমতি ছিল না। বিয়ের পর দিনগুলো বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছিল।
রাজু ভালো গাইতে জানত। খুব মিষ্টি কন্ঠ তার! এলাকায় গানের একটা সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিল সে। প্রায় সময়ই গানের অনুষ্ঠান থাকলে দলবল নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ছুটে যেত। গভীর রাত পর্যন্ত অনুষ্ঠান চলত। ঢাকার বাইরে গেলে কখনও কখনও দুই-তিন দিন পর ফিরত। আয়-উপার্জন যা করত তাতে সংসার কোনওভাবে চলে যেত। এখানে বাবার বাড়ির মতো এত অভাব ছিল না। তিনবেলা খাবারের জন্য হা-হুতাশ করতে হত না।
তখন যৌবনের জোয়ারে মাতাল বুক। দেহের ভাঁজে ভাঁজে ঝরে পড়ে কাম। সময়ে-অসময়ে বাইরে থেকে ফিরেই রাজু আমার শরীরে হাত দিত। জড়িয়ে ধরত। আদর করত। আমার ভালো লাগত।
একসময় ঘর আলো করে এল আমাদের মেয়ে রেশমা। কিন্তু রাজু তখন গানের দল নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। সকালে বাসা থেকে বেরুলে গভীর রাতে বাসায় ফেরে। বাসায় ফেরার পরও আমার বা রেশমার প্রতি তার তেমন কোনও মনোযোগ ছিল না। অকারণেই রেগে যেত। সংসারের কোনও প্রয়োজনীয় কথা বললেও বিরক্ত হত। দিনের পর দিন আমরা যেন তার কাছে অসহ্য হয়ে উঠছিলাম।
এ অবস্থা থেকে মুক্তির কোনও উপায় না দেখে একসময় মায়ের বাড়িতে গিয়ে উঠি।
কিন্তু তাতে কোনও লাভ হলো না। দুই মাস কেটে যাবার পরও রাজু আমাদের খোঁজ নিতে আসেনি। এদিকে প্রতিবেশি, আত্মীয়-স্বজনেরা নানা কথা বলাবলি করে। তাদের ধারণা রাজু আমায় তাড়িয়ে দিয়েছে। এই ধারণাকেই তারা সত্য ঘটনা ভেবে পুরো গ্রাম জুড়ে প্রচার করতে থাকে।
অন্যদিকে একার উপার্জনে দুই বোনকে নিয়ে সংসার চালাতে মায়ের খুব কষ্ট হত। তার মধ্যে আবার যোগ হয়েছি আমি আর আমার মেয়ে রেশমা। মা বেশ কিছুদিন ধরে পুরনো কাজের পাশাপাশি বাসার কাছেই গাজিপুরের একটা সোয়েটার ফ্যাক্টরি থেকে অল্পস্বল্প কিছু কাজের অর্ডার এনে এলাকায় গরিব মানুষদের দিয়ে করিয়ে নেয়। সেইখান থেকে কিছু কমিশন পায়। তাতে দু-বেলা মুখে ভাত জোটে। সারাদিন মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে একবার কাজ দিয়ে আসে আবার তাদের কাজ শেষ হলো কিনা গিয়ে দ্যাখে! নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ জমা না দিলে পরে আর কাজ পাওয়া যাবে না, তাই কি চৈত্রের রোদ আর কি বৃষ্টি কোনও কিছুতেই ঘরে বসে থাকার কোনও উপায় নেই। মায়ের রোদেপড়া মুখের দিকে তাকিয়ে আমার বুকের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যায়।
মায়ের সংসারের এ অবস্থা দেখে সিদ্ধান্ত নিই, স্বামীর সংসারেই ফিরে যাব। কিন্তু অনেকদিন পর নিজ সংসারে ফিরলেও রাজুর কোনও পরিবর্তন চোখে পড়েনি। একদিন সকালে বাজারে যাবার সময় রাজুকে বললাম, ‘ঘরে চাল নাই, এই বেলা চাল না আনলে না খাইয়া থাকা লাগব।’ কথা শুনেই রাজু আমার দিকে তেড়ে আসে। মুখের উপর বলে, ‘চাল না থাকলে আমি কি করুম! না থাকলে খাবি না। আর এত যদি খাওনের সখ হয়, মায়ের বাড়িত থেইকা আইনা গিল! পয়সা-কড়ি ছাড়া তোর মায়ে এক ফকিরনি গছাইছে আমারে, আমি বিয়া না করলে তোরে বিয়া করত কে শুনি ?’
এরপর বহুদিন কেটে যায়, রাজু আমার বিছানায়ও আসে না। হঠাৎ করে মানুষটার কি হলো! কিভাবে এত বদলে গেলো! দিনরাত ভেবে ভেবে আমি দিশেহারা।
এক দুপুরে মায়ের কাছে গিয়েছিলাম কিছু টাকা আর কেজি খানিক চালের জন্য। ফিরে এসে দেখি, আমার ঘরের দরজাটা ভেজানো। আমাকে দেখেই মেয়েটি তাড়াহুড়ো করে বিছানা থেকে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমি চিৎকার করে উঠি। দেয়ালে মাথা ঠুকি। বলি, হায় আল্লাহ! কি কপাল আমার! এটাও দেখতে হইলো আমারে!
রাজু গলা উঁচিয়ে বলল, ‘বেশ করেছি, আমার ঘরে আমি যারে ইচ্ছা আনবো! ভালো না লাগলে বাহির হইয়া যা। দরজা খোলা আছে। আমারে মুক্তি দে।’
দুপুরের এত আলোর মাঝেও আমার দু’চোখে যেন অন্ধকার দেখতে পাই। তখন মাথাটা ঝিমঝিম করছিল। মাথার দু’পাশের রগ মনে হলো তখনই ছিঁড়ে যাবে। আমার দিকে ভ্রæক্ষেপ না করে রাজু ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
আমি রেশমার নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবি, বাচ্চাটা নিয়ে আমি এখন কি করব! কোথায় যাব, জানি না। গলায় দড়ি দিব ? পানিতে ডুবে মরব ? তাতে হয়ত আমি এ জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচব। কিন্তু আমার মেয়ের কি হবে ? ওকে কে দেখবে ?
কোনও উপায় না পেয়ে মায়ের কাছে যাই। গরিব মা ছাড়া আমার তো আর কেউ নেই। মাকে সব কিছু খুলে বলি। রাজু যে অন্য মেয়েকে নিয়ে ঘরে এসেছে সে কথাটাও জানাই। আমার সব কথা শুনে রাজুর প্রতি মা’র কোনও রাগ তো হইয়নি বরং মা আমাকে বলেছে, ‘মাইয়া মানুষের এত তেজ থাকতে নাই। সামান্য বিষয় নিয়া ঝামেলা কইরা ঘর ছাইড়া আসা তোর ঠিক হয় নাই। যা হওয়ার হইছে। নিজের ঘরে ফিরা যা। আর আরেকটা কথা তোরে জানাইয়া রাখি, আমার এখানে আমি তোরে রাখতে পারুম না।’
সেদিন মায়ের কথায় আমার দু’চোখ জুড়ে অন্ধকার নেমে এসেছিল। শেষ পর্যন্ত কোথাও কোনও আশ্রয় না পেয়ে দূরম্পর্কের এক চাচার কাছে যাই। যদি তিনি একটু আশ্রয় দেন, সেই আশায়। সেখানে গিয়ে দেখি, তার অনেক বড় বাড়ি। বাড়িতে চাচি আর চাচা ছাড়া আর কেউ নেই। শুনেছি তাদের কোনও সন্তানাদি হয়নি। আমার সব কথা শুনে তিনি আমাকে তার ঘরের পাশে ছোট্ট একচালা একটি টিনের ঘরে থাকতে দিলেন। সেখানে ঘর-দোর পরিষ্কার করা, থালা-বাসন ধোয়া, সবার কাপড়-চোপড় ধোয়া―এগুলো সবই করতে হত। তবু ভাবলাম, এভাবেই দিন যদি কেটে যায়, তাতে মন্দ কি ? কারও মুখাপেক্ষী তো থাকতে হচ্ছে না। তাছাড়া রেশমাকে চাচি খুব আদর করে। আমি যখন বাড়ির কাজ করি, তখন চাচিই রেশমাকে সামলায়। কোলে নিয়ে রাখে, এটা ওটা খেতে দেয়।
এ বাড়িতে কোনও কিছুরই অভাব নেই। খাটের উপর শুয়ে বসে চাচির দিন কাটে। শুনেছি, চাচির সাথে চাচা গলা চড়িয়ে কথা বলেছেন এমন ঘটনা খুব কম। আর গায়ে হাত তোলা তো অনেক দূরের ব্যাপার। তার মানে এই নয়, চাচা চাচিকে খুব সম্মান করেন বা ভালোবাসেন। আমার মনে হয়, তাকে তিনি যতটা না ভালোবাসতেন তার চেয়ে বেশি ভয় পেতেন। কারণ চাচি ছিলেন চেয়ারম্যানের মেয়ে। তার বাবার টাকাতেই এ বাড়িটি করা। শ্বশুরবাড়ির লোকজন বেড়াতে এলে চাচা তাদের খুব সমিহ করতেন। বাজার থেকে তাজা মাছ, মুরগি এনে রান্না করে খাওয়াতেন।
তবু চাচাকে ঠিক বুঝতে পারতাম না। চুপচাপ থাকতেন। খুব প্রয়োজন না হলে আমার সামনে আসতেন না। পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও তাকে কখনও খারাপ মানুষ মনে হয়নি। কিন্তু চাচার সম্পর্কে আমার এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো এর কিছুদিন পরেই।
একদিন রাতে বিছানায় শুয়ে আছি। ঘরের আলো তখন নিভান। দরোজাটা ভেজানো ছিল। আমার চোখ সারাদিনের ক্লান্তিতে বুঁজে আসছে। হঠাৎ কখন যে চাচা আমার ঘরে ঢুকেছে তা টের পাইনি।
কিন্তু যখন সব শেষ হয়ে গেলো আমার ভিতরে তখন বিবেক জেগে উঠল। মনে হলো এ আমি কি করলাম, কেন নিজেকে সঁপে দিলাম! আবার মনে হলো, এছাড়া আমার কিইবা করার ছিল! আমি চিৎকার দিলে, চাচি যদি মনে করত তার স্বামীকে ফাঁসানোর জন্য এই গল্প ফেঁদেছি! তাতে কি লাভ হত! বরং চাচি কষ্ট পেত। বিশ্বাস ভাঙ্গার কষ্ট।
আমার তখন মনে হলো, যার আশ্রয়ে থেকে, খেয়ে-পরে আমি আর আমার সন্তানের দিন কেটে যাচ্ছে, তার ঘরে আমি অশান্তির ঝড় তুলতে পারি না। এ বড় অন্যায়! যে ভুল একবার ঘটে গেছে তার পুনরাবৃত্তি হোক আমি তা চাই না। তাই তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম, আমাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে। কিন্তু কোথায় যাব ? কার কাছে যাব ? কেউ তো নেই! আর আমার মেয়ে রেশমা ওরই বা কি হবে! সেদিন আবার বুঝলাম-সহায় সম্বলহীন কোনও নারীর জীবনের পথ চলাটা সহজ নয়। তাদের ঘর যতটা শৃঙ্খলে আবদ্ধ, বাহির তার চেয়ে ঢের বেশি।
আমি রেশমার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ও ঘুমাচ্ছে! বাইরে চাঁদের আলো। জানালার গ্রিল গলে সেই আলো এসে পড়ছে আমার রেশমার মুখে! কি মায়াময় লাগছে ওর মুখটা! রাত্রিজুড়ে তখন জোছনার লুকোচুরি। আশপাশের ঘরগুলো যেন চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পরেই আমি রেশমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। রাত্রির গভীর নীরবতার মাঝে ঘর থেকে বেরিয়ে যখন বট গাছটার মোড় পেরুলাম ঠিক তখনই বুকের ভেতরটা হুহু করে কেঁদে উঠল। এক সন্তানের জন্য। আমার রেশমার জন্য। বাঁধভাঙা চোখের পানিতে গাল ভিজেছিল সেদিন। হঠাৎ তখন মনে হলো, সব মায়া সবার জীবনে মঙ্গল বয়ে আনে না। কিছু মায়া ত্যাগেই হয়ত সুখ লুকিয়ে থাকে। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, আমার মাতৃত্বের সবটুকু মমতার বিসর্জনে রেশমার জীবন যদি নিরাপদে থাকে, তাতে ক্ষতি কি! যে নিরাপদ জীবন অর্থাভাবে কোনওদিন আমি পাইনি, মানুষের কত অপমান আর লাঞ্ছনা সয়েছি! শুধু এখানে ওখানে একটু আশ্রয় খুঁজে ফিরেছি। তা যদি রেশমা পায়, তাতে যদি ও ভালো থাকে তবে মা হয়েও সন্তানের প্রতি সব অধিকার থেকে নিজেকে স্বেচ্ছায় মুক্তি দিতে আমার কোনও দ্বিধা নেই। হয়ত চাচি রেশমাকে নিরাপদ একটা জীবন দিতে পারবে। অর্থ-বিত্ত, সম্মান সবকিছুর মধ্য দিয়ে রেশমা বেড়ে উঠবে। যা আমি ওকে কখনওই দিতে পারব না। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ভাবনার অতলে ডুবে গিয়েছিলাম।
‘রজনী, কোথায় গেলে ?’ আকরাম সাহেবের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। এখন তাকে এক কাপ চা দিতে হবে। প্রতিদিন এ সময়ে এক কাপ চা তার চাই।
তবু ভালো যে আকরাম সাহেবের মতো একজন মানুষের আশ্রয়ে আমি আছি। চাচার বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কোথায় যাব, কি করব এসব যখন ভাবছিলাম তখনই আকরাম সাহেবের ছেলে আসিফ সাহেবের সাথে দেখা হয়। তার বাবার দেখাশোনার জন্যই তিনি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন। অবশ্য তার বিনিময়ে মাস শেষে মাইনেও দেন। তাদের দয়ায় আজ এখানে আছি। অথচ আমিও চেয়েছিলাম, স্বামী, সন্তান নিয়ে আমার ছোট্ট একটা সংসার হবে। হলো না। কিছুই হলো না। নিজের বলে আজ আর কিছুই নেই। যা আমার, শুধুই আমার ছিল, তাও হারিয়ে ফেলেছি। আমার সন্তান আজ অন্য কারও আশ্রয়ে বেড়ে উঠছে। আমি যে তার মা এ সত্যটুকু সে হয়ত কোনওদিন জানবে না।
সচিত্রকরণ : রাজীব দত্ত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button