আর্কাইভক্রোড়পত্র

হাসান আজিজুল হকের কথাসাহিত্য : প্রসঙ্গ দেশ ভাগ

আহমেদ মাওলা

বিশ্বমানের বাংলা ছোটগল্পের জনয়িতা হাসান আজিজুল হক (১৯৩৯-২০২১) আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। শেষবার অসুস্থ হবার পর তাঁকে চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টারযোগে ঢাকায় আনা হয়েছিল। চিকিৎসায় কিছুটা সুস্থ হলে আবার ফিরে গিয়েছিলেন নিজ আবাসে। ১৫ নভেম্বর রাত নয়টায় হঠাৎ তাঁর মৃত্যুর হৃদয়ভাঙা দুঃসংবাদ আমাদেরকে অপ্রস্তুত করে তুলেছিল। পুরো সাহিত্য-সমাজে নেমে আসে শোকের ছায়া। আমরা যেন দিন দিন অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়ছি। ‘যেন একে একে নিভিছে দেউটি’। এই তীব্র শোক আর বেদনা নিয়ে লিখতে বসে মনের অজান্তেই চোখ ভিজে গেল। কিন্তু জন্মের আরেক নাম তো মৃত্যু! এই চরম সত্য মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় কী ? দস্তয়ভস্কি, তলস্তয়, হেমিংওয়ে, গার্সিয়া মার্কেজ, রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, মানিক প্রমুখের মূল ধারার যে গল্প―যারা জীবন ও সমাজের দিকে তাকিয়েছেন নির্মোহ দৃষ্টিতে। সেই মূল ধারাকে সামনে রেখে হাসান আজিজুল হকের গল্প পড়তে গেলে দেখা যায়, তিনি গল্প লেখার জন্য নিজস্ব এক ভূমি খুঁজে নিয়েছিলেন, স্বতন্ত্র এক বয়ানভঙ্গি রপ্ত করেছিলেন আপন সাধনায়। হাসানের গল্পের জমিন ছিল ছোট কিন্তু ছোট্ট জমিনে ঘনপিনদ্ধ বয়ান এবং বিস্তার, সূক্ষ্ম, ব্যঞ্জনাময় ইঙ্গিতগুলো পাঠককে বৃহৎ উপন্যাসের জগতে নিয়ে যায়। এটাই হাসানের গল্প লেখার আশ্চর্য কৌশল। তাঁর প্রত্যেকটি গল্পই ঔপন্যাসিকের লেখা ছোটগল্প। গল্পের ব্যাপ্তি ও বিস্তারে, গঠন কাঠামোতে উপন্যাসের সেই বীজ নিহিত। তাঁর গল্পের চরিত্র মূলত প্রান্তিকবাসী মানুষ। মনস্তাত্ত্বিকভাবে কেন্দ্র আর প্রান্ত ধারণা ঔপনিবেশিক। ঢাকাবাসী, ঢাকামুখী না-হলে কারও সাহিত্যজগতে স্থান হয় না। হাসান আজিজুল হক সেদিক থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত স্রোতের যাত্রী ছিলেন। লেখা এবং আবাসের দিক থেকে হাসান আজিজুল হক প্রান্তবাসীই ছিলেন আমৃত্যু। প্রান্তকে কেন্দ্রে টেনে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন, কেবল লেখার গুণে। প্রান্তিক এবং প্রবঞ্চিত মানুষের বেঁেচ থাকার নিরন্তর সংগ্রামই ছিল তাঁর গল্পের একমাত্র বিষয়। আশির দশকের মাঝামাঝি আমি তখন পদ্যমাতাল এক কিশোর। চট্টগ্রামের মোমিন রোডে ‘কথাকলি’ লাইব্রেরি থেকে কিনেছিলাম পাতালে হাসপাতালে। গল্পগ্রন্থের নামের মধ্যেই একটা অভিনবত্ব ছিল। বইয়ের শেষ মলাট জুড়ে ছিল হাসান আজিজুল হকের ঘাড়সমান নেমে আসা চুলের একটা ছবি। পড়তে গিয়ে টের পেলাম, এ গল্পগুলোর ভাষা আর ঘটনাগুলো অন্যরকম! আন্দরকিল্লার ‘তাজ লাইব্রেরিতে’ একদিন পেয়ে গেলাম আত্মজা ও একটি করবী গাছ। নামিক গল্প পড়ে থ’ হয়ে গেলাম, একি গল্প! অনেক পরে জেনেছিলাম তাঁর জন্ম পশ্চিমবঙ্গে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রাম থেকে ভিটেমাটি ছেড়ে বাংলাদেশের খুলনায় থিতু হয়েছিলেন। হাসান আজিজুল হকের গল্পের ওপর প্রথম একাডেমিক গবেষণা করেন মহীবুল আজিজ। শিরোনাম- ‘হাসান আজিজুল হক : রাঢ় বঙ্গের উত্তরাধিকার’। মহীবুল আজিজের এটি ছিল মাস্টার্স থিসিস। পরে সেটি গ্রন্থাকারেও প্রকাশিত হয় চট্টগ্রামের গুটেনবার্গ (অধুনা লুপ্ত) নামে চট্টগ্রামের একটি প্রকাশনী থেকে। হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ-পরিচয় হয় ১৯৯৬ সালে ১৭ জুন চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের এক অনুষ্ঠানে। মনে পড়ে সেদিন অনুষ্ঠান শেষে কথা হয়েছিল মূলত তাঁর ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ ‘পরবাসী’ ‘মারী’ ‘উট পাখি’  ‘শকুন’ ‘পাতালে হাসপাতালে’ ‘সরল হিংসা’ ইত্যাদি গল্প নিয়ে। ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্পের প্রসঙ্গ উঠতেই তিনি স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বললেন―‘ওটা তো খুলনার ফুলতলার ঘটনা। গল্পে যদিও বাবা-মেয়ে দেখানো হয়েছে, বুড়ো চরিত্রটি ছিল মামা আর রুকু ছিল তার ভাগ্নি। নামগুলো কাল্পনিক।’ ওই সময় কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় ‘বিজ্ঞাপন পর্ব’ হাসান আজিজুল হক সংখ্যা। সেটা ছিল আমার কিশোর জীবনের সাহিত্য-যাপনের অনুপম সঙ্গী। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার সুবাদে আমি তাঁকে ‘স্যার’ সম্বোধন করতাম। পরে পত্র যোগাযোগ, সাক্ষাৎ, ফোনে কথা বলার মধ্য দিয়ে হাসান আজিজুল হক আমার জীবনে হয়ে উঠেছিলেন (তাঁর সরাসরি ছাত্র না হয়েও) শিক্ষক, অভিভাবক, দীক্ষাগুরু। আজ তাঁর মহাপ্রয়াণে সেই সব স্মৃতি হৃদয়ে করুণ বেদনার সুর তুলছে। হাসান আজিজুল হক নিজেই ছিলেন উদ্বাস্তু লেখক, তাই হয়ত ব্যক্তি ও সমাজের ওপর দেশভাগের প্রভাব তাঁর গল্প-উপন্যাসে গুরুত্বের সঙ্গে রূপায়িত হয়েছে। দেশভাগ নিয়ে লেখা তাঁর ছয়টি গল্প ‘উত্তর বসন্তে’ ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ ‘পরবাসী’ ‘মারী’ ‘খাঁচা’ ‘দিবাস্বপ্ন’ বাংলা কথাসাহিত্যে অমূল্য সম্পদ হিসেবে স্থায়ীভাবে স্থান করে নিয়েছে। ‘উত্তর বসন্তে’ গল্পে হাসান আজিজুল হক তুলে ধরেছেন দেশভাগ-উত্তর একটি পরিবারের নির্মম বিষাদময় কাহিনি। বর্ধমানের পুরোনো জেলা শহরে লাল রোদের কথা খুব মনে পড়ে বাণীর। বাণী স্কুলে আর লিপি কলেজে যেত শরতের লাল রোদের মধ্যে। একদিন লিপি বলেছিল, বেড়াতে যাবি ? আমার এক বন্ধুর বাড়ি, একটা দরকারি বই আনতে যাব। সুরকি ঢালা লাল রঙের রাস্তা, ঝোপজঙ্গলে ভরা নিথর বাড়িগুলো সত্যি রাজপ্রাসাদের মনে হচ্ছে, আর লিপি নিজেকে রাজকন্যার মতো ভাবছে। জনহীন দিঘির পাড়ে দেবদারু গাছের নিচে বাদাম খাচ্ছিল একটি ছেলে। লিপি বলল, কতক্ষণ এসেছ ?’ তারপর প্রায় বিকেল বেলা দেখা হতো কবীরের সঙ্গে। সেই বাড়িতে ফিরে যাওয়া তাদের হলো না। দেশভাগের পর ঢাকা থেকে বড় ভাই সব ব্যবস্থা করে ফেললেন। বাড়ি বিনিময় করে তিন মাসের মধ্যে তারা পাকিস্তানে চলে আসে। আম, জাম, কাঁঠাল বাগানের মধ্যে হতাশার অন্ধকারের দলা পাকিয়ে থাকা বাড়িটার মাত্র দুটা ঘর ব্যবহৃত হয়, বাকি দুটা ঘর তালাবদ্ধ। মা বলে―‘জনমনিষ্যি নেই―ছি ছি ছি, এমন দেশ ভূভারতে দেখি নাই’ মায়ের কাছে বেঁচে থাকাটা যন্ত্রণা ভোগ ছাড়া আর কিছু নয়।’ আর বাপ-মায়ের কাছে জীবনটা জীর্ণ ন্যাকড়ার মতো বাতাসে উড়ছে।’

কোনও কিছুই তাদের প্রিয় নয়, পরিচিত নয়, ছোট্ট দুই ভাই নিরানন্দ, তারা রিফিউজি, উদ্বাস্তু। বাণীদের পরিবারের যে অস্বাভাবিক অসুস্থ পরিবেশ তার নেপথ্যে রয়েছে দেশভাগজনিত প্রভাব। দেশত্যাগী হবার ফলে লিপি ও কবীরের প্রেমময় সম্পর্ক ভেঙে যায়। পরিণামে লিপি একদিন আত্মহত্যা করে। সেই ট্র্যাজিক যন্ত্রণাদগ্ধ পরিবারটির বাস্তবতা রূপায়ণে হাসান আজিজুল হক বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। গল্পে বাণীর কলেজে কবীর একদিন ইতিহাসের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেয় এবং বাণীর সঙ্গে তাদের বাড়িতে এলে মায়ের কাছ থেকে চাবি নিয়ে কবীরকে বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাতে চায়। মায়ের নিষেধ সত্ত্বেও―

‘চোখভরা পানি নিয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরল বাণী, খোলা যে দরকার মা। … চাবি দিয়ে ঘরটা খুলল, নিষ্ঠুর একটা আলো ঘরটাকে বীভৎস করে তুলল। লিপির হাস্যস্ফুরিত বড় ছবিটা হাওয়ায় দুলছে। বাণী থেমে থেমে উচ্চারণ করল, লিপি। … এ বাড়ির সবকটি মানুষ অসুস্থ … ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল বাণী, না, আমাকে লোভী করে তুল না। আমরা সবই অসুস্থ। … কবীর কি এখনও অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রয়েছে ? বাস পেলেও কি সে বাসটায় ওঠেনি ?’ 

ব্যক্তি ও পরিবারের ওপর দিয়ে দেশভাগের পরিণতি কতটা গভীরভাবে পড়েছে, তা সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণ দিয়ে পরিচর্যা করেছেন লেখক। দেশভাগের ফলে উন্মূলিত মানুষের অসহায় অস্তিত্ব যন্ত্রণা কতটা হৃদয়বিদারক হতে পারে ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্পটি তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। এ গল্পে করবী গাছ এবং আত্মজা সমান্তরাল প্রতীকী তাৎপর্যে অভিব্যঞ্জিত হয়েছে। হাসান আজিজুল হক গল্পটি শুরু করেছেন ‘এখন নির্দয় শীতকাল, ঠাণ্ডা নামছে হিম’ এ রকম বাক্য দিয়ে এখানে ‘নির্দয়’ ‘ঠাণ্ডা’ শব্দ দুটি দ্বারা সংকেতায়িত হয়েছে গল্পের শৈল্পিক গন্তব্য। সত্যি, এমন নির্দয় গল্প পাঠ করার পর শরীরের রক্ত ঠাণ্ডা হিম না হয়ে পারে না। দেশত্যাগের ফলে মানুষ যে উন্মূলিত বৃক্ষের মতো অসহায়, মর্যাদাহীন হয়ে পড়ে, তা বৃদ্ধ পিতার অক্ষম সংলাপে প্রকাশ পায়―‘দেশ ছেড়েছে যে―তার ভেতর বাহির নাই। সব এক হয়ে গেছে।’ টাকার বিনিময়ে নিজ আত্মজাকে গ্রামের বখাটে যুবক ইনাম, সুহাস, ফেকুর লালসার কাছে সমর্পণ করে অসহায়, অক্ষম পিতা।

‘সুহাস চাদরের মধ্যে নোট খড়মড় করে। সেগুলো নিয়ে ফেকু নিজের পকেট থেকে দুটো টাকা বের করে, দলা পাকায়, ভয় পায়, শেষে বুড়োর দিকে ঝুঁকে পড়ে, সুহাস আর আমি দিচ্ছি। … তোমরা দিচ্ছ, তুমি আর সুহাস ? … দাঁড়াও―হারিকেনটা রেখে বুড়ো বেরিয়ে যায়। মুরগিগুলো আবার কঁ কঁ করে ওঠে, কথা বলে ওঠে এক বৃদ্ধ স্ত্রীলোক। … চুপ, চুপ, মাগি চুপ কর, কুত্তী … বুড়ো মাথা নামিয়ে ফিস ফিস করে, যাও তোমরা, কথা বলে এসো, উই পাশের ঘরে। এনাম তুমি বসো, এসো গল্প করি। … শ্লেষ্মা কিছুতেই কথা বলতে দেবে না তাকে। আমি যখন এখানে এলাম, হাঁপাতে হাঁপাতে, কাঁপতে কাঁপতে সে বলছে, বুঝলে যখন এখানে এলাম, তার এখানে আসার কথা কিছুতেই ফুরাচ্ছে না। এলোমেলো শাড়ির শব্দ আর ইনামের অনুভবে ফুটে উঠল নিটোল সোনার রঙের দেহ―সুহাস হাসছে হি হি হি … থামল বুড়ো, কান্না শুনল, হাসি শুনল―ফুলের জন্য নয়, বিচির জন্য বুঝেছ, চমৎকার বিষ হয় করবী ফুলের বিচিতে। … আর ইনাম তেতো তেতো―এ্যাহন তুমি কাঁদতিছ ? এ্যাহন তুমি কাঁদতিছ ? এ্যাহন কাঁদতিছ তুমি ?

আত্মজার দেহদানের গ্লানি, যন্ত্রণাদগ্ধ হৃদয়ের অভিব্যক্তি ‘ফুলের জন্য নয়, বিচির জন্য, বুঝেছ ? চমৎকার বিষ হয় করবী ফুলের বিচিতে।’ দারিদ্র্যলাঞ্ছিত অসহায় বৃদ্ধপিতা জীবনযন্ত্রণার সংকেতময় আবহ সৃষ্টি করে ‘চুড়ির শব্দ’ ‘শাড়ির শব্দ’ ‘কান্নার শব্দ’ ‘হাসির শব্দ’ এবং ‘চমৎকার বিষ হয় করবী ফুলের বিচিতে।’ বলার মধ্য দিয়ে। দেশভাগের পটভূমিকায় উদ্বাস্তু, অসহায় হয়ে বেঁচে থাকার অমোঘ প্রয়োজনে পিতা আপন কন্যাকে সমাজ নিষিদ্ধ অশুচিতার পথে ঠেলে দেওয়ার মর্মন্তুদ যন্ত্রণা করবী ফুলের বিচির বিষ হয়ে উৎসারিত হয়। হাসান আজিজুল হক গল্পের ভাষা, চিত্রকল্প, সংকেত নির্মাণে, প্রতীকী তাৎপর্যের আশ্রয় গ্রহণে অসাধারণ শিল্প কুশলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। সামান্য টাকার বিনিময়ে বুড়ো কৌশলে ইনাম, সুহাস, ফেকু, তাদেরকে যুবতী কন্যার ঘরে পাঠিয়ে দেয়। বিগলিত হয়ে বলে―‘এখানে না-খেয়ে মারা যেতাম তোমরা না-থাকলে বাবারা!’ এই যে ক্লেদাক্ত, গ্লানিকর জীবন―তার অক্ষম ক্রোধ আর যাতনা, করবী ফুলের বিচির বিষ হয়ে বুড়োর দেহে ছড়িয়ে পড়ে। ইনাম, সুহাস, ফেকুর কদর্য রিরংসার কাছে সমর্পিত রুকুর সম্ভ্রম প্রতীকধর্মী―

‘গঞ্জের রাস্তার ওপর উঠে আসে ডাকু শিয়ালটা মুখে মুরগি নিয়ে। ডানা ঝামরে মুমূর্ষু মুরগি ছায়া ফেলে পথে, নেকড়ের মতো ছায়া পড়ে শিয়ালটারও’

‘শিয়ালের মুখে মুমূর্ষু মুরগি’র প্রতীক হয়ে উঠেছে ইনাম ফেকুদের লালসার কাছে আত্মজা রুকু। যেন মৃত্যুর মুখে নিক্ষিপ্ত মুরগি―রুকু। ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্পে দেশভাগের ফলে ছিন্নমূল পরিবারের বিকলাঙ্গ, কদর্য রূপ এভাবে উন্মোচিত হয় এবং ইতিহাসকে আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড় করায়। ‘এ্যাহন তুমি কাঁদতিছ ? এ্যাহন তুমি কাঁদতিছ ? এহ্যঅন কাঁদতিছ তুমি ?’ এই কান্না ছিন্নমূল হওয়ার কান্না, উদ্বাস্তু হবার যন্ত্রণাময় রোদন।

‘পরবাসী’ গল্পটিতে মূলত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার হত্যাযজ্ঞ ও মনুষ্যত্ববোধের জাগরণ তুলে ধরেছেন হাসান আজিজুল হক। কনকনে শীতের সন্ধ্যায় বশির ওয়াজদ্দি চাচাকে বাতাসে ভাসতে থাকা গুজবের কথা বলে―‘তুমি কিছুই শোন নাই ? পাকিস্তানে হিন্দুদের লিকিন একচার কাটছে―কলকাতা তেমনি কাটছে মোচলমানদের।’ ওয়াজদ্দি কথাটা কানে নেয় না। দু’জনই কৃষিশ্রমিক, ক্ষেতে খোলায় কাজ করে। বশিরের কথায় ওয়াজদ্দি রাগ করে বলে―‘তোর বাপ কটো ? এ্যাঁ―কটো বাপ ? মা কটো ? একটো তো ? দ্যাশও তেমনি একটো। বুইলি ?’ কিন্তু বশিরের মনে দ্বিধা-শঙ্কা দূর হয় না। রাত্রিবেলায় লবাবপুর, ছিস্টিধরপুর থেকে কালি পূজা দিয়ে ওরা আসে। বশিরের সামনে প্রথম ওয়াজদ্দি খুন, বশির দৌড়ে বাড়িতে গিয়ে দেখে বাড়ি পুরে শেষ, স্ত্রী পোড়া কাঠ হয়ে আছে, বল্লমে, গাঁথা সাত বছরের ছেলেটা। পাগলের মতো ছুটতে থাকে বশির। রাতের অন্ধকারে সীমান্তের কাছে খালের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা মানুষ। পরনে ধুতি, মোটা চাদর গায়ে―সেও বশিরের মতো উল্টো দিক থেকে পলায়নপর। বশিরের মনে হঠাৎ ভেসে ওঠে ওয়াজদ্দি, স্ত্রী, সন্তানের রক্তাক্ত দেহ। মাথায় খুন চেপে যায়, সমস্ত শক্তি দিয়ে হিন্দু লোকটাকে হত্যা করল সে। তার পর রক্তাক্ত মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে বশির দেখল

‘ঠিক যেন ওয়াজদ্দির মুখ―রক্তাক্ত, বীভৎস, তেমনিই অবাক। চোখের ওপর থেকে ধোঁয়াটে পর্দাটা যেন সরে গেল, আর তার চোখের পানিতে ধূসর হয়ে এল দুটি পৃথিবী―যাকে সে ছেড়ে এল এবং যেখানে সে যাচ্ছে।’

 অর্থাৎ বর্বরতা আর মনুষ্যত্ব―এই দুটির মধ্যে পার্থক্য কী ? অহেতুক হত্যাযজ্ঞ। নিদারুণ নিরর্থকতা, তখনই বশিরের মধ্যে মনুষ্যত্ব হাহাকার করে উঠে। হিংস্রতার জগত থেকে পৌঁছে দেয় নিরুচ্চারিত মানবিক পৃথিবীতে।

‘মারী’ গল্পে লেখক দেখিয়েছেন, মফস্সল শহরের স্কুলঘরে আশ্রয় নেওয়া রিফিউজিদের অনুপুঙ্খ চালচিত্র। রিফিউজি আগমনে স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া ‘আমরা মরতিছি নিজেগো জ¦ালায়, এ্যাহন রিফুজি আলি বাঁচবেন একডা লোক―কন দিনি।’ মতলেব সাধু আর নফর একঘড়া দুধ নিয়ে উদ্বাস্তু বাচ্চাদের দেবার জন্য যায়। স্কুলঘরে ছড়ানো ছিটানো বিছানাপত্র, অকথ্য গোলমালের মধ্যে নফর আর মতলেব দেখে উদ্বাস্তুরা সরকারের কাছে আগেই চাল পেয়ে গেছে। দুধের খোঁজ পেয়ে অনেকেই ছুটে আসে, মতলেব ধমক দেয়―‘সরকার চাল দেয়নি তোমাদের ?’ অজস্র শিশুর চিৎকার দুধ, দুধ। একসময় হট্টগোলের মধ্যে কবীরের কথায় দুধ বিতরণ হয়। দুধ খেয়ে একটা মানুষ বমি করছে, কিছুক্ষণ পর দেখা যায় অসংখ্য মানুষ বমি করছে। আধশোয়া বমিরত মানুষদের পাশে হলুদ রঙের পাখি নেচে নেচে বেড়াচ্ছে। এই বিষাদময়, বিয়োগান্ত পরিণাম দিয়েই লেখক ‘মারী’ গল্পটি শেষ করেছেন।

‘খাঁচা’ গল্পটি হাসান আজিজুল হকের জীবন ঘষে আগুন (১৯৭৩) গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। এই গল্পে এক শৌখিন সেতার বাদক অম্বুজকে দেখতে পাই। পরে সে সেতার বাজানো ছেড়ে দিয়ে বিশাল সংসারের হাল ধরতে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পেশা গ্রহণ করে। দেশভাগের তিন বছর পর ঘরবাড়িসম্পত্তি বিনিময় করে ভারতে চলে যাবার প্রয়াস চালায়।

অম্বুজের স্ত্রী সরোজিনী স্বপ্ন দেখে নতুন দেশের, নতুন করে জীবন সাজাতে। কিন্তু অম্বুজের মনের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব চলে। যাদের সঙ্গে বিনিময় হবে, ওরাও মেয়েদের সংখ্যালঘু, অম্বুজের মতো তারাও মনে করে, সেখানে- ‘ভবিষ্যত নেই, নিরাপত্তা নেই।’ সরোজিনীর স্বপ্ন বুনন চলতে থাকে। অম্বুজের মনে ভিন্ন এক ভাবনা চলতে থাকে।

‘একটি মাত্র দেশলাই কাঠি খরচ করলেই হু হু আগুন জ¦লবে। আগুন এগিয়ে যাবে ছাদে, বরগায়, শূন্য ধানের গোলায়, সরোজিনীর শুকনো হাড়ে। লাগিয়ে দিলেই হয়, অম্বুজ আবার ভাবল, তারপর সরোজিনীকে জড়িয়ে ধরি, বুকে টেনে আনি―তারপর আমি সরোজিনী, বাবা, সূর্য, বরুণ, কমল, ভ্যাবলা―সবাই দাঁড়িয়ে থাকি, সর্বনাশ দেখি―শেষে ধ্বংস হয়ে যাই।’

 অম্বুজের আত্মধ্বংসী এই ভাবনা স্থায়ী হয়না। সে আবার সেতার হাতে তুলে নেয়, সরোজিনীকে বলে―আমরা যাচ্ছি না সরোজিনী। … গিয়ে লাভ কী বলো ? একই কথা। খবরাখবর যা পাচ্ছি তাতে মনে হয়, এখানে তবু খেতে পাচ্ছি দুমঠো―সেখানে লোকজন শুকিয়ে মরে যাচ্ছে।’ সরোজিনীর লালিত স্বপ্ন ভেঙে  গেলে সে ক্ষিপ্ত হয়ে সেতারটা ভেঙে চুরমার করে দেয়, হারিকেনটাও চুরমার হয়ে যায়। অম্বুজ মিনতি করে বলে― ‘সরোজিনী আমাকে নয়, আমি নই।’ আসলে সরোজিনী যেন খাঁচায় বন্দি, সে খাঁচা সে ভাঙতে পারে না। সেতারের খোল ভাঙা হয়ত সহজ কিন্তু দেশভাগের বাস্তবতা ভাঙা, অম্বুজের পক্ষে সম্ভব নয়। হাসান আজিজুল হক দেশভাগের বাস্তবতাকে খাঁচার রূপকে চিহ্নিত করেছেন।

দেশভাগ নিয়ে এ পর্যন্ত যত উপন্যাস রচিত হয়েছে হাসান আজিজুল হকের আগুনপাখি (২০০৬)  তার মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। প্রমাণ কী ? নানাভাবে এর উত্তর দেওয়া যায়, প্রথমত লেখক নিজেই দেশত্যাগী উদ্বাস্তুদের একজন। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে তাঁর জন্ম। স্কুলে পড়া শেষ করে তিনি বাংলাদেশে চলে আসেন। স্বাধীনতা আন্দোলন, দাঙ্গা, দেশভাগ প্রভৃতির সঙ্গে যুক্ত হাসান আজিজুল হকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটেছে এই উপন্যাসে। দ্বিতীয়ত ভারতের রাঢ়বঙ্গের ভুবনডাঙ্গা গ্রামের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাহীন মুসলিম মহিলা, একজন মা, এক দৃঢ়চেতা নারী, এমন কথক চরিত্র বাংলা কথাসাহিত্যে বিরল। তৃতীয়ত, রাঢ়বঙ্গের আঞ্চলিক কথ্যভাষার বয়ান, গদ্যভঙ্গি আগুন পাখি উপন্যাসকে নতুন এক ফর্মে উন্নীত করেছে। চতুর্থত, দেশভাগের ফলে ব্যক্তি ও পরিবারের এমন অন্তর্ভেদী ক্ষতবিক্ষত মর্মস্পর্শী অবলোকন, দ্বিতীয় কোনও উপন্যাসে নেই।

গ্রামীণ সরল মহিলা পত্রপত্রিকা পড়ে লোকজনের মুখে শুনে দেশভাগের রাজনীতি, দাঙ্গার বিষয়টা বুঝতে পারে, কিন্তু তার জিজ্ঞাসা অনেক―

‘আচ্ছা, হিঁদু-মুসলমান তফাৎ কি বলো তো শুনি। ই আবার কি কথা ? ইসব তো কুনোদিন ভাবি নাই, ভাবতে হবে বলে কুনোদিন মনেও করি নাই। … আমাদের এই বেরাট গাঁয়ে মাওর বিশ ঘর মোসলমান। চানাপোনা নিয়ে একশোটা লোক হবে কিনা সন্দ। হিঁদু কম করে হলেও পাঁচশো ঘর। আশেপাশের গাঁগুলিনও মোটামুটি হিঁদু গাঁ। এই কথা কুনোদিন মনে হয় নাই। ক্যান মনে হবে? মানুষ আপন মনে বাস করছে। নিজের নিজের পেরান, ছেলেমেয়ে সোংসার নিয়ে হাবু সোঁটা খেতে হবে সবাইকে। হিঁদু-মোসলমান আবার কি ? কুনোদিন মনেও করি নাই যি ই নিয়ে আবার ভাবনা করতে হবে। মনে তো অ্যাকনো করতে চাই না কিন্তু খালি যি মানব ভেতর আগা লিছে, যেদি ই গাঁয়ে দাঙ্গা লাগে তাইলে এই কটি মোসলমান তো এক লাপটেই মারা পড়বে। সাথে সাথে মনে হলো, মনে পাপ ঢুকেছে তাই এই কথা মনে হচ্ছে। … পাকিস্তান হওয়া না হওয়াতে যেদি কুনো তফাৎই না হবে তাইলে এমন রক্তগঙ্গা ক্যানে করলে সবাই ? … ছি ছি চেরকালের লেগে এমন ক্ষেতি করে সারা দ্যাশের মানুষের ? মেতর-বৌ ভাবেন, দ্যাশ আলেদা হোক আমি চাই নাই অথচ আমারই ছেলেমেয়ে বিদ্যাশে চলে গেল আর আলেদা দ্যাশের লেগে যারা লাফাইছিল তারা যেমনকার তেমনিই রইল। বিনা কারণে শুদু হিঁদু-মোসলমানের মাঝখানে একটা ছেঁয়া পড়ে গেল। সেই ছেঁয়া আর কুনোদিন গেল না। … মেতর-বৌ তার ছেলেকে বলেন, ‘আমি ক্যান তোমাদের সাথে দেশন্তরী হব এই কথাটি কেউ আমাকে বুঝাইতে পারে নাই।’

এই দৃঢ়চেতা নারী, একজন মা কিছুতেই দেশভাগ মেনে নিতে পারে না। তার ছেলেমেরা এমনকি স্বামী পাকিস্তানে চলে গেলেও সে বসতভিটে আঁকড়ে পড়ে থাকে।

‘আমাকে কেউ বুঝাইতে পারলে না ক্যান আলেদা একটো দ্যাশ হয়েছে গোঁজামিল দিয়ে যিখানে শুদু মোসলমানরা থাকবে কিন্তুক হিঁদু কেরেস্তানও আবার থাকতে পারবে। তাইলে আলেদা কিসের ? আমাকে কেউ বুঝাইতে পারলে না যি সেই দ্যাশটো আমি মোসলমান বলেই আমার দ্যাশ আর এই দ্যাশটি আমার নয়। … সকাল হোক, আলো ফুটুক, ত্যাকন পুবদিকে মুখ করে বসব। সুরুজের আলোর দিকে চেয়ে আবার দাঁড়াব আমি। আমি একা। তা হোক, সবাইকে বুকে টানতেও পারব আমি। একা।’

গ্রিক পুরাণের সেই ফিনিক্স পাখি, যে জিউসের রথ থেকে আগুন চুরি করে এনেছিল মানুষকে উত্তাপ দিতে। সে উত্তাপ পাখি নিজে উপভোগ করতে পারেনি, সেই আগুনে পাখি নিজেই দগ্ধ হয়েছিল। গ্রিক পুরাণের সেই মিথকে অসাধারণ দক্ষতায় ব্যবহার করেছেন হাসান  আজিজুল হক। আগুন পাখি-মেতর বৌ’র মধ্যে বিপন্ন মানবতার ক্রন্দন ধ্বনিত হয়েছে। স্বাধীনতা তাকে রক্ষা করে না, তাকে খণ্ডবিখণ্ড, বিচূর্ণ, বিপন্ন করে। স্বামী, ছেলে, মেয়ে পাকিস্তানকে নিজেদের দেশ মেনে নিয়ে স্বভূমি ত্যাগ করে চলে যায় কিন্তু ব্যক্তিত্বসম্পন্ন গ্রাম্য নারী নিজের সিদ্ধান্তে অটল, অবিচল থেকে একা। পূর্বদিকে মুখ করে সূর্যের আলোর দিকে দাঁড়াবার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। আগুন পাখি’র রূপকল্পে মেতর-বৌ, মূলত দেশভাগের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের স্মৃতি ও চেতনা।

রাজনীতি ও ক্ষমতাকে ইতিহাস থেকে পৃথক করে দেখলে ঔপনিবেশিক সমাজ বাস্তবতার যে বিবর্ণ ইতিহাস উঠে আসে আগুন পাখি যেন সেই অলিখিত ইতিহাসের বয়ান। ইটের নিচে চাপা পড়া সবুজ ঘাসের হলুদ হয়ে যাওয়ার মতোই বঙ্গীয় ভাবুকরা যাকে ‘সাব অলটার্ন স্টাডিজ বা নিম্নবর্গের ইতিহাস’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ঔপনিবেশিক ভারতের মাটি-লগ্ন, প্রান্তবর্তী জনপদের এক নারী। তার আঞ্চলিক উচ্চারণে উঠে এসেছে গ্রামীণ, কৃষিভিত্তিক জীবনের মন্থর প্রকৃতি, শতাব্দী লাঞ্ছিত বিশ্বযুদ্ধ, মানবতা বিপন্ন মনন্তর, ভ্রান্ত রাজনীতির বিষবাষ্প সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশভাগ, গড়িয়ে আসা বিরূপ বাস্তবতার মধ্যেও এক সাধারণ নারীর অসাধারণ জাগরণ, অগ্নিময় উপলব্ধি নিজ বসতভিটে আগলে থাকার মতো স্থিতি, দেশত্যাগে অস্বীকৃতি আগুন পাখি উপন্যাসের মূল বর্ণনীয় বিষয়। লড়াকু জীবন, আত্মকথনে নিজস্ব ভাষাশৈলী, চেতনার অগ্নিময় উদ্বোধন, সেই নামহীন নারীকে রূপকথার ফিনিক্স পাখিতে রূপান্তরিত করেছে। অর্থাৎ সেই নারীই হয়ে উঠেছে আগুন পাখি। উপন্যাসের নামকরণের প্রতীকী তাৎপর্য হয়ত এখানে খুঁজে পাওয়া যায়। ইতিহাসের লিখিত ‘বয়ান’ একমাত্র ইতিহাস নয়। কারণ ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে প্রবলপক্ষ যে ‘লিখিত বয়ান’ রচনা করেন, তার মধ্যে কর্তৃত্ববাদী আরোপন থাকে। যেমন বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন যাকে আমরা বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্ফুরণ বা মহৎ বিদ্রোহ বলি, তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী প্রবলপক্ষে ক্ষমতা কেন্দ্রে বসে তাকে নৈরাজ্য বলে সরকারি দলিল পত্রে অভিহিত করেছে। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের লেখা ইতিহাস মূলত এ দেশীয় এলিট, ব্রিটিশ প্রশাসন, প্রতিষ্ঠান এবং পলিসির সৃষ্টি। যাতে লেখা হয়নি  নিম্নবর্গ/অধস্তন/ব্রাত্য/অন্ত্যজ/ সাধারণ/ সাব অলটার্ন/জনপদ ও জীবন ধারার ইতিহাস। অধ্যাপক রণজিৎ গুহ, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, দীপেশ চক্রবর্তী, গৌতম ভদ্রের উদ্যোগে এক গুচ্ছ ভাবুক যে ‘সাবঅল টার্ন স্টাডিজের’ প্রস্তাব করেছেন, তাতে অভিজাততন্ত্রের আকল্প ভেঙে দিয়ে নিম্নবর্গের বিষয়সমূহে, কার্য ও চেতনা, ক্ষমতা ও ডিসকোর্সের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তারা বলেছেন, অভিজাততন্ত্র অনুসরণ করেছে, ব্রিটিশদের প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতিক ছক, অভ্যাস, অনুশাসন, অন্যদিকে নিম্নবর্গ চালিত হয়েছে আত্মীয়তার সম্পর্কে জ্ঞাতি গোষ্ঠী কম্যুনিটির। তাদের সহমর্মী অনুপ্রেরণায়। অভিজাততন্ত্রের রাজনীতি সংবিধান কেন্দ্রিক, শাসনতান্ত্রিক, আর নিম্নবর্গের সক্রিয়তা রূপ নিয়েছে সন্ত্রাস, নৈরাজ্য এবং নিয়ম বিরোধিতায়। কারণ, ‘নিম্নবর্গের মানুষেরা এলিটদের দ্বারা বিভিন্নভাবে প্রতারিত, প্রবঞ্চিত, লুণ্ঠিত হয়েছে। বঞ্চনার অভিজ্ঞতা থেকেই নিম্নবর্গের রাজনীতির চরিত্র বোঝা যায়, ঔপনিবেশিক ভারতের ব্যাপক কৃষক বিদ্রোহের দিকে তাকালে তা বোঝা যায়। নিম্নবর্গের রাজনীতির ইতিহাস তৈরি হয়েছে বহু ধরনের স্বতন্ত্র কথনরীতি, বিভিন্ন শব্দ, স্লোগান, পরিভাষা’।  (গৌতম ভদ্র/ইমান ও নিশন ‘বাংলার কৃষক চৈতন্যের এক অধ্যায় : পরিপ্রেক্ষিতের সন্ধানে’ সুবর্ণরেখা, কলকাতা, ১৯৯৪, পৃ: ৩২৬-৩৯৫) ভাষার ছকের ভেতরে নিম্নবর্গের মানুষের সক্রিয়তা, অভিজ্ঞতা ও বিবরণ তুলে ধরা কঠিন। ভাষার ছকে ধরতে গেলে তার অপরিচিত মহত্ত্ব নষ্ট হতে পারে। কিন্তু হাসান আজিজুল হক আগুন পাখি উপন্যাসে নিম্নবর্গের অপরিচিতির  মহত্ত্ব নষ্ট হতে দেন না। আঞ্চলিক উচ্চারণে আগাগোড়া ধরে রাখেন অসীম সাহসিকতায়। ফলে নিম্নবর্গীয় চাষী জনতার জীবনায়নের স্বরূপ ও সংকট সহজে বোঝা যায়। নিম্নবর্গের একটা অংশ যদি শ্রমিক শ্রেণিকে ধরি, দেখা যাবে তৎকালীন ভারতের শ্রমিক শ্রেণি নিজেদের সামাজিক সত্তা এবং শ্রেণিগত অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। যার কারণে নিম্নবর্গের চাষী এবং কর্মজীবী শ্রেণির বহুরকম বিদ্রোহ, আন্দোলন, অভ্যুত্থান  (যেমন টং আন্দোলন, নানকার বিদ্রোহ, তে-ভাগা আন্দোলন, তেলেঙ্গানা অভ্যুত্থান, কৃষকদের নীল বিদ্রোহ) যথার্থ নেতৃত্বের অভাবে ব্যর্থ হয়ে যায়। ঔপনিবেশিক ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ভারত দ্বি-খণ্ডিত হলে শুধু ভূগোলই আলাদা হয় না, মানব শরীরও দু’টুকরা হয়। আর সেই যন্ত্রণাদগ্ধ অভিজ্ঞতার ভাষ্য হয়ে উঠেছে আগুন পাখি উপন্যাস। ভুবনডাঙ্গার ধূলি ধূসরিত জনপদের এক নারীর ‘ডায়ালেক্ট’ ম্যাক্রোলেভেল থেকে মাইক্রোলেভেলে উঠে এসে, ডায়ালজজিতে রূপান্তরিত হয়। আগুন পাখি শুরু হয় এভাবে―

‘আমার মায়ের য্যাকন মিত্যু হলে আমার বয়েস ত্যাকন আট-ল’ বছর হবে। ভাইটোর বয়েস দেড় দু’বছর। এই দুই ভাই বুনকে অকূলে ভাসিয়ে মা আমার চোখ বুজল’।

এই আত্মকথন বা আঞ্চলিক ডায়লগের মাধ্যমে কাহিনি এগিয়ে যায়। মা মরা দেড় বছরের ‘ভাই কাঁকালে পুঁটলি হলো’। কোলের খোকা নিয়ে একদিন বাপের বাড়িতে বেড়াতে এসে দেখে―

‘বাড়িতে মা বাপজি ছাড়া এক ভাই, তিন বুন রয়েছে। সৎ ভাইটো বেশ বড়োসড়ো হয়েছে, দুটি বুনও অন্যাকটো ডাগর হয়েছে। শুধু একটো বুন দুধের শিশু। আমার মা মরে গেলে কি হাল হয়েছিল ই সংসারে―সব পেরায় ভেসে গিয়েছিল। সৎ মা এসে  আবার ভর-ভরন্ত সোনার সংসার করেছে।’

বাপের বাড়িতে কয়দিন বেড়ানোর পর স্বামীর বাড়িতে ফিরে যায়। কোলের খোকা বড় হয়ে শহরের স্কুলে পড়তে যায়। তার চাচা স্কুল শেষ করে কলেজে ভর্তি হয়েছে। দ্যাশে এ্যাকন রাজার আইন না মানা চলছে। অর্থাৎ অসহযোগ আন্দোলন চলছে। দেওর একটা চাকরি নিয়ে কর্তার পাশে দাঁড়াতে চায়। সারা জীবন কর্তা সংসারের বোঝা একাই টেনে গেলেন। তাই চাকরি নিয়ে সে ভাইয়ের পাশে দাঁড়াবে। নিজের ভাইটিও স্কুল পাস দিয়েছে কিন্তু কলেজে ভর্তির হলে খরচ চালাবে কে ? সেও একটা কোনও চাকরি-বাকরি পায় কি না চেষ্টা করছে। ফিরে গেছে মামার বাড়ি। এ সময় বজ্রের মতো খবর এল, খোকা আইন না-মানা দলে যোগ দিয়ে মিছিল করতে গেলে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। খবর শুনে পাগলের মতো কর্তার কাছে গিয়ে বললাম, আমার ছেলেকে বাড়ি এনে দাও, আর পড়তে হবে না। কর্তা শেষ পর্যন্ত শহরে গিয়ে ছেলেকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনে কিন্তু ছেলের গায়ে প্রচণ্ড জ্বর। সে জ্বর থেকে ছেলে ওঠে না। খোকার মৃত্যুর পর সারা দুনিয়া যেন শূন্য হয়ে যায়। বাবার ফুফু আমি ডাকতাম দাদি, তিনি মরে যাওয়ার সময় আমাকে জমিটুকু দিয়েছিল তা বিক্রি করে এনে কর্তা সংসারের সম্পত্তি আরও বাড়ায়। সংসারে দেবর, ননদ, জা, শাশুড়ি, কাজের লোক, আত্মীয় কুটুম্ব ভর-ভরন্ত অবস্থা। বড় ননদের মৃত্যু হলে তার ছেলেমেয়ে কর্তা মামার বাড়িতে নিয়ে আসে। বিশাল সংসারে কেউ কাউকে মানে না। ছোট বউ বাসা করে শহরে উঠে গেছে। এই প্রথম আমাদের সংসারে কেউ একজন গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন চলছে। এ সময় শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সংসারে ভাঙন শুরু হয়। কর্তা দেওয়রদের সম্পত্তি সব আলাদা করে দেয়। শাশুড়ির তখন যায় যায় অবস্থা। কি দিন এল, যেন সারা দুনিয়ায় আগুন লাগল। যুদ্ধের ভয়াল থাবায় পুরো ভারতবর্ষজুড়ে শুরু হয় খাদ্যাভাব, দুর্ভিক্ষ। ভাত কাপড়ের অভাবে গ্রামের মানুষ দলে দলে শহরের দিকে যাত্রা শুরু করে। কাপড়ের অভাবে মানুষ ন্যাংটা, ক্ষুধায় শুকিয়ে কংকালসার দেহ।

‘যুদ্ধ কি এইবার একটু একটু বুঝতে পারছ তো ? প্রথমে দেখলে মানুষের পরনের কাপড় নাই। এখন দেখছ একটি একটি করে জিনিস গরমিল হচ্ছে-নুন নাই, কেরোসিন নাই, চিনি নাই। তার মানে গাঁয়েগঞ্জে যা যা তৈরি হয় না, তৈরি করতে পারা যায় না, তাই তাই নাই।

যুদ্ধের ভয়াবহতার মধ্যে শাশুড়ির মৃত্যু হয়। অনেক দিন পর বাপের বাড়ি গিয়ে দেখি বাপজিও মারা গেছে। সে পতন আর রোধ করা যায় না। গ্রামে কন্ট্রোলের দোকান হয়েছে। কিছু বাঁধা জিনিস সেখানে পাওয়া যায়। দু’বছর আকালে, মহামারির কষ্ট না ফুরোতেই শুরু হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা।

এমন সময় খবর প্যালম রায়দের বড়ো ছেলে সত্য কলকাতায় হিন্দু মুসলমানের হিড়িকে কাটা পড়েছে। পেথম ই কথার কুনো মানে বুঝতে পারলাম না। কাটা পড়েছে আবার কি ?’

মানুষ কি কদু কুমড়ো যি বঁটির ছামনে ধরলাম আর ঘ্যাঁস কটে ফেললাম।’

কয়েক বছর থেকে শোনা যাচ্ছিল যে, মুসলমানরা আলাদা একটি দেশের জন্য আন্দোলন করছে। প্রেসিডেন্সিগিরি যাবার পর কর্তা প্রায় ঘরে বসে থাকে। ‘বঙ্গবাসী’ কাগজে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, জিন্নাহ, নেহেরু, গান্ধী, প্যাটেলের নাম প্রায় চোখে পড়েছে। আকাল গেল, যুদ্ধ গেল, এখন ব্রিটিশরা লোক দেখানো হোক আর যাই হোক, চেষ্টা করছে হিন্দুদের গান্ধী, নেহেরু, প্যাটেল আর মুসলমানদের নেতা জিন্নাহর সঙ্গে বসে একটা পথ বের করতে, যাতে দেশটা আর ভাগ করতে না হয়। লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান স্লোগান দিচ্ছে মুসলমান দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। সারাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগুন জ্বলছে। কলকাতায় হিন্দু বেশি মুসলমান কম, কাজেই সেখানে মুসলমান মারা পড়ছে বেশি। মোট কথা এখন আর স্বাধীনতা-টাধিনতার কথা নয়, স্বাধীনতা দাও আর না দাও, দেশ ভাগ করে দাও। গান্ধী দাঙ্গা থামাতে নোয়াখালী গেছেন। সেখানে মুসলামন বেশি, খুব হিন্দু মারা যাচ্ছে। বিহারে মুসলমান মরছে বেশি। ইংরেজরা যা চেয়েছিল তা-ই হলো। হিন্দু-মুসলমান দুই জাতকে চিরদিনের মতো একে-অপরের শত্রু করে দিল। শুধু দেশ ভাগ নয়, মানুষও ভাগ হয় গেল। খোকা ভালো চাকরি পেলো ঢাকায়। ‘চাকরি পেয়ে পেথম বার থ্যাকন বাড়ি এল, আমিই তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, সবাই এইখানে, তুমি পাকিস্তানে চাকরি নিলে ক্যান ? চাকরি একটা দরকার ছিল মা, পেলামই যখন, নেব না ক্যান ?

কপাল, এমনি বটে ? এক মাডর মেয়ের বিয়ে হলো ইখানে। কিন্তু বিয়ে ক’দিন বাদেই শোনা গেল জামাই বড়ো চাকরি পেয়েছে পাকিস্তানে। বিয়ে য্যাকন হয়েছিল, ত্যাকন ঐ পাসপোর্ট না কি বলে হয় নাই। তারাও যেদিন আসছিল, ইবার তারাও আসতে পারছে না।

দ্যাশ আলাদা হোক আমি চাই নাই অথচ আমারই ছেলে মেয়ে বিদ্যাশে চলে গেল … বাপের সোংসারে, ভাইয়ের সোংসার, কত্তার সোংসার সব ভেঙে খান খান।

হিন্দুস্তান, পাকিস্তান মেনে নিয়েছে সবাই। কিন্তু দেশ আলাদা হওয়ায় যাদের জীবনকে ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছে, তাদের অবস্থা কী ? ছেলেমেয়ে পাকিস্তানে গিয়ে স্থিতু হয়েছে। নাতি-নাতিও সেখানে যখন, তখন এ দেশে আর পড়ে থাকা কেন ? কত্তারও ইচ্ছা এখানকার জমি- সম্পত্তি বাড়ি ঘরের ব্যবস্থা করে ঐ দেশে চলে যাওয়া। বাড়ি বদলির দলিল হয়ে গেছে। শুনে, সেই অশিক্ষিত, নিম্নবর্গীয় নারী আগুন পাখি হয়ে ওঠে’ এই বাড়িটিতে আমি থাকব।’ কারণ আমাকে কেউ বুঝাতে পারেনি কেন দেশ আলাদা হয়েছে।

‘একই দ্যাশ, একই রকম মানুষ, একই রকম কথা, শুধু ধম্মো আলেদা একটো দ্যাশ হয়ে গেল, ইকি কুনোদিন হয় ?

স্বামীর আদেশ, ছেলের আবদার, মেয়ের অনুরোধ তাকে নিজের সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারে না। নিজের সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারে না। নিজের সিদ্ধান্তে সে নারী থেকে অবিচল, অনড়। হাসান আজিজুল হক উপন্যাসের সমাপ্তি টানেন এভাবে :

মানুষ কিছুর লেগে কিছু ছাড়ে, কিছু একটা পাবার লেগে কিছু ছেড়ে দেয়। আমি কিসের লেগে কি ছাড়লাম ? অনেক ভাবলাম, শ্যাষে একটি কথা মনে হলো, আমি আমাকে পাবার লেগেই এত কিছু ছেড়েছি। আমি জেদ করি নাই, কারুর কথার অবাধ্য হই নাই। আমি সব কিছু শুধু নিজে বুঝে নিতে চেয়েছি। আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না ক্যান আলেদা একটো দ্যাশ হয়েছে গোঁজামিল দিয়ে, যেখানে শুধু মোসলমানরা থাকবে কিন্তুক হিঁদু কেরেস্তানও আবার থাকতে পারবে। তাইলে আলাদা কিসের ? আমাকে কেউ বোঝাতে পারলে না যি সেই দ্যাশটা আমি মোসলমান বলেই আমার দ্যাশ আর এই দ্যাশটি আমার লয়। আমাকে আরও বোঝাইতে পারলে না যি ছেলেমেয়ে আর জায়গায় গেয়েছে বলে আমাকেও সিখানে যেতে হবে। আমার সোয়ামি গেলে আমি আর কি করব ? আমি আর আমার সোয়ামি তো একটি মানুষ লয়, আলেদা মানুষ। খুবই আপন মানুষ, জানের মানুষ কিন্তুক আলেদা মানুষ।’

আগুন পাখি উপন্যাসের এই পরিসমাপ্তি পাঠককে একটি জিজ্ঞাসার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়, শুধু ধর্মের ওপর ভিত্তি করে একই ভাষা-সংস্কৃতির ভূ-খণ্ডকে পৃথক দেশ হিসেবে ভেঙে টুকরো করার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কতটা অসার, অযৌক্তিক হয়েছে, ইতিহাসই তা প্রমাণ করছে। সাত চল্লিশের রাজনৈতিক ভুলের কারণেই উনিশ’শ একাত্তরে বাঙালিকে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করতে হয়েছে। ভ্রান্ত রাজনীতির শিকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগুনে ঝলসে যাওয়া কোটি হৃদয়ের দায়ভার কে নেবে ? ইতিহাস ? না রাজনীতি ? মেলে না উত্তর। ধর্ম তবে মানুষকে উদ্বাস্তু করে, দেশহীন করে, ঝলসে দেয় হৃদয় ?

 ভেদরাজনীতির বিষবাষ্প আর ইতিহাসের ইটের নিচে চাপাপড়া হলুদ ঘাসের সবুজ কষ্টের লিখিত বয়ানে’ এর উত্তর পাওয়া যায় না। আগুন পাখি উপন্যাসে হাসান আজিজুল হক সময়ের বাস্তবতাকে ধরতে চেষ্টা করেছেন, ফলে সময় হয়ে উঠেছে এ উপন্যাসের প্রধান নিয়ামক।

আগুন পাখি উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য প্রসঙ্গ হচ্ছে ঔপনিবেশিক শাসন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও দেশভাগ। তৃণমূল পর্যায়ে উপনিবেশের শোষণ স্পষ্ট হয় গ্রামজীবনের স্থবিরতায়। বিশ্বযুদ্ধের বাস্তবতা গ্রামীণ জীবনে অতটা স্থায়ী রেখাপাত না-করলেও কলকাতার নাগরিক জীবনকে ভীত ও আতঙ্কগ্রস্ত করেছিল। কারণ দুর্ভিক্ষ ও দাঙ্গা নগরের চেহারাকে পাল্টে দিয়েছিল। হাসান আজিজুল হক এ দুটি ঘটনাকে বর্ণনা করেছেন অভিজ্ঞতার আলোকে। দুর্ভিক্ষকে তিনি যেমন অকারণে বাড়িয়ে দেখাননি, তেমনি দাঙ্গার দৃশ্যকেও কল্পনার রং দিয়ে সাজাননি।

হিন্দু মোসলমানের হিড়িক মানেই হচ্ছে হিন্দুকে মোসলমান মারবে, মোসলমান হিন্দু মারবে। আর কিছু দেখাদেখি নাই, পাঁচজন হিন্দু কলকাতায় রাস্তায় একটা মোসলমানকে একা বাগে পেলে তো পিটিয়ে কিম্বা ছোরা ঢুকিয়ে মেরে ফেললে আবার পাঁচজনা মোসলমান একটো হিঁদু দেখতে পেলে কি চিনুক না চিনুক, কিছু করুক না করুক তাকে তলোয়াল নাইলে টাংগি, নাইলে যা দিয়েই হোক মেরে ফেললে।  হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কের জটিল অন্ধকারে আলো ফেলেছেন লেখক। যুক্তি-তর্ক ও মানবিকতাকে পদদলিত করে হিন্দু-মুসলমান মেতে উঠেছিল রক্তের হোলিখেলায়। বীভৎস সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার এতগুলো নিরপরাধ মানুষকে কেন মরতে হলো অকারণে ? সমস্যা শেকড়ে এর উত্তর খুঁজে ফেরেন হাসান আজিজুল হক। সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে যখন ভাগ হয়ে গেল ভারত পাকিস্তান, তখন সেই প্রতারিত মানুষগুলোর হতবিহ্বল মুখের দিকে তাকানোর লোক ছিল না। দুর্লভ সেই অভিব্যক্তিও লেখকের অনুসন্ধানী চোখ এড়ায়নি। ভূমির সঙ্গে কেবল বসবাসের সম্পর্ক নয়, ভূমি মানুষের অদ্বৈত সত্তা। নিজের দেশ ও মাটির সঙ্গে বিচ্ছেদও দাঙ্গার চেয়ে কম ভয়াবহ নয়। আর এজন্য দায়ী ভ্রান্ত রাজনীতি। জন্ম-জন্মান্তরের মাটির সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করতে চায়নি ভুবনডাঙ্গার সেই নারী। সে বলে ‘চারাগাছ এক জায়গায় থেকে আর জায়গায় লাগাইলে হয়, এক দ্যাশ থেকে আরেক দ্যাশে লাগাইলেও বোধহয়. কিন্তু গাছ বুড়িয়ে গেল আর কিছুতেই ভিন মাটিতে বাঁচে না।’

এই উক্তির মধ্য দিয়ে সেই নামহীন নারীর সত্তা অস্তিত্ববান হয়ে ওঠে। জাঁ পল সার্তের অস্তিত্ববাদী দর্শনই এখানে কার্যকর হয় না শুধু, মানবিকতাও বিস্তার লাভ করে। মাটির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কতটা নিবিড় ঐকান্তিক, অবিচ্ছেদ্য তা ফুটে ওঠে তার উপলব্ধিতে―‘সুরুজের আলোর দিকে চেয়ে আবার উঠে দাঁড়াব আমি।

আমি একা তা হোক, সবাইকে বুকে টানতেও পারব আমি একা।’

সত্তা ও অপরতা একই সঙ্গে অস্তিত্ববান হয়ে ওঠে তার এ সংলাপে। এ সত্তা যেন আগুনের পাখি। সে ক্ষায়িত, খণ্ডিত কিন্তু নিঃশেষিত নয়, অনন্ত ও আত্মবিস্তারিত।

 লেখক : প্রাবন্ধিক

———————-

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button