আর্কাইভউপন্যাস

অঙ্গুস্তানা

গোয়েন্দা উপন্যাস

অরুণ কুমার বিশ্বাস

ডা. নিশাত তার নিজের ফ্ল্যাটে খুন হয়েছেন। কলাবাগানের ডলফিন গলিতে বাসা। একাই থাকতেন। অথচ একসময় তার পরিবার ছিল, আছে দুই সন্তানও।

বস্তুত, এই ‘ছিল আর আছে’র মাঝখানে খুব বাজেভাবে ঘুরপাক খাচ্ছিলেন বছর চল্লিশেক বয়সের গাইনিবিশেষজ্ঞ ডা. নিশাত চৌধুরী। বেঁচে থাকাটা তার কাছে মোটেও উপভোগ্য ছিল না, বরং তিনি মরেই যেন বেঁচে গেলেন।

শুরুতে মনে হয়েছিল আত্মহত্যা করেছেন তিনি। একলা ঘরে কেইবা তাকে খুন করতে আসবে! ঘরের দরজাও ভেতর থেকে বন্ধ ছিল বলে অনুমান। কিন্তু এই একটা ব্যাপারে শুরুতে প্রায় সকলেই খুব ভুল করে। আজকালকার দিনে বেশির ভাগ ঘরের দরজাই ইয়েল-লক সিস্টেম। অর্থাৎ কষ্ট করে একবার ভেতরে ঢুকতে পারলে কামকাজ সেরে বেরিয়ে আসবার সময় দরজাটা জাস্ট একটু টেনে দিলেই হয়। তখন আর বোঝার উপায় থাকে না যে, বাইরের কেউ ভেতরে ঢুকেছিল কি না। 

ক্রাইম সিন দেখছেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়। সঙ্গে তার দুই সহযোগী আর্কিটেক্ট উর্বী বোস এবং রিপোর্টার আসিফ ইমরুল। কলবাগান থানার ওসি (তদন্ত) শিবলি নোমান আছেন, আছে তার কিছু সাবঅর্ডিনেট অফিসারও।

এখানে বলে রাখা ভালো, দোতলার এই বাসায় ডা. নিশাত একা থাকতেন বিধায় বাড়তি বিবেচনায় দুটো রুম তিনি সাবলেট দিয়েছিলেন। তিন রুমের ফ্ল্যাটে দুটি ওয়াশরুম, একটা কমন কিচেন আর দু’টুকরো স্বল্পপরিসর বারান্দা রয়েছে। নিশাত অবশ্য রান্নাবান্না খুব একটা করতেন না, প্রায়ই তিনি বাইরে খেয়ে আসতেন―হাসপাতালের ক্যান্টিনে। 

করোনার আকালের কারণে শহরে থেমে থেমে লকডাউন, শাটডাউন বা কঠোর লকডাউন জারি থাকছে, চাইলেও তাই ফ্রি মুভমেন্ট করা সম্ভব নয়। স্কুল-কলেজও বন্ধ, ডা. নিশাতের দুই প্রতিবেশীর মাঝে একজন ঘটনার সময় ঢাকাতেই ছিল না বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। আরেকজন ঢাকায় থাকলেও ঘটনার রাতে নাকি সে তার বন্ধুর বাসায় অবস্থান করছিল―বনানীতে।

তার মানে ঘটনাটা খুব সহজে এবং নিশ্চিন্তে ঘটিয়ে ফেললেন ডা. নিশাত। কী ঘটনা সেই ব্যাপারে একটু জানা যাক। কলাবাগান থানার ইন্সপেক্টর শিবলি নোমান এখনও অবদি মনে করছেন যে এটা নিছক একটা অপঘাত। অর্থাৎ ভুলক্রমে বা স্বেচ্ছায় নিজেকে পুড়িয়ে মেরেছেন ডা. নিশাত চৌধুরী। কারণ, খুব সকালে তার ঘর থেকে ধোঁয়া বেরুতে দেখে দারোয়ান জলিল মিঞা দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকেছিল, এবং ঘরের ভেতরে যথারীতি কেউ ছিল না। তাহলে প্রশ্ন- ভিকটিমকে খুন করবে কে ? কীভাবে!

ঘটনার ‘দুই মাত্র’ প্রত্যক্ষদর্শীর অন্যতম দারোয়ান জলিলকে ডাকার আগে ডা. নিশাতের ঘরখানা খুব ভালো করে পর্যবেক্ষণ করছেন অলোকেশ। কারণ, এই সুযোগ তিনি বারবার পাবেন না। প্রতি মুহূর্তে ক্রাইম সিনের (অবশ্য যদি ক্রাইম কিছু ঘটে থাকে তাহলেই) চেহারা ও চরিত্র বদলে যাবে।

দশ ফুট বা বারো ফুট প্রায় বর্গাকার ঘরের দক্ষিণ-পুবে একটা সেমি-ডাবল খাট পাতা আছে। সঙ্গে একটা কাঠের তৈরি আলমারি, ওয়ারড্রোব, একটা ছোট আলনা, এবং একজোড়া টেবিল-চেয়ার। এই হলো গিয়ে ভিকটিমের ঘরের বিন্যাস ও আসবাবপত্র।

খাটের একপাশ থেকে তার আধখানা লাশ মেঝেতে নেমেছে, উল্টোভাবে। শরীরের নিম্নাংশ অনেকখানি পুড়ে গেছে, তবে ওপরের দিকটা অটুট আছে, যা কি না খাট থেকে নিচের দিকে ঝুলছিল। তার পরনে শাড়ি, খুব একটা দামি বলে মনে হয়নি, বরং আটপৌরে বলা চলে। অলংকারাদিও কিছু নেই, শুধু তার ডান হাতের অনামিকায় ছোট্ট আংটি, তাতে নীলাভ পাথর বসানো। তার চেহারায় হতাশার ছাপ স্পষ্ট। একাদিক্রমে অনেকগুলো রাত না ঘুমালে বা নিয়মিত ঘুমের ওষুধ খেলে মুখমণ্ডল যেমন ফোলা-ফোলা দেখতে হয়, ডা. নিশাতের চেহারাও ঠিক তেমনি। অর্থাৎ তিনি যে খুব সুখে ছিলেন না, সে-কথা হলফ করে বলা যায়।

অলোকেশ রয় পেশাদার ডিটেকটিভ, আপনারা জানেন। তার অনুসন্ধিৎসু মন সবসময় কিছু একটা খুঁজে ফেরে। হতে পারে ডা. নিশাত আগুনে পুড়েছেন, কিন্তু তিনি পুড়লেন কী করে! স্বেচ্ছায়, নাকি দুর্ঘটনাবশত! ঝটপট তিনি কিচেনে গেলেন।

হুঁ! কিছু একটা গন্ধ পাচ্ছেন অলোকেশ। গ্যাস! রান্নার চুলা থেকে হয়ত গ্যাসের উদ্গিরণ ঘটেছে, কিন্তু সেই ইগনিশন বাল্ব কোথায়! গ্যাস তো আর এমনি এমনি জ¦লে না, কিছু একটা উপলক্ষ চাই। দেশলাই, সুইচ বা অন্যকিছু! 

ইন্সপেক্টর নোমান অবশ্য গ্যাসের গন্ধ পেয়েই খুশি। তিনি ধরে নিয়েছেন কেসটা অপঘাত মাত্র। বা আরও বাজে কিছু ঘটলে, হতে পারে, সুইসাইড।

নোট নিচ্ছে রিপোর্টার ইমরুল, দ্রষ্টব্য যা কিছু সব লিখছে তার কেস-ডায়েরিতে। উর্বী ওর সদ্য কেনা ক্যামেরায় স্পটের স্যাটাস্যাট কিছু ছবি তুলল। বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে লাশের ক্লোজ শট নিল, নানান দিক থেকে রুমের লং-শট ইত্যাদি।

কী বুঝলেন ডিটেকটিভ অলোকেশ, কেসটা কী ? সিম্পল ডেথ বাই বার্নিং, তাই তো ? মৃদু হেসে বললেন ইন্সপেক্টর শিবলি নোমান। অলোকেশ অবশ্য এখানে হাসি পাবার মতোন কোনও উপাদান খুঁজে পেলেন না। তাহলে ভদ্রলোক হাসলেন যে!  

ডিটেকটিভ অলোকেশ ‘হুঁ আর উহুঁ’র মাঝামাঝি এক রকম শব্দ করলেন। অর্থাৎ তিনি এখনও ডা. নিশাতের মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না। বস্তুত, দেখার এখনও অনেক কিছুই বাকি আছে। ইটস টু আরলি টু কমেন্ট!

কেন ভাই, আর কী দেখবেন ? ভিকটিমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, রান্নাঘরে গ্যাসের গন্ধ, নিশাতের ঘরে কেউ ঢুকেছে বলেও মনে হয় না, কারণ ঘরের দরজায় ফোর্স-এন্ট্রির আলামত নেই। তাহলে ?  

শুরুতেই দুটো হুড়কো দিলেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়। মানে ডিসেন্ট। কষা গলায় বললেন, দেখুন ইন্সপেক্টর, রান্নাঘরের গ্যাসের গন্ধে প্রমাণ হয় না যে আগুনটা লাফিয়ে লাফিয়ে ডা. নিশাতের ঘরে এসে ঢুকেছিল। তাছাড়া কিচেনে আগুন লাগলে কিচেন আর নিশাতের ঘরের মাঝখানে যে প্যাসেজ, সেখানে রাখা সয়াবিন তেলের প্লাস্টিক বোতলেও আগুন লাগত, নয় কি! আর তেলের আগুনÑআপনি তো জানেনই ইন্সপেক্টর, এত অল্পে দমে না। কিচেনে গ্যাস লিক করছে, অথচ সেখানে কিছুই পোড়েনি! হয় কখনও ? 

তাহলে! একটু যেন থতমত খান ইন্সপেক্টর শিবলি নোমান।

তাহলে আর কি! আমার যতটুকু অনুমান, কেসটা আগুনের নয়, অন্য কিছু। সম্ভবত আগুন লাগিয়ে আমাদের মিস-লিড করা হচ্ছে।

আগুনের ব্যাপারটা মিস-লিডিং! কীভাবে ? কৌতূহলী হয়ে ওঠেন ইন্সপেক্টর নোমান। 

ওই যে, কিচেনে গ্যাসের গন্ধ, ডা. নিশাতের শরীরের নিম্নাংশ পোড়া, তার ঘর থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছিল। সেটা দেখেই নীচ থেকে ছুটে এল দারোয়ান জলিল মিঞা, কিন্তু―!

কিন্তু কী আবার ? ফের জানতে চান মিস্টার নোমান।

এবার একটু সময় নেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়। তিনি যেন কী ভাবছেন। উর্বী আর ইমরুলকে দেখছেন তিনি। ওরা ঠিকঠাক কাজ করছে তো!

বলুন না ডিটেকটিভ, এখানে কিন্তু-র কী দেখলেন ? প্লিজ, শেয়ার উইদ মি। 

ডা. নিশাত সম্ভবত আগুনে পুড়ে মারা যাননি। অমনি দুম করে বললেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়।

হোয়াট! তাহলে তার মৃত্যুর কারণ আর কী হতে পারে ? আপনি কী করে নিশ্চিত হলেন যে তার মৃত্যুর কারণটা অন্য ? উত্তেজনার চোটে ডাবল-সাইজ প্রশ্ন করে বসলেন ইন্সপেক্টর শিবলি নোমান। 

তাতে মুচকি হাসেন ডিটেকটিভ অলোকেশ। বললেন, ক্রমশ প্রকাশ্য। এখনই অত অধৈর্য হবেন না, ইন্সপেক্টর। শুধু জেনে রাখুন, এই কেসে মসলা আছে, ব্যাপক রহস্য দেখতে পাচ্ছি আমি। 

রহস্য! হাউ ফানি। আমার তো মনে হয় ইটস অ্যা সিম্পল কেস অফ বার্নিং। সবাই তাই বলবে―আগুনে পুড়ে মারা গেছেন ডা. নিশাত চৌধুরী।

কে কী বলল তাতে কিছু এসে যায় না ভাই নোমান। মনে রাখবেন, গোয়েন্দার চোখ আর আমজনতার নজর মোটেও এককথা নয়। মওকা বুঝে বেশ খানিকটা ভাব নিয়ে ফেললেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়। 

দুই.

উর্বীও অলোকের সঙ্গে একমত। আগুনটা মোটেও আগুন নয়, ওটা জাস্ট পুলিশের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেবার কৌশল মাত্র।

কৌশল নয়, বরং বলুন অপপ্রয়াস। রিপোর্টার ইমরুল শুধরে দিল।

এগজাক্টলি। মাথা নাড়লেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়। কেসে প্রচুর ঘাপলা আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আগুনে না পুড়লে ডা. নিশাত মারা গেলেন কী করে ? কেই বা মারল ?

মারলো মানে? আপনি শিওর যে, খুন হয়েছেন ডা. নিশাত ? অমনি ঘাঁউ করে উঠলেন ইন্সপেক্টর শিবলি নোমান।

তাতে আলতো হাসেন অলোকেশ। বললেন, অলমোস্ট নাইনটি পারসেন্ট নিশ্চিত যে এটা খুনের কেস, সুইসাইড বা অপঘাত নয়। অলোকের কণ্ঠে প্রত্যয়। তিনি আরও একটু যোগ করলেন, আমি আপনাকে একটা রিকোয়েস্ট করতে পারি, ইন্সপেক্টর ?

ওহ্ শিওর। বলুন কী করতে হবে!

অকুস্থল আই মিন ক্রাইম-সিন আরেকটু ভালো করে দেখুন। সবচে ভালো হয় যদি হোমিসাইড-বিশেষজ্ঞ কাউকে ডাকা যায়। ‘অ্যা টিম অফ কেমিকো-ফরেনসিক স্পেশালিস্টস’। কারণ এখানে আগুনের উপস্থিতি রয়েছে।

আবার আগুন! আপনি না বললেন আগুনটা স্রেফ লোক দেখানো! ডা. নিশাত আদতে আগুনে পুড়ে মারা যাননি! স্পষ্টই উষ্মা প্রকাশ করলেন ইন্সপেক্টর শিবলি নোমান।

তা বলেছি। কিন্তু মিস্টার ইন্সপেক্টর, আমার কাজের নির্দিষ্ট কিছু দস্তুর বা রীতিপদ্ধতি আছে। আমি যেমন কাউকে সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখি না, ঠিক সেই রকম কোনও সম্ভাবনাই শুরুতে একেবারে উড়িয়ে দিই না, অন্তত যতক্ষণ কেসটা পুরো খোলাসা হয়। তাতে সত্যকে পাশ কাটিয়ে যাবার সুঁড়িপথ তৈরি হয়। তদন্তও বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

ইন্সপেক্টর নোমান কী বুঝলেন জানি না, কাকে যেন তিনি ফোন করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনজনের একটা টিম এসে হাজির হয়। তাদের একজন আবার ডিটেকটিভ অলোকেশের বিশেষ পরিচিত। সিআইডি অফিসার ফয়সল মুরাদ। তিনি অলোকের বিশেষ অনুরাগীও বটে। তাঁর গুণপনা সম্পর্কে মুরাদের বেশ ধারণা আছে।

ডিটেকটিভ অলোকেশ, আপনি এখানে! আপনার মক্কেল কে জানতে পারি ? হেসে বললেন মুরাদ।

উত্তরে তিনি উর্বীকে দেখিয়ে দিলেন। আপাতত ইনিই আমার মক্কেল এবং সহযোগীও বটে। যিনি মারা গেছেন তিনি উর্বীর বিশেষ পরিচিত। খবর পেয়েই আমরা এখানে এসেছি। সেই অর্থে ‘রবাহুত’ বলতে পারেন।

অলোকের রসবোধ ইন্সপেক্টর নোমানকেও আকৃষ্ট করে। তিনি মিছে আর রাগ পুষে রাখেন না। ডিটেকটিভ অলোকেশের সঙ্গে দিব্যি সন্ধি করে নেন। কারণ, ইতোমধ্যে তিনি জেনে গিয়েছেন যে, চৌকস গোয়েন্দা অলোকেশ, এবং পুলিশের উপরতলায় গোয়েন্দাপ্রবরের বেশ জানাশোনাও আছে। তাই চাইলেও তিনি তাকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারবেন না। আর তার দরকারও নেই।    

সিআইডি টিম খুব যত্নসহকারে ক্রাইম-সিন এগজামিন করছেন। প্রতি ইঞ্চি জায়গা তারা খতিয়ে দেখছেন। সেই সঙ্গে যোগ দিয়েছে উর্বী আর ইমরুল। যেখানে ডা. নিশাতের লাশ পড়েছিল, তার থেকে ঘরের দরজার দূরত্ব কম করে হলেও আড়াই ফুট। এই আড়াই ফুট জায়গায় কিন্তু আগুনের তেমন কোনও আলামত নেই। অথচ আগুনে তার শরীর পুড়েছিল। নিম্নাঙ্গের অনেকখানি পুড়ে কালো হয়ে গেছে। শাড়িও পুড়েছিল, তবে তিনি পুরোপুরি বেআব্রু হয়ে যাননি। 

আগুনের ব্যাপারটা পুরোপুরি সাজানো। নাটক বলতে পারেন। আবারও বললেন অলোকেশ।

হোয়াট ডু ইউ মিন, মিস্টার ডিটেকটিভ ? কৌতূহলোদ্দীপক প্রশ্ন করলেন ইন্সপেক্টর শিবলি নোমান।

মানে আমি বলতে চাইছি, কিচেনে গ্যাসের গন্ধ পাওয়া গেলেও, বস্তুত, সেই গ্যাসের সঙ্গে ভিকটিম নিশাতের পুড়ে যাবার কোনও সম্বন্ধ নেই। ওটা স্রেফ আই-ওয়াশ!

সে-কথা আপনি আগেও বলেছেন ডিটেকটিভ অলোকেশ। মনে করিয়ে দেন ইন্সপেক্টর।  

হুঁ। কারণ সেটাই সঠিক বলে আমি মনে করি। বারবার বললেও সত্যিটা কখনও বদলে যায় না নোমান ভাই।

এই কেসে ব্যাপক রহস্যের আঁচ পেয়ে অলোককে বরং বেশ খুশিই মনে হয়। কারণ কেসে জম্পেশ মাল-মসলা না থাকলে মাথা ঘামিয়ে তিনি বিশেষ আরাম পান না। কেসটা কেমন যেন আলুনি মনে হয়!  

প্রায় আধা ঘণ্টামতো কাটল। সিআইডি টিমের কাজ মোটামুটি শেষ। তারা ডা. নিশাতের রুম থেকে কিছু আলামত তুলে নিলেন। পোড়া শাড়ি, নিশাতের চুল, চুলের ক্লিপ, স্যান্ডেল ইত্যাদি। লাশ খুঁটিয়ে দেখলেন অলোকেশ। ভোর রাতের দিকে নিশাতের মৃত্যু হয়েছে বলে তার অনুমান। ফরেনসিক ডক্টর এ বিষয়ে আরও ভালো বলতে পারবেন। অলোকের এমন ধারণার পেছনে যুক্তিটা হল, এরই মধ্যে লাশের রিগ্যার মরটিস শুরু হয়ে গেছে। তার মানে অন্তত সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা আগে তার মৃত্যু হয়েছে।  

তাতে একটা সমস্যা হল। চাইলেও অলোকেশ ডা. নিশাতের লাশটা খুব ভালো করে খুঁটিয়ে দেখতে পেলেন না। তবে সাদা চোখে দেখে মনে হল মৃত্যুটা তার ধোঁয়ার কারণে হয়েছে, হয়তো দম আটকে। কিন্তু লাশের কমপ্লিট পোস্টমর্টেম না হওয়া অবদি এ বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। বলা সংগতও নয়।

উর্বী হঠাৎ একটা দামি প্রশ্ন করল। বলল, আচ্ছা অলোক, আগুনটা তাহলে লাগলো কী করে ? ডা. নিশাত কি সত্যি সত্যি নিজের প্রাণ দিতে চেয়েছিলেন ?  

দুটো প্রশ্নেরই উত্তর দিলেন ডিটেকটিভ অলোকেশ―সংক্ষেপে। প্রথম উত্তর, ‘এখনও জানি না’। আর দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাবে বললেন যে ‘তিনি নিশ্চিত নন’। হতে পারে অপঘাত, আবার খুনও হতে পারে! অথচ খুনের কোনও যুতসই হাতিয়ার আমরা এখনও পাইনি। বা এই ঘরে কারও প্রবেশের আলামতও নেই! বাড়ির গেটে সিসিটিভি ক্যামেরা থাকলে কাজে দিত।

কেসটা তাই বেশ জটিল বলেই মনে হচ্ছে উর্বী। তোমরা দুজন চোখকান খোলা রাখো। ইমরুল, তুমি খুব ভালো করে খুঁটিনাটি বিষয়গুলো নোট করে নাও। পরে কাজে লাগবে।  

  নিচে পুলিশ ভ্যানের শব্দ শোনা যায়। অ্যাম্বুলেন্সও এসেছে। ডা. নিশাতের লাশ এবার ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে চলে যাবে। সেখানে লাশের কাটাছেঁড়া পোস্টমর্টেম হবে। তখন জানা যাবে ঠিক কী কারণে তিনি মারা গেছেন।

কিছুক্ষণের মধ্যে নিশাতের লাশ তুলে দিয়ে ফিরে এলেন কলাবাগান থানার ইন্সপেক্টর শিবলি নোমান। এবার জেরা-জিজ্ঞাসার পালা। শুরুতেই দারোয়ান জলিল মিঞা। সে-ই এই কেসের সবচে গুরুত্বপূর্ণ উইটনেস বললে উইটনেস, বা সাসপেক্টও হতে পারে।  দিনকাল যা পড়েছে, তাতে কাউকে আর এখন বিশেষ ভরসা করা যায় না, বিশ^াস তো নয়ই। ঘরের লোকেও এখন স্বার্থের লোভে পেছন থেকে আচমকা ছুরি মারছে। টেরও পাওয়া যায় না।

জলিল মিঞা!

জি সাব!

কেসটা কী করে হলো ?

জানি না, সাব। তয় ভোর রাত্তিরে আপার ঘরে আগুন দেখি আমি ছুটি যাই। মেলা দরজা ধাক্কাই, কিন্তু সে খোলে না। তারপর গ্যারেজথন রুবেল পোলাডারে ডাকি আনি, দুইজন মিল্যা দরজা ভাঙি। দেখি যে আপায় মরি পড়ি আছে।

কী দেখলে ? আগুন, নাকি ধোঁয়া ? অমনি হুড়কো দেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়।

 জি সাব, ধুমা। হাচা কতা কি―আমরা আগুন দেহি নাই।

অলোকেশ গলা খাঁকরে কণ্ঠনালীর শ্লেষ্মা সাফ করলেন। বললেন, ধোঁয়া কোথা দিয়ে বেরোচ্ছিল ? দরজা, নাকি খাটের ওপাশের জানলা দিয়া ?

কী যেন ভাবলো জলিল মিঞা। তারপর বলল, জি―না সাব, মনে নাইক্কা। এমুন ভয় পাইছিলাম যে সাব, কিচু মনে রাকবার পারি নাই। 

ঠিক আছে জলিল, এবার বলো তো ডা. নিশাতের দরজার সামনে সে প্যাসেজ বা করিডর, তারপর রান্নাঘর, সেখানে কি আগুন বা ধোঁয়া ছিল ?   

জলিল চুপ। পাশ থেকে এক ছোকরা পুট করে বলল, না সাব, আছিল না।

এই, তুমি কে ? কড়া ধমক দেন ইন্সপেক্টর নোমান। জেরার মধ্যে অনুপ্রবেশ! এসব পুঁচকো-পঁচকার কথা তিনি আমলে নিতে রাজি নন। যত্তো সব উটকো কথাবাত্তা! প্রায়ই এরা মিসলিডিং হয়। অকারণ গল্প ফাঁদে।  

জি সাব, মুই রুবেল। মুই এই বাসার গ্যারেজ পাহারা দেই।

জলিলও তাতে সায় দেয়। বলে যে, এই রুবেলকে ডেকে নিয়ে সে নিশাতের দরজা ভেঙেছিল। এই প্রথম লোকটিকে নজর করে দেখলেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়। দারোয়ান জলিল মিঞা বেশ শক্তপোক্ত দেখতে, মাথায় চুল কম, গালে কয়েকদিন না-কামানো খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ইংরেজিতে যাকে বলে স্টাবল্। তিনি আরও খেয়াল করলেন জলিলের বাঁ হাতে একটা আঙুল বেশি―কুনি আঙুলের পাশেই আরেকটা নাতিদীর্ঘ আঙুল গজিয়েছে, যা কিনা বেশির ভাগ মানুষের থাকে না।

এর নাম পর্যবেক্ষণ। সকলে যা দেখে, ডিটেকটিভ অলোকেশ তারচে কিছুটা বেশি দেখেন। তিনি বিশ^াস করেন, শুধু চেয়ে থাকার নাম দেখা নয়, মন ও মগজ একসঙ্গে করে দেখতে হয়। গল্পের আড়ালের গল্প খুঁজে ফেরাই গোয়েন্দাগিরি।    

তোমরা দুজন মিলে দরজাটা ভাঙতে পারলে ? একটা আপাত-অদরকারি প্রশ্ন করলেন ইন্সপেক্টর নোমান।

পারুম না ক্যান, সাব ? দরজাডা তো কাঠের না, প্লাস্টিকের। হাঁটু দিয়া এমুন ধাক্কা দিছি যে দরজা ধপাস করি পড়ি গেছে।

আচ্ছা জলিল, ফের প্রশ্ন করেন ডিটেকটিভ অলোকেশ, একটু মনে করে বলো তো, রাতের দিকে ডা. নিশাতের কাছে কেউ এসেছিল কি ? গেস্ট বা পরিচিত কেউ ?  

জি―না সাব, মনে অয় না।

ঠিক করে বলো জলিল। তাড়াহুড়ার কিছু নেই, ভেবে বলো। প্রশ্নটা কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ। ফের বললেন অলোকেশ। 

তেমুন কেউরে দেখি নাই সাব। তয় কাইল রাত্তিরে নিশাত আপায় দেরি করি বাসায় আইছিল।

কখন, মনে পড়ে ?

মাঝরাত্তির হবি সাব। মানে রাইত বারোটা সাড়ে বারোটা বাজে তহন। জলিল বলল।

তাতে খ্যাঁক করে উঠলেন ইন্সপেক্টর নোমান। এই, তুই কি সব সময় ঘড়ি ধরে থাকিস ? এত শিওর হলি কী করে ?

জি সাব, আমার বসার জায়গায় এট্টা ঘড়ি আছে ওই দেহেন। দেয়ালে ঝুলাইন্যা। মন না চাইলেও ওডার দিকে নজর পড়ে।

কথা মিছে নয়। সত্যিই একটা বড়সড় ঘড়ি ঝুলছে ওর নাকের ডগায়। আবার এমনও হতে পারে, দারোয়ান জলিল হয়তো স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে খেয়াল করে নিশাত কখন বাসায় ফেরে, বা কখন সে বেরিয়ে যায়। মানুষের মন- মনের ভিতর কত রকম কৌতূহল কাজ করে! মন তো নয়, যেন আলু-পটল আর ঝিঙে-করোলার ঘ্যাঁট!  

আমাদের মনে কত কী তার খেয়াল ওঠে! সত্যি, বড় বিচিত্র এই মন-এর তল খুঁজে পাওয়া ভার!  

কী যেন ভাবছেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়। তারপর বাঁ গালের জুলপি মুচড়ে ধরে বললেন, আচ্ছা জলিল, ভোর রাতের দিকে কেউ কি বাড়িতে ঢুকেছিল? তার আগে বলো, তুমি কি সারারাত জেগে পাহারা দাও, জলিল? সত্যি করে বলো। 

মোক্ষম প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর অন্তত জলিল যে জানেন না, ইন্সপেক্টর নোমান আবার তা জানেন। তার মতে, দুনিয়ার প্রায় সব দারোয়ান ফাঁকিবাজ। তারা ঠিকঠাক কাজ করে না। হয় কাজ বাদ দিয়ে বিড়ি ফোঁকে বা খৈনি ডলে, নয়ত ঘণ্টায় ঘণ্টায় টয়লেটে যায়, তখন বাড়ির মূল ফটক অরক্ষিত থাকে, আবার কখনও কখনও ওরা চোরের সঙ্গে সন্ধি করে গৃহস্থের মালসামানা হাতিয়ে নিতেও হেল্প করে। মোদ্দা কথা এই, দারোয়ানদের চরিত্র বলে আদতে কিছু নেই। ওরা জন্মগত ফাঁকিবাজ। মিথ্যুকও।  

বলা বাহুল্য, জলিল এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারেনি। ইন্সপেক্টরের চাপে সে স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে, ভোরের দিকে তার দুচোখ খানিকটা লেগে আসে। টুলে বসে সে ঢুলছিল। তখন সুড়ুত করে কেউ ভিতরে ঢুকে পড়লে তার জানার কথা নয়।

এই কথা বলে সে আবার একবিঘত জিভ কাটল, দুহাতে কান ধরলো, আর মিউ মিউ স্বরে মিনতি করল, সাব, আমার চাকরিটা যেন বাঁচি থাকে। চাকরি গেলে আমি ধনেপ্রাণে মারা পড়ুম সাব। আমার পরিবার বানের পানির লাহান ভাসি যাবে। সাব, আমি অকালে এতিম হমু।  

রুবেল, তুই কিছু বলবি ?

তাতে দেয়ালঘড়ির দোলকের মতোন এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ে সে। অর্থাৎ তার কিছু বলার নাই। সাতসকালে দারোয়ান জলিল মিঞা যখন তাকে ডাক দিল, তখন সে কাঁচাঘুম ভেঙে চোখ ডলতে ডলতে বেরিয়ে এলো। সে গ্যারেজের এক কোণে কাঠের বেঞ্চির ওপর গুটিসুটি মেরে ঘুমায়। এই হল তার গাড়ি পাহারা দেবার নমুনা। 

তখন সকাল দশটা। জলিলকে জেরা করবার এক ফাঁকে সুশ্রী-সুবেশা দেখতে এক তরুণী হাতে একটা ট্রলিব্যাগ নিয়ে ওদের সামনে দিয়ে ভিতরে ঢুকে যাচ্ছিল। ইন্সপেক্টর নোমান তাকে কাঠের রুল দেখিয়ে থামালেন।

এই, একটু শুনুন তো!

কেন! কী হয়েছে ? এখানে এত ভিড়! খারাপ কিছু ঘটেছে নাকি! তরুণী বলল। ওর নাম তিন্নি, ডা. নিশাতের সাবলেট বাসিন্দার একজন। সেও এখানে একাই থাকে। পড়াশুনা শেষ, এবার সে মিডিয়ায় কিছু করবার জন্য জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। দেখেও অবশ্য তাকে উঠতি মডেল বলেই মালুম হয়। তার পোশাকাদি ও সাজগোজ তারই ইঙ্গিত দেয়।

কী হয়েছে স্যার ? ফের জানতে চায় তিন্নি।

ডা. নিশাত মারা গেছেন।

ডিটেকটিভ অলোকেশ শুধরে দেন―আপসে মরেনি, সম্ভবত খুন!      

সে কী! খুন ? নিশাত আপা খুন হয়েছেন! কী করে ?

আপনি কিছু জানেন নাকি ? তেরছা চোখে মেয়েটিকে দেখছেন ইন্সপেক্টর নোমান। তার চোখে স্পষ্টই সন্দেহের দৃষ্টি। 

সে কি! আমি কী করে জানব স্যার ? আমি মাত্রই এখানে এলাম। গেল রাতে আমি তো বন্ধুর বাসায় ছিলাম―বনানীতে।

কেমন বন্ধু শুনি ? বন্ধু, নাকি বান্ধবী ? একটা আপত্তিকর প্রশ্ন করলেন নোমান সাহেব।

তিন্নি চাইলে রাগ করতে পারত, কিন্তু সে তা করেনি। বেশ পরিপক্ক মেয়ে বলেই মনে হয়। আলতো হেসে তিন্নি বলল, উঁহু, সে আমার ছেলেবন্ধু নয় স্যার, বান্ধবী। আমরা একসাথে কাজ করি।

কোথায় ?

একটা প্রোডাকশন হাউজে। নাম বলল তিন্নি।

অ্যাড্রেস দিন। গুরুগম্ভীর স্বরে ইন্সপেক্টর বললেন। ডিটেকটিভ অলোকেশও ঠিকানাটা চাইতেন অবশ্য। ওর বক্তব্য ক্রসম্যাচ করে দেখতে হবে তিন্নি সত্যি বলছে কি না। নাকি ওটা তার ‘ফলস অ্যালিবাই’।

তিন.

৭/৪ তাজমহল রোড, ব্লক-সি, ডিটেকটিভ অলোকেশের মোহাম্মদপুরের ডেরা।

‘বেচুদা, নাশতা দাও। জলদি।’ হাঁক দিলেন অলোকেশ। কিচেন থেকে ঠুনঠান আওয়াজ ভেসে আসছে, তার মানে বেচুরাম নাশতার বেশ ভালই এন্তেজাম করছে। ইত্যবসরে ডা. নিশাতের কেসটা নিয়ে একচোট মাথা ঘামিয়ে ফেললেন তিনি। সঙ্গে রয়েছে তার দুই সহযোগী উর্বী আর ইমরুল, উর্বী যাকে ইমু বলে ডাকে―সস্নেহে বা স্রেফ মজা করে।

ইমরুল, তুমি আগে পড়ে শোনাও তো কী-কী পয়েন্টস টুকে আনলে। কুইক!

অলোকেশের নির্দেশ পেয়ে অমনি পাখিপড়ার মতো করে পড়তে শুরু করে ইমরুল। এই কেসের একেবারে গোড়া থেকে শুরু করল সে।

ভিকটিমের নাম ডা. নিশাত চৌধুরী, কলাবাগানের ডলফিন গলির ৩/১ ভবনের দোতলার একটি রুমে থাকতেন তিনি। বাকি দুই রুম অন্য দুজনকে ভাড়া দিয়েছিলেন। তাদের একজনের নাম তিন্নি, যে কিনা উঠতি মডেল। আরেকজনের নাম অবশ্য জানা যায়নি, তার দরকারও নেই। কারণ আপাতত সে ঢাকার বাইরে আছে। এটাই তার সবচে শক্ত অ্যালিবাই।

তারপর ?

ডা. নিশাত একজন গাইনিবিশেষজ্ঞ, বয়স আনুমানিক চল্লিশ, ভদ্রস্থ দেখতে, তিনি একা থাকতেন, যদিও তার দুই সন্তান রয়েছে। স্বামীর খবর এখনও জানা যায়নি। বাচ্চারা ভিকটিমের মায়ের সঙ্গে থাকে, অর্থাৎ ডা. নিশাতের আম্মা।

নেক্সট ? তাড়া দেন অলোকেশ।

এবার ঘটনাস্থল সম্পর্কে বলি। দশ ফুট বাই বারো ফুট আয়তনের প্রায় বর্গাকার ঘরের মেঝে আর বিছানায় ভাগাভাগি করে পড়েছিল ডা. নিশাতের লাশ। শরীরের নিম্নাংশের অনেকখানি পুড়ে গেছে, বা বলা ভালো সেঁকা লেগে কালো হয়ে গিয়েছে। কিন্তু উপরের অংশ স্বাভাবিক ছিল। লাশের শরীরে ‘রিগ্যার মরটিস’ বা মৃত্যুপরবর্তী শক্ত হয়ে যাবার লক্ষণ দৃশ্যমান ছিল, ফলে তার দেহের অন্ধিসন্ধি ঠিকঠাক পরীক্ষা করা যায়নি। সাদা চোখে একে ‘অপঘাত’ বলে মনে হলেও কেসটা সম্ভবত তা নয়। আগুন লাগার ব্যাপারটাও রীতিমতো সন্দেহজনক। কারণ আগুনের উৎস সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি।     

এটুকু পড়ার পর নাশতা এসে গেল। বেচুরাম ডিমের ওমলেট, পরোটা, সাথে মাছের তেলের বড়া ভেজে নিয়ে এসেছে। মাছের তেলে প্রচুর ওমেগা-৩ আছে বিধায় শরীরের পক্ষে ভাল। এসবই ডিটেকটিভ অলোকেশের আবিষ্কার। তার একটাই কথা―খাবি তো ভালো কিছু খা। মদ বা বিড়ি-সিগারেটের মতো আজেবাজে জিনিস খেয়ে অকালে মরিস না।

উর্বী, তোমার ছবিগুলো দেখাও এবার। অলোকেশের পরবর্তী নির্দেশ। 

উর্বী ছবি গুছিয়ে নিয়ে প্রস্তুত ছিল। বলামাত্র তার ক্যামেরা থেকে সদ্য তোলা ছবিগুলো সে মেলে ধরল। ঘরের দরজার ধারেকাছে কোথাও কিন্তু আগুনের আলামত নেই, অথচ ডা. নিশাতের গায়ে আগুনের সেঁকা! আবার তাতে নাকি তার মৃত্যুও হয়েছে! সন্দেহজনক!

ছবিগুলো খুব নিরিখ করে দেখলেন তিনি। তারপর এপাশÑওপাশ মাথা নেড়ে গম্ভীর স্বরে বললেন, বুঝলে উর্বী, এই কেসে ‘কিন্তু’ আছে। সেই কিন্তু-টা কী, জানো তো ?

কী ? উর্বী আর ইমরুল দুজনে প্রায় একসঙ্গে বলল।

আমার যদ্দূর অনুমান, এটা নিছক অ্যাকসিডেন্ট নয়, খুন হয়েছেন ডা. নিশাত। আর ওই আগুনের কেসটা আসল ঘটনাকে স্রেফ ধামচাপা দেবার জন্যই করা হয়েছে। ইটস অ্যা ক্যামাফ্লাজ। 

রিয়েলি! বিস্ময় প্রকাশ করে উর্বী। ইমরুল কিছু বলে না। সে শুধু বোঝার চেষ্টা করে নিশাত সত্যি সত্যি যদি খুন হয়ে থাকে, তাহলে এখানে আগুনের আবার কী দরকার পড়ল! খুনি কেসটাকে এভাবে সাজাতেই বা যাবে কেন! খুন মানেই খুন। এপার-কা মাল উপর! খুনের আবার ক্যামোফ্লাজ!

খুক খুক করে কাশলেন অলোকেশ। তারপর বললেন, নইলে দেখ, ভিকটিমের লাশ যেভাবে পড়েছিল (মাথাটা খাটের নিচের দিকে আর পা উপরে), তাতে আগুনে ওর চুল পুড়বার কথা, কিন্তু তা না পুড়ে পুড়েছে তার দুই পা ও কোমর।

রাইট। এবার কিন্তু ইমরুল কেসটা মোটামুটি বুঝতে পারল। তাছাড়া আগুনের উৎসও কিছু জানা যায়নি। কিচেন থেকে যদিও গ্যাস বেরোচ্ছিল, কিন্তু সেই গ্যাস থেকে আগুনটা লাগেনি। কারণ, ডা. নিশাতের রুম আর কিচেনের মাঝখানের প্যাসেজে আগুন লাগার আদৌ কোনও আলামত নেই। ওটা খুনির তাৎক্ষণিক প্রয়াস, দেখে যাতে মনে হয় কিচেন থেকে গ্যাস বেরিয়ে তাতেই পুড়েছে ডা. নিশাত। নিছক দুর্ঘটনা। 

সে না হয় বুঝলাম, উর্বী তেলের বড়া খেতে খেতে বলল, কিন্তু সেই খুনি কে ? নিশাত কীভাবে খুন হলেন ? কেনই বা!

অলোকেশ চুপ। তিনি তার কাঠের চেয়ারে সোজা হয়ে বসে ভাবছেন। তার বাঁ হাত নিসপিস করছে, গালের জুলপি মোচড়াবেন কিনা ঠিক করতে পারছেন না। তাছাড়া একসাথে এতগুলো প্রশ্নের উত্তর দেয়া মোটেও সহজ নয়।

কিছুক্ষণ পর তিনি বললেন, ইয়েস, খুনের মোটিভ আর হাতিয়ার―এই দুটো জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এই কেসে এখনও অবদি এর দুটোই অনুপস্থিত। খুনি কে―তাকে আমরা চিনি না। অকুস্থলে হাতিয়ারও পাওয়া যায়নি। মোটিভ সম্পর্কেও আমাদের তেমন কোনও আইডিয়া নেই। এ তো দেখছি মস্ত গেরো! 

তা হলে ? ঘোলাটে চোখ মেলে তাকায় লেডি ডিটেকটিভ উর্বী বোস। সে দাঁতে নখ কাটে। ইমরুল ওর নোটবুকে চোখ রাখে। কী যেন বোঝার চেষ্টা করে।

অলোকেশ প্রায় স্বগতোক্তির মতো বললেন, লাশের পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা পেলে হত। খুনের কারণ বা ধরন―এই দুটো যেকোনো কেসের পরবর্তী তদন্তের জন্য খুব দরকারি।

বেচুদা, আরেক প্রস্থ কফি দাও। আমার গলা শুকিয়ে গেছে। অলোকেশ বললেন।

ইমুর জন্য চা, আর উর্বী চা-কফি দুটো মিলিয়ে খাবে। অর্থাৎ ‘চাফি’। বেচুদা অবশ্য নতুন আরেক রকমের পানীয় উদ্ভাবন করেছে―ভারতীয়রা বলে নিম্বুপানি। আর বেচুদার ভাষায় লেবুর দুধ-শরবত, সঙ্গে অবশ্য দুধের সরও আছে। খেতে খুব একটা উপাদেয় না হলেও শরীরের পক্ষে বেশ উপকারী। কারও হার্টের ব্যামো থাকলে তাদের এই বস্তু না খাওয়াই ভাল। সরে চর্বি আছে। 

সে যাক, অলোকেশ মাত্র ধূমায়িত কফিতে চুমুক দিয়েছেন, অমনি তার সেলফোন বেজে ওঠে। ফোন করেছেন ডা. সোহেল মাহমুদ,  ফ্রম ডিএমসি। এই ফোনটার জন্যই তিনি অপেক্ষা করেছিলেন। ঢাকা মেডিকেলের বিশিষ্ট ফরেনসিক স্পেশালিস্ট ডা. সোহেল তার পূর্বপরিচিত। তাদের সম্পর্কটা স্রেফ প্রফেশনাল নয়, ইমোশনাল, অর্থাৎ বন্ধুত্বের। সত্যি বলতে, রহস্যপ্রিয় ডক্টর সোহেল অলোকেশের গোয়েন্দাগিরির বেশ সমঝদারও বটে।  

বলুন ভাই সোহেল, কেসটা কী ? কী করে মারা গেলেন ডা. নিশাত ? আগুনে পুড়ে―!

কথা শেষ হয় না অলোকের। ফোনের ওপারে অমনি হাÑহা শব্দ করে উঠলেন সোহেল মাহমুদ। বললেন, উহুঁ, এটা মোটেও বার্নকেস নয়, রীতিমতো খুন!

কী বলেন ডক্টর! ইজ ইট ? ফোনটা লাউড স্পিকারে ছিল, ফলে উর্বী ও ইমরুল দুজনেই ডক্টর সোহেলের কথা শুনতে পায়। খুনের কথা শুনে ওদের সবার বাঁ চোখ টেরা হয়ে যায়। মুখ দিয়ে বিস্ময়সূচক শব্দ বেরোয়―‘রিয়েলি! তার মানে অলোকেশের অনুমান ঠিক। ‘হি ইজ অলওয়েজ রাইট’! 

ইয়েস, ইট ইজ! কনফার্ম করলেন ডক্টর সোহেল। আর আগুনটা কীভাবে লাগলো বুঝতে পারছি না, কারণ আমি ক্রাইম সিনে যাইনি। হতে পারে ওটা খুনিরই একটা চাল, লোকে যাতে কেসটাকে স্রেফ দুর্ঘটনা বলে মনে করে। 

আমিও তাই ভাবছি ডক্টর। অলোকেশ বললেন। তাকে বেশ খুশি খুশি লাগছে। আচ্ছা ডক্টর, খুনের কারণটা কি একটু জানা যায় ?

আলবাত যায়! কেন যাবে না ? ফোনের ওপার থেকে সোৎসাহে বললেন ফরেনসিক স্পেশালিস্ট সোহেল মাহমুদ।   

একটু থেমে তিনি বললেন, খুনটা কিন্তু একটু অদ্ভুতই বলতে পারেন। সচরাচর এমন ঘটে না। 

অদ্ভুত! আই মিন আনইউ (শ্) জুয়াল!

ইয়েস ডিটেকটিভ। ভিকটিম নিশাতের সারা গায়ে কোথাও কোনও কাটাছেঁড়ার দাগ নেই, না কোনও ধস্তাধস্তি বা আঁচড়-কামড়, শুধু―!

শুধু কী, সোহেল ? উত্তেজনায় যেন প্রায় ফেটে পড়ছেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়। ইন ফ্যাক্ট, অলোককে এমন ছেলেমিসুলভ বিস্ময়াক্রান্ত অবস্থায় উর্বী আগে কখনও দেখেনি। হি’জ জাস্ট বাব্লিং ইন সারপ্রাইজ।

‘শুধু একটু সুঁচের গুঁতো’। ওপার থেকে ছোট্ট কথা ভেসে এলো। 

শুধু গুঁতো! আর কিছু নয় ? তাতেই একটা মানুষ মরে গেল! হতে পারে! নাকি সুঁচের ডগায় বিষ ছিল ? গোঁÑগোঁ করে কথাগুলো বললেন বিস্ময়াপন্ন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়।

উহুঁ, বিষটিস কিছু নয়, খুনি সম্ভবত অত চালাকও নয়। হতে পারে যা দিয়ে সে গুঁতোটা মেরেছে ওটা তার প্রফেশনেরই অংশ। অর্থাৎ সেই যন্ত্র দিয়ে হয়ত সে কাজ করে। বুঝিয়ে বললেন ফরেনসিক ডক্টর সোহেল মাহমুদ।

মানে আপনি বলতে চাইছেন, খুনি মোটেও পেশাদার কেউ নয় ?

একদম নয়। এমন অদ্ভুত যন্ত্র বা কারও শরীরে এমন আঘাত আমি আজ অবদি দেখিনি।

যন্ত্র! ওটা আপনি পেলেন কোথায়, ডা. সোহেল ? ফের জানতে চান ডিটেকটিভ অলোকেশ।

এবার কিন্তু সরাসরি কোনও উত্তর দিলেন না সোহেল মাহমুদ। তিনি হো হো করে উচ্চস্বরে হাসছেন।

কী হল! যন্ত্র কোথায় পেলেন, বলুন না!

‘কল্পনায়। জাস্ট বাই ইম্যাজিনেশন, মিস্টার ডিটেকটিভ’। তখনও হাসছেন ডা. সোহেল। দম ফাটিয়ে হেসেই চলেছেন তিনি। দুঁদে ডিটেকটিভ অলোককে এই প্রথম তিনি বোকা বানাতে পেরেছেন, এটা কি কম আনন্দের কথা!

ফোন রাখার আগে সুস্থির হন সোহেল মাহমুদ। এটুকু অন্তত ক্লিয়ার করলেন যে, খুনি আদতেই অপেশাদার মানুষ, খুনের সময় হয়তো তার মাথার ঠিক ছিল না। ঝোঁকের বশে কাজটা হয়তো সে করেছে, আবার তা নাও হতে পারে। এমনও হতে পারে, ভিকটিমের সঙ্গে খুনির কোনও পুরনো হিসাব চুকানোর ছিল, তাই সে আটঘাট বেঁধে মাথা খাটিয়ে খুনটা করেছে।

ওহ, আরেকটা কথা বললেন ডা. সোহেল। রেপের স্পষ্ট কোনও আলামত পাওয়া না গেলেও তার প্রাইভেট পার্টসে আঁচড়ের দাগ ছিল। অথচ ওটা ডা. নিশাতের নিজের আঙুলের নয়, অন্য কারও নখের আঁচড়। হতে পারে খুনির। তবে ওটা যে তার শ্লীলতাহানির সময়ে ঘটেছে, হলফ করে এমনটা বলা যায় না। খুন করবার সময় ধস্তাধস্তির কারণেও তা হয়ে থাকতে পারে।

অবশেষে অনেকটা আত্মগত স্বরে বললেন, অস্বাভাবিক খুন! আমরা, মানে আমি এবং ইন্সপেক্টর নোমান কিন্তু ভিকটিমের শরীরের কোথাও কোনও আঘাতের চিহ্ন পাইনি। আপনি পেলেন কী করে, ডক্টর ? শেষ প্রশ্নটা করলেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়।  

তাতেও হাসছেন ডা. সোহেল। পরিমিত হাসি। তারপর বললেন, পাবেন কী করে ? দোষ অবশ্য আপনাদের নয়,  আপনারা যখন স্পটে পৌঁছলেন, ততক্ষণে লাশের রিগ্যার মরটিস শুরু হয়ে গিয়েছিল। ফলে আপনারা তার বগল বা হাঁটুর ভাঁজ ঠিকমতো পরীক্ষা করতে পাননি। ততক্ষণে ভিকটিমের হাত-পা সব শক্ত হয়ে একে অপরের সঙ্গে লেগে গেছিল। ফলে আপনাদের অলক্ষ্যেই রয়ে গেছে ভিকটিমের গায়ের সেই সুঁচের খোঁচা। ঠিক সুঁচও নয়, হয়ত জিনিসটা আরও একটুখানি মোটা এবং লম্বা কিছু।

খোঁচা কোথায় লেগেছিল বললেন ?

বাঁ বাহুর নিচে, বগল সোজা একটু নেমে গিয়ে পাঁজরে। ফলে যেটা হয়েছে, লম্বা সুঁচটা খাড়া ঢুকে গিয়ে ভিকটিমের ফুসফুস ফুটো করে দিয়েছে। আর তাতেই মারা গেছেন হতভাগ্য ডা. নিশাত চৌধুরি। খুব কুশলী বা খুব কাঁচা হাতের খুন। যন্ত্রটাও অদ্ভুত।

ফোন ছেড়ে দিয়ে কিছুক্ষণ থম্ মেরে রইলেন অলোকেশ। তার মুখে আর কোনও কথা সরছে না। কী সব উল্টোপাল্টা কথা শোনালেন ডক্টর সোহেল! বলছেন, ‘খুব কুশলী বা খুব কাঁচা হাতের খুন। যন্ত্রটাও অদ্ভুত।’  

চার. 

পরদিন সকাল দশটা। ইন্সপেক্টর নোমানের চেম্বার, কলাবাগান থানা।

ডিটেকটিভ অলোকেশ রয় সেখানে সপারিষদ হাজির। স্বেচ্ছায় যাননি অবশ্য, ইন্সপেক্টর স্বয়ং ফোন করে তাকে যেতে বলেছেন। অনেকটা অনুরুদ্ধ হয়েই থানায় গেলেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়।

আসুন, আসুন মিস্টার ডিটেকটিভ। আগে এক রাউন্ড কফি হয়ে যাক, নাকি ?

কফি বলবেন? বলুন না হয়। শুভস্য শীঘ্রম। হেসে বললেন ডিটেকটিভ অলোকেশ। সঙ্গে টফিও কিছু দিতে বলুন। নইলে কফিটা ঠিক জমে না। কেমন যেন খালি খালি লাগে! মনে হয় যেন রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে সস্তার কফি খাচ্ছি। 

অবশ্যই। হ্যান্ডমেড কফির সঙ্গে ভাল টফিও আসছে। হেসে বললেন ইন্সপেক্টর নোমান। এর কিছুক্ষণের মধ্যে স্পেশাল কফি এসে গেল। ভিন্ন ফ্লেভার, সামান্য কটুস্বাদ, তবে খেতে নেহাত মন্দ লাগেনি। কফির স্বাদে নতুনত্ব এসেছে।

বেচারা ইমু পড়ল বিপদে। সে কফি খুব একটা পছন্দ করে না। কফিতে নাকি তার অ্যাসিডিটি হয়। কিন্তু থানায় এসে নিজের মতো করে চা খেতে চাওয়া সমীচীন নয় বুঝে চেপে যায় ইমরুল। ভদ্রতার খাতিরে কফিতেই ঠোঁট ছোঁয়াতে হয় আর কি! অনুরোধে মানুষ কত কী গেলে, আর এ তো সামান্য গরম কফি।

কফিপর্ব মিটে গেলে পোস্টমর্টেম রিপোর্টের একটা কপি নিয়ে বসলেন ইন্সপেক্টর নোমান। বললেন, এটা দেখেছেন নিশ্চয়ই ?

জি। ছোট্ট করে বললেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়।

কী মনে হয় আপনার! গাঁজাখুরি নয় ? তেতো গলায় বললেন ইন্সপেক্টর নোমান। বলে কিনা সামান্য খোঁচার আঘাতে মারা গেছেন ডা. নিশাত!

রাগ করতে গিয়ে নিজেকে নামলে নেন ডিটেকটিভ অলোকেশ। বললেন, ডা. সোহেলকে আপনি কদ্দিন চেনেন ইন্সপেক্টর ?

কেন বলুন তো ? তাকে চেনাচিনির কী আছে ? চোখ নাচান ইন্সপেক্টর। সেখানে স্পষ্টই তাচ্ছিল্য দোল খায়। 

আহা, বলুন না। প্রেস করলেন অলোকেশ।

আগে কখনও আলাপ হয়নি অবশ্য, তার লেখা রিপোর্টও পাইনি। স্বীকার করলেন মিস্টার নোমান। 

তাহলে দয়া করে আপনি তার সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করবেন না ইন্সপেক্টর। আই নো হিম ফর দ্য লাস্ট সেভেন ইয়ারস। এই লাইনে তার অভিজ্ঞতা দীর্ঘই শুধু নয়, হি’জ ওয়ান অফ দ্য বেস্ট ফরেনসিক ডক্টরস ইন বাংলাদেশ। তার রিপোর্ট ভুল হবার নয়।

শেষের দিকে অলোকের গলার স্বর খানিকটা চড়ে গিয়ে থাকবে। তাতে বিব্রত হন ইন্সপেক্টর নোমান। লজ্জিতও। বুঝতে পারলেন, ডা. সোহেলের সঙ্গে অলোকের বোঝাপড়া একটু বেশিই। সোহেলকে তিনি ভালো জানেন, ভরসাও করেন।

সরি ভাই ডিটেকটিভ, চলুন এবার বরং আমরা কাজের কথায় আসি। এত বড় ভুলটা আমাদের কী করে হল বলুন তো! ‘সরি’ বলে আবার একটুখানি মন্তব্যও জুড়ে দিলেন তিনি।

কীসের ভুল ?

ওই যে, ভিকটিমের বগলের তলায় আমরা কোনও দাগ বা নিডল-মার্ক দেখতে পাইনি। ইন্সপেক্টর বললেন।

পাইনি কারণ ততক্ষণে লাশের ‘রিগ্যার মরটিস’ বা পেশি সংকোচন শুরু হয়ে গেছিল। তার দুই বাহু এবং হাঁটু শরীরের সঙ্গে লেগে গিয়েছিল। তাছাড়া সবার সামনে আমরা তার প্রাইভেট পার্টস দেখতেও যাইনি। বগলও নয়।

তা অবশ্য ঠিক। সমর্থনসূচক মাথা নাড়লেন মিস্টার নোমান। এবার তাহলে কী হবে ডিটেকটিভ ? এমনভাবে কথাটা বললেন যেন তিনি কুড়ি হাত পানির নীচে তলিয়েছেন। কিছুতেই আর থৈ খুঁজে পাচ্ছেন না।   

কী আবার হবে, হাসলেন অলোকেশ, ডা. নিশাতের খুনি কে―তাকে আমাদের খুঁজতে হবে। কাজটা কঠিন আমি মানছি, তবে অসাধ্য কিছু নয়। জানেন তো, আমার ক্যারিয়ারে ব্যর্থতা বলে কিছু নেই। অসাধ্য সাধন করাই আমার দস্তুর। তবে এও বলছি, আমি কিন্তু ভগবান বা অন্তর্যামী নই। আই ওনলি ক্যান ট্রাই মাই লেভেল বেস্ট, আর গোয়েন্দাগিরি কোনও জাদুবিদ্যা নয় ইন্সপেক্টর, মন ও মগজ নিবিষ্ট করে কাজ করলে সাফল্য আসবেই। 

ডিটেকটিভ অলোকেশ, বস্তুত, ছোটখাটো একটা লেকচার দিয়ে ফেললেন। কারণ ইন্সপেক্টর তার বিশেষ বন্ধু ডা. সোহেল সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করেছেন। তাকে তিনি অর্বাচীন ও অনভিজ্ঞ ভেবেছেন। 

আরেক প্রস্থ কফি এল। ইমরুলকে আবার সেই কফি নাকচোখ বন্ধ করে গিলতে হল। কিন্তু কিছু করার নেই―যস্মিন দেশে যদাচার! তাই বলি কি, দুধ-ঘি-চা-পানি-দই-শরবত সবকিছু চাখার অভ্যাস থাকা ভাল। শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবে তাই সয়!

বস্তুত, আমাদের শরীর সবকিছুই সইতে পারে, কিন্তু তাই বলে অত্যাচার নয়। চাণক্য পণ্ডিত যথার্থই বলেছেন, কোনও কিছুর বাড়াবাড়ি হলেই তা পয়জন। তাই ভাব-ভালোবাসাও বুঝে-শুনে করবেন, মাত্রাছাড়া নয়। তাহলেই কিন্তু বাহুল্যদোষে দুষ্ট হবেন―আতিশয্যজনিত ক্লান্তি পেয়ে বসবে।   

নিন, এবার কাজ শুরু করা যাক। তাড়া দেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়। এনি গ্রাউন্ডওয়ার্কস, ইন্সপেক্টর ?

জি, ইয়েস। আমি ভিকটিম সম্পর্কে বেশকিছু তথ্য জোগাড় করেছি। আই হোপ, কাজে লাগবে। বেশ বড়সড় একটা ফাইল এগিয়ে দিলেন ইন্সপেক্টর। চটজলদি কফি শেষ করে তাতে মনোনিবেশ করলেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়।

ডা. নিশাত চৌধুরি দু-দুবার বিয়ে করেছেন। প্রথম স্বামী মোলাকাত হোসেন ব্যবসায়ী, সে ঢাকাতেই আছে। গুলশানের দিকে থাকে। প্রায় বছর আষ্টেক আগে নিশাতের সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়। মোলাকাত নাকি মদ্যপ, ঠগবাজ ও পরনারীতে আসক্ত। মোটামুটি তিনখানা স˜গুণ আছে তার, যার জন্য নিশাতের জীবন থেকে তাকে ছেঁটে ফেলা যায়। অথচ মোলাকাত হোসেন নিশাতের দুই ছেলেমেয়ের বাবা। সেই সম্পর্কটা ছেড়ে আসা নিশাতের জন্য কঠিন ছিল বৈকি। ছেড়ে এসেছেন, হয়তো বাধ্য হয়েছেন তাই।   

তারপর বেশ কিছুদিন একাই ছিলেন ডা. নিশাত। একা মানে মায়ের সঙ্গে থাকতেন। শৈশবে নিশাতের বাবা মারা যান, মা তাকে লালন-পালন করেন, নিজের সাধ্যমতো নিশাতকে উপরে ওঠার সিঁড়ি বাগিয়ে দেন।

কিন্তু দুঃখের বিষয়, ডা. নিশাতের দ্বিতীয় বিয়েটাও টেকেনি। ভদ্রলোকের নাম নজির আহমেদ। বেশ বয়স্ক, নিশাতের চেয়ে তার বয়স অন্তত বছর দশেক বেশি। কিন্তু তাদের বিচ্ছেদের কারণ সেটা নয়, খোঁজ নিয়ে জানা যায় নজির আহমেদ নাকি ডিপ্রেশনের পেশেন্ট, রোগটা তার বেশ পুরনো, ফলে পরিবার-পরিজনের প্রতি সে কোনও দায়িত্বই পালন করত না। কাজকর্ম কিছু ছিল না, সে বরং ডা. নিশাতের আয়ের উপরে নির্ভর করেই চলত। সত্যি বলতে কি, মায়ের চাপে আর কিছুটা ঝোঁকের বশে নজির সাহেবকে নিশাত বিয়ে করেছিল। ভেবেছিল, লোকটা যেহেতু বয়স্ক, নিশাতকে সে দেখেশুনে রাখবে, ভালোবাসবে। এই লোকটার কাছ থেকে তাকে অন্তত বাড়তি কোনও ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হবে না।  

আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, এদেশে একটা সোমত্ত মেয়ের একা থাকা কতটা অনিরাপদ। আপনাকে পদে পদে সহকর্মীদের টিকা-টিপ্পনি শুনতে হবে, বসের ইঙ্গিতপূর্ণ কথা হজম করতে হবে, প্রতিবেশীরা সুযোগ নেবে, এমনকি, ড্রাইভার-লিফটম্যানেরাও সুযোগ পেলে আপনাকে অপমান করতে ছাড়বে না। কত সভ্য মানুষ আমরা ভাবুন তো!  

ও আরেকটি কথা―ডা. নিশাতের সদ্যসাবেক স্বামী নজির কিন্তু তাদের সেপারেশনটাকে খুব ভালোভাবে নেয়নি। তা অবশ্য না নেবারই কথা। কারণ নিশাত ছিল তার সোনার ডিমপাড়া হাঁস। মাস গেলে তিনি যা পেতেন, তার অর্ধেকটা তিনি নজিরের হাতে তুলে দিতেন। আত্মীয়-পরিজনসূত্রে জানা যায়, শেষবেলায় রেগেমেগে নজির নাকি বলেছিল নিশাতকে সে দেখে নেবে! এই দেখে নেবার মানেটা ঠিক কী, এই মুহূর্তে তা প্রমাণ করা কঠিন।

আর তার আগের স্বামী মোলাকাত হোসেনও নিশাতকে কিছু ছাড় দেয়নি। মাঝে মাঝেই সে নাকি নিশাতকে এই বলে হুমকি দিত―টাকা ছাড়ো, নইলে বৈবাহিক জীবনের সব ছবি ও সিক্রেটস আমি ইন্টারনেটে ভাইরাল করে দেবো। তাই বেচে টাকা কামাবো। অবস্থা বোঝো! এই হল গিয়ে অধঃপতিত পুরুষের আসল চরিত্র। সরি, কাপুরুষ বা কুপুরুষ!

দেখেশুনে ফাইলখানা নোমান সাহেবকে ফেরত দেন অলোকেশ। তারপর মৃদু গলা খাঁকরে বললেন, কোত্থেকে শুরু করবেন বলুন! এই কেসে তো ভায়া ভরপুর রহস্য। ক্যাঁচালও কিছু কম নেই। যাকে দেখছি তাকেই খুনি বলে মনে হচ্ছে। অন্তত এদের প্রত্যেকেরই নিশাতকে খুনের মোটিভ আছে।   

মাথা নাড়লেন ইন্সপেক্টর নোমান। হতে পারে, দুই স্বামীর অত্যাচারে ডা. নিশাত নিজেই নিজের জীবন নিয়েছেন! আর নয়তো তাদের কেউ একজন নিশাতকে দুনিয়াছাড়া করেছে। 

তাতে চোক চোক করে হাসলেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়। ইউ মাস্ট বি জোকিং ইন্সপেক্টর। আপনার প্রথম কথার আদৌ কোনও সারবত্তা নেই। কারণ লাশের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে এই কেসটা আর যাই হোক, সুইসাইড হবার কোনও সম্ভাবনাই নেই। কারণ নিজে নিজের বগলের তলায় সুঁচ ফোটানো যায় না। ওটা বড্ড কষ্টকল্পিত ব্যাপার। তাছাড়া ডা. নিশাত যদি আত্মহননই করবেন, তাহলে তিনি এত কষ্ট করতে যাবেন কেন! সামান্য বিষ বা অন্য কিছু খেয়ে নিলেই পারতেন। ভুলে যাবেন না তিনি একজন ডক্টর, হাজারটা তরিকা তার জানা থাকবার কথা। তাই বলছি, এটা জ্বলজ্যান্ত খুনের কেস ইন্সপেক্টর। ইয়েস, আই মিন ইট।

ইন্সপেক্টর নোমান চুপ। আসলে তিনি এই কেসের কোনও দিকদিশে করে উঠতে পারছেন না। বড্ড বাজে কেস! তাই বলে তিনি হাত গুটিয়েও বসে নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই থানায় একজন এলো। তাকে দেখে পুরো চোট্টাটাইপ বলে মনে হয়। নাকি মেয়েছেলের দালাল!  

ইনি কে ? কৌতূহলী চোখে তাকান অলোকেশ।

ইন্সপেক্টরের হয়ে নিজেই উত্তর দিলো সেই আগন্তুক। জি, আমি মোলাকাত হোসেন। নিশাতের এক সময়কার স্বামী। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, আমাকে কেন থানায় ডাকা হল ? আর আপনাদের মাঝে ইন্সপেক্টর নোমান কে ? উল্টো প্রশ্ন করে আগন্তুক।

মাথা নাড়লেন নোমান। তাকে বসতে বললেন। বসুন মিস্টার মোলাকাত। আপনার সঙ্গে ‘মোলাকাত’ হয়ে আমার বেশ ভালো লাগছে। 

তাতে খেপে যায় আগন্তুক। তেতো গলায় বলল, এখানে লাগালাগির কিছু তো নাই ইন্সপেক্টর। আপনার ভালো লাগলেও আমার কিন্তু লাগছে না। আমাকে কেন ডেকেছেন তাই বলুন। আমি কাজের মানুষ, আমাকে যেতে হবে। জলদি। 

ডিটেকটিভ অলোকেশ খুব মনোযোগ দিয়ে লোকটিকে দেখলেন। এই মোলাকাত হোসেন ছিল ডা. নিশাতের প্রথম স্বামী। যে কিনা মদ্যপ, ঠগবাজ ও বিশিষ্ট রোমিও। ক্ষণে ক্ষণে প্রেমে পড়ে, আর বোকাসোকা মেয়েদের ফাঁসিয়ে তারপর মাল খিঁচে নেয়। রিপোর্ট বলছে অনেক নারীর সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে। ‘পলিগ্যামিস্ট’ শব্দটির বোধ হয় এদের জন্যই উৎপত্তি হয়েছে।

রিপোর্টার ইমরুল বুঝলো, সকাল সকাল মাল খেয়ে বেটা ভরপুর টাল হয়ে আছে। এর সঙ্গে বাক্যালাপ বৃথা। কিন্তু মিছে সময় নষ্ট না করে ডিটেকটিভ অলোকেশ ও ইন্সপেক্টর নোমান যৌথ-জেরা শুরু করলেন। হাতের কাছে যখন পেয়েইছেন, একটু বাজিয়ে নিতে দোষ কী!   

আপনি ডা. নিশাতের স্বামী, তাই না ?

ছিলাম। এখন আর নয়। সে মেলা দিনের কেস, চুকেবুকে গেছে। ওটা পাস্ট টেন্স, বুঝলেন! নাটকের ভিলেনের মতো গলা ঘুরুনি দিয়ে বলল মোলাকাত হোসেন। 

কিন্তু গান শেষ হলেও তার রেশটা যে বেশ খানিকটা রয়ে গেছে মিস্টার মোলাকাত হোসেন! হালকা চালে বললেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়।

তার মানে ? আপনি কী বলতে চান ? অমনি তেড়ে ওঠে ডা. নিশাতের প্রাক্তন স্বামী মোলাকাত।  

কিছু না। নিশাত যে মারা গেছে আপনি জানেন তো ? নাকি আপনিই মেরেছেন ? সরাসরি কাজের কথায় এলেন অলোকেশ।

মারা গেছে! কবে মরলো ? আমি কিছু জানি না। মরলে মরেছে, ছেড়ে যাওয়া অবাধ্য বউয়ের খবর কে রাখে কন! তার সঙ্গে আমার আর কোনও সম্পর্ক ছিল না, ব্যস! এক লাইনে কথাগুলো উগড়ে দেয় মোলাকাত।

সম্পর্ক না থাকলে তো চলবে না মোলাকাত! আপনি তো মাসে মাসে তার কাছ থেকে টাকা নিতেন। মাসোহারা!

কে বলল এসব! একদম মিছা কথা!

মোটেও মিছা না মিস্টার। টাকা না দিলে আপনি তার আপত্তিকর ব্যক্তিগত ছবি নেটে ছড়িয়ে দেবেন বলে হুমকি দিয়েছেন, বলুন ঠিক কি না! ওয়াজ-নসিহতের মতো করে বললেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়।

না ঠিক না। ঝড়ের বেগে মাথা নাড়ে নিশাতের প্রাক্তন স্বামী মোলাকাত।

কিন্তু ‘না’ বললে চলবে কেন। ইন্সপেক্টর নোমান আচমকা তার পেটে রুলের গুঁতো দেন। তাতে বনমোরগের মতোন কোঁক করে ওঠে মোলাকাত। তিনি জানেন, এসব মদ্যপ ও ফিচেল লোকের পেট থেকে কীভাবে আসল কথা টেনে বের করতে হয়।

ডা. নিশাতের ডায়েরিতে এসব কেচ্ছা-কাহিনি সবিস্তারে লেখা আছে মিস্টার। অভিযোগ স্বীকার করে নেন, নইলে গুঁতো আরও বাড়বে। বুঝতে পারছেন তো, আপনি এই কেসের অন্যতম সাসপেক্ট। কারণ আপনি নিশাতকে থ্রেট করেছেন! টাকা না দিলে আপনি তার সম্মানে হাত দেবেন।  

টুক টুক করে নোট নেয় ইমরুল। উর্বীও কিছু কথা মনে গেঁথে রাখছে। মোলাকাত লোকটা ফিচেল বটে, ঠগ ও জুলুমবাজ। কিন্তু এর পক্ষে কি খুন করা সম্ভব! অবশ্য মোটিভ তার ভরপুর আছে। ইন্টারনেটে ছবি ছাড়ার ভয় দেখিয়ে সে নিশাতের কাছ থেকে নিয়মিত টাকা খিঁচে নিত। নইলে একজন ডাক্তার কেন তার তিনরুমের বাসার দুটো রুম সাবলেট ভাড়া দেবে! পরে একসময় নিশাত তাকে টাকা দিতে অস্বীকার করায়…! 

জেরা ক্রমশ জোরদার হয়। ইন্সপেক্টর ও অলোকেশ দুজন মিলে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তাকে একেবারে নাজেহাল করে ছাড়ে। ফলে একপর্যায়ে নিশাতের কাছ থেকে টাকা নেবার বিষয়টা স্বীকার করল মোলাকাত। এও বলল যে, নিশাতকে সে আজীবন ভালোবেসেছে। বিনিময়ে এটুকু সে পেতেই পারে। কিন্তু নিশাতকে সে খুন করতে পারে না। খুনটা সে করেনি।

কী যেন ভাবলেন ডিটেকটিভ অলোকেশ। তিনি নিচুস্বরে ইন্সপেক্টরকে কিছু বললেন। তারপর তাদের যৌথসিদ্ধান্তে মোলাকাত হোসেনকে আপাতত ছেড়ে দেয়া হল। তবে সে থানা চত্বর থেকে বেরিয়ে যেতেই তার পিছে নেংটি ইঁঁদুর মানে চর লাগিয়ে দেয়া হল। দেখা যাক, বেটা কোথায় যায়, কী করে!

ইন্সপেক্টর বললেন, যাও, তাকে ফলো করো। সে কোথায় যায়, কী করে প্রত্যেক দিন তার ঠিক ঠিক রিপোর্ট আমার চাই।

পাঁচ.     

কলাবাগান থানা থেকে সোজা নজির আহমেদের বাসায় গেলেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়। সঙ্গে ইন্সপেক্টর শিবলি নোমান, উর্বী ও ইমরুল। নোমান সাহেব এই কেসের আইও বা ইনভেস্টিগেটিং অফিসার। তাকে ছাড়া কি চলে! 

ভাগ্যিস নজির আহমেদ বাসায় ছিলেন। আগেভাগে খবর দিয়ে আসা হয়নি, তাই তিনি বাসায় না থাকলেও কিছু বলার ছিল না। মানুষ তো আর গরু-ছাগল নয় যে, সারাক্ষণ গোয়ালে বসে ঝিমোবে বা জাবর কাটবে।

নজির সাহেব!

জি-বলুন।

ডা. নিশাত মারা গেছে আপনি জানেন ? বলবেন না যে জানেন না, কারণ খবরটা পত্রিকায় বেরিয়েছে।

তাতে কাঁচুমাচু মুখ করে থাকেন নজির। বললেন, সরি স্যার, জানতাম না।

কেন জানেন না ? সে কি আপনার স্ত্রী নয় ?

কারণ আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম স্যার। হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। এই দেখুন স্যার ছাড়পত্র। সত্যি সত্যি পকেট থেকে ছাড়পত্র বের করে দেখালেন নজির আহমেদ। লোকটা বয়স্ক, বেশ নাজুক দেখতে। তার চেহারায় অসুস্থতার ছাপ স্পষ্ট।

ডিটেকটিভ অলোকেশ একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলেন। ডা. নিশাতের মৃত্যুর খবর শুনেও নজিরের মাঝে কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। কেমন ভাবলেশহীন চোখে চেয়ে আছে, যেন মরা মাছের চোখ। মানুষ এমন নিস্পৃহ হতে পারে! নাকি ইনিই খুনি!

কথাটা শেষমেষ বললেনও অলোকেশ। আপনাকে দেখে মনে হয় নিশাতকে আপনি নিজের হাতে মেরেছেন নজির সাহেব! নইলে তার মৃত্যুর খবর শুনে আপনি একটুও চমকালেন না কেন ?

তাতে থতমত খান নজির আহমেদ। ‘এসব কী কথা বলছেন আপনি! আমি কেন তাকে মারতে যাব ? একটু আগে বললেন সে মারা গেছে। এখন বলছেন খুন! কোনটা ঠিক অফিসার?’

নিশাত আপনার স্ত্রী, তাই না ?   

ছিল, এখন নেই। ওটা পাস্ট টেন্স। করোলা-খাওয়া কণ্ঠে নজির বললেন।

আপনাদের সেপারেশন কেন হল, একটু বলবেন ?

ওটা প্রাইভেট ম্যাটার স্যার। বলতে চাইছি না।  

তাতে নাকের ডগায় কাঠের রুল নাচান ইন্সপেক্টর নোমান। উঁহু, স্ত্রী আপনার পারসোনাল হতে পারে, কিন্তু অপরাধ নয়। খুন হয়েছেন ডা. নিশাত, তাই সবকিছু খুলে মেলে বলতে হবে। বলুন, আপনাদের সেপারেশনের কারণ কী! আমরা জানতে চাই।      

এবার একটু সময় নেন নজির আহমদে। তারপর অনেকটা স্বগতোক্তির মতো বললেন, ও ঘরোয়া মেয়েই নয় স্যার। ও কারও স্ত্রী হতে পারে  না। ওর বাইরের দিকে টান ছিল।

‘বাইরের টান’ মানে! কী বলতে চান আপনি ? ডিটেকটিভ অলোকেশ সরাসরি তার চোখের দিকে তাকালেন।

লাজুক চোখে তাকান নজির আহমেদ। কুণ্ঠিতও। বললেন, তাহলে বলছি শুনুন। ওর বয়ফ্রেন্ড ছিল। এক নয়, একাধিক। সেটা জানার পরই আমাদের সম্পর্কে চিড় ধরে। আমরা সেপারেট থাকার সিদ্ধান্ত নিই। মিউচুয়াল ডিসিশন। 

হঠাৎ বয়ফ্রেন্ড! কেন বলুন তো ? স্বামী থাকতে আবার বয়ফ্রেন্ড কেন! ডাউট দেন ইন্সপেক্টর নোমান।

নিশাতের অভিযোগ, আমি তাকে তুষ্ট করতে পারছি না। আমি বুড়িয়ে গেছি। আমার হাঁপানির অসুখ আছে, অল্পতেই হাঁপিয়ে যাই। তাকে আর আমার দেবার কিছু নেই, আমি ফুরিয়ে গেছি।

কথা সত্যি ?

জিÑঅফিসার। যা সত্যি তাই বলছি। এসব বিষয়ে কেউ মিথ্যে বলে! মেয়েটা খারাপ। বহুগামী। স্বৈরিণী। ইন ফ্যাক্ট, ও আমার যোগ্যই ছিল না।

ওহ! ওকে। আচ্ছা, সেই রাগেই কি তবে আপনি…! আই মিন নিজের অক্ষমতার দায় নিশাতের উপর চাপালেন!

কী বলছেন অফিসার! আমি কেন তাকে খুন করতে যাব ? আমি আজ সাত দিন ধরে হাসপাতালে পড়ে আছি। আমি কী করে তাকে মারতে পারি ? কেনই বা! খুনটুন অত সহজ কাজ নয়, বুঝলেন। তাতে এলেম লাগে। সবার দ্বারা সবকিছু হয় না। আমার জীবনেও কিছু হয়নি, আই’ম অ্যা লুজার। আই জাস্ট হেইট মাইসেলফ! 

তার মানে সুযোগ ও সাহস পেলে নিশাতকে আপনি খুন করতেন ?

‘হয়তো।’ তারপর বিড়বিড় করে কী যেন বললেন নজির আহমেদ। তাতে অ্যাম্পলিফায়ার সংযোগ দিলে দিব্যি শোনা যেত নজির বলছেন, অমন মেয়েমানুষের বাঁচার কোনও অধিকার নেই। বলে কিনা আমি নপুংসক, আমি অক্ষম। আসল কথা কি জানেন, এক পুরুষে সে তৃপ্ত নয়। তার নিত্যনতুন অভিজ্ঞতা চাই, ফিল চাই, থ্রিল চাই। আর স্ত্রীর মুখে স্বামীর অক্ষমতার অভিযোগ যে কত নিদারুণ ও কষ্টের হতে পারে, তা যে শুনেছে সে-ই কেবল বুঝতে পারে। মহিলা মরেছে, বেশ করেছে। সমুচিত শাস্তি পেয়েছে। শি ইজ টু ডাই!      

ডিটেকটিভ অলোকেশ নোমানের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলেন। বললেন, চলুন এবার যাওয়া যাক। একে মিছেমিছি সন্দেহ করে লাভ নেই। দ্য কিলার মাস্ট বি ‘অন্যকেউ’।

অলোকের কথায় সায় দেন ইন্সপেক্টর নোমান। নজিরের কাছ থেকে তিনি নিশাতের বয়ফ্রেন্ডের নাম-ঠিকানাটা নিয়ে নিলেন। জুয়েল, বনানী থাকে। পরে কখনও কাজে লাগবে। 

এরপর নিশাতের মায়ের বাসা। বনানী, ব্লকÑসি। 

নিশাতের মা রাবেয়া একজন সাহসিনী মহিলা। কত কষ্ট করে স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি তার একমাত্র মেয়ে নিশাতকে মানুষ করলেন! ডাক্তার বানালেন, উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশেও পাঠাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু হঠাৎ সে সবার অমতে মোলাকাতের মতোন একটা গণ্ডমূর্খকে বিয়ে করে বসল। সেই থেকে মায়ের সঙ্গে তার দূরত্ব তৈরি হয়, যা কিনা আর কখনও ঘোচেনি।

সরাসরি কাজের কথায় এলেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়। বললেন, আপনি কি কাউকে সন্দেহ করেন ?

জানি না। ছোট্ট উত্তর রাবেয়ার।

না মানে, কে আপনার মেয়েকে খুন করতে পারে ? প্রথম স্বামী মোলাকাত হোসেন ?

রাবেয়া চুপ। যেন তার কিছু বলার নেই।

নাকি দ্বিতীয় স্বামী নজির আহমেদ ? কে খুনি ?

জানি না, বললাম তো! রেগে যান রাবেয়া। ও আমার মেয়েই নয়, তাহলে ও এমন করতে পারত না। নিজের হাতে জীবনটা নষ্ট করল । ও অপয়া।

নিশাতের একজন বয়ফ্রেন্ড ছিল, জানেন কিছু ? জানতে চান ইন্সপেক্টর নোমান।

কে ?

জুয়েল। জুয়েল ভুঁইয়া। ওর হাসপাতালেই কাজ করে। প্রশাসনে। খেই ধরিয়ে দেন ইন্সপেক্টর।

তাতে এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়েন রাবেয়া। মেয়ের কাণ্ডকীর্তি সম্পর্কে তার আসলে কিছু জানা নেই। কৌতূহলও নেই। মেয়ে কিছু বলেনি, এসব ব্যাপারে তিনিও কখনও ঔৎসুক্য দেখাননি।

আচ্ছা, আপনার মেয়ে কি ড্রাগ নিত ? সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের একটি প্রশ্ন করলেন ডিটেকটিভ অলোকেশ। তাতে অবাক হন রাবেয়া। এ বিষয়েও তার কোনও ধারণা নেই।

ওকে। নিশাতের ছেলেমেয়েদের একটু ডেকে দেবেন ? ওরা এখানেই থাকে শুনেছি!

প্রথমে আপত্তি করলেও পরে রাজি হন রাবেয়া। নিশাতের ছেলেটা বড়―নাম ফারহান। এ-লেভেলে পড়ছে। ওর ইচ্ছে এ-লেভেল শেষ করে দেশের বাইরে পড়তে যাবে।

ছোটমেয়ে নাতাশা। ক্লাস সেভেন।

খুব সফটলি হ্যান্ডেল করছেন ডিটেকটিভ অলোকেশ। তিনি জানেন ব্রোকেন ফ্যামিলির ছেলেমেয়েদের মন এমনিতেই ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত হয়ে থাকে। খুব সেনসিটিভ ও সাসেপ্টিবল। সারাক্ষণ তাদের মনের ভেতর কিছু একটা ভাঙচুর চলে। বড় হতভাগা সন্তান এরা!

ফারহানকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমার মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়েছ ?

তাতে শুধু হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো ছেলেটা। 

খুন হয়েছেন তিনি। কিলার খুব ট্যাক্টফুলি কাজটা করেছে। সুঁচ ফুটিয়ে মেরে তারপর কেসটাকে ভিন্ন খাতে নেবার জন্য ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।

ও-ও! শুধু এটুকু বলল ফারহান। নাতাশা সামনেই ছিল। এসব শুনে ওড়নায় চোখ মোছে মেয়েটা। সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। যেমনই হোক, মা তো! সো শকিং! 

তুমি কি কাউকে সন্দেহ করো ফারহান ? এনি সাসপেক্টস ? ফের জানতে চান ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়।

নো স্যার। নো আইডিয়া। ফারহানের সংক্ষিপ্ত উত্তর। আমার সত্যি কোনও ধারণা নেই। ইন ফ্যাক্ট, মাকে আমি চিনতামই না। শি’জ সো সেলফিশ!  

উর্বী সেই একই প্রশ্ন নাতাশাকেও করল। উত্তরটাও সেইম। নাতাশার কোনও আইডিয়া নেই। তবে সে এটুকু তথ্য দিল যে, বান্ধবীদের কাছে শুনেছে ওর মায়ের নাকি অনেকগুলো বয়ফ্রেন্ড। প্রায়ই এখানে সেখানে কফিশপে তাকে ঘুরতে দেখা যায়। মধ্যরাত অবদি। 

উর্বী বুঝতে পারল, ছেলেমেয়ের কাছে ডা. নিশাত আরও আগেই মারা গেছেন। ফিজিক্যালি না হোক, ইমোশনালি। ফারহান বা নাতাশা তাদের জীবনে মায়ের ঋণ স্বীকার করতে নারাজ। ডা. নিশাত শুধু তাদের বায়োলজিক্যাল মম, এরচে বেশি কিছু নয়।  তাকে বরং ওরা ভুলেই থাকতে চায়।  

ভোঁস করে শ^াস ছাড়ল উর্বী। সেও একটা মেয়ে―কারও না কারও উড-বি মাদার। ফারহান আর নাতাশার কথা শুনে তার মনে হল এমন মা হবার চেয়ে না-হওয়াই বরং ভালো। একটা মেয়ে কি আসলে এতটা খারাপ বা স্বার্থপর হতে পারে! দৃশ্যমান পুরো গল্পটাই সত্যি! নাকি এর পেছনেও অন্য কোনও গল্প আছে! দুঃখজনক হলেও সত্যি, তেমন কোনও গল্প থাকলেও সেই গল্পটা এখন আর জানবার উপায় নেই। কারণ যে নিজের মুখে বলতে পারত, সে তো মরে গেছে। শি ইজ নো মোর! ডা. নিশাত ইজ নাউ ‘ডেড অ্যাজ ডোরনেইল’!     

আরও কিছু মামুলি প্রশ্ন করলেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়। ইন্সপেক্টর নোমান শেষে একটা কাজের কথা বললেন।

তিনি জানতে চাইলেন, আচ্ছা মিসেস রাবেয়া, আপনার মেয়ে খুন হয়েছে। বিধিমোতাবেক মামলা হবে। কিন্তু মামলার বাদী কে হতে চান ? আপনি, নাকি… ?

তাতে ঝড়ের বেগে মাথা নাড়লেন রাবেয়া। বললেন, না বাবা না। যা হবার তা তো হয়েই গেছে। এই নিয়ে আমরা আর কোনও পানি ঘোলা দেখতে চাই না। আমি মামলা করব না। যে যাবার সে চলে গেছে। আপদ বিদায় হয়েছে। 

সে কি, আন্টি! নিশাত আপনার মেয়ে! মনে করিয়ে দেয় উর্বী। আপনি কি চান না আপনার মেয়ের খুনি শাস্তি পাক ?   

না, চাই না। যা করেছে বেশ করেছে। যেমন কর্ম তার তেমন ফলই তো হবে। কে খুন করেছে, কেন করেছে আমি জানি না। হতে পারে, ও নিজেই খুনিকে দাওয়াত দিয়ে এনেছিল! তাকে দিয়ে কিচ্ছু বিশ^াস নেই বাবা। তোমরা আমাকে মাপ করো, আমি মামলা করতে চাই না। মেয়ের লাশও চাই না। ওর লাশ বরং আঞ্জুমানরে দিয়া দাও। ওরা যা করার করবে।    

কী যেন ভাবছেন ডিটেকটিভ অলোকেশ। সামনে নিশাতের ছেলেমেয়ে বসে আছে―ফারহান আর নাতাশা।

তোমরা কি কেউ বাদী হবে ? আই মিন কমপ্লেইন্যান্ট ? তোমার আম্মু যেমনই হোক, তাকে খুন করার রাইট তো কারও ছিল না, তাই না ? ইটস অ্যা ক্রিমিনাল অফেন্স। খুনের বিচার হওয়া উচিত। বুঝিয়ে বললেন তিনি।

ফারহান কিছু বলতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে দেন রাবেয়া। বললেন, দেখ বাবা, আমার মেয়ের জীবন তো শেষই, তোমরা কি চাও আমার নাতির জীবনটাও শেষ হোক! ফারহান এ’লেভেল শেষ করে দেশের বাইরে পড়তে যাবে। এসব মামলার চক্করে জড়িয়ে পড়লে ওর ক্ষতি হবে। আমি তা হতে দিতে পারি না। অনেক কষ্ট করে আমি ওদের বড় করেছি। আমি চাই ওরা সামনে যাক, মায়ের মতোন নষ্ট না হোক।  

ইন্সপেক্টর নোমান আইনের দিকটা দেখছেন। কেউ না চাইলে তাকে মামলার ব্যাপারে জোর করা যায় না। সেটা আইনের খেলাপ। উর্বী ভাবছে অন্য কথা। ডা. নিশাতের পরিণতি কেমন নিদারুণ! বেঁচে থাকতে যে সুখ পায়নি সেটা পরিষ্কার। মরার পরেও নয়। কী জানি―হয়তো একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে সে স্বখাত সলিলে ডুবেছে! মদ্যপ মোলাকাত হোসেনকে সে সবার অমতে বিয়ে করল, বিয়েটা তার টিকলো না। তাকে ছেড়ে এসেও শান্তি পায়নি নিশাত। পুরনো পাপ তাকে আস্তাকুঁড়ের দিকে ঠেলেছে। মোলাকাত তার কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা আদায় করেছে, ছবি ভাইরাল করবার ভয় দেখিয়েছে।

তারপর আবারও সে সেই একই ভুল করল। একজন বয়স্ক ভদ্রলোককে বিয়ে করল, যাকে কিনা সে ভালোবাসেনি। ভালোই যদি বাসত তাহলে তার বিরুদ্ধে সে অক্ষমতার অভিযোগ আনত না। শরীরী ব্যাপারটা মোটেই কেবল শরীরী নয়, বরং অনেকখানি আবেগ ও মানসিক। মন থেকে না এলে বিশেষ মুহূর্তে স্বামীর সক্ষমতা আসবে কোত্থেকে!

উর্বীর সবচে বেশি কষ্ট লাগছে ডা. নিশাতের মৃত্যুপরবর্তী অবস্থা দেখে। তার লাশের কোনও দাবীদার নেই, মামলা করা তো দূরের কথা। দু-দুটো স্বামী, দুটো সন্তান, এমনকি, তার নিজের মাও তাকে দেখতে চায় না। কতোটা হতভাগ্য সে! 

সত্যি বলতে, এই কেসের উপর থেকে মন উঠে গেছে উর্বীর। ডিটেকটিভ অলোকেশও যেন ঠিক উৎসাহ পান না। কিন্তু তিনি তো পেশাদার গোয়েন্দা, তাকে স্রেফ আবেগে ভর করে চললে হবে না, খুনিকে খুঁজতেই হবে। রহস্য তাকে টানে, দুর্নিবার সেই আকর্ষণ, চাইলেও তিনি রহস্য থেকে দূরে থাকতে পারবেন না।

ছয়.  

ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়ের ডেরা, তাজমহল রোড, মোহাম্মদপুর।    

বৈকালিক চা, কফি ও চা-ফি সহযোগে কথা হচ্ছিল এই কেসের ব্যাপারে। ডিটেকটিভ অলোকেশ ভাবছেন, আর মাঝে মাঝে কফির মগে চুমুক দিচ্ছেন। তিনি চিন্তিত, তবে তার এই ভাবনার রকমফের আছে। তিনি সচরাচর শুধু কেস নিয়ে ভাবেন, কিন্তু এখানে ভাবনার অনেক দিক রয়েছে। খুন হলেন ডা. নিশাত চৌধুরি। বড় অদ্ভুতভাবে তাকে খুন করা হয়েছে, বগলের তলায় সুঁচ ফুটিয়ে। কেমন সেই সুঁচ ? কারা ব্যবহার করে! প্রফেশনাল কেউ! ভিকটিম নিশাতের প্রতিপক্ষ কোনও ডাক্তার! যে কিনা তার হাতযশে নিশাতের ব্যাপারে খুব জেলাস!

ফরেনসিক স্পেশালিস্ট সোহেল মাহমুদ স্পষ্ট করে বললেন, এটা একরকম যন্ত্র হতে পারে যা কিনা নির্দিষ্ট কোনও পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত।

কেসটা যে খুনের, এটুকু অন্তত নিশ্চিত হওয়া গেছে। বেচারি নিশাত!

অন্যান্য কেসে ভিকটিমের প্রতি তেমন কোনও কমপ্যাশন বা সহানুভূতি বোধ করেন না অলোকেশ। কিন্তু এই কেসের ব্যাপারটা ভিন্ন। তিনি নিশ্চিত যে, উর্বী এবং ইমরুলও ডা. নিশাতের গল্প শুনে কষ্ট পেয়েছে। মেয়েটা বোকা তাতে কোনও সন্দেহ নেই। নিজের ছেলেমেয়েও তাকে পছন্দ করে না, ভালোবাসে না। তার জন্মদাত্রী মা-ও নয়। দিনের পর দিন এভাবে একলা জীবন বয়ে বেরিয়েছেন তিনি। দু-দুবার বিয়ে করেও সুখের মুখ দেখেননি। কলিগরা নিশ্চয়ই এই নিয়ে তাকে ‘পোক’ কিংবা ‘প্রোভোক’ করেছে, বা আড়ালে আবডালে গল্পও ছড়িয়েছে।

সে যাক, আপাতত কয়েকটি বিষয় নিয়ে এগোচ্ছেন ডিটেকটিভ অলোকেশ। তার ব্যবচ্ছেদের বিষয় মূলত দুটো―খুনটা কী করে হল! খুনের হাতিয়ার কি খুনি তার সঙ্গে করে নিয়ে গেছে? আরেকটি বিষয়ও খুব ভাবাচ্ছে তাকে―খুনের মোটিভ আসলে কী ছিল ? প্রফেশনাল রাইভালরি, নাকি পারসোনাল ইস্যুজ!

ইয়েস, খুনের মোটিভ আর খুনের হাতিয়ার সম্পর্কে জানতে পারলে খুনিকে পাকড়াও করা বেশ সহজ হয়। অথচ এই কেসে এর দুটোই এখনও অবধি অধরা। দ্যাট রিয়েলি কমপ্লিকেটস দ্য কেস!    

উর্বী, কী মনে হয় তোমার ? কে খুনি ? আমরা আজ অবধি যাদেরকে জেরা করেছি তাদের কাউকে কি তোমার সন্দেহ হয় ? হলে তার পেছনে যুক্তি কী ? একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন উপস্থাপন করলেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়। প্রশ্নটা শুধু উর্বীকে নয়, ইমরুলের উদ্দেশ্যেও সেই একই প্রশ্ন করলেন তিনি। 

উর্বী সরাসরি কিছু বলল না। শুধু এটুকু জানালো যে, ভিকটিমের প্রথম ও দ্বিতীয় স্বামীর মধ্যে পরের জন অর্থাৎ নজির আহমেদের মোটিভ বেশি স্ট্রং।

কেন বলো তো ? প্রশ্নবোধক চোখ তুলে তাকান ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়। সত্যি বলতে, কেসটা নিয়ে তিনি বেশ বেকায়দায় পড়েছেন।  

কারণ ডা. নিশাত তার পৌরুষ নিয়ে কথা বলেছে। জেনেশুনে তাকে অপমান করেছে, যা কিনা একজন পুরুষের পক্ষে মেনে নেয়া বেশ কঠিন। তাকে নপুংসক বলেছে ডা. নিশাত।

বুঝলাম। কিন্তু তার পক্ষে নিশাতকে খুন করা কঠিন। এটা বাস্তবসম্মত নয়। ইন ফ্যাক্ট, ঘটনার সময় নজির সাহেব হাসপাতালে ছিলেন বলে প্রমাণিত।

ইমরুল মাঝখান থেকে বলল, নিজে না করে অন্য কাউকে দিয়েও খুন করাতে পারে। আই মিন কন্ট্র্যাক্ট কিলার।

তা অবশ্য পারে। মাথা নাড়লেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়। কিন্তু―!

কীসের কিন্তু অলোক ? জানতে চায় উর্বী। তার ‘চাফি’ শেষ হয়ে এসেছে। তাও খালি কাপে সে একবার ঠোঁট ছোঁয়ায়। অনেকটা অভ্যাসের বশে। 

না মানে নজিরকে আমি যতটুকু দেখলাম, তাতে তাকে খুব একটা রিভেঞ্জফুল বা প্রতিশোধপরায়ণ বলে মনে হয়নি। বেচারা বড়ই নিরীহ গোবেচারা গোছের মানুষ বলেই মালুম হল। তাছাড়া সে নিজেই অসুস্থ, কাউকে মারা-ধরার মতো মনের অবস্থা কি তার আছে! নিশাতকে মেরে লাভটাই বা কী! তাতে তার শারীরিক অক্ষমতা তো আর দূর হয়ে যাবে না, তাই না!

তা অবশ্য ঠিক। হি ইজ টু ইনক্যাপাবল টু বি দ্য কিলার! তাকে আমরা আপাতত ‘রুলÑআউট’ করতে পারি অলোক। সায় দেয় উর্বী। 

প্রথম স্বামী মোলাকাত হোসেন ? তার ব্যাপারে কী ভাবছ উর্বী?

লোকটা জাত ছুঁচো। তার চেহারায় একরকম নিঘিন্নেটাইপ কুতকুতে ভাব আছে। বদস্বভাবের মানুষ এই মোলাকাত হোসেন। নইলে নিজের স্ত্রীকে কেউ এভাবে ব্ল্যাকমেল করে! তার পক্ষে খুন করাটা মোটেও অস্বাভাবিক কিছু নয়। লাভের জন্য সে সব পারে।  

হুঁ। কফি শেষ করে বাদাম ধরলেন ডিটেকটিভ অলোকেশ। স্পেশাল অর্ডার দিয়ে আনানো হ্যাজেল নাট। হার্টের পক্ষে এই বাদাম খুব উপরকারী।

কীসের হুঁ ? খুলে বলো অলোকেশ। তাড়া দেয় উর্বী। উন্মুখ হয়ে আছে ইমরুল। অলোককে সে গুরু মানে। তার কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে ক্রাইম রিপোর্টার আসিফ ইমরুল।  

আমার মনে হয় মোলাকাত লোকটা খারাপ হলেও বোকা নয়, তাই সে খুনটা করবে না।

কেন করবে না শুনি ? হতে পারে নিশাত তাকে মাসোহারা দিতে অস্বীকার করায় রাগের মাথায় সে কাজটা করেছে!

অসম্ভব কিছু নয়। খুনির মনস্তত্ত্ব কে বুঝবে বলো! সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ কি আর কারও জীবন নিতে পারে ? তবে আমি হলে খুনটা করতাম না।

কেন করতে না শুনি ? না করলে কী লাভ ?

খুন না করলেই তো বেশি লাভ উর্বী। ভুলে যেও না, ডা. নিশাত ছিল তার সোনার ডিমপাড়া হাঁস। নিশাত না থাকলে মাসে মাসে সে মোটা অংকের টাকা চাইবে কার কাছে ?

মাথা নাড়ল উর্বী। তারপর বলল, তা অবশ্য ঠিক। তবে আমি কিন্তু মোলাকাত হোসেনকে এখনও খুনির তালিকা দিতে বাদ দিতে রাজি নই। ব্যাটা একটা বাস্তুঘুঘু। তার পক্ষে অসম্ভব কিছুই নয়।    

কথার মাঝে আরেক প্রস্থ পানীয়ের অর্ডার দেন ডিটেকটিভ অলোকেশ। কফি না খেলে তার মগজ খোলে না। তাছাড়া কফি জিনিসটা শরীরের জন্য ভাল। নিয়মিত এবং পরিমিত কফি খেলে অন্তত কয়েকটি রোগের উপশম হয়। এই যেমন―আলঝেইমারস, ডিমেনশিয়া, পারকিনসন্স ডিজিজ, ডিপ্রেশন, অবসাদগ্রস্ততা, এমনকি, কফিতে প্রচুর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকে বিধায় ক্যানসার প্রতিরোধক হিসেবেও কাজ করে। এটা একরকম ‘এনারজাইজিং’ ড্রিঙ্কসও বটে। খেলে শরীরে বেশ চাঙাভাব আসে। তাই তিনি হাঁকলেন, বেচুদা, কফি লে আও। জলদি।

কফি খেতে খেতে আরও একটা কথা বললেন অলোকেশ। তিনি বললেন, এই কেসের সবচে বড় দুর্বলতা বা গলদ কী জানো উর্বী―! অমনি ব্রেক দেন অলোকেশ। বড্ড বিরক্তিকর ব্রেক।

কী ?

এতবড় বাড়িটার প্রবেশপথে সিসিটিভি ক্যামেরা না থাকার কোনও মানেই হয় না। এই জামানায় এমন বোকার মতোন কাজ কেউ করে! কত টাকাই বা খরচা হত বলো উর্বী! অথচ ওটা থাকলে আমাদের কাজ অনেকটাই আসান হয়ে যেত। 

তা অবশ্য―কিন্তু তাতে দুঁদে গোয়েন্দা অলোকেশের মগজের জোর কী করে প্রমাণ হত বলো! ক্যামেরার চোখ দিয়ে খুনি সবাই ধরতে পারে। হেসে বলল উর্বী। তার ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি দোল খায়।  

চুকচুক করে চা চাখে ইমরুল। শব্দটা বড্ড কানে লাগে। তিনি উর্বীকে ইশারায় বললেন, বাচ্চাটাকে চা খাওয়া শেখাও তো। তোমার ইমু এখনও চা-পান শিখলো না, তো সে উচ্চশিক্ষার্থে জাপান যাবে কী করে! কোনও উর্বী, বেঁচে থাকাটা একটা আর্ট। সবাই এই শিল্প জানে না, রপ্তও করতে পারে না। সবার জন্য জীবন নয়, বুঝলে। পাহাড়প্রমাণ কষ্ট নিয়ে বেঁচে থেকে কী লাভ! তারচে বরং ছুটি নেয়া ভালো। আপসে।      

অমনি ডিসেন্ট দেয় উর্বী। ভুল বললে তুমি, অলোকেশ। সাজানো বাগান থেকে সকলেই ফুল তুলতে পারে, তাতে কিন্তু কোনও মুন্সিয়ানা নেই। পারলে নিজের হাতে বাগান বানিয়ে, তারপর ঘাস-লতাপাতা সাফ করে কাঁটার খোঁচা বাঁচিয়ে সেখান থেকে পুষ্প আহরণ করো। তবেই না বুঝব তুমি কত বড় ঝানু ও এলেমদার লোক।

কথা বাড়ান না অলোকেশ। উর্বীর চোখে তাকিয়ে একটা আলতো ভ্রকুটি হেনে কাকে যেন ফোন করলেন তিনি। রিং হচ্ছে। ফোনটা রিসিভডও হল। ফোনের ওপারে ফরেনসিক ডক্টর সোহেল মাহমুদ।

ফোনের স্পিকার যথারীতি অন করলেন অলোকেশ। দুজনের কথোপকথন উর্বী ও ইমরুলের শোনা দরকার। আফটার অল, ইটস অ্যা টিম-ওয়ার্ক।

তারপর, কেস কদ্দুর এগোল ডিটেকটিভ ? কণ্ঠে তারল্য মিশিয়ে বললেন ডক্টর সোহেল।

খুব একটা নয় ডক্টর। বলতে গেলে যে তিমিরে ছিলাম, আমি এখনও সেখানেই পড়ে আছি। নো ইমপ্রুভমেন্ট।

 সে কি! কেন ? বাংলাদেশের বেস্ট ডিটেকটিভের মুখে তো এমন কথা মানায় না। খুলে বলুন অলোকেশ, প্রবলেম কী!

প্রবলেম অনেক। প্রথমত, তেমন কোনও ক্লু ক্রাইম সিনে নেই। ঘটনার সময় ভোর রাত, অথচ বাড়ির একমাত্র দারোয়ান জলিল তখন টুলে বসে দিব্যি ঝিমুচ্ছিল, ফলে সে কিছুই দেখতে পায়নি। খুনি সম্ভবত আউটসাইডার, আর ভিতরের কেউ হলে তো কথাই নেই। তাহলে তার পোয়াবারো। আরামসে কাজটা সেরে ফেলেছে।  ভিকটিমের দরজায় ফোর্স-এন্ট্রির কোনও চিহ্ন নেই, তাতে মনে হয় ডা. নিশাত নিজেই দরজা খুলে দিয়েছিলেন। আবার এমনও হতে পারে, নিশাত হয়তো কোনে কাজে বাইরে বেরিয়েছিলেন। ঘুম না আসায় ভোরের হাওয়া গায়ে মাখছিলেন!  

তাই বলে অত রাতে ?

হতে পারে। কারণ আমরা শুনেছি তার দীর্ঘদিনের ‘ইনসমনিয়া’ ছিল। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, যাদের অনিদ্রার রোগ আছে, জীবন তাদের কাছে স্রেফ নরক মনে হয়। সময়মতো ঘুম না এলে মানুষ তখন কী না করে বলুন ডক্টর! আমি তো শুনেছি যাদের রাতে ঘুম হয় না তারা যখন তখন ছাদে উঠে ভূতের মতো ঘুরপাক খায়, হাওয়া শোঁকে, গাছপালার সঙ্গে কথা বলে―ইত্যাদি। আবার কেউ কেউ মুঠিÑমুঠি ঘুমের ওষুধ গেলে।  

জি। তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু এই কেসের সাসপেক্টস কেউ নেই নাকি ?

আছে, বাট দুর্বল। নিশাতকে মেরে তাদের কারওই নগদে কোনও লাভবান হবার সুযোগ নেই। সে বরং বেঁচে থাকলেই তাদের লাভ। বড্ড জটিল কেস, বুঝলেন ডক্টর। হতাশার সুরে বললেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়।

কিছুক্ষণ নীরবতা, যেন নৈঃশব্দ হিরন্ময়। দুজনের কেউ কিছু বলছেন না। একটু পরে ডক্টর সোহেল নীরবতা ভাঙলেন। বললেন, একটা ক্লু কিন্তু আমি আপনাকে দিতে পারি ডিটেকটিভ। বলতে পারেন ভেরি স্পেশাল ক্লু। 

কী ? বলুন প্লিজ। সোৎসাহে বললেন ডিটেকটিভ অলোকেশ। তিনি যেন আঁধার ঘরের মানিক খুঁজে পেলেন, বা ডুবন্ত পিঁপড়ার কাছে ভাসমান পাতা যেমন।  

সোহেল বললেন, ডা. নিশাতের খুনে ব্যবহৃত অস্ত্রটি সম্পর্কে আমি খানিকটা গবেষণা করেছি, বলতে পারেন ‘ফরেনসিক অ্যানালিসিস বাই ইম্যাজিনেশন’।

সে কেমন শুনি ? অলোকের কণ্ঠে বাড়তি উত্তেজনা।

হতে পারে ওটা ভোর বা ভোমর।

ভ্রমর মানে বাম্বল―বি ? অলোকের প্রশ্ন।

আরে না রে ভাই, এই ভোমর কালোভ্রমর নয়, এ একরকম কাঠ ছেঁদা করার যন্ত্র। আগার দিকটা সুঁচালো―স্পাইরাল করা থাকে। সেটাই পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ভিতরে ঢুকে যায়। কাঠে ছিদ্র হয়।   

ওহ হো! ছুুতোর মিস্ত্রিরা ব্যবহার করে, তাই না ?

ইয়েস। ইউ আর রাইট অলোকেশ। আবার মনে হয়, ঠিক তাও না―অন্যকিছু।

অন্যকিছু মানে ?

সেলাই-ফোঁড়াইয়ের কাজে ব্যবহৃত ‘হুক’ও হতে পারে। কারণ ভিকটিম ডা. নিশাতের বগলের তলায় যে ছিদ্র দেখেছি, যাতে তার ফুসফুস ফুটো হয়ে গেছে, সেই যন্ত্রের আগায় বড়শির মতোন বাঁকানো হুক থাকাও বিচিত্র নয়। নইলে বগলের চামড়ার নিচে চিকন ফুটোর মুখটা অত বড় হবে কেন! মনে হয় যেন ওটার আগায় যে হুক তা টেনে বের করতে গিয়ে ভেতর থেকে অনেকখানি মাংস ও টিস্যু বেরিয়ে এসেছিল। কেসটা বোধ করি বুঝতে পারছেন আপনি, অলোকেশ ?

উঃ! বোঝার চেষ্টা করছি। তার মানে আপনি বলছেন ওটা ছুতোর-মিস্ত্রি বা দর্জির যন্ত্র হতে পারে!

আই’ম নট শিওর, হতেও পারে। আপনি বরং ক্রাইম সিনে আরেকবার যান, ভালো করে খুঁজুন ডিটেকটিভ, পেলেও পেতে পারেন আপনার সেই অমূল্য রতন, মানে ডা. নিশাত খুনের অস্ত্র।

ফোন ছেড়ে দেন অলোকেশ। তিনি বেশ আশ^স্ত বোধ করেন। অন্ধকার টানেলের আগায় তিনি যেন খানিকটা আলোর আভাস টের পান। কেসটা সম্ভবত এবার তিনি খোলাসা করতে পারবেন। খুব দামি কিছু তথ্য দিয়েছেন ফরেনসিক স্পেশালিস্ট সোহেল মাহমুদ।  

সাত.

ডক্টর সোহেলের কথামতো সপারিষদ কলাবাগান ডলফিন গলিতে গমন করেন ডিটেকটিভ অলোকেশ। এমনিতে গলিগমন মোটেও ভালো কিছু নয়, তবে কাজের প্রয়োজনে তাকে অনেক জায়গায় যেতে হয়। ‘প্রফেশনাল আরজেন্সি’ বলে কথা!

গিয়ে দেখেন যথারীতি বাড়ির মূল ফটকে দারোয়ান জলিল মিঞা নেই। তবে সেই পুঁচকে ছোকরা রুবেল অবশ্য ছিল। তার কাজ গ্যারেজ পাহারা দেয়া, বাড়ি দেখে রাখা নয়। হতে পারে দারোয়ান জলিলকে ভালোবেসে তার প্রতিস্থাপক হিসেবে রুবেল মাঝেসাঝে উপরি সার্ভিস দেয়।

ওই, তোর দারোয়ান কই ? আলগোছে চোখ নাচান ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়।

কেডা! জলিল ভাই ?

হুঁ। বল, সে কোথায় গেছে ? 

হেয় তো এহন নাই। মনে কয় হাগু দিতে গেছে। রুবেল ছিঁচকে হেসে বলল। যেন হাগু দেয়াটা কোনও কাজের কথা নয়, স্রেফ কাজে ফাঁকি দেয়া।

সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যান অলোকেশ। সঙ্গে তার দুই সহযোগী উর্বী ও ইমরুল। কিন্তু ভিকটিম নিশাতের ঘর তালাবন্ধ, সিলগালা করা আছে। কারণ ওটা এখন ক্রাইম মিস, চাইলেই যে কেউ ঢুকে পড়তে পারে না। এই কেসের কিনারা না হওয়া অবদি ওই ঘর খুলে দেয়া যাবে না। অলোক অবশ্য ইন্সপেক্টর নোমানকে চাবি পাঠাতে বলেছেন। একজন কনস্টেবলের চাবি নিয়ে আসবার কথা। কিন্তু এখনও সে আসেনি কেন কে জানে! সঙ্গীসমেত নিচে নেমে এলেন অলোকেশ।

একটু পরে জলিল এলো। বেটা দারোয়ান বহুত ফাঁকিবাজ। কিন্তু সে এমন একখানা সহজ সরল ভাব ধরে থাকে যে তার উপর রাগ করা যায় না। চাবি আনবার ফাঁকে লোকটাকে আরেক দফা বাজিয়ে নেন অলোকেশ।

জলিল!

জি সাব!

তোমার ম্যাডাম মানে ডা. নিশাত মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন ?

উত্তর না দিয়ে দুবলা বাছুরের মতোন নিষ্পাপ চোখে তাকায় জলিল মিঞা। বলে, মাইনে কী! কেমুন মানুষ সাব! মানুষ তো মানুষই! দুই হাত দুই পাও, চোখ-মুখ-নাক-কান সব আছে। শুধু লেঙুড় নাই―গরুর লগে ওইডাই যা তফাৎ!

ফাজলামি করবে না জলিল। যা জানতে চাইছি তার ঠিক ঠিক জবাব দাও। নইলে পুলিশ কিন্তু তোমাকে ছাড়বে না। ঘটনার সময় তোমার গেটে পাহারায় থাকবার কথা, কিন্তু তুমি ছিলে না। কে বলতে পারে, তুমিই হয়তো টাকা খেয়ে খুনিকে খুনের সুযোগ করে দিয়েছ! হালকা থ্রেট করলেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়। যে কাজের যেমন দস্তুর! 

তাতে কাঁদো কাঁদো হয় জলিল মিঞা। সে বুঝতে পারে, কেস খাবার মতোন কাজ সে করেছে। তার অবর্তমানে কেউ একজন উপরে উঠে গেল, খুনও করল অথচ সে দেখল না! দোষ তো তারই। তার চরম শাস্তি পাওনা হয়ে গেছে।  

ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে জলিল বলল, কী কমু সাব, বলেন আপনে!

অলোকেশ ফের জানতে চান ডা. নিশাত মানুষ হিসেবে কেমন ? তার মেজাজ-মর্জি চাল-চলন ?

মিছা বলুম না সাব। হেয় মানুষ ভালা, তয় তার মেজাজটা এট্টু বেশি গরম। সবসময় রাগ অইয়া থাকত। আমাগো লগে তুই-তোকারি করত, বকশিস দিলেও ভালা মুখে দিত না। খিস্তি-খেউর করত। জলিল জানায়।

এই তো পাখির মুখে বেশ বুলি ফুটেছে। চাপে পড়লে সকলেই বাপ ডাকে! মানুষ যে কী চিজ, সে কি আর বুঝতে বাকি!  

যেমন! কীÑকী গালাগাল দিত শুনি ? কাকে দিত ?

শুয়োরের বাচ্চা, কুত্তার ছাও, মিউ বিলাই এইসব, সাব। জলিল মিঞা ডা. নিশাতের গালাগালের কিছু নমুনা পেশ করল। 

ওর কথা শুনে হাসি পায় উর্বীর। তার মনে হয় বেটা জলিল বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলছে। অবশ্য মিথ্যা বললেও এখন আর কিছু করবার নেই। কারণ যে ওর কথায় ‘ভেটো’ দেবে সে তো আর বেঁচে নেই। কবেই লাশ হয়ে গেছে!

আচ্ছা, নিশাত কি সবসময় মুখ খারাপ করত বা রেগে থাকত, জলিল ?  

জি সাব। মাসখানেক আগে সে যা করল, ভাবতে এহনও মোর লজ্জা অয়। সেই কতা মনে করতি চাইনে।

কী কাজ, জলিল ? খুলে বলো। ভুলে যেও না, কেসটা কিন্তু খুনের কেস। খুব গম্ভীর ব্যাপার!  

স্যার আর কইয়েন না, এক মুচির লগে আপার প্রায় হাতাহাতি কাণ্ড! তার স্যান্ডেলের সেলাই ঠিকঠাক হয় নাই, তাই তার জামার কলার ধরি দিল দুই থাপ্পড়! চুল টানলো। আবার কয় কিনা তুই ছোটো লোকের জাত―তুই মুচি। তুই একটা কুত্তার ছাও, ইত্যাদি। বেডা মুচি হ্যাতে কাইন্দা ভাসাইলো। কয় কিনা কুত্তার ছাও! সহ্য অয়!

কথা আর খুব একটা এগোল না। চাবি আসায় দেরি দেখে আবারও দোতলায় উঠে পড়লেন অলোকেশ। কী কারণে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। পাশের একটা ঘর (সাবলেট) থেকে ধুন্ধুমার ঝগড়ার শব্দ আসছে। সেই মেয়েটা, কী যেন নাম, সেই উঠতি মডেল তিন্নির গলা মনে হচ্ছে! তাই হবে। কারণ এই ফ্লোরের আরেকজন সাবলেটবাসী তো ঢাকায় নেই। করোনায় কলেজ বন্ধ, তাই সে এখনও তার বাড়িতেই অবস্থান করছে। 

কান পাতলেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়। উৎকর্ণ হলেন তিনি। কী বলছে একটু শোন যাক। দুটো গলা দুরকম। তিন্নি যার সঙ্গে ঝগড়া করছে সে মেয়ে নয়, ছেলে। কমবয়সী বলেই তো মনে হয়।

প্রায় মিনিট পাঁচেক ঝগড়া শুনলেন তিনি। তাদের কণ্ঠ স্পষ্ট শোনা যায়, কেননা, ঘরের দরজা কিঞ্চিত ফাঁকা ছিল। তিন্নি যা বলছে তার মর্মার্থ এই―ছেলেটা, যার নাম জুয়েল, তাকে সে একদম বিশ^াস করে না। তিন্নিকে লুকিয়ে সে একাধিক প্রেম করছে। তা করুক, তাতে ডিটেকটিভ অলোকেশের কোনও প্রবলেম নেই। কিন্তু শেষে তিন্নি যে-কথা বলল তাতে মনে হল এই কেসের সঙ্গে জুয়েলের সম্বন্ধ থাকলেও থাকতে পারে।

কী কথা শুনি ?

ওই যে, তিন্নি বলল সদ্য খুন হওয়া নিশাতের সঙ্গেও নাকি তার বয়ফ্রেন্ড জুয়েলকে বারদুই ঘুরতে দেখা গেছে। কফিশপেও মিট করেছিল তারা। কফি ওয়ার্ল্ডে। হতে পারে, এখানেই ওরা অর্থাৎ জুয়েল এবং ডা. নিশাত দুয়েকবার ঘনিষ্ঠও হয়েছে। নাকি নিয়মিত!   

সে কি! সত্যি ? ইমরুল ও উর্বী দুজনেই বিস্ময়ে হাঁ।

সত্যি, না তো কি মিথ্যা! তোমরা নিজের কানেই শুনেছ, নয় কি! অলোকেশ বললেন।

তার মানে নিশাত মেয়েটার চরিত্র সত্যিই গড়বড়ে ছিল। সাধে কি আর তার নিজের মা ও ছেলেমেয়ে তাকে অপছন্দ করত! এমন বদখাসলত মেয়েকে কে-ই বা আর ভালোবাসে বলো!

খানিক বাদে নিশাতের ঘরের চাবি এসে গেল। কনস্টেবল নন্দ দুলাল হাতে করে চাবি নিয়ে এসেছে। সাথে ঘরের সিল ভাঙার অনুমতিপত্র।  

অকুস্থলে যান ডিটেকটিভ অলোকেশ। তার ছায়াসঙ্গী দুজনও ঢুকলো। ফরেনসিক ডক্টর সোহেলের কথা মাথায় রেখে ঘর খুঁজছেন। প্রতি ইঞ্চি জায়গা তন্ন তন্ন করে খুঁজতে হবে। এক চিলতে জায়গাও যেন বাদ না পড়ে। অলোকের দৃঢ় বিশ^াস এখানেই কিছু আছে, কোনও ক্লুÑথাকতেই হবে।

ঘরে ঢুকে কীসের যেন গন্ধ পান অলোকেশ। একটু কটু, ঝাঁঝালো এবং বিবমিষার উদ্রেককর―যা কি না, প্রথম দিন স্পটে এসে পাননি। কিছু একটা পোড়া গন্ধ। তবে কি ঘটনার পরেও এখানে কেউ এসেছিল! কিন্তু সিলগালা তো ভাঙা ছিল না। রীতিমতো অটুট। তার মানে মনের দোষ, বা স্রেফ নাকের।   

ছুঁচোর মতো ছোঁক ছোঁক করেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়। উর্বীকে বললেন, ভালো করে নাকটা দাও তো দেখি। সামথিং সিমস টু বি রঙ―ভেরি রঙ, ইনডিড।  

ফলে কী হলো―তিনখানা নাক সমানে ছোঁক ছোঁক করতে শুরু করল। সে এক অদ্ভুত সিস্ফোনির মতোন ব্যাপার। লাডউইগ ভন বিটোভেনের নবম সুরকেও যেন হার মানায়। 

ওরা কিছু একটা খুঁজছে আর শুঁকছে―উইলিয়াম বেকেটের ‘ওয়েটিং ফর গোডো’ নাটকের মতো। তারা জানে না, তারা কী খুঁজছে। প্রায় মিনিট দশেক শোঁকাশুঁকির পর কিছু একটা পেলেন অলোকেশ। খাটের একেবারে ভিতরের দিকে একটা জুতোর বাক্স, তার ঠিক তলায়। কী জিনিস পেলেন তিনি ?

প্রায় পুড়ে যাওয়া চামড়ার কিছু অবশিষ্টাংশ। এটা থেকেই সেই কটু আর ঝাঁঝালো গন্ধটা বেরোচ্ছিল বোধ হয়। কিন্তু ঘটনার এতদিন পর! অবাক করার মতোন বিষয়। জিনিসটা নাকের ডগায় তুলে ধরলেন তিনি। উর্বী আর ইমরুলও কৌতূহল নিয়ে দেখছে।

কী এটা ?

আগুনে জিনিসটার প্রায় আশি শতাংশ পুড়ে যাবার কারণে ঠিক চেনা যায় না। অর্থাৎ জিনিসটা তার মূল চরিত্র খুইয়েছে, নারী তার সতীত্ব হারালে যেমন হয়। তাতে তার মনুষ্যত্ব থাকে, আবার থাকেও না। কিন্তু চরিত্র কি শুধু নারীর যায়, পুরুষের নয়! পুরুষেরও চরিত্র খোয়া যায় বটে, ওটা বিগড়োলে তখন আর তার ব্যক্তিত্ব থাকে না। স্রেফ ফালতু হয়ে যায়। 

উর্বী বা ইমরুল না বুঝলেও ডিটেকটিভ অলোকেশ কিন্তু জিনিসটা কী তা ধরে ফেললেন। তার ঠোঁটে অদ্ভুত এক হাসির রেখা উঁকি দিল। আরেকটু হলেই আর্কিমিডিসের মতোন চেঁচিয়ে উঠতেন তিনি―ইউরেকা! অর্থাৎ পেয়েছি, আমি তাকে পেয়েছি। 

বলাই বাহুল্য, ডিটেকটিভ অলোকেশের হাতে গ্লাভস। দস্তানা ছাড়া খালি হাতে কখনও তিনি কোনও আলামতে হাত দেন না। এ ব্যাপারে তিনি সদা সতর্ক, কারণ এটাই এই কাজের দস্তুর। এভিডেন্স প্যাকে জিনিসটা টুক করে ফেলে দিয়ে শুধু একটি শব্দ উচ্চারণ করলেন অলোকেশ―অঙ্গুস্তানা! 

অঙ্গুস্তানা! সেটা আবার কী ? দস্তানার ছোটভাই, নাকি আফগানিস্তান থেকে আসা বেদানা জাতীয় কোনও ফল?

মুখে জাস্ট কুলুপ এঁটে নেন ডিটেকটিভ অলোকেশ। তিনি এ বিষয়ে আপাতত আর কিছুই বলবেন না ঠিক করেছেন। একেবারে স্পিকটি নট!  

অকুস্থল আবার সিলগালা করে দিয়ে নিচে নেমে এলেন ডিটেকটিভ অলোকেশ ও তার দল। নেমে দেখেন যে, সেই ছেলেটিকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে রেখেছে কনস্টেবল নন্দ দুলাল। তার প্রতি অবশ্য এমনই নির্দেশ দিয়েছিলেন অলোকেশ। এই ব্যাটাকে একটু বাজিয়ে দেখা দরকার। ডা. নিশাতের সঙ্গে ওর যা সম্পর্ক, তাতে এর মুখ থেকে কিছু না কিছু নতুন তথ্য পাওয়া যাবেই। কে বলতে পারে, খুনের মোটিভ হয়তো এই ব্যাটাই তার বুকের ভিতর দামি সুগন্ধীর ন্যায় সযত্নে গুঁজে রেখেছে।  

নাম ?

কার ? আমার, না আমার―!

নিজের নাম বল। খেঁকিয়ে ওঠেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়। ছোকরাকে দেখে তার মোটেও ভদ্রসভ্য বলে মনে হয়নি। তাই মুখ ফসকে তুই-তোকারি বেরিয়ে গেল। এমনিতে তিনি কাউকে কখনও অপমান করে কথা বলেন না। এমনকি, দাগী আসামিকেও নয়। কারণ যতক্ষণ না কারও অপরাধ প্রমাণিত হচ্ছে, ততক্ষণ কাউকে অপরাধী ভাবা ঠিক নয়। ওটা আইনের খেলাপ। 

আমি জুয়েল। তিন্নি আমার বন্ধু।

কেমন বন্ধু শুনি ? ফের জানতে চান ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়।

ছেলেটা কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই তেড়েফুঁড়ে ওঠে তিন্নি। বলল, স্যার, ওর কথা আপনি বিশ^াস করবেন না। ও একটা ঠগ, জোচ্চোর, বাটপাড়।

কেন বলো তো ? কী করেছে জুয়েল ?

ও একটা প্লেবয়। একসাথে অনেক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। তাদের টাকায় ঘোরে ফেরে, খায়, লাফাঙ্গার মতো পয়সা খরচা করে।  

ওহ, তাই নাকি! তা তোমরা মেয়েরা তাকে সেই সুযোগ দাও কেন বলো তো! ঘরের দরজা খোলা রেখে ঘুমোলে চোর তো ভিতরে ঢুকবেই! চাই কি, দলিল-দস্তাবেজ টাকা-পয়সা সব তুলে নিয়ে চম্পট দেবে।

অলোকের কথা শুনে মনক্ষুণ্ন হয় তিন্নি। কারণ কথাটা মোটেও তার মনমতো হয়নি। বলল, আপনি স্যার ওর পক্ষ নিয়ে কথা বলছেন! আপনি জানেন ওর সঙ্গে নিশাত ম্যাডামেরও সম্পর্ক ছিল! একসঙ্গে ওরা রাত কাটিয়েছে, আমার কাছে ধরাও খেয়েছে। 

সত্যি নাকি ? জুয়েলের দিকে জুলুজুলু চোখে তাকান ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়। সেখানে যুগপৎ কৌতুক ও কৌতূহল খেলা করে। উর্বী বসে বসে নাটক দেখে। চোখ পিটপিট করে ইমরুল।

কেসটা জুয়েল অস্বীকার করতে গিয়েও খুব একটা সুবিধা করতে পারলো না। কারণ দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় অলোকেশ কাঁচা মিথ্যুকের মিথ্যাটা খুব সহজেই ধরতে পারেন।

বললেন, অস্বীকার করে লাভ নেই জুয়েল। নিশাতকে তুমি কেন মেরেছ তাই বলো ? ছেলে তুমি বেশ চালাক আমি বুঝতে পারছি। নইলে কারও বগলে সুঁচ ফুটিয়ে মেরে তারপর কেউ আবার ঘরে আগুন দেয়! তুমি একটা দুর্ঘটনার নাটক সাজিয়েছিলে। সরি টু সে, তাতে তুমি সফল হওনি। কেসটা আমি ধরে ফেলেছি।

হঠাৎ একটা কাজ করে বসলো জুয়েল। ওদের সবাইকে চমকে দিয়ে সে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল তিন্নি আর ডা. নিশাতের কথিত প্রেমিক জুয়েল ভুঁইয়া।   

কান্নাজড়ানো গলায় বলল, স্যার আমি মানছি নিশাতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল, সে আমার কলিগ, কিন্তু আমি তাকে মারিনি স্যার। সত্যি মারিনি। কেন মারব বলেন! নিশাত আমাকে কত সাপোর্ট করত! হাতখরচের টাকা দিত, ভালোও বাসতো।

ওর কথা শুনে তেলেবেগুনে জ¦লে উঠল তিন্নি। হাতের কাছে দারোয়ান জলিলের পিঠ চুলকানো প্লাস্টিকের লাঠি ছিল একটা। তাই নিয়ে তেড়ে গেলো তিন্নি।

‘তুই শালা এত্ত বড় হারামজাদা! গাছের খাবি আবার তলারও কুড়াবি! মায়ের বয়সি এক মহিলার সঙ্গে শুচ্ছিস, আবার আমার সাথে―!’ তিন্নিও অমনি কান্না জুড়ে দিল। এমন নাটক মিনিট কয়েক চলল। তিন্নি ওড়নায় নাক মুছে শেষে বলল, স্যার, জুয়েলকে একদম বিশ^াস করবেন না। ও একটা নিমচা শয়তান। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে ও মেয়েদের ভুলায়, তারপর তাদের টাকাকড়ি সব চুষে-চিবিয়ে খায়। মেয়েদের দেহ-মন দুটোই জিম্মি করে রাখে।

ছেলেটাকে খুব নজর করে দেখলেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়। বয়স খুব বেশি হলে তেইশ কি চব্বিশ। সিঁড়িঙ্গেমতোন, তবে সে দেখতে শুনতে মন্দ নয়। রমণীমোহন যাকে বলে। এই ছেলের এত্ত এলেম! সত্যি বলতে কি, মেয়েরা এসব ছেলের তৈলাক্ত কথায় ভুলে গিয়ে টুপটাপ প্রেমে পড়ে, যেন শীতের সকালে গাছের পাতায় শিশির ঝরছে।

কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখেন অলোকেশ। তার একটু তাড়া আছে, তাই জুয়েলকে নিয়ে মিছে সময় নষ্ট না করে ইন্সপেক্টর নোমানকে ফোন করলেন। বললেন, জলদি গাড়ি পাঠান, এই কেসের অন্যতম সাসপেক্ট জুয়েলকে তুলে নিন। কাজে লাগবে। সে ‘সাচ্চা জুয়েল’ একটা! 

নন্দ দুলাল, ভাই আমার, যতক্ষণ না গাড়ি আসে তুমি এই রোমিওটাকে শক্ত করে ধরে রেখো। দেখো, ও যেন পালিয়ে না যায়। হেসে বললেন অলোকেশ।

যাবে না স্যার, আমি আছি না! খসখসে গলায় বলল উঠতি মডেল তিন্নি। পালাতে গেলে ইটা মেরে আমি ওর ঠ্যাঙ খোঁড়া করে দেবো। থোঁতা মুখ ভোঁতা করে দেব। শালা ঘুঘু দেখেছে, কিন্তু ফাঁদ দেখেনি! প্রেম খেয়েছে কিন্তু ইট খায়নি!

ওদের দুজনের কথাবার্তা শুনে ও কাণ্ডকীর্তি দেখে উর্র্বীহেসেই বাঁচে না। হায় প্রেম! আজকাল বুঝি এসবই হচ্ছে! টুপটাপ প্রেমে পড়ো, মোমের মতোন গলে যাও, তারপর ইয়ে মানে ‘ওটুকু’ মিটে গেলে একে অপরকে ইট মারো। ‘ভাবি’ হাবিকে হারামজাদা বলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দাও।

আট. 

নিজের ডেরায় বসে কফি খাচ্ছেন ডিটেকটিভ অলোকেশ। কফি যে শুধু তার মেজাজ ঠিক রাখে তাই নয়, আট আউন্স কফিতে আমেজও আসে, দেহ-মন বেশ চাঙা ও ফুরফুরে হয়। তবে সবার জন্য কফি নয়, স্মার্ট লোকেরা কফিটাকে উপভোগ করতে পারে। কারণ ‘স্যুটেবিলিটি’ বলে একটা কথা আছে। এই দুনিয়ায় সবার জন্য সবকিছু নয়। কিছু জিনিস মানিয়ে গুছিয়ে নিতে জানতে হয়, নইলে বিপত্তি বাঁধে। কফিতে পোড়ে ঠোঁট, হৃদয়ে লাগে চোট। নিমিষেই সব মিসম্যাচ হয়ে যায়! 

কিছুক্ষণ বাদে ডোরবেল বাজল। বড্ড কর্ণ-সুখকর বাজনা। 

দেখ তো বেচুদা, কে এলো আবার ? হাঁকলেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়।

ছুটে যায় বেচুরাম। এই লোকটার প্রশংসা যতই করি, কম করা হবে। তাকে দেবী দুর্গার পুরুষ-সংস্করণ বলা যেতে পারে। একা হাতে সে সবদিক সামাল দেয়। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠ, কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে ঘরদোর সাফ, সবকিছুÑসবকিছু একাই করে বেচুরাম। 

তাকে চমকে দিয়ে যে লোকটা সহসা সামনে উদয় হন তিনি আর কেউ নন, ডক্টর সোহেল মাহমুদ। বিশিষ্ট ফরেনসিক স্পেশালিস্ট।

আপনি! হঠাৎ গরিবের দোরে পা রাখলেন! আই কান্ট বিলিভ মাই আইজ, ডক্টর! বিস্ময়াপন্ন চোখ মেলে তাকান অলোকেশ। 

না মানে এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ মনে হলো আপনার নতুন ঠিকানাটা একটু চিনে রাখি, দেখে যাই। বিশিষ্ট গোয়েন্দা আপনি, কখন কোন কেসে দরকার লাগে কে বলতে পারে! তৈলাক্ত হেসে বললেন ডক্টর সোহেল। 

বাহ! বেশ করেছেন, এসেছেন। আমি তো জাস্ট বিশ^াস করতে পারছি না। ইউ আর টু বিজি অ্যা ম্যান!

বেচুরাম মানুষ চেনে। ডিটেকটিভ অলোকেশের সঙ্গে কার কেমন সম্বন্ধ তাও সে বুঝতে পারে। কার জন্য কেমন নাশতার আয়োজন হবে সেটা তার অজানা নয়। অর্থাৎ ওজন বুঝে চলতে জানে অলোকেশের বেচুরাম।

ডক্টর সোহেলকে পেয়ে ডা. নিশাতের ঘর থেকে উদ্ধার হওয়া সেই জিনিসটা বের করলেন অলোকেশ। দেখুন তো, এটা চিনতে পারেন কিনা ?

আঙুরের থোকার মতোন তার নাকের ডগায় জিনিসটা দোলাতে থাকেন অলোকেশ। অঙ্গুস্তানা!

মানে! সেটা আবার কী ? বিস্ময়বোধ করেন ডক্টর সোহেল। এমন শব্দ তিনি জীবনে শোনেননি। তাতে আবার বিশেষ ভাব নেন অলোকেশ।

বললেন, আমি ইংরেজি সাহিত্যে পড়েছি বটে, কিন্তু মায়ের ভাষায় আমার দখল কিছু কম নেই ভায়া। আমি বাংলাতেও সিদ্ধিলাভ করেছি। বাংলা অভিধান বলতে গেলে আমার মুখস্থ। 

জানি জানি, আপনি একজন পণ্ডিত ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তি। এবার বলুন তো এটা কী ? পুড়ে গেছে দেখছি!

আগুনের ধর্মই পোড়ানো, আর জলে নামলে ভিজবেন, তাতে আর আশ্চর্য কী! আপনার পরামর্শে আমি দ্বিতীয়বার খুনের স্পটে গিয়ে এই জিনিস কুড়িয়ে পেয়েছি। ইংরেজিতে বলে থিম্বল, আর বাংলায় অঙ্গুস্তানা―গ্লাভসের বাংলা যেমন দস্তানা। বুঝিয়ে বললেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়। 

ও আই সি! ‘থিম্বল’ শব্দটি অবশ্য আমার নলেজে আছে। কিন্তু অকপটে স্বীকার করছি, ‘অঙ্গুস্তানা’ আমি আমার বাপের জন্মেও শুনিনি।

ওকে ডক্টর, আই আন্ডারস্ট্যান্ড। এবার বলুন তো, এই বস্তুর ব্যবহারবিধি সম্পর্কে জানেন কিছু ? আই মিন অঙ্গুস্তানা!

জানি তো। ওই যে, লেপকাঁথা যারা সেলাই করে সুঁচের খোঁচা থেকে আঙ্গুল বাঁচাতে তারা এই জিনিস ব্যবহার করে থাকবে। ইটস মোর লজিক্যাল, নয় কি!

ইয়েস! বাটÑ! অমনি ব্রেক কষলেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়। এটা তার একটা চরম বদভ্যাস বলতে পারেন। যখন তখন আচমকা থেমে যাওয়া, বা বিনা নোটিশে বক্তব্য থামিয়ে দেয়া।     

বেচুরাম ট্রেতে করে নাশতা নিয়ে এল। তাতে ফলমূল, বেকারি বিস্কুট, লোÑফ্যাট মিল্কসহ নানান কিছু আছে। ডক্টর সোহেল এই বাসার বিশেষ গেস্ট, বেচুরাম বুঝতে পেরেছে। এই লোকটির হেল্প না পেলে অনেক কেসেই হয়তো হাঁটুভাঙা ‘দ’ হয়ে বসে থাকতেন ডিটেকটিভ অলোকেশ। তাই তার এমন স্পেশাল সমাদর।

বাটÑকী, বলুন না ডিটেকটিভ! আমি জানতে চাই। তাড়া দেন ডক্টর সোহেল।

উত্তর না দিয়ে অলোকেশ উল্টো প্রশ্ন করলেন, এখন সময়টা কী বলুন তো ডক্টর ?

কেন, জুনের শেষ। সোহেলের ঝটপট জবাব।

তাতে হতাশার ভঙ্গি করলেন অলোক। নাহ, হল না। কিছুই তো মিলছে না।

কী মিলছে না ডিটেকটিভ ?   

না-মানে এখন তো গরমকাল। এসময় কি কেউ অর্ডার দিয়ে লেপকাঁথা বানায়, বলুন! ওটা তো শীতের অনুষঙ্গ। 

এবার একটু সময় নেন সোহেল মাহমুদ। তারপর সোৎসাহে বললেন, ওহ, আপনি ক্রাইম সিনে পাওয়া ‘থিম্বলের’ সাথে কিছু একটা সম্বন্ধ খুঁজছেন!

ঠিক তাই। ভিকটিম নিশাত একজন ডাক্তার। আরও স্পেসিফিক্যালি বললে তিনি গাইনোকোলজিস্ট। অঙ্গুস্তানার তার কী দরকার পড়লো বলুন তো ? দরকার আছে কি ?

নাহ, তার কোনও দরকার নেই। সোহেল নিশ্চিত করে বললেন। 

তাহলে! ওটা নিশ্চয়ই খুনির সম্পত্তি হতে পারে। নয় কি ? জ¦লজ¦লে চোখে ডক্টর সোহেলের দিকে তাকালেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়। 

কফিতে বড়সড় একটা চুমুক দিয়ে অলোক আবারও বললেন, আপনি কি দয়া করে বলবেন ডক্টর, লেপকাঁথা প্রস্তুতকারী ছাড়া আর কে-কে এই জিনিস ব্যবহার করে! অঙ্গুস্তানা ?

ছুতোর-মিস্ত্রি!

বোধ হয় না। দুদিকে মাথা নাড়লেন অলোকেশ। ও হ্যাঁ, আপনি অবশ্য খুনের হাতিয়ার হিসেবে কাঠ ছেঁদা করা ভোমরের কথা বলেছিলেন। ওটা আমার মাথায় আছে অবশ্য। মগজের স্থায়ী মেমরিতে যত্ন করে রেখে দিয়েছি।

অঙ্গুস্তানার ব্যবহার নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ভাবলেন ডক্টর। কিন্তু যুতসই কিছু খুঁজে পেলেন না। কফির সাথে সাথে মগজ ঘামান অলোকেশ। কাঠের চেয়ারে সোজা হয়ে বসে বাঁ হাতে জুলপি মোচড়ানÑ যা কিনা তার গভীর মনঃসমীক্ষণের লক্ষণ। 

আবারও দরজায় কলিং বেল বাজল। দেখো তো বেচুদা, কে এল ? নতুন মক্কেল নাকি!

মক্কেল নয়, উর্বী এসেছে। আসলে ব্যাপার কি জানেন, কোনও কেস পেন্ডিং থাকলে উর্বী বা ইমরুল―এদের কারও ঘুম হয় না। কেসের সুতোনাতা সারাক্ষণ তাদের গুঁতোয়।

উর্বীর সম্মানে আরও একপ্রস্থ স্ন্যাকস এলো। সঙ্গে কফি, টফি এবং ‘চাফি’। ফরেনসিক ডক্টর সোহেল মাহমুদ উর্বীর অচেনা নয়, বরং বেশ ভাল সখ্য রয়েছে তাদের।

দুটো জিনিস নিয়ে সমানে মাথা ঘামাচ্ছেন অলোকেশ। কাঠ ছেঁদা করা ভোমর, আর আঙুল বাঁচানো অঙ্গুস্তানা।

সেই একই প্রশ্ন উর্বীকেও করলেন অলোক। বলো তো উর্বী, লেপকাঁথা প্রস্তুতকারক ছাড়া আর কে থিম্বল মানে অঙ্গুস্তানা ব্যবহার করে? ভালো করে ভেবে তারপর বলো। নো হারি অ্যাট অল।

চা মিশ্রিত কফি ‘চাফি’ খেতে খেতে ভয়ানক ভাবছে উর্বী, কিন্তু আদতে সে কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না। অনেকক্ষণ ভাবাভাবির পর স্রেফ মূষিক প্রসব করলো উর্বী। বলল, জানি না!

দুনিয়ার সবচে সহজ কথা ‘আমি জানি না’! ফোড়ন দেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়। তার মানে গোয়েন্দার আজ মুড খারাপ। এত চেষ্টা করেও সামান্য ক্লু বোঝা গেল না! তিনি ভেবে পান না, ভিকটিম ডা. নিশাতের ঘরে এই ‘অঙ্গুস্তানা’ গেল কী করে! তবে তিনি নিশ্চিত, ওটা খুনির সঙ্গেই ছিল। অঙ্গুস্তানার রহস্য উদ্ধার করা গেলে কেসটাও খোলসা হবে।

বেচুরামের আপ্যায়নে ও আন্তরিকতায় ডক্টর সোহেল খুব খুশি। বললেন, ‘আমার এমন একজন মানুষ চাই―যে কি না জুতো সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠ―!’

এই অবধি সোহেল মাত্র বলেছেন, পুরো কথা শেষ করতে পারেননি, অমনি হাÑহা করে করে উঠলেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়। ইয়েস, আই গট ইট! এইমাত্র আপনি কী বললেন ডক্টর ?

কী আবার! জুতো সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠ! আবারও বললেন ডক্টর সোহেল।

উঁহু! জুতো সেলাই অবধি থাকুন। দয়া করে আর সামনে এগোবেন না ডক্টর।

চেয়ার ছেড়ে অমনি সটান উঠে দাঁড়ান ডিটেকটিভ অলোকেশ। প্রায় ধেই ধেই করে নাচতে শুরু করেন তিনি! ইয়েস, জুতো সেলাই!

মানে! উর্বী আর সোহেলের দুজোড়া চোখ ডিটেকটিভ অলোকেশের চোখের উপর নিবদ্ধ হয়। তারা বুঝতে পারে না, কীসে অলোক এত খুশি হলেন! তার এই হঠাৎ উত্তেজনার কারণটা আসলে কী! 

ওদের সকল ঔৎসুক্য মিটিয়ে দিয়ে অলোকেশ বললেন, লোকটা সম্ভবত চামার! আই মিন মুচি, বা কবলার।

কোন লোক ? কে চামার ? জোড়া প্রশ্ন উর্বীর।

দুম করে বললেন অলোকেশ―ডা. নিশাতের খুনি! মুচির আঙুলে অঙ্গুস্তানা বা থিম্বল থাকে। আমি নিজের চোখে দেখেছি উর্বী।

কিন্তু মোটিভ ? মোটিভ কী তার ? উর্বী রিফ্লেক্সের মতো বলে ফেললো।

তাতে বিরক্ত হন ডিটেকটিভ অলোকেশ। কষা গলায় বললেন, মোটিভ পরে দেখছি। একে একে সামনে এগোতে হবে। স্টেপ বাই স্টেপ, উর্বী। গোয়েন্দাগিরিতে উল্লম্ফন চলে না, বুঝলে। দ্য ডিটেকটিভ ইজ নট অ্যা ফ্রগ। রাদার হি’জ অ্যা রেপটাইল। যুক্তির আলোয় বুকে হেঁটে চলে।    

নয়.

ওদিকে ইন্সপেক্টর শিবলি নোমান আরেক কাণ্ড বাঁধিয়ে বসে আছেন। এরই মধ্যে তিনি দু-দুটো খুনি ধরে ফেলেছেন। তার মানে ‘দ্য কেস ইজ ওভার’।     

কী করে শুনি! হাউ কাম ?

ইন্সপেক্টর নোমানের সঙ্গে ফোনে কথা হচ্ছিল। তিনি জানালেন যে, তিন্নির প্রেমিক জুয়েল খুনের দায় অলরেডি স্বীকার করেছে। সে-ই নাকি সেদিন ভোররাতে ডা. নিশাতকে খুন করেছে। ইটস অ্যা কোল্ড-হেডেড মার্ডার। 

বুঝলাম। কিন্তু তার মোটিভ কী ? খুনের কারণ বা হাতিয়ার ?

প্রেমঘটিত ব্যাপার ভায়া। প্রেমটাই যত নষ্টের গোড়া, বুঝলেন ডিটেকটিভ। প্রেম বলে আসলে কিছু নেই, পুরোটাই স্রেফ লেনদেন বা ই-কমার্স, অর্থাৎ ‘গিভ-এন্ড-টেক ওনলি’। চোক চোক করে হেসে বললেন ইন্সপেক্টর নোমান। 

হুঁ। কী দিয়ে মারল শুনি ? আই মিন উয়েপন ? বিরক্তি চেপে রেখে অলোকেশ বললেন।

নো উয়েপন, জাস্ট গলা টিপে মেরেছে। নোমান বললেন। তাছাড়া জুয়েল নিজের মুখে সবকথা স্বীকার করেছে। আর মোটিভ ? সেই লেনদেন। কথা ছিল প্রতি মাসে ডা. নিশাত জুয়েলকে কুড়ি হাজার করে দেবে। অর্থাৎ সে ছিল নিশাতের ‘মেল কেপ্ট’। পরে কোনও কারণে তার উপর থেকে নিশাতের মন উঠে গিয়ে থাকবে, তাই সে মাসোহারা বা রসদ বন্ধ করে দেয়। আর তাতেই ক্ষেপে যায় জুয়েল। রেগেমেগে নিশাতকে সে খুন করে ফেলেছে।

গল্পটা দারুণ, কিন্তু সত্যি নয়। অলোকেশ ভাবছেন। কথা আদায়ের জন্য কত ডিগ্রি দিয়েছে কে জানে!  

তিনি মুখে অবশ্য বললেন, বাট ইন্সপেক্টর, লাশের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে ভিকটিমের গলা টেপা হয়নি, তার মৃত্যুর কারণ ফুসফুসে ফুটো, অর্থাৎ সুঁচ ফুটিয়ে খুনটা করেছে।

ওসব রিপোর্টের কথা বাদ দিন। খুনি নিজের মুখে যা বলছে সেটাই সত্যি!

উহুঁ, মোটেও তা নয়। ডিসেন্ট দেন ডিটেকটিভ অলোকেশ। এই কেস তো ধোপে টিকবে না ইন্সপেক্টর। কেস কোর্টে উঠলে জুয়েল উল্টো সুরে গাইবে, তখন কিন্তু আপনি বিপদে পড়ে যাবেন। জানেন তো, কোর্ট শুধু প্রমাণে বিশ^াসী, গল্পে নয়। তাছাড়া―!

তাছাড়া কী, ডিটেকটিভ ? কেমন যেন ধন্দে পড়েন ইন্সপেক্টর নোমান।

আপনি বলছিলেন আরও একজন খুনি খুঁজে পেয়েছেন! কে সে ? আর তাতে আপনার তদন্ত প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেল না ? একসাথে দু-দুজন খুনি কী করে হয়! তার মোটিভ কী ? তবে কি কাজটা তারা ভাগাভাগি করে করেছে! 

জবাবে মিন মিন করে নোমান সাহেব বললেন, না মানে, নিশাতের প্রথম স্বামী মোলাকাত হোসেনও খুনটা করতে পারে। তারও কিন্তু বেশ স্ট্রং মোটিভ ছিল। লোকটা তার প্রথম স্বামী, ব্যক্তিগত ছবি ভাইরাল করবার ভয় দেখিয়ে নিশাতকে সে সমানে দুইছিল। তাই নিশাত যখন টাকা দিতে অস্বীকার করে, তখন হয়তো সেই মোলাকাত―! 

তাই বুঝি! সেক্ষেত্রে আপনি তার দ্বিতীয় স্বামী নজিরকেই বা বাদ দিচ্ছেন কেন ? তারও তো মোটিভ আছে। নিশাত তার পৌরুষ নিয়ে উপহাস করেছে। তাকে নপুংসক বলেছে। এটাই কি যথেষ্ট মোটিভ নয়? নোমান সাহেবকে যুক্তির মারপ্যাঁচে উসকে দেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়।

তা বটে! তা বটে। ফোনের ওপারে মাথা নাড়লেন নোমান সাহেব। এবং বললেন, তাছাড়া তাদের দুজনের সঙ্গেই ঘটনার আগে ডা. নিশাতের ফোনালাপ হয়েছিল। ডা. নিশাতের ফোনের কলÑহিস্ট্রি তাই বলছে। 

বলেন কি! সত্যি? ফোনালাপের স্থায়িত্ব কেমন ?

জি―ডিটেকটিভ, কথা হয়েছে। আমি কেন মিছে বলতে যাবো! আমি তো আর সাসপেক্ট নই! হেসে বললেন ইন্সপেক্টর। সঙ্গে তিনি যোগ করলেন,  তাদের মাঝে বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে তবে স্থায়িত্ব খুব বেশি নয়, এই ধরুন আধা সেকেন্ড বা একটু বেশি। ওটা অবশ্য ধর্তব্যের নয়।

কী কথা হতে পারে বলে আপনার অনুমান ? ফের জানতে চান অলোকেশ। লোকটাকে খুঁচিয়ে বেশ আনন্দ পাচ্ছেন তিনি।

নো আইডিয়া, ডিটেকটিভ। মেবি, জাস্ট থ্রেট কল। তবে আপনার সঙ্গে কথা বলে এখন মনে হচ্ছে এদের কেউই আসলে খুনটা করেনি। তারা জাস্ট নিশাতের কাছ থেকে সুবিধা নিয়েছে। তবে খুন করবার মতো সাহস হয়তো কারও ছিল না। পৌরুষ তো কিছু নেই, দুটোই স্রেফ অপোগণ্ড!

অলোকেশ এ বিষয়ে আর কিছু না বলে উল্টো নিজের যুক্তি পেশ করলেন। তাতেই ইন্সপেক্টর নোমান বেশ বিপাকে পড়ে যান। খুন বিষয়ে তার বিশ^াসেও বেশ চিড় ধরলো।    

সত্যি বলতে, অলোকের সঙ্গে কথা বলে ইন্সপেক্টর নোমান প্রথমে ‘কনফিউজড’ পরে ‘ফিউজ’ হয়ে গেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, খুনের মোটিভ এবং উয়েপন বিবেচনায় তার তদন্ত সঠিক হয়নি। জুয়েল সম্ভবত খুনি নয়। কংক্রিটের মিক্সচারে পানি মিশে গেছে। তাহলে উপায় ? 

উপায় আছে ইন্সপেক্টর। অভয় দিলেন ডিটেকটিভ অলোকেশ। আমার কাছে ক্লু আছে, জবরদস্ত ক্লু। আপনি বরং এক কাজ করুন। জলদি অকুস্থলে চলে আসুন। অর্থাৎ ডা. নিশাতের বাসায়। 

ইন্সপেক্টর আর কথা বাড়ালেন না। তিনি পত্রপাঠ সায় দেন। এবং বললেন যে, তিনি এক্ষুনি আসছেন। ‘শুভস্য শীঘ্রম’!

কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডের কাছে ডলফিন গলি―ডা. নিশাতের বাসা। অর্থাৎ খুনের স্পট বা ক্রাইম সিন।  

জলিল কিন্তু আজ জায়গামতোই ছিল। টুলে বসে জাস্ট ঢুলছিল, তবে সে স্থান ত্যাগ করেনি। টয়লেটেও যায়নি। জলিলের হাতে বিলাইয়ের লেজের মতোন ছোট্ট একখান লাঠি, তার ক্ষমতা ও দায়িত্বের প্রতীক। 

উর্বীর পিঙ্ক-রঙ মোপেডে চেপে আসতে আসতে মিটিমিটি হাসছিলেন অলোকেশ। শব্দ না করলেও সেটা কিন্তু ঠিক বুঝতে পেরেছে উর্বী। দুজনের মাঝে কী মিল দেখুন! একে অপরের মন পড়তে পারছে। এই না হলে বোঝাপড়া!

তুমি বেশ খুশ-মেজাজে আছো মনে হয়! কেসটা কী ? মোপেডের ড্রাইভিং সিটে বসে বলল উর্বী। ইমরুলও স্পটে যাচ্ছে, তবে তার নিজের মতোন করে।

ঠিক ধরেছ উর্বী। অলোকেশ বললেন। আই’ম রিয়েলি হ্যাপি নাউ।

কিন্তু কেন ? হোয়াট হ্যাপেন্ড নিউ ?  

একটু পরেই জানতে পারবে উর্বী। চলো, আগে স্পটে যাই। কেসটা আমি ধরতে পেরেছি বলে আমার অনুমান। 

সত্যি! কীভাবে ?

জাস্ট অ্যা স্মল ক্লু। তবে সবার আগে ডক্টর সোহেলকে ধন্যবাদ দিতে হয়। এবারেও সে আমাকে মরতে মরতে বাঁচিয়ে দিয়েছে। হি ইজ জাস্ট অসাম, উর্বী। লোকটা ডিটেকটিভ হলে ভালো করত।  

ইশ! প্লিজ আমাকে বলো অলোক। আমি জানতে চাই ফরেনসিক ডক্টর তোমাকে কীভাবে বাঁচালো ? হাউ’জ দ্যাট ?  

নাহ, পুরোটা এখন বলবো না। তাহলে আর মজা থাকবে না। তাছাড়া আরও কয়েকটা বিষয় যাচাই করে নিতে চাই। তারপর হবে এই কেসের ‘গ্র্যান্ড ফিনালে’!  

ওক্কে বস। তাহলে আমাকে একটা আইডিয়া দাও, দেখি আমি কিছু আন্দাজ করতে পারি কিনা। প্রায় অনুনয়ের সুরে বলল উর্বী। তার যেন আর তর সইছে না। উর্বী জানতে চায় ডা. নিশাতের খুনি কে এবং তার মোটিভ কী ছিল! এমন বাজে কেস সে আগে আর কখনও দেখেনি।

তাতে হেসে ফেললেন ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়। বললেন, ওকে, ক্লু দিচ্ছি। তবে খুব সাবধান, মোপেড চালাতে চালাতে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না উর্বী। লেটস রিচ দ্য প্লেস ফার্স্ট, এন্ড দেন থিংক ওভার দ্য ম্যাটার! 

ঠিক আছে। এবার আইডিয়াটা দাও দেখি।

‘ডা. নিশাতের মেজাজ ও গালাগাল। আর কিছু জানতে চেও না উর্বী। ইটস এনাফ ফর নাউ!’ এটুকু বলেই অলোকেশ অমনি মুখে কুলুপ আঁটলেন। শত চাপাচাপিতেও আর কিছু বললেন না।    

দশ. 

কলাবাগান থানার ইন্সপেক্টর এবং ওসি (তদন্ত) শিবলি নোমান আগেই স্পটে হাজির। সঙ্গে সেই নন্দদুলালও এসেছে। লোকটা বেশ আমুদে এবং ফানি দেখতে। এমন ছোট করে নাকের নিচে গোঁফটুকু রেখেছে যে, দেখে মনে হয় সেখানে যেন একটা কালো রঙের পোকা বসে আছে। নাকি কালো ভ্রমর!  

দুজনে বৈকালিক শুভেচ্ছা বিনিময়ের পরে অলোকেশ বললেন, ঘরের সিলগালা খুলুন। চলুন, ভিতরে গিয়ে বসি। বসে কথা বলি। 

চলুন তবে যাই। সায় দেন ইন্সপেক্টর নোমান। তারা সদলবলে ক্রাইম সিনে গিয়ে ঢুকলেন। সময়টা মৌসুমী বিকেল, নন্দ দুলাল নিজ উদ্যোগে ঘরের জানালা খুলে দেয়। আসুক, একটু আলো-বাতাস আসুক। ঘরটা কেমন গুমোট হয়ে আছে। আমাদের অনেকের জীবনে টাকাকড়ি, পোস্টপজিশন, ক্ষমতার দম্ভ অনেক কিছুই থাকে, শুধু এই আলোটুকুই নেই। ফলে কী হয়, জীবনে সবকিছু থেকেও যেন সুখ থাকে না। বড্ড অর্থহীন হয়ে পড়ে এই জীবন।  

এবার বলুন ডিটেকটিভ, কেসটা আদতে কী ? খুব আন্তরিকতার সুরে জানতে চাইলেন ইন্সপেক্টর।

অলোকও সহজভাবে জবাব দিলেন―কালোভ্রমর আর অঙ্গুস্তানা।   

কী বললেন ডিটেকটিভ ? অঙ্গুস্তানা ? কী জিনিস ওটা ?

এবার উর্বী তাকে সবিস্তারে বোঝালেন অঙ্গুস্তানা কী―এবং তা কী কাজে লাগে। ইংরেজিতে বলে ‘থিম্বল’। প্রায় সমোচ্চারিত শব্দ হল গিয়ে নিম্বল, মানে ক্ষিপ্র বা চটপটে। আর ভ্রমর মানে হল গিয়ে ভোমর। কাঠ ছেঁদো করার একরকম যন্ত্র। তবে ওটা হুকও হতে পারে। হুক হলেই বরং জমে ভালো। কারণ হুক দিয়ে শক্ত কিছু সেলাই করা হয়, আর সুঁচের খোঁচা থেকে আঙুল বাঁচাতে থিম্বল বা অঙ্গুস্তানা কাজে লাগে।

কেসটা এবার অনেকটাই ক্লিয়ার, বুঝলেন ইন্সপেক্টর নোমান! 

তাতে বাবুদের মতো মাথা নাড়েন নোমান সাহেব। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন না, এসবের সঙ্গে এই খুনের কেসের কী সম্পর্ক! ডা. নিশাতের খুনি থিম্বল পরে খুন করতে যাবে কেন! এখানে খোঁচাখুঁচির তো কোনও কাহিনি নেই!

‘আছে ইন্সপেক্টর, আছে। বলছি শুনুন―!’ ডিটেকটিভ অলোকেশ এবার জাল গুটাতে শুরু করেন। মিছে আর কত লম্বা করবেন গল্প। তার অনুমান ভুল না হলে খুনিকেও তিনি এরই মধ্যে চাক্ষুস করেছেন। তার পেছনে চর বসিয়েছেন, যাতে সে টের পেয়ে পালাতে না পারে।

বলুন, আমি শুনছি। ক্ষুণ্ন মনে বললেন ইন্সপেক্টর নোমান।

কী এটা দেখতে পাচ্ছেন ? এই সেই মহামূল্যবান ক্লু বা আলামত―অঙ্গুস্তানা। এটা আমি কোথায় পেয়েছি জানেন ? এই যে―এখানে। ডা. নিশাতের ঘরে খাটের তলায় এই জুতোর বাক্সের নিচে।

সে কি! সত্যি? আমি তো দেখিনি!

ইয়েস, মিস্টার নোমান। আমিও প্রথমে বুঝতে পারিনি। কিন্তু ফরেনসিক ডক্টর সোহেল যখন বললেন যে, নিশাতের খুনে ব্যবহৃত অস্ত্রটি ভোমর বা হুক জাতীয় কিছু হতে পারে, অমনি আমার চোখ খুলে গেল। দিব্যচোখে আমি যেন সবকিছুই পরিষ্কার দেখতে পেলাম।

কী দেখলেন শুনি ? ব্যঙ্গাত্মক হাসলেন ইন্সপেক্টর।

তার আগে বলি আমি কীভাবে কেসটা অনুমান করলাম। আপনি শার্লক হোমস পড়েছেন নিশ্চয়ই! তিনি একটা দারুণ কথা বলেছেন। তাঁর মতে, যে যা খায়, সে তারই ঢেঁকুর তোলে। অর্থাৎ সিরিয়াল কিলার না হলে মানুষ সচরাচর তার রুচি-পছন্দ বা পেশার সঙ্গে জড়িত কিছু দিয়ে খুনখারাবি বা অপরাধ করে থাকে। বেলজিয়ান ডিটেকটিভ এরকুল পোয়ারোর ভাষ্য―যে ডিমের কারবারি, বাড়িতে মেহমান এলে সে ডিমের তরকারি দিয়েই তাকে আপ্যায়ন করবে। তাই অপরাধী ধরতে গেলে তার অবস্থানে নিজেকে বসাও, তার রুচি-পছন্দ অনুযায়ী ভাবো। তাহলে তাকে খুঁজে পাবে, যেমনটি করতেন মার্কিন লেখক এডগার অ্যালান পো’র গোয়েন্দা অগস্ত দুঁপ্যা।

তো! তাতে কী হল ? অবুঝের মতো প্রশ্ন করলেন ইন্সপেক্টর নোমান।  

আহা, বুঝলেন না! ডক্টর সোহেল যখন বললেন অস্ত্রটা ভোমর বা সেলাইপাতির হুক হওয়া অসম্ভব নয়, অমনি আমি এসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত যেসকল পেশা রয়েছে তার তালিকা বানিয়ে ফেললাম। তাতে কয়েকটা বিষয় সামনে এলো। এই যেমন―কাঠমিস্ত্রি, লেপতোষক প্রস্তুতকারী বা ধুনকার, পুরোনো বইয়ের বাঁধাইকারী, মুচি এবং দর্জি। অনেকগুলো অপশন্স―বুঝতেই পারছেন, পরের কাজটা অর্থাৎ বাছাই করাটা আমার জন্য তত সহজ ছিল না।

তাহলে ? কীভাবে এগোলেন ? এবার কিন্তু ইন্সপেক্টরকে বেশ আগ্রহী ও আন্তরিক মনে হল। তার কণ্ঠে আর ব্যঙ্গাভাস নেই, বরং উচ্ছ্বাস রয়েছে।   

এখন গরম কাল, তাই লেপতোষকের ভাবনাটা শুরুতেই বাদ দিলাম। কাঠমিস্ত্রিও কাট, ডা. নিশাতের সঙ্গে ছুতোর-মিস্ত্রির তেমন কোনও যোগাযোগ থাকার কথা নয়। কারণ সে ভাড়াবাসায় থাকে, সেখানে কাঠের কারবার নেই। তারপরও কয়েকটা অপশন্স রয়ে গেল। 

তখন ? উর্বী আর ইন্সপেক্টর একযোগে প্রশ্নটা করলেন।

তারপর পেলাম একটা বড়সড় ব্রেক-থ্রু। দারুণ এক চমক বলতে পারেন। সে আমার সৌভাগ্য বটে। গোয়েন্দা হলেও আমি কিছুটা ভাগ্যে বিশ^াস করি। ইনটুইশনও একটা ব্যাপার। মন থেকে কিছু ভাবনা নিজের অজান্তেই উঠে আসে। আচমকা। এই যেমন শুরু থেকেই আমার মনে হয়েছে শক্ত মোটিভ থাকলেও ডা. নিশাতের কেসে তার কোনও স্বামীই জড়িত নয়। কারণ নিশাত মারা গেলে তাদের মোটের উপর কিছু লাভ নেই, বরং বেঁচে থাকলেই বেজায় সুবিধা।

বেশ। বুঝলাম। তারপর ? আপনার সেই ব্রেকÑথ্রুটা কী জানতে পারি, মিস্টার ডিটেকটিভ ? তাড়া দেন ইন্সপেক্টর নোমান। তিনি উসখুস করছেন। হয়ত তিনি ভাবছেন গানের চেয়ে দেখি ধুয়ো বড় বেশি। কাঁকুড়ের চেয়ে যেমন বিচি বড়।

এই যে, অঙ্গুস্তানা। আবারও ওটা বের করে দেখান অলোকেশ। বললেন, ভিকটিমের ঘরে তার খাটের নিচ থেকে এই জিনিস পাবার পর আমার ভাবনায় নতুন করে শিখা জ¦লে ওঠে। আমি পুনরায় ভাবতে শুরু করি। এবার আমার সেই তালিকা থেকে বই বাঁধাইকারী বাদ যায়, কাঠমিস্ত্রিও থাকে না, বাকি থাকে শুধু দর্জি আর মুচি। মেয়েরা দর্জিবাড়ি গিয়ে নিজের পছন্দমতো ড্রেস বানাবে এটাই তো বরং স্বাভাবিক।

কিন্তু অঙ্গুস্তানা ব্যবহার করে ঢাকা শহরে কি কেউ ড্রেস সেলাই করে! উঁহু, সেই সম্ভাবনাও একেবারেই ক্ষীণ। এখানে সবকিছু মেশিনে তৈরি হয়।

তাহলে―! উর্বী বলল।  

তাহলে― ? উর্বীর সুরে সুর মিলিয়ে বলেন দুঁদে ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়। ইয়েস, এই ‘তাহলে’র উত্তরটা পেলেই কেসটা বেশ ওপেন হয়ে যায়, নয় কি! 

জিÑডিটেকটিভ। আমিও তাই ভাবছি অঙ্গুস্তানা আর কে ব্যবহার করে! আর সেটা নিয়ে খুনি নিশাতের ঘরে যাবেই বা কেন! থতানো গলায় বললেন ইন্সপেক্টর নোমান।

এবার একটু সময় নেন অলোকেশ। তার গলা শুকিয়ে গেছে, তিনি কফির তেষ্টা অুনভব করেন। কিন্তু চটজলদি এখানে কফি পাওয়া যাবে না। দারোয়ান জলিল বুদ্ধি করে খানিক চা পাঠালেন। রাস্তার ফেরিঅলার সস্তা চা। চা যেমনই হোক, ধোঁয়া উড়ছে―এটুকুই যা প্লাস পয়েন্ট। এতে আর যাই হোক, রোগ-জীবাণু থাকবে না।

বলুন ডিটেকটিভ, আবার শুরু করুন। তাড়া দেন নোমান সাহেব।

গলা খাঁকরান অলোকেশ। তিনি বলতে শুরু করলেন―

বুঝলেন, এই দর্জির ব্যাপারটা মিটে গেলে বাকি থাকে কেবল একজন―মুচি বা চর্মকার। খুব উচ্চমার্গীয় ধনী না হলে মুচির সঙ্গে আমাদের মাঝে মাঝেই দেখা সাক্ষাত হয়। কারণ ভ্যানিটি ব্যাগ বা পার্সের চেইন যেমন নষ্ট হয়, তেমনি ছেঁড়ে জুতো। তখন মুচি আমাদের কাজে আসে। ভেবে দেখলাম, অঙ্গুস্তানার মালিক কোনও মুচি-টুচিও হতে পারে। কিন্তু―!

আবার কীসের কিন্তু, ডিটেকটিভ ? উসখুস করেন ইন্সপেক্টর। একটু বুঝি বিরক্তও। 

কিন্তুটা হল এইÑ সামান্য একজন মুচি কেন ডা. নিশাতকে খুন করতে যাবে! নিশাতের সঙ্গে তার কীসের বোঝাপড়া! কী এমন শত্রুতা তাদের মাঝে থাকতে পারে! আবারও কেসে প্যাঁচ লেগে যায়। 

তাই তো! ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্য হল না। কথাটা নোমান সাহেব বললেও উর্বী এবং ইমরুল ঠিক তাই ভাবছে। মুচির সঙ্গে ডা. নিশাতের কী এমন শত্রুতা থাকতে পারে যে, তাকে সে হঠাৎ খুন করে বসবে! যথেষ্ট কষ্টকল্পিত ব্যাপার বৈকি!  

তাতে হো হো করে হেসে উঠলেন অলোকেশ। হাসি মিটলে তারপর বললেন, দেখুন ইন্সপেক্টর, দুনিয়াটা বড় বিচিত্র জায়গা। এখানে এমন অনেক কিছুই ঘটে যা কিনা মোটেও যুক্তিগ্রাহ্য বলে মনে হয় না। জীবন কিন্তু কখনও কখনও গল্পের চেয়েও বিস্ময়কর মনে হয়! 

খুলে বলুন ভাই, আমার যে আর তর সইছে না। শেষমেষ বললেন নোমান সাহেব।   

ওকে, বলছি শুনুন। আমি যখন মুচি আর অঙ্গুস্তানার ভাবনায় অস্থির, ঠিক তখনই ব্যাপারটা বুঝলাম। সেদিন ডা. নিশাতের ঘর পুনর্বার সার্চ করতে এসে চাবি-সমস্যায় পড়ি। আপনার কনস্টেবল নন্দদুলাল চাবি নিয়ে আসতে দেরি করছে দেখে দারোয়ান জলিলের সঙ্গে কিছু খুচরো আলাপ করছিলাম। জানতে চাইলাম, ডা. নিশাতের মেজাজ-মর্জি কেমন ? খুব বেশি মাথাগরম, নাকি সে শান্ত-শিষ্ট ভদ্রস্থ মেয়ে! তাতে জলিল যা বলল, শুনে আমি স্তম্ভিত। সেখানেই মূলত এই কেসের গুরুত্বপূর্ণ ক্লু লুকিয়েছিল।

কী বলল জলিল ? কীসের ক্লু ? একটু বলবেন প্লিজ!

নিশাত যে মোটেও সুস্থির প্রকৃতির নয়, বরং বড্ড বেশি রেগে যায়, যাকে তাকে খিস্তিখেউর করে, এই কথা কিন্তু জলিলই আমাকে বলল। এও জানালো যে, মাসখানেক আগে একদিন সে মুচির সঙ্গে যাচ্ছেতাই আচরণ করেছে। এমনকি, বাপ তুলে গালাগাল দেবার পর মুচিকে সে সপাটে থাপ্পড়ও মেরেছিল। বলেছে, সে নাকি ছোটোলোক, তার বাবা একটা কুকুর!  

তাই নাকি! মুচিকে মেরেছে ডা. নিশাত! বলেন কি ডিটেকটিভ! খেটেখাওয়া সাধারণ মানুষের সঙ্গে এমন আচরণ সে করতে পারল! বিস্মিত হন ইন্সপেক্টর নোমান। তিনি আরো বললেন, গরিব মানুষের সঙ্গে এমন আচরণ কোনওভাবেই বরদাস্ত করা যায় না। আমরা লেখাপড়া করছি বটে, কিন্তু মনুষ্যত্ব শিখছি না। 

ঠিক। একদম ঠিক বলেছেন ইন্সপেক্টর। সায় দেন অলোকেশ।

কিন্তু সেই কালপ্রিট ? সেই মুচি কোথায় ?

সে সম্ভবত কাছেপিঠে কোথাও আছে। আমার চরেরা তাকে পাহারা দিচ্ছে, তবে নিরাপদ দূরত্বে থেকে। কারণ লোকটা মোটেও নিরীহ প্রকৃতির নয়, যাকে তাকে সে যখন তখন মেরে দিতে পারে। নইলে একটা চড় খেয়ে কেউ কাউকে এভাবে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে পারে!

তবে একটা বিষয় আমার নিজেরও এখনও মাথায় ঢুকছে না। অনেকটা আত্মসমালোচনার সুরে বললেন তিনি।  

কী কথা ডিটেকটিভ ?

মুচি বেটা ভিকটিমের ঘরে ঢুকলো কী করে! ডা. নিশাত কি তবে দরজা খোলা রেখে ঘুমাতেন ?

কী ভেবে ইন্সপেক্টর নোমান বললেন, ভেরি সিম্পল। এই প্রশ্নের উত্তর যে জানে তাকে ধরে আনলেই হয়।

উহুঁ! ও কাজ করবেন না। আমরা কিন্তু অকুস্থলে মুচির কোনও ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাইনি। অর্থাৎ যা দিয়ে প্রমাণ হয় যে মুচি বেটাই খুনি। তাই তাকে বমালসমেত ধরতে হবে, হাতেনাতে। এভাবে সন্দেহের বশে ধরলে কোর্টে পরে সে ‘হস্টাইল’ হয়ে উঠতে পারে। তাতে কেসটা উল্টো কেঁচে যাবে। 

তাহলে এখন করণীয় ? ভ্রু নাচান ইন্সপেক্টর।

চলুন, এখান থেকে বরং যাওয়া যাক। প্রস্তাব করলেন অলোকেশ।

চলে যাব! খুনি তো তাহলে ভাগবে! অনায়াসে পগার পার! 

উহুঁ, সে যাবে না। কারণ মুচি বেটার নিজের উপর খুব বেশি বিশ^াস আছে। সে ভাবছে পুলিশ তাকে কখনওই ধরতে পারবে না। কারণ কাজটা করবার সময় কেউ তাকে দেখতে পায়নি। তাছাড়া তাকে সন্দেহ করবার দৃশ্যত কোনও কারণও নেই। বরং এক কাজ করি চলুন। নিচে নেমে এই কথা চাউর করে দিই যে, ক্রাইম সিনে খুনির ফেলে যাওয়া কিছু একটা খুঁজছে পুলিশ। ক্লু বা আলামত। কী জিনিস―তা অবশ্য বলা হবে না। ওটা পেলেই নাকি খুনিকে ট্রেস করা যাবে। দেখবেন, বেটা মুচি খুনের প্রমাণ লোপাটের জন্য একবার হলেও স্পটে যাবে। ঠিক তখনই আমরা তাকে ক্যাঁক করে চেপে ধরব। রেড হ্যান্ডেড। 

নট অ্যা ব্যাড আইডিয়া। মাথা নাড়লেন ইন্সপেক্টর শিবলি নোমান। চলুন তবে যাওয়া যাক। কৌশলে ব্যাটাকে পাকড়াতে হবে।  

এগারো.

আগেই বলেছি, ডিটেকটিভ অলোকেশ রয় মগজের পাশাপাশি ইনটুইশনেও বিশ^াস রাখেন। ঠিক যেমনটি করতেন এডগার অ্যালান পো’র গোয়েন্দা অগস্ত দু্যঁপা। সহি ওয়াক্ত বা সঠিক মুহূর্তও গোয়েন্দগিরিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে বলে মানতেন আর্থার কোনান ডয়েলের ডিটেকটিভ মিস্টার হোমসও। 

অলোকেশের অনুমান মোটেও ভুল হয়নি। ডা. নিশাতের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার সময় সাদা পোশাকে (ইন সিভিল ড্রেস, হোয়াইট নয়) দুজন পুলিশ পোস্ট করে যান। আর তিনি থাকেন ‘অন-কল অ্যাভেইলেবল’। অর্থাৎ ফোন পাওয়া মাত্র ছুটে যাবেন ইন্সপেক্টর নোমান।

অলোকেশ নিজেও বলতে গেলে উৎকর্ণ হয়ে ছিলেন। ইন্সপেক্টর নন্দ দুলালের ফোন পেলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে ডাকবেন, এই ছিল তাদের মুসাবিদা বা পরিকল্পনা। সন্ধ্যার পর পরই ফোন পান অলোকেশ। ইমরুল আর উর্বী তার সফর সঙ্গী হয়। ইন্সপেক্টর নোমান ফোন করে সহাস্যে বললেন, চলে আসুন ডিটেকটিভ, ইঁদুর বোধ হয় ফাঁদে পা দিয়েছে। জলদি আসুন।

কেসটা কিছুটা চমকপ্রদ মনে হলেও বাস্তবে ঠিক তাই ঘটেছে, অলোকেশ যেমন ভেবেছিলেন। কাছেপিঠে ওঁত পেতে থাকা সাঙ্গু মুচি জলিল দারোয়ানের মুখে শুনেছে যে ডা. নিশাতের ঘরে নাকি খুনির রেখে যাওয়া আলামত খুঁজছে পুলিশ। ওটা পেলেই নাকি খুনি ধরা পড়বে।   

আসলে কী জানেন তো, মানুষ এমনিতে অপরাধপ্রবণ হলেও সহজে অপরাধ করতে চায় না, বা পারে নাÑখুন তো নয়ই। একটা মানুষের জীবন নিয়ে নেয়া কি এতই সোজা! আর যদি ঝোঁকের বশে বা রাগের মাথায় কাজটা কেউ করেও থাকে, খুনের পর থেকেই শুরু হয় তার (যদি না সে সিরিয়াল কিলার হয়) কঠিন মনস্তাপ। সেই সঙ্গে ভয় তো থাকেই। ধরা পড়বার ভয়, ফাঁসিতে ঝোলার আতঙ্ক। 

সাঙ্গু মুচি এক ফাঁকে দারোয়ান জলিলকে কৌশলে চা খেতে পাঠিয়ে তার চোখ এড়িয়ে দোতলায় উঠে যায়, বিড়ালের মতোন নিঃশব্দে ঢুকে পড়ে ডা. নিশাতের ঘরে। বেটা মুচি নিশাতের ঘর খোলা দেখেও সন্দেহ করেনি যে, এটা একটা চোরা ফাঁদ হতে পারে। তখন তার একটাই ভাবনা―যেমন করে হোক, স্পটে ফেলে আসা থিম্বল বা অঙ্গুস্তানা তাকে উদ্ধার করে আনতে হবে। নইলে সে কট!    

কনস্টেবল নন্দদুলাল ও তার সাগরেদ কাছেই ছিল, অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে। সাঙ্গু মুচি নিশাতের ঘরে ঢোকামাত্র তাকে দুজন মিলে জাপটে ধরলো। তারপর মুচির দুহাতে পরিয়ে দিল লোহার চুড়ি―মানে হাতকড়া।  

অপরাধী ধরা পড়ার পর গল্পে আর তেমন আমেজ থাকে না। তাও কৌতূহলবশত কয়েকটি প্রশ্ন করলেন অলোকেশ।

বললেন, কী নাম তোর ?

আজ্ঞে, সাঙ্গু।

কী কাজ করিস ?

মুচিগিরি সাব।

শুধুই জুতো সেলাই, নাকি খুনটুনও করো ? খুনপ্রতি কত টাকা পাও ? তুই থেকে তুমিতে উঠে এলেন তিনি।

জি না সাব, খুন আমি করি না। আমি অপরাধী না। একটাই খুন করছি শুধু, বেদ্যপ মহিলারে মারছি। তাতে আমার কোনও আপসোস নাই। 

কেন মারলে তাকে ?

মহিলা খুব খারাপ। বেজায় বদখাসলত তার। জুতা সিলাইয়া টেকা দিবার চায় না, আবার কয় কিনা আমি ছোটোলোক! আমার বাপ শুয়ার, আমার নাকি জন্মের ঠিক নাই! কন সাব, এমুন কতা কি মানন যায়! আমার বাপ কেন শুয়োর হতি যাবে? মানুষের আবার ছোটলোক-বড়লোক কী! সব শালা এক―চান্স পাইলেই অন্যের হক মারি খায়! যত বড় লোক, তারা তত বড় চোর। আমি সাব গরিব মানুষ, কাম করি খাই, অন্যের হক মারি না।  

ইন্সপেক্টর নোমান মুচির গালে থাপ্পড় মারতে গিয়ে নিজেকে সামলে নেন। সেই জন্য তাকে মনে মনে ধন্যবাদ দেন অলোকেশ। সাঙ্গু মুচি অপরাধ করেছে―সে খুনি। কিন্তু সে কথা কিছু ভুল বলেনি। যত বড় লোক, তারা তত বড় চোর। সোজা পথে খুব বেশি ধনার্জন সম্ভব নয়। কিছু না কিছু অন্যায় তারা করেই থাকে। 

তাই বলে মেয়েটিকে খুন করবে ? অলোকেশ বললেন।

অমনি ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে মুচি। তার বয়স কম―খুব জোর তেইশ কি চব্বিশ। তাই হয়তো নিজের বাবাকে অপমান করায় সে সহ্য করতে পারেনি। অপমানটা তার বুকে একটু বেশিই বেজেছিল।

কী করে নিশাতের ঘরে ঢুকলে ? দোর বন্ধ ছিল না ? কৌতূহলবশত জানতে চান অলোকেশ।

জি না সাব। আমি দিনের পর দিন তারে বাগে পাওনের চেষ্টা করছি। দরজা বন্ধ দেখলে ফিরা আইছি। কিন্তু সেইদিন তার ঘরের দরজা খোলা আছিল। সে ঘরে বইসা কাঁদতেছিল। কিন্তু তাও আমার মন গলে নাই, আমার বাপেরে সে গালাগাল দিছিল। কয় কিনা শুয়ারের বাচ্চা, কুকুরের ছাও!

একটু থেমে সাঙ্গু মুচি কাঁদতে কাঁদতে বলল, ভুল করিচি আমি, সাব আমারে ফাঁসি দেন, মারি ফেলেন আমারে। এমুন জীবন আমি চাই না। আমি অপরাধী না, রাগের মাতায় কামডা করি ফেলিচি। তাও মাপ চাই না আমি, আমারে ফাঁসি দেন।

 সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

——————

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button